তাহার কিশোর বয়সে আর একটি অনুরূপ অভিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। তখন তিনি দক্ষিণেশ্বরে পরমহংসদেবের নিকট যাতায়াত করিতেছেন। একদিন বাড়িতে নিজের ক্ষুদ্র পাঠকক্ষে বসিয়া তিনি ধ্যান করিতেছেন, এমন সময়ে সহসা তাহার সামনে এক দীর্ঘাকৃতি বিশালবপু পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। তাঁহার মুখমণ্ডলে এরূপ স্থির, গভীর শান্তি বিরাজমান ছিল যে, তাহার দিকে চাহিয়া তরুণবয়স্ক স্বামীজীর মনে হইল, অনন্তকাল ধরিয়া তিনি যেন সুখ এবং দুঃখ উভয়ই বিস্মৃত হইয়াছেন। সাধক আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন, এবং আগত পুরুষের চরণে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। অতঃপর ভক্তি ও বিস্ময়ে আত্মহারা হইয়া তিনি নিশ্চলভাবে একদৃষ্টে তাহার প্রতি চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সহসা তাহার বোধ হইল, সম্মুখস্থ মূর্তি যেন কিছু বলিতে উদ্যত। কিন্তু উহাতে বালক-হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হওয়ায় তিনি কিছু শুনিবার অপেক্ষা না করিয়া ধীরে ধীরে কক্ষের বাহিরে গেলেন এবং দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। ঐ দর্শন সম্বন্ধে স্বামীজী পরে বলিতেন, বাল্যকালে তাহার কক্ষে ভগবান বুদ্ধই প্রবেশ করিয়াছিলেন। আমি তার চরণে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করেছিলাম, কারণ আমি জানতাম তিনি স্বয়ং ভগবান।” শ্রীবুদ্ধের প্রতি স্বামীজীর যে জীবন্ত, জ্বলন্ত আবেগ, তাহার অসাধারণ স্থির বুদ্ধি সম্পর্কে যে প্রগাঢ় বিশ্বাস, তাহার অসীম ত্যাগ ও করুণা সম্বন্ধে যে দৃঢ় ধারণা, তাহার কতখানি সেই কৈশোরে তাহার প্রত্যক্ষদর্শনের অনুভূতির মুহূর্ত হইতে উদ্ভূত, তাহার পরিমাণ করা সহজ নহে।
তাহার অন্তরঙ্গ ভক্তগণের যতদূর জানা আছে, এই প্রকার দিব্য দর্শন তৃতীয় এবং শেষবারের মতো ঘটে স্বামীজীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। বুঝিতে পারা যায় যে, ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলিতে ভ্রমণকালে তাঁহার পূর্ববর্তী অপর ভারতীয়গণের ন্যায় তিনিও পরিচিত সহস্র প্রকার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে হিন্দুধর্মের সহিত খ্রীস্টধর্মের সাদৃশ্য দেখিয়া চমৎকৃত হন। খ্রস্টানদের ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে নিবেদিত রুটী ও পানীয় (Blessed Sacrament তাঁহার নিকট হিন্দুদের ভোগনিবেদনের বিশদ রূপান্তর বলিয়া বোধ হইত। যাজকদিগের মস্তকের কিয়দংশ মুণ্ডন (tonsure) তাহাকে ভারতীয় সন্ন্যাসিগণের মস্তক মুণ্ডনের কথা স্মরণ করাইয়া দিত। আর যখন তিনি একখানি চিত্রে দেখিতে পাইলেন যে, জাস্টিনিয়ন(৩) দুইজন মুণ্ডিতমস্তক সাধুর নিকট হইতে মুসা-প্রচারিত ধর্মবিধি গ্রহণ করিতেছেন, তখন তাহার মনে হইল, যাজকদের মুণ্ডনপ্রথার উৎপত্তিস্থল তিনি আবিষ্কার করিয়াছেন। তাহার নিশ্চয়ই মনে ছিল, বৌদ্ধধর্মের পূর্বেও ভারতে সন্ন্যাসি-সন্ন্যাসিনী ছিল, এবং ইউরোপ থিবাইড(৪) হইতে সন্ন্যাসি-সম্প্রদায়ের ভাব গ্রহণ করে; হিন্দু ক্রিয়াকাণ্ডেও ধূপদীপ দান ও গীতবাদ্য আছে। ক্যাথলিকদের মধ্যে মধ্যে অঙ্গুলিদ্বারা অঙ্গে ক্রুশ চিহ্ন অঙ্কিত করিতে দেখিয়া তাহার হিন্দুদের পূজাদিতে ন্যাসের কথা মনে পড়িয়াছিল। অতঃপর যখন তিনি এক গীর্জায় প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, মাত্র কয়েকখানি চেয়ার রহিয়াছে, এবং ঘেরা নির্দিষ্ট আসন (pews) একেবারেই নাই, তখন তিনি এই বিষয়ের চরম নিদর্শন লাভ করেন। অবশেষে তিনি অনুভব করেন, তিনি যেন স্বদেশেই অবস্থান করিতেছেন। এখন হইতে খ্রীস্টধর্মকে আর বিদেশী বলিয়া তাহার বিশ্বাস হইত না।
স্বামীজীর যে স্বপ্নবৃত্তান্ত আমি বলিতে যাইতেছি, হয়তো কতকগুলি চিন্তাধারা তাহাকে অজ্ঞাতসারে উহার জন্য প্রস্তুত করিয়াছিল। ঘটনাটি এই ঃ আমেরিকায় স্বামীজীর এক ইহুদী শিষ্য ছিলেন। স্বামীজীকে তিনি নিষ্ঠাবান ইহুদী সমাজের সহিত পরিচিত করিয়া দেন এবং অল্পবিস্তর মনোযোগসহকারে ইহুদী-ধর্মগ্রন্থ ‘তালমুদ’ অধ্যয়নে প্রবৃত্ত করেন। এইরূপে, যে চিন্তার পটভূমিতে সেন্টপলের উদ্ভব, সে সম্পর্কে সাধারণ লোক অপেক্ষা স্বামীজীর ধারণা অধিকতর স্পষ্ট ছিল।
তাঁহার খ্রীস্টধর্ম আলোচনা সম্পর্কে আরও একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমেরিকায় তিনি কৃশ্চান সায়েন্স’ নামক আন্দোলনের সহিত বিশেষ পরিচিত ছিলেন। পরে তিনি একবার বলেন যে, সকল ধর্মেরই উৎপত্তি আলোচনা করিতে গেলে তিনটি উপাদানের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে হইবে—মতবাদ, কর্মকাণ্ড এবং ইন্দ্রজাল বা অলৌকিক কিছু, যাহা সাধারণতঃ ব্যাধি আরোগ্য করারূপেই প্রচারিত। লক্ষণত্রয়ের মধ্যে শেষোক্তটিকে অন্তর্ভুক্ত করিবার কারণ, আমার ধারণা, কতকটা তাহার ‘কৃশান সায়েন্স’ এবং সমশ্রেণীর অন্যান্য আন্দোলন পর্যবেক্ষণের ফল—সেই সঙ্গে তাঁহার নিজের দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমরা বর্তমানে ধর্মের এক নূতন মহাসমন্বয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত, এবং কতকটা তাঁহার নিজের দিব্যদর্শন—যেহেতু ঐ অনুভূতি বা দর্শন বাস্তব ও জীবন্ত প্রত্যক্ষ বিষয়গুলির অন্যতমরূপে চিরকাল তাঁহার স্মৃতিতে বিদ্যমান ছিল।
তখন রাত্রিকাল; নেপলসে যে জাহাজে তিনি ওঠেন, তাহা তখনও পোর্টসৈয়দ অভিমুখে চলিতেছে, এমন সময়ে তিনি এই স্বপ্নটি দেখেন—এক বৃদ্ধ শ্মশ্রুধারী ব্যক্তি তাহার সম্মুখে আবির্ভূত হইয়া বলিলেন, “যে স্থানটি তোমাকে দেখাচ্ছি, তা ভাল করে লক্ষ্য কর। তুমি এখন ক্রীট দ্বীপে। এখানেই খ্রীস্টধর্মের আরম্ভ।” খ্রীস্টধর্মের এই উৎপত্তির সমর্থন হেতু তিনি দুইটি শব্দের উল্লেখ করেন—উহার মধ্যে একটি শব্দ থেরাপিউটি’—এবং উভয় শব্দই যে প্রত্যক্ষভাবে সংস্কৃত ধাতু হইতে উৎপন্ন, তাহাও বলিলেন। পরবর্তী কালে স্বামীজী বার বার এই স্বপ্নের উল্লেখ ও সর্বদা শব্দদ্বয়ের ধাতুপ্রত্যয় নির্দেশ করিতেন। কিন্তু অপর শব্দটি(৫) মনে হয়, আর কখনো পাওয়া যাইবে না। চিরতরে হারাইয়া গিয়াছে। বৃদ্ধ ‘থেরাপিউটি’ (থেরপুত্র) শব্দের অর্থ বলিয়াছিলেন—‘থের’ অর্থাৎ উচ্চপদস্থ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পুত্রগণ-পুত্র শব্দ সংস্কৃত। ভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশপূর্বক বৃদ্ধ আরও বলেন, “প্রমাণ সব এখানে আছে, খুঁড়লেই দেখতে পাবে।”