তাঁহার গুরুদেব একটি বালকের সম্বন্ধে যে গল্প বলিতেন, তাহার মধ্যেও ঐ উপদেশ পাওয়া যায়। বালকটি জলের উপর দিয়া হাঁটিয়া যাইবার জন্য কুড়ি বৎসর ধরিয়া পরিশ্রম করে। এক সাধু তাহাকে বলেন, “বাঃ, মাঝিকে এক পয়সা দিয়ে লোকে যা করে, তুমি সেই কাজ করবার জন্য কুড়ি বছর পরিশ্রম করলে?” বালকটি উত্তরে বলিতে পারিত, কুড়ি বছর সহিষ্ণুতার সহিত পরিশ্রমের ফলে সে চরিত্রে যে-সব সদগুণ লাভ করিয়াছে, কোন মাঝি তাহার আরোহিগণকে তাহা দিতে পারিবে না। কিন্তু একথা সত্য যে, পরম বিবেচক এই ধরনের আচার্যগণের নিকট জাগতিক নৌবিদ্যারও যথোচিত পূর্ণ মূল্য ও উপযুক্ত স্থান আছে। বহু বৎসর পরে প্যারিসে এক ব্যক্তি এই সকল বিষয়ে ভারতীয় চিন্তাধারার ক্রমবিকাশের সাধারণ ইতিহাস সম্পর্কে এক প্রশ্ন লইয়া তাহার নিকট আসেন। প্রশ্নটি এই–”সনাতন হিন্দুধর্ম এককে সৎ (real) ও বহুকে অসৎ (unreal) বলেছেন, আবার বুদ্ধ কি বহুকেই সৎ ও (তদধিষ্ঠান) অহংকে (ego) অসৎ বলেননি?” স্বামীজী উত্তর দেন, “হাঁ, আর শ্রীরামকৃষ্ণ ও আমি কেবল এইটুকু তার সঙ্গে যোগ করেছি যে, বহু ও এক উভয়ে একই মনের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধ সেই একই সত্য।”
অধ্যাত্ম বিষয়ে জ্বলন্ত ভাষায় বলিবার অসাধারণ ক্ষমতা হেতু এবং অদ্ভুত গভীর ও গাম্ভীর্যময় এক প্রাচীন সাহিত্য হইতে উপকরণ সংগ্রহ করিতেন বলিয়া তিনি আমাদের নিকট সর্বোপরি আধ্যাত্মিক জীবনের প্রচারকরূপে, বহিজীবন অন্তৰ্জীবন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত—এই মতবাদ প্রচারের ঋষিরূপে প্রতিভাত হইতেন। একবার তিনি জনৈক শিষ্যকে বলেন, “মনে রেখো, ‘আত্মা’ প্রকৃতির জন্য নয়, প্রকৃতিই আত্মার জন্য—ভারত সর্বদা এই বাণী ঘোষণা করছে।” বস্তুতঃ ইহাই যেন ছিল মূল সুর, সুগম্ভীর ধ্বনি—তিনি যে সকল যুক্তিপূর্ণ উপভোগ্য বিষয়সমূহ আলোচনা করিতেন, বা যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করিতেন, তাহার মধ্য দিয়া ক্ৰমশঃ ইহাই শ্রুতিগোচর হইত। দীর্ঘকাল ধরিয়া যিনি তাহার বক্তৃতা শ্রবণ করিয়াছেন, হয়তো তাহার নিকট পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য আধ্যাত্মিক জীবনের প্রভেদ এইরূপ বোধ হইবে—একটি বাশীব সুরের মতো—অতি প্রত্যুষে বহুদূরে কোন নদীতীর হইতে ভাসিয়া আসিতেছে, অতি সুমিষ্ট, কিন্তু উহা জাগতিক অন্যান্য সুমধুর সঙ্গীতের অন্যতম। আর একটি, সেই সুরলহরীই, কিন্তু শ্রোতা ক্রমশঃ তাহার সমীপবর্তী হইয়া অবশেষে এতদূর তন্ময় হইয়া যান যে, তাহার সমগ্র সত্তা সেই সুরে বিলীন হইয়া যায়—শ্রোতা পরিণত হন গায়কে। আর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলন্তভাবে প্রকাশ পায় ত্যাগের মাহাত্ম। এমন নহে যে, ত্যাগ শব্দটি তাহার উপদেশসমূহে পূর্বাপেক্ষা অধিকবার প্রযুক্ত হয়; কিন্তু সেই মুক্ত, অপরিসীম, অপ্রতিহত জীবনের সত্যতা প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হয়। মৌনব্রত অবলম্বন করিয়া কপর্দকহীন সন্ন্যাসীর জীবনযাপনের জন্য সংসার ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবার এবং অসহ্য বোধ হইলেও আত্মনিবেদনরূপ শৃঙ্খলে নিজেকে আবদ্ধ করিয়া রাখিবার প্রলোভনের সহিত সংগ্রাম করিতে হয়।
অবশেষে এমন সময় উপস্থিত হইল, যখন এই আহ্বান অতি গম্ভীর নির্ঘোষে উচ্চারিত হইল। একদিন প্রশ্নোত্তর-ক্লাসে কথায় কথায় কিছু বাদানুবাদ ঘটে। সহসা স্বামীজী, যাহাকে ‘তিনি বোমা ছুড়িয়া লোককে চমৎকৃত করা বলিতেন’ সেইরূপ এক সঙ্কল্পের বশবর্তী হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “জগতে আজ কিসের অভাব জানো? জগৎ চায় এমন বিশজন নরনারী, যারা সদর্পে পথে দাঁড়িয়ে বলতে পারে, ‘ঈশ্বরই আমাদের একমাত্র সম্বল।’ কে কে যেতে প্রস্তুত?” বলিতে বলিতে তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং শ্রোতৃবর্গের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন, যেন কাহাকে কাহাকেও তিনি ইঙ্গিত করিতেছেন তাহার সহিত যোগদান করিতে। কিসের ভয়? তার পর বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে দৃঢ়প্রত্যয়ের সহিত তিনি যে কথাগুলি বলিলেন, তাহা এখনও আমার কানে বাজিতেছে, “যদি ঈশ্বর আছেন একথা সত্য হয়, তবে জগতে আর কিসের প্রয়োজন? আর যদি একথা সত্য না হয়, তবে আমাদের জীবনেই বা ফল কি?”
তাহার ক্লাসের এক সদস্যকে তিনি এই সময় এক পত্রে লেখেন, “জগৎ চায় চরিত্র। জগতে আজ সেইরূপ মানুষেরই প্রয়োজন, যাদের জীবন জ্বলন্ত প্রেমস্বরূপ, যারা সম্পূর্ণ স্বার্থশূন্য। সেই প্রেম প্রত্যেক বাক্যকে বজ্রের ন্যায় শক্তিশালী করে তুলবে। জাগো, জাগো, মহাপ্রাণ, জগৎ যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে, তোমার কি নিদ্রা সাজে?”
আমার মনে আছে, চরিত্রই সত্যকে সজীব করিয়া তোলে, সর্বপ্রকার সাহায্যের সফলতা নির্ভর করে প্রেমের উপর, কোন বাক্যের পিছনে চিত্তের যতটা একাগ্রতা থাকে, তাহাই বাক্যটিকে শক্তিপ্রদান করে—ভারতীয় এই ধারণা সেই সময় আমার নিকট কিরূপ নূতন বোধ হইয়াছিল। স্বামীজী বলিয়াছিলেন, “এইজন্য বাইবেলের এই উক্তি ‘কুমুদফুলগুলির কথা ভাবিয়া দেখ, তাহারা কেমন স্বতই বিকাশপ্রাপ্ত হয়’ কেবল উহার সৌন্দর্যের জন্য নহে, পরন্তু উহাতে যে গভীর ত্যাগের ভাব প্রকাশ পাইতেছে, সেজন্যই আমাদিগকে মুগ্ধ করে।”
ইহা কি সত্য? আমার মনে হইল, পরীক্ষা দ্বারা প্রশ্নটির সত্যাসত্য নির্ণয় করা যাইতে পারে; এবং কিছুকাল পরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, উহা সত্যই। যাহার ভাষার অন্তরালে চিন্তাশক্তি বিদ্যমান, এমন ব্যক্তির একটি মাত্র মৃদু বাক্যের দ্বারা তৎক্ষণাৎ কাজ হইয়া যায়, কিন্তু যিনি চিন্তার ধার ধারেন না, এমন ব্যক্তির মুখে ঐ কথাটিই উচ্চারিত হইলে কেহ তাহাতে কর্ণপাতও করে না। এই সম্পর্কে খলিফা আলির একটি উক্তি অপেক্ষা প্রকৃষ্টতর কোন উদাহরণ আছে বলিয়া আমার জানা নাই। “সংসারে তুমি যে পদ লাভ করিবে, তাহা তোমাকে অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছে, অতএব, তুমি উহার অন্বেষণ না করিয়া নিশ্চিন্ত মনে অবস্থান কর”—অনেকেই ইসলামধর্মের এই পুরুষসিংহের এই কথাগুলি শ্রবণ করিয়া মুগ্ধ হইয়া পারেন না। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত আমরা কথাগুলিকে বক্তার জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করিয়া না দেখি—যাহাকে চার বার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত খলিফার পদ হইতে বঞ্চিত করিয়া অপরকে ঐ পদে অভিষিক্ত করা হইয়াছিল—যতদিন পর্যন্ত আমরা জানিতে না পারি যে, কিরূপে এই ব্যক্তির সমগ্র জীবনের স্পন্দন ঐ কথা কয়টির মধ্যে অনুভূত হইতেছে, ততদিন আমরা ঐ সামান্য বাক্যটির মধ্যে যে অসাধারণ শক্তি নিহিত রহিয়াছে, তাহার কোন অর্থ খুঁজিয়া পাই না।