বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে প্রধান পার্থক্য এই যে, বৌদ্ধধর্ম বলেন, যা কিছু দেখছ, তা সবই মায়া বলে জেনো! আর হিন্দুধর্ম বলেন, জেনো যে, মায়ার অন্তরালে রয়েছেন সেই সত্যবস্তু। এই অনুভূতি কি উপায়ে লাভ হবে, সে সম্বন্ধে হিন্দুধর্ম কোন বাধাধরা নিয়ম করে দেননি। বৌদ্ধধর্মের আদেশ কেবল সন্ন্যাসের দ্বারাই পালন করা চলে; হিন্দুধর্মের আদেশ জীবনের সকল অবস্থায় পালন করা যায়। হিন্দুধর্মমতে সকল মতই সেই অদ্বিতীয় সত্যে উপনীত হবার এক একটি পথ। হিন্দুধর্মের অন্যতম উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ উপদেশ এক ব্যাধের মুখ দিয়ে বিবৃত হয়েছে এক পতিব্রতা নারীর নির্দেশে কোন সন্ন্যাসীর নিকট তিনি ঐ উপদেশ প্রদান করেন (ব্যাধগীতা)। এইরূপে বৌদ্ধধর্ম এক সন্ন্যাসিসঙ্রে ধর্মে পরিণত হয়, হিন্দুধর্ম কিন্তু সন্ন্যাস-আশ্রমকে উচ্চ স্থান প্রদান করলেও চিরকাল নিষ্ঠার সহিত প্রতিদিনের কর্তব্য-পালনকে—তা যেমনই হোক, ঈশ্বরলাভের পথ বলে নির্দেশ দিয়ে আসছে।”
———–
(১) উক্ত বৃহৎ মন্দিরের চারিদিকে খননকার্য ১৮৭৪ খ্রীস্টাব্দে ব্ৰহ্মদেশীয় সকার কর্তৃক প্রথম আরম্ভ হয়। ১৮৭৯ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ সবকাব উহাব ভার গ্রহণ করেন, এবং ১৮৮৪ খ্রীস্টাব্দে উহা শেষ।
(২) যাহা বুদ্ধিবৃত্তির পারে অতীন্দ্রীয় রাজ্যে লইয়া যায়।
(৩) এই দুইখানি পুস্তক তখন ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের দক্ষ সম্পাদকতায় এশিয়াটিক সোসাইটি ইতে প্রকাশিত হইতেছিল। সাধারণ পাঠকের সুবিধার জন্য গ্রন্থের মূল পালির পরিবর্তে সংস্কৃত অক্ষরে ছিল’—স্বামী সারদানন্দ
(৪) তথাগত শব্দের আক্ষরিক অর্থ—যিনি লব্ধসত্য, অর্থাৎ তত্ত্ব সাক্ষাৎকার করিয়াছেন। স্বামীজী বুঝাইয়া বলিলেন, “এই শব্দ অনেকটা তোমাদের ত্রাণকর্তা(Messiah) শব্দের মতো।”
(৫) শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দের ১৬ আগস্ট শ্ৰীযুক্ত কৃষ্ণগোপাল ঘোষের কাশীপুরস্থ উদ্যানবাটীতে মহাসমাধিলাভ করেন।
(৬) বিনয় পিটক–প্রথমভাগ দ্রষ্টব্য।
(৭) স্বামীজী এখানে সূত্তনিপাতের অন্তর্গত ধনিয়া সূত্তের Rhys Davids-কৃত পদ্যের অনুবাদের ভাবার্থ তাহার স্মৃতি হইতে আবৃত্তি করিতেছিলেন; Rhys Davids-এর আমেরিকার বক্তৃতাগুলি দ্রষ্টব্য।
(৮) ‘উপালি পৃচ্ছা’ নামক গল্পটি প্রধান বৌদ্ধগ্রন্থে যে আকারে প্রকাশিত হয়, অধুনা তাহা লুপ্ত। কিন্তু ঐরূপ একটি রচনার অস্তিত্ব ‘বিনয় পিটক’ প্রভৃতি অন্যান্য বৌদ্ধগ্রন্থে উহার উল্লেখ দ্বারা জ্ঞাত হওয়া যায়।
(৯) যদি আমরা ভাবি যে আমাদের দুষ্কৃতিসমূহের ফলভোগ আমাদের পরিবর্তে অপরে করিবে, তাহা হইলে আমাদের সৎকর্ম করিবার প্রবৃত্তি আরও দৃঢ় হয়! অপরের সম্পত্তি বা সন্তান-সন্ততি রক্ষার জন্য আমাদের যে দায়িত্ববোধ, তাহাও এই জাতীয়।
১৯. ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী
আমাদের জীবনে কতকগুলি গভীর বিশ্বাসের মূলে এমন সব ঘটনা থাকে, যাহা স্বভাবতই আমাদের ছাড়া অপর কাহাকেও প্রভাবিত করিতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বলা যায়, কোন উদ্দেশ্য অথবা ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে মুহূর্তকাল মধ্যে আমাদের যে ধারণা জন্মে, তাহা ঠিক ঐরূপ সুস্পষ্টভাবে অপরকে বুঝানো যায় না। আমাদের মনে কিন্তু উহা দৃঢ়বদ্ধ হইয়া যায়। ঘটনা সত্য অথবা মিথ্যাও হইতে পারে—অর্থাৎ হয়তো উহা এমন এক সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের উপর প্রতিষ্ঠিত, যাহা অল্প সংখ্যক ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। অথবা উহা আবেগপ্রসূত মস্তিষ্কের খেয়ালমাত্র। ঘটনা যাহাই হউক, যাহার একবার ঐরূপ অনুভূতি হইয়াছে, তাহার পরবর্তী জীবনের চিন্তাধারা ঐ ব্যক্তিগত প্রবল অনুভূতিদ্বারা অনুরঞ্জিত হইবেই। সৌভাগ্যক্রমে বাহ্য ঘটনার সহিত মিলিয়া গেলে অপরের নিকট উহা জ্ঞান বলিয়াই প্রতিভাত হইবে, আর দূরদৃষ্টিবশতঃ মিল না হইলে মাথার খেয়াল বলিয়া গণ্য হইবে। সেইরূপ, তর্কের খাতিরে আমরা যদি পুনর্জন্মবাদ সত্য বলিয়া মানিয়া লই, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ আমরা বুঝিতে পারি যে, কয়েকজন ব্যক্তির নিজ নিজ অন্তরে সঞ্চিত সুপ্ত স্মৃতিভাণ্ডারে অবগাহন করিবার ক্ষমতা আছে, যাহা অপরের নিকট দুঃসাধ্য। যদি তাই হয়, তাহা হইলে ঐরূপ অবগাহনের ফলে কতকগুলি মূল্যবান তথ্যের আভাস পাওয়া তাঁহাদের পক্ষে সম্ভব, যদিও বিশুদ্ধ কল্পনা ও ইহার মধ্যে যে পার্থক্য অবস্থিত, তাহা সেই ব্যক্তির পক্ষেই কেবল উপলব্ধি করা সম্ভব, যিনি ঐ আন্তররাজ্যে প্রবেশ করিতে পারিয়াছেন।
আমার গুরুদেবের মন ও চিন্তার উপর যে তিনটি অদ্ভুত স্বসংবেদ্য অনুভূতি সন্দেহাতীতরূপে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, সেগুলি সম্পর্কে বিশেষরূপে অবহিত হইবার জন্য কতকটা ঐ ধরনের চিন্তার প্রয়োজন। ইহাদের মধ্যে সম্ভবতঃ প্রধান হইল—ধ্যানযোগে সিন্ধুনদতীরে বৈদিক ঋক্-মন্ত্র আবৃত্তিরত এক বৃদ্ধের দর্শনলাভ। উহা হইতেই তিনি তাহার সংস্কৃত আবৃত্তির নিজস্ব অদ্ভুত রীতি শিক্ষা করেন। ঐ শিক্ষারীতি সাধারণ বেদোচ্চারণপ্রণালী অপেক্ষা অনেকাংশে গ্রেগরি-প্রবর্তিত সাদাসিধা সুরের সদৃশ।(১) তিনি সর্বদা বিশ্বাস করিতেন যে, এইভাবেই তিনি আর্য পূর্বপুরুষগণের সঙ্গীতসুরের পুনরুদ্ধার করেন। শঙ্করাচার্যের কবিতার মধ্যে তিনি এমন কিছু দেখিতে পান, যাহার সহিত এই আবৃত্তিকরণ-প্রণালীর আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য বিদ্যমান। এই ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি নিজ মত প্রকাশ করিয়া বলেন যে, আচার্য শঙ্করও তাহারই মতো কোন প্রকার দিব্য-দর্শন হইতেই বেদমন্ত্র-উচ্চারণ রীতির ইঙ্গিত লাভ করিয়া থাকিবেন।(২)