প্রচলিত ধারণা সম্পর্কে স্বামীজীর অসহিষ্ণু উক্তিগুলির মধ্যে প্রায়ই উপরিউক্ত চিন্তা-পরম্পরা প্রকাশ পাইত। যেমন, একদিন সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন, “কি আশ্চর্য! এক জন্ম শরীর ধারণই মনে হয়, লক্ষ লক্ষ বৎসর কারাগারের তুল্য; লোকে আবার পূর্ব পূর্ব জন্মের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে চায়। প্রতিদিনের ভাবনা-দুশ্চিন্তাই প্রতিদিনের পক্ষে যথেষ্ট, আর অন্য দিনের ভাবনায় কাজ নেই!” তথাপি অভিজ্ঞতার এক দীর্ঘ শৃঙ্খলে আবদ্ধ বিভিন্ন ব্যক্তিগণের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কের প্রশ্নটি তাহার নিকট সকল সময়ে চিত্তাকর্ষক বোধ হইত। পুনর্জন্মবাদকে তিনি কদাপি অবিসংবাদী সত্য বলিয়া জ্ঞান করিতেন না। ব্যক্তিগতভাবে তাহার নিকট উহা এক বিজ্ঞানসম্মত অনুবাদ মাত্র, তবে উহাতে বিশেষভাবে সন্দেহের নিরসন ঘটে। ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি হইতে সকল জ্ঞানের উৎপত্তি, আমাদের পাশ্চাত্য দেশে শিক্ষা-সম্বন্ধে এই মতের প্রতিকূলে স্বামীজী সর্বদাই জন্মান্তরবাদের প্রসঙ্গ উত্থাপনপূর্বক নিজ পক্ষ সমর্থন করিবার জন্য দেখাইয়া দিতেন যে, পাশ্চাত্য-কথিত এই জ্ঞানোন্মেষ প্রায়ই নির্দিষ্ট ব্যক্তির সুদূর অতীত জীবনে ঘটিয়া থাকে বলিয়া উহাকে আর লক্ষ্য করা যায় না।
তথাপি উভয় পক্ষের সব বক্তব্য শেষ হইবার পরেও বৌদ্ধধর্ম অবশেষে দার্শনিক তথ্য হিসাবে যথার্থ প্রতিপন্ন হইতে পারে কিনা এ প্রশ্ন থাকিয়াই যায়। পুনঃ পুনঃ জন্মপরিগ্রহের মধ্যে একই আত্মার অনুবর্তন ও অপরিবর্তনীয়তা—এই সম্পর্কে আমাদের সমগ্র ধারণা কি ভ্রান্তিমূলক নহে, যেহেতু পরিশেষে একই সৎ, বহু অসৎ’—এই অনুভূতির নিকট উহার পরাভব ঘটে? দীর্ঘকাল নীরবে চিন্তার পর একদিন স্বামীজী বলিয়া উঠিয়াছিলেন, “ঠিক, বৌদ্ধধর্ম নিশ্চয় যথার্থ বলছে! পুনর্জন্ম মরীচিকামাত্র! কিন্তু এই অনুভূতিলাভ কেবল অদ্বৈতমার্গেই সম্ভব।”
সম্ভবতঃ বুদ্ধ ও শঙ্করাচার্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধাইয়া দিয়া অবশেষে বৌদ্ধধর্মের অপূর্ণতা দূর করিবার উদ্দেশ্যে অদ্বৈতবাদের অবতারণা করিয়া স্বামীজী কৌতুক অনুভব করিতেন। হয়তো ইহা দ্বারা ইতিহাসের দুই বিভিন্ন যুগের সম্মিলন সাধিত হয় বলিয়াই তিনি এত আনন্দিত হইতেন, যেহেতু ইহা দ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে, উক্ত মদ্বয়ের মধ্যে একটি অপরটির সাহায্য ব্যতীত অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। মনুষ্যত্বের চরম বিকাশের সংজ্ঞা নির্দেশ করিতে গিয়া তিনি সর্বদাই বলিতেন, ”বুদ্ধের হৃদয় এবং শঙ্করাচার্যের মনীষা।” বৌদ্ধ কর্মবাদেব বিরুদ্ধে জনৈকা পাশ্চাত্য মহিলার যুক্তিসমূহ তিনি ঐভাবেই শ্রবণ করেন। ঐ মত গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে যে একটা অসাধারণ সামাজিক দায়িত্ববোধ জড়িত থাকে(৯) সে কথা মহিলা ধরিতে পারেন নাই। তিনি বলিলেন, “যেখানে আমার সৎকর্মের ফল আমি ভোগ করতে পারব না, অপরে করবে, সেখানে আমি আদৌ সৎকর্ম করতে যাব কেন, তার কারণ আমি খুঁজে পাই না।”
স্বামীজী নিজে ঐ ভাবে চিন্তা করিতে একান্ত অশক্ত হইলেও উক্ত মন্তব্যে তিনি বিশেষ আকৃষ্ট বোধ করেন; এবং দুই-একদিন পরে নিকটস্থ এক ব্যক্তিকে বলেন, “সেদিন যে কথাটি উঠেছিল, তা বড় চমৎকার—অর্থাৎ পরের উপকার করবার কোন কারণই থাকে না, যদি যাদের উদ্দেশ্যে করা হয়, তারা তার ফলভোগ না করে অপরে করে।”
স্বামীজী যাহাকে কথাগুলি বলেন, তিনি অশিষ্টের মতো উত্তর দেন,”কিন্তু তা নিয়ে তো তর্ক হয়নি! কথা ছিল এই যে, আমি ছাড়া অপর কেহ আমার কর্মের ফল ভোগ করবে।”
ধীরভাবে স্বামীজী উত্তর দিলেন, “তা জানি, কিন্তু আমাদের পরিচিতা মহিলা যদি কথাটি ঐভাবে বলতেন, তবে তার নিজের মতটি আরও যুক্তিযুক্ত হতো। ধর, তিনি ঐভাবেই প্রশ্নটি করেছেন—অর্থাৎ অপরের উদ্দেশ্যে উপকার করে আমরা বঞ্চিত হয়ে থাকি, কারণ ঐ উপকার তাদের কাছে পৌঁছায় না। দেখছ না, ওর একটিমাত্র উত্তর আছে, তা হলো অদ্বৈতবাদ! কারণ, আমরা সকলেই এক!”
তিনি কি হৃদয়ঙ্গম করেন যে, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের হিন্দুমনের মধ্যে ঠিক এই পার্থক্যই বিদ্যমান যে, ভারতের আধুনিক ধারণায় বৌদ্ধধর্ম ও বুদ্ধের স্থান সর্বদাই থাকিবে? তিনি কি ভাবিয়াছিলেন যে, গুপ্তযুগ হইতে যে রামায়ণ ও মহাভারত ভারতীয় শিক্ষার উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়া আসিয়াছে, অতঃপর সাধারণ লোক তাহার সহিত অশোক ও তাহার পূর্ববর্তী যুগের ইতিহাসও সংযুক্ত করিয়া দিবে? এশিয়ার পক্ষে এরূপ একটি সমন্বয়সাধনের উৎপর্য কত ব্যাপক, বৌদ্ধদেশসমূহের ধমনীতে হিন্দুধর্ম হইতে কি নূতন প্রাণ সঞ্চার হইবে, আবার জননীস্বরূপ হিন্দুধর্মও আত্মস্থ হইয়া কন্যাস্থানীয় বৌদ্ধজাতিগুলিকে জ্ঞানামৃত পান করাইলে স্বয়ং ভারতও কত শক্তি বীর্য লাভ করিবে—এ-সকল কথা কি স্বামীজী ভাবিয়াছিলেন? তিনি কি ভাবিয়াছিলেন জানি না, কিন্তু আমাদের বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে, হিন্দুধর্মের মধ্যেই তিনি এই দুই ধর্মের দৃঢ় সম্মিলনভূমি দেখিতে পাইয়াছিলেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, জননী হিন্দুধর্মই সকল ধর্মমতকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করিতে সমর্থ; কন্যা বৌদ্ধধর্ম নয়। যেহেতু তিনি মহীয়সী ও প্রেমময়ী জননী, তাই তাহার ক্রোড়ে অবতারগণের মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা বিশাল-হৃদয় সেই মহামহিম বুদ্ধাবতারের স্থান চিরকালের জন্য আছে। বুদ্ধ প্রবর্তিত সম্প্রদায়গুলিকে তিনি আশ্রয় দিয়াছেন, তৎ-প্রচারিত শিক্ষার মর্ম তিনি অনুধাবন করিয়া শ্রদ্ধা করেন, তাহার আশ্রিত ভক্তগণের প্রতি মাতার ন্যায় স্নেহশীলা, এবং তাহার নিকট আনীত সকল নবজাতক সন্তানের (বৌদ্ধধর্ম বা বুদ্ধের জন্য সহানুভূতি বা সাদর সম্ভাষণও রহিয়াছে। কিন্তু সত্যকে বুদ্ধ যে আকারে প্রচার করিয়াছেন, সত্য তাহাতেই বদ্ধ, তাহার বাহিরে নাই, কেবল সন্ন্যাসমার্গ অবল নেই। মুক্তিলাভ সম্ভব, অথবা চরম পূর্ণতালাভের একটিই পথ বিদ্যমান-এ-সব কথা হিন্দুধর্ম কখনও বলিবে না। বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে সম্ভবতঃ স্বামীজীর শ্রেষ্ঠ উক্তি হইলঃ