“এক বিরামহীন বর্ষণের রাত্রি। তিনি এক গোপের কুটিরে এসে ছাঁচের নিচে দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালেন। ছাঁচ থেকে বৃষ্টির জল ঝরছে। প্রবল বৃষ্টি পড়ছে, এবং বাতাসের বেগ বাড়ছে।
“কুটিরের ভেতর গোপ জানালার মধ্য দিয়ে চকিতের ন্যায় একখানি মুখ দেখতে পেল। মনে মনে সে বললে, “বেশ, বেশ! গেরুয়াধারী! থাকো ওখানে, তোমার পক্ষে ঐ যথেষ্ট। তারপর সে গান আরম্ভ করে দিল, আমার গরুবাছুর নিরাপদে ঘরে উঠেছে, আগুনও খুব জ্বলছে, আমার স্ত্রী নিরাপদ, ছেলেমেয়েরাও সুখে নিদ্রা যাচ্ছে! সুতরাং মেঘেরা, আজ রাত্রে তোমরা স্বচ্ছন্দে বর্ষণ করতে পার!
“বুদ্ধ বাইরে থেকে উত্তর দিলেন, ‘আমার মন সংযত, ইন্দ্রিয় প্রত্যাহৃত; আমার হৃদয় দৃঢ়। অতএব মেঘেরা, আজ রাত্রে তোমরা স্বচ্ছন্দে বর্ষণ করতে পার?’
“তারপর গোপ আবার গাইল, ‘ক্ষেতে ফসলকাটা শেষ, খড়গুলিও খামারে ভাল করে রাখা আছে; নদী পরিপূর্ণ, আলগুলি বেশ দৃঢ়। সুতরাং মেঘেরা, ইচ্ছা হলে তোমরা আজ রাত্রে বর্ষণ করতে পার।’
“এইভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পর, অবশেষে বিস্মিত ও অনুতপ্ত হয়ে গোপ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করল।(৭)
“অথবা নাপিত উপালির(৮) আখ্যান অপেক্ষা সুন্দরতর আর কিছু হতে পারে কি?–
“ভগবান আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন; আমি একজন সামান্য নাপিত আমারও বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন! আমি দৌড়ে গেলাম। কিন্তু তিনি নিজেই ফিরলেন এবং আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
“আমি এক নগণ্য নাপিত, আমার জন্য অপেক্ষা করলেন!
আমি বললাম, প্রভু, আপনার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি কি?
তিনি বললেন, হাঁ।
আমি নাপিত, আমাকেও ‘হাঁ’ বললেন!
আমি বললাম, নির্বাণ কি আমাদের মতো লোকদের জন্যও?
তিনি বললেন, নিশ্চয়!
আমি নাপিত, আমার জন্যও।
তারপর আমি বললাম, প্রভু, আমি কি আপনার অনুসরণ করতে পারি?
উত্তরে তিনি বললেন, নিশ্চয় পার।
আমি যে নাপিত, সেই আমাকেও অনুমতি দিলেন!
আমি আবার বললাম, প্রভু, আমি আপনার নিকট থাকতে পারি?
তিনি বললেন, তুমি আমার কাছে থাকতে পার।
আমি এক দরিদ্র নাপিত, আমাকেও তিনি তার কাছে থাকবার অনুমতি দিলেন!”
একদিন স্বামীজী বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সংক্ষেপে এইরূপ বলেন যে, বৌদ্ধধর্মের তিনটি যুগের মধ্যে পাচশত বৎসর বুদ্ধোত্ত বিধিসমূহের যুগ, পঁচশত বৎসর প্রতিমা পূজার এবং পাচশত বৎসর তন্ত্রের যুগ। সহসা ঐ প্রসঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া তিনি বলিলেন, “কখনো ভেবো না যে, ভারতে কোনকালে বৌদ্ধধর্ম বলে কোন পৃথক ধর্ম ছিল, আর তার নিজস্ব মন্দির ও পুরোহিত প্রভৃতি ছিল! একেবারেই নয়। বৌদ্ধধর্ম চিরকাল ছিল হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত। কেবল একসময়ে বুদ্ধের প্রভাব অত্যধিক হয়ে উঠে, এবং তার ফলে সমগ্র জাতি সন্ন্যাসপথ অবলম্বন করে।” আমার বিশ্বাস, বহু সময় ও অধ্যয়নের দ্বারাই কেবল এই মতবাদের সত্যতা পণ্ডিতগণের নিকট ক্রমে ক্রমে প্রতিপন্ন হইতে পারে। এই মতানুসারে প্রচারক প্রেরণের দ্বারা বিজিত দেশগুলিতেই বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব মন্দিরাদি স্থাপন করিয়াছিল। কাশ্মীর ঐসকল দেশের অন্যতম। স্বামীজী এই সম্পর্কে এক চিত্তাকর্ষক ঐতিহাসিক তথ্য বর্ণনা করিয়া বলেন যে, ঐ দেশে ভারতীয় মহাপুরুষগণ বৌদ্ধধর্মের অঙ্গরূপে পরিগৃহীত হইবার পর স্থানীয় নাগগণ (অর্থাৎ কুণ্ডের অভ্যন্তরস্থ যে-সকল অদ্ভুত ক্ষমতশালী সর্পের অস্তিত্ব কল্পনা করা হইত) স্বভাবতঃ দেবত্বপদবী হইতে বিচ্যুত হয়। আশ্চর্যের বিষয়, তাহাদের ঐ ক্ষমতাচ্যুতির পরেই প্রচণ্ড শীত পড়ে, এবং ভীত জনসাধারণ কর্তৃক পুরাতন কুসংস্কার ও নূতন সত্য—এই উভয়ের মধ্যে দ্রুত একটা আপসবিধান হয়। ফলে নূতন ধর্মের মহাপুরুষ অথবা গৌণ দেবতারূপে নাগগণের পুনঃ প্রতিষ্ঠা ঘটে—মানব স্বভাবের এই প্রকার কার্যের দৃষ্টান্ত অন্যত্রও বিরল নহে।
বৌদ্ধধর্ম ও তাহার জননীস্বরূপ হিন্দুধর্মের মধ্যে অন্যতম প্রধান পার্থক্য এই যে, হিন্দুরা একই আত্মার পুনঃ পুনঃ জন্মান্তর পরিগ্রহের দ্বারা কর্মসঞ্চয়ে বিশ্বাস করেন, কিন্তু বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা হইল, এই আপাত-প্রতীয়মান একত্ব মায়ামাত্র এবং ক্ষণিক। বৌদ্ধমতে প্রকৃতপক্ষে আমরা এ-জীবনে যে কর্ম সঞ্চিত রাখিয়া যাই, অপর এক আত্মায় উহা বর্তায় এবং আমাদের ঐ অভিজ্ঞতাসহ সে নূতন কর্মবীজবপনে অগ্রসর হয়। এই প্রতিদ্বন্দ্বী মতদ্বযের অন্তর্নিহিত গুণাবলী সম্পর্কে স্বামীজী প্রায়ই চিন্তা করিতে বসিনে। তাহার মতো যাহাদের নিকট অতীন্দ্রিয় অনুভূতির দ্বার উদঘাটিত হইয়াছে তাহাদেব, এবং উহার ছায়ায় যাহারা বাস করিয়াছেন—কতক পরিমাণে তাহাদের নিকটেও আত্মার শরীরে অবস্থিতি এক চিরযন্ত্রণাকর বন্ধন। পিঞ্জরাবদ্ধ আত্মা শরীররূপ কারাগারের গারদে বিদ্রোহীর ন্যায় অবিরত আঘাত হানিতেছে; কারণ, শবীররূপ কারাগারের বাহিরে সেই শুদ্ধ, চৈতন্যময়, ভাবঘন, সদানন্দ পরম জ্যোতির্ময় ধাম সে দেখিতে পায় ঃ উহাই তাহার আদর্শ ও লক্ষ্য। এই সকল ব্যক্তির নিকট শরীর পরস্পরের সহিত সম্পর্ক স্থাপনের সহায় হওযাব পরিবর্তে একটা আবরণ, মহা প্রতিবন্ধক! সুখ-দুঃখ সেই আদি চৈতন্যই—কেবল ব্যষ্টিচৈতন্যের পরকলাব মধ্য দিয়া প্রতিভাত। সকলেই একমাত্র আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত—এই উভয়ের পারে যাইয়া সেই শুদ্ধ, অখণ্ড জ্যোতিস্বরূপকে প্রত্যক্ষ করা।