অমর কাহিনী ক্রমে সমাপ্ত হইল। কিন্তু বর্ণনাকালে স্বামীজী যখন “কনুয়ের উপর ভর দিয়ে একটু উঠে তাকে উপদেশ দিলেন” এইখানে আসিয়া একটু চুপ করিলেন, এবং কথার পিঠে বলিলেন, “দেখ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের জীবনে এটা আমি নিজের চোখে দেখেছি?”—তখন শ্রোতার নিকট ঐ অংশটি সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হইয়াছিল। আমার মনে সেই ব্যক্তির কথা উদিত হইল, সেই আচার্যশ্রেষ্ঠের নিকট শিক্ষালাভ যাহার ভাগ্যে ছিল। একশত মাইল দূর হইতে তিনি আসিতেছিলেন, এবং যখন তিনি কাশীপুরে উপনীত হইলেন, তখন পরমহংসদেবের অন্তিমকাল উপস্থিত। এক্ষেত্রেও শিষ্যগণ তাহার আগমনে বাধা দিতেন, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ আপনা হইতে বলিলেন, “ওকে আসতে দাও, আমি ওকে উপদেশ দেব।”
বৌদ্ধমতবাদের ঐতিহাসিক ও দার্শনিক তাৎপর্য সম্পর্কে স্বামীজী সর্বদা মনে মনে গভীরভাবে আলোচনা করিতেন। হঠাৎ ঐ প্রসঙ্গের উল্লেখ এবং আকস্মিক উক্তিসকল দ্বারা বোঝা যাইত যে, তাহার মনে ঐ সম্পর্কে চিন্তা সর্বদা বিদ্যমান। একদিন তিনি বুদ্ধের উপদেশ হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলিলেন, “রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান—এই হলো পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চতত্ত্ব যা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল, এবং পরস্পরের সঙ্গে সংমিশ্রিত। এরই নাম ‘মায়া। কোন একটি বিশেষ তরঙ্গ সম্বন্ধে কিছুই বলা যায় না, কারণ যা ছিল, এখন আর তা নেই। এক সময়ে সেটা ছিল, কিন্তু এখন গত। হে মানব, জেনো যে, তুমি সাগরস্বরূপ!” তিনি আরও বলিলেন, “মহর্ষি কপিলও এই দর্শনই প্রচার করেন; কিন্তু তার মহানুভব শিষ্যের (বুদ্ধের) অদ্ভুত হৃদয় সেই দর্শনকে জীবন্ত করে তোলে।”
তারপর সেই পুরুষশ্রেষ্ঠের কথাগুলি অন্তরে ধ্বনিত হওয়ায় তিনি ক্ষণকালের জন্য নীরব রহিলেন। পরে ধম্মপদ হইতে মানবাত্মার প্রতি তাহার অমর আদেশবাণী আবৃত্তি করিলেন, “কোন নির্দিষ্ট পথের দিকে লক্ষ্য না রেখে ক্রমাগত এগিয়ে যাও! নির্ভীক অন্তরে, সমস্ত তুচ্ছ করে একাকী গণ্ডারবৎ বিচরণ কর।” “সিংহ যেমন কোন শব্দে ভীত হয় না, বায়ু যেমন জালে বদ্ধ হয় না, পদ্মপত্র যেমন জলে লিপ্ত হয় না, তুমিও তেমনি একাকী গণ্ডারবৎ বিচরণ কর।”
একদিন স্বামীজী বৌদ্ধদের প্রথম সভা এবং তাহাদের সভাপতি নির্বাচন সম্পর্কে বিবাদ—এই প্রসঙ্গ বর্ণনা করিতে গিয়া বলিলেন, “তাদের তেজ কিরূপ ছিল, তোমরা কি তা কল্পনা করতে পার? একজন বললেন, ‘আনন্দই সভাপতি হবে, কারণ সেই তাকে সর্বাপেক্ষা ভালবাসত।’ কিন্তু আর একজন অগ্রসর হয়ে বললেন, ‘তা হবে না। কারণ আনন্দ তার মৃত্যুশয্যায় ক্রন্দন করার অপরাধে অপরাধী। সুতরাং তাকে বাদ দিয়ে অন্য ব্যক্তিকে নির্বাচন করা হলো।”
তিনি বলিতে লাগিলেন, “কিন্তু বুদ্ধ মারাত্মক ভুল করেছিলেন এই ভেবে যে, সমগ্র জগৎকে উপনিষদের উচ্চ আদর্শে উন্নীত করা যেতে পারে। ফলে স্বার্থপরতা সমস্ত নষ্ট করে দিল। শ্রীকৃষ্ণ বুদ্ধের চেয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন, কারণ তিনি দেশকাল-পাত্র বুঝে কাজ করবার কৌশল জানতেন কিন্তু বুদ্ধের কাছে কোন আপস ছিল না। জগতের ইতিহাসে ইতিপূর্বেই দেখা গেছে যে, আপস করবার জন্য অবতারপুরুষও বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছেন, বুঝতে না পেরে তাকে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বুদ্ধ যদি মুহূর্তের জন্যও আপস করতেন, তবে তার জীবিতকালেই তিনি সমগ্র এশিয়ায় ঈশ্বররূপে পূজিত হতেন। কিন্তু তার উত্তর ছিল, ‘বুদ্ধত্ব এক উচ্চ অবস্থাপ্রাপ্তি, কোন ব্যক্তি বিশেষ নয়। সত্যই, জগতে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সম্পূর্ণ প্রকৃতিস্থ ছিলেন—জগতে যত লোক জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি।”
খ্রীস্টান আমরা যে যন্ত্রণাভোগকে পূজা করিতে ভালবাসি, তাহার প্রতি স্বামীজীর ঘৃণা ছিল। উহা দ্বারা ভারতের স্বচ্ছ চিন্তাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যে অনেকে তাহাকে বলেন যে, বুদ্ধ ক্রুশবিদ্ধ হইয়া প্রাণত্যাগ করিলে তাহার মহত্ত্ব অধিকতব হৃদয়গ্রাহী হইত! ইহাকে তিনি ‘রোমক বর্বরতা বলিয়া তীব্রভাবে নিন্দা করিতে বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ করেন নাই। তিনি দেখাইয়া দেন, “সর্বাপেক্ষা নীচ ও পাশবপ্রকৃতির লোকেরাই কোন একটা অসাধারণ ব্যাপারের পক্ষপাতী। অতএব জগৎ চিরকাল বীরত্বের কাহিনী বা মহাকাব্য ভালবাসবে। কিন্তু ভারতের সৌভাগ্য যে, সে কখনো হেঁট মুণ্ডে গভীর অতলস্পর্শ গহুরে নিক্ষেপ করলেন (Hurled headlong down the steep abyss)’, এই রকম রচনার স্রষ্টা মিল্টনের মতো কবি প্রসব করেনি। ঐ কাব্যের সবটার বদলে ব্রাউনিঙ-এর দুই-এক ছত্র কবিতা পাওয়া গেলেও লাভ!” তাহার মতে খ্রীস্টজীবনের কাহিনীগুলির মধ্যে এই মহাকাব্যোচিত শক্তি বা তেজই রোমকদের হৃদয় স্পর্শ করিয়াছিল। ঐ ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাই রোমীয় জগতের সর্বত্র খ্রীস্টধর্ম প্রসারিত হওয়ার কারণ। তিনি পুনরায় বলিলেন, “একথা অস্বীকার করা যায় না যে, পাশ্চাত্যবাসী তোমরা বড় বড় কাজ দেখতে চাও! জীবনের প্রত্যেক সাধারণ ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্যে যে কবিত্ব নিহিত থাকে, তা তোমরা এখনো অনুভব করতে পার না। মৃতপুত্র ক্রোড়ে তরুণী মাতার বুদ্ধের নিকট আসা—এ কাহিনীর মতো আর কোন্ কাহিনীর মাধ্য বেশি? অথবা, ছাগশিশুদের জীবনরক্ষার গল্পটি? তোমরা জান যে, মহাভিনিষ্ক্রমণ ব্যাপারটি ভারতে কিছু নূতন নয়। গৌতম ছিলেন এক সামান্য রাজার পুত্র। তার পূর্বে অনেকে ঐরূপ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে চলে গেছে। কিন্তু নির্বাণের পর, আহা! দেখ কি কবিত্ব।