বুদ্ধ উত্তর করিলেন, “জ্ঞানে কি কখনো লিঙ্গভেদ থাকতে পারে? আমি কি কখনো বলেছি যে, স্ত্রীলোকের সঙেঘ প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু আনন্দ, এ প্রশ্ন তোমারই উপযুক্ত।”
এইরূপে যশোধরাও শিষ্যারূপে গৃহীত হইলেন। অতঃপর সেই দীর্ঘ সাত বৎসরের অবরুদ্ধ প্রেম ও করুণা জাতক কাহিনীগুলিতে প্রবাহিত হইল! কারণ, ঐগুলি সবই যশোধরার জন্য! পঁচ শতবার উভয়েই অহংভাবনা বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিলেন। এখন তাহারা উভয়ে একত্রে চরম পূর্ণত্বলাভ করিবেন।
“হাঁ, হাঁ, এইরূপই হয়েছিল! যশোধরা এবং সীতার পক্ষে তাদের প্রেমপরীক্ষার জন্য একশ বছর যথেষ্ট সময় নয়।”
ক্ষণকাল নীরবতার পর আখ্যায়িকা সমাপ্ত করিতে গিয়া স্বামীজী আপন মনে বলিলেন, “না, না, এস, আমরা সকলেই স্বীকার করি যে, আমাদের মধ্যে এখনো কামক্রোধাদি বর্তমান! এস, আমরা প্রত্যেকেই বলি, ‘এখনো আমি আদর্শ অবস্থায় উপনীত হইনি।’ কেউ যেন অপর কোন ব্যক্তিকে ভগবান বুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে সাহস না করে!”
যৌবনের প্রারম্ভে আমাদের গুরুদেব যখন দক্ষিণেশ্বর যাতায়াত করিতেন, সেই সময়ে বৌদ্ধধর্মের প্রতি জগতের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়াছিল। ব্রিটিশ সরকারের আদেশে এই সময়ে বুদ্ধগয়ার বৃহৎ মন্দিরের পুনরুদ্ধার(১) কার্য চলিতেছিল, এবং বাঙালী পণ্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্র উক্ত কার্যে যোগদান করায় সমগ্র ভারতবাসীর মধ্যে গভীর আগ্রহ দেখা যায়। অধিকন্তু ১৮৭৯ খ্রীস্টাব্দে সার এডউইন আর্ণন্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ গ্রন্থখানি প্রকাশিত হওয়ায় ইংরেজীভাষী দেশগুলিতে অল্পশিক্ষিত সাধারণ লোকের কল্পনাও বিশেষভাবে উদ্দীপিত হয়। ঐ গ্রন্থের অধিকাংশ স্থল অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিতের’ প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ বলিয়া কথিত। কিন্তু স্বামীজী কখনও অপরের মুখে কিছু শুনিয়া তৃপ্ত হইতেন না, এবং এই বিষয়েও তিনি নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন নাই; অবশেষে ১৮৮৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি গুরুভ্রাতাদের সহিত একত্র কেবল ‘ললিত বিস্তর’ নহে, বৌদ্ধধর্মের মহাযান শাখার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রজ্ঞাপারমিতার’(২) মূল সংগ্রহ করিয়া অধ্যয়ন করেন।(৩) তাহাদের সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তিই পালিভাষা বুঝিতে সাহায্য করে, কারণ পালিভাষা সংস্কৃত হইতেই উদ্ভূত। ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের রচনাবলী এবং ‘লাইট অব এশিয়া’র অধ্যয়ন স্বামীজীর জীবনের স্বল্পকাল স্থায়ী ঘটনামাত্র হয় নাই। শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট শিষ্যরূপে অবস্থানকালে তাহার এই প্রধান শিষ্যের সূক্ষ্মভাবপ্রবণ চিত্তে এইরূপে যে বীজ উপ্ত হয়, তাহা সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষালাভের সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পভারে বিকশিত হইয়া উঠে। কারণ, ঐ সময়ে তাহার প্রথম কার্য হইল অবিলম্বে বুদ্ধগয়া গমন, এবং সেই মহাবৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া আপনমনে চিন্তায় মগ্ন হইয়া যাওয়া, “এ কি সত্যই সম্ভব, তিনি যে বায়ুতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করেছিলেন, আমিও সেই বায়ুতে শ্বাস গ্রহণ করছি?—যে ভূমির উপর তিনি বিচরণ করেছিলেন, আমিও তার উপরেই বিচরণ করছি?”
তাহার জীবনের শেষভাগে—তাহার উনচল্লিশ বৎসরের জন্মদিনের প্রাতঃকালে তিনি অনুরূপভাবে বুদ্ধগয়ায় উপস্থিত হন। কাশী দর্শনান্তে এই যাত্রার শেষ হয়, এবং ইহাই তাহার জীবনের শেষ ভ্রমণ। তাহার ভারত পর্যটনের বৎসরগুলিতে কোন সময়ে তিনি বুদ্ধের ভস্মাবশেষ অস্থি স্পর্শ করিবার অনুমতি লাভ করেন—সম্ভবতঃ যে স্থানে ঐসকল অস্থি প্রথম আবিষ্কৃত হয়, তাহারই সন্নিকটে। ঐ সময় তিনি যে প্রবল ভক্তি ও নিঃসংশয়তার ভাবে বিশেষ অভিভূত হইয়াছিলেন, পরবর্তী কালে ঐ ঘটনার উল্লেখ করিতে গেলে তাহার কিছুটা প্রকাশ সর্বদাই দেখা যাইত। অবতারগণকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করা সম্বন্ধে একবার তাহাকে কেহ প্রশ্ন করিলে তিনি যে উত্তর দেন, তাহা খুবই স্বাভাবিক; তিনি বলেন, ‘সত্য বলতে কি মহাশয়া, ন্যাজারেথবাসী ঈশার সময়ে আমি যদি জুডিয়ায় বাস করতাম, তাহলে চোখের জল দিয়ে নয়, হৃদয়ের শোণিতে আমি তার পা-দুখানি ধুয়ে দিতাম।”
তিনি কোন ধর্মাবলম্বী ঠিক না জানিয়া, একজন ভ্রমবশতঃ তাহাকে বৌদ্ধ বলায় তিনি বলিয়া উঠেন, “বৌদ্ধ! আমি বুদ্ধের দাসানুদাসের দাস!” বুদ্ধের প্রতি তাহার ভক্তি এরূপ প্রগাঢ় ছিল যে, বৌদ্ধমতে বিশ্বাসী হওয়াও যেন তাহার নিকট এক উচ্চ অবস্থায় উপনীত হওয়া বোধ হইত—যেন তিনি উহাও দাবি করিতে পারেন না।
বুদ্ধের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক প্রামাণ্যই কেবল তাহাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে নাই। আর একটি প্রধান কারণ এই যে, তাহার প্রত্যক্ষদৃষ্ট গুরুদেবের জীবনের সহিত আড়াই হাজার বৎসর পূর্বেকার এই সর্বজনস্বীকৃত ইতিহাসের বহু পরিমাণে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। ভগবান বুদ্ধের জীবনে তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে; শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে তিনি দেখিয়াছিলেন ভগবান বুদ্ধকে।
একদিন বুদ্ধের দেহত্যাগের দৃশ্য বর্ণনা করিতে করিতে চকিতের ন্যায় তাহার মনে এই চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিল। তিনি বলিতে লাগিলেন—কিরূপে এক বৃক্ষতলে তাহার জন্য কম্বল বিছানো হইয়াছিল, এবং সেই আনন্দময় পুরুষ “সিংহের ন্যায় দক্ষিণ পার্শ্বে শয়ন করিয়া” মৃত্যু-প্রতীক্ষায় রত, এমন সময়ে সহসা এক ব্যক্তি তাহার নিকট দৌড়িয়া আসিল উপদেশ গ্রহণের জন্য। শিষ্যগণ তাহাদের প্রভুর মৃত্যুশয্যার নিকট যেরূপে হউক শান্তিরক্ষা করিবার জন্য ঐ ব্যক্তির সেই সময়ে আগমন অনুচিত ভাবিয়া তাহাকে ফিরাইয়া দিতেছিলেন, কিন্তু ভগবান দূর হইতে তাহাদের কথাবার্তা শুনিতে পাইয়া বলিলেন, “না, না! ফিরিয়ে দিও না! তথাগত(৪) সর্বদাই প্রস্তুত।” তিনি কনুয়ের উপর ভর দিয়া একটু উঠিয়া তাহাকে উপদেশ দিলেন। চারবার এইরূপ ঘটিল; তখনই কেবল বুদ্ধ ভাবিলেন, এখন আমি নিশ্চিন্তচিত্তে মরতে পারি। তাহার পূর্বে নহে। স্বামীজী বলিতে লাগিলেন, “কিন্তু প্রথমে তিনি ক্রন্দন করার জন্য আনন্দকে তিরস্কার করেন। বললেন, বুদ্ধ কোন ব্যক্তি বিশেষ নয়, উহা এক উচ্চ অবস্থাবিশেষ এবং যে কেহ ঐ অবস্থা লাভ করতে পারে আর শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে তিনি কারও পূজা করতে নিষেধ করেন।”