আজগুবী ব্যাপার সম্পর্কে সাধারণের যে ঔৎসুক্য, বুদ্ধ তাহার প্রতি এত বীতস্পৃহ ছিলেন যে, জনতার সমক্ষে একটা লম্বা খুঁটির উপর হইতে কেবল শব্দের দ্বারা মণিমুক্তাখচিত একটি বাটি নামাইয়া আনার জন্য এক যুবককে সঙ্ঘ হইতে নির্মমভাবে বাহির করিয়া দেন। তিনি বলিয়াছিলেন, ধর্মের সহিত বুজরুকির কোন সম্পর্ক নাই।
এই আনন্দময় পুরুষের কি অসাধারণ স্বাধীনতাবোধ ও নিরভিমানতা ছিল! বারনারী অশ্বপালীর নিমন্ত্রণে তিনি যোগ দেন। মৃত্যু ঘটিতে পারে জানিয়াও তিনি এক অন্ত্যজের গৃহে ভিক্ষাগ্রহণ করেন, কারণ তাঁহার ইচ্ছা ছিল,দীন-হীন ব্যক্তিগণের সহিত সংযোগস্থাপনই যেন তাহার জীবনের শেষকার্য হয়। অতঃপর যাহার গৃহে ভিক্ষা গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাকে মহাপরিনির্বাণলাভে সহায়তার জন্য সৌজন্যপূর্ণ বার্তা পাঠান। কি প্রশান্ত! কি পুরুষোচিত আচরণ! সত্যই তিনি ছিলেন পুরুষর্ষভ এবং অশেষ গুণাকর।
আবার তাহার মধ্যে যেমন বিচারশক্তির পূর্ণতা ঘটিয়াছিল, তেমনি তিনি ছিলেন আশ্চর্য দয়ার আধার। রাজগৃহে ছাগগুলির জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। একবার এক ব্যাঘ্রীর ক্ষুধা পরিতৃপ্তির জন্য নিজ শরীর দান করিতে চাহিয়াছিলেন। পঁচশতবার পরার্থে জীবন বিসর্জনের ফলেই ধীরে ধীরে সেই অপার পবিত্র করুণার উদ্ভব হয়, এবং উহাই তাহাকে বুদ্ধত্বে উপনীত করে।
জনৈক যুবক সম্বন্ধে তিনি যে গল্পটি বলেন, তাহা হইতে বহুযুগের ব্যবধানেও আমরা তাহার রসজ্ঞানের কিঞ্চিৎ আভাস পাই। যাহাকে জীবনে দেখে নাই, এবং যাহার নাম পর্যন্ত শোনে নাই, এইরূপ এক নায়িকার প্রতি ঐ যুবক গদগদভাবে নিজের প্রেম ব্যক্ত করিতেছে—এই কষ্টকর অবস্থাকে তিনি মানবের ঈশ্বর সম্পর্কে নানা উক্তির সহিত তুলনা করেন। একমাত্র তিনিই ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে স্বর্গ-নরকাদি কল্পনা হইতে মুক্ত করিতে সমর্থ হন। অথচ উহা দ্বারা তাহার শক্তি এবং মানবহৃদয়ে তাহার প্রাণস্পর্শী আবেদন কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। উহার কারণ তাহার নিজের মহান ব্যক্তিত্বপূর্ণ ক্ষমতা এবং সমসাময়িক ব্যক্তিগণের উপর উহার অসীম প্রভাব।
এক সন্ধ্যায় স্বামীজী, বুদ্ধের সহধর্মিণী যশোধরার নিকট বুদ্ধের জীবনকাহিনী যেরূপ প্রতিভাত হইয়াছিল, তাহার একটি কাল্পনিক চিত্র আমাদের কয়েকজনের নিকট বর্ণনা করেন। ইতিহাসের শুষ্ক অস্থি ঐরূপ পরিপূর্ণ জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ ঘটনার ন্যায় বর্ণিত হইতে আমি ইতিপূর্বে কখনও শুনি নাই। স্বয়ং হিন্দু সন্ন্যাসী হইলেও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক বোধ হইয়াছিল যে, বুদ্ধের ন্যায় দৃঢ়চেতা ব্যক্তির পরিণয় সম্পর্কে ইউরোপীয়দের মতো ধারণা” থাকিবে, এবং তিনি স্বয়ং দেখিয়া পাত্রী নির্বাচন করার ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব অবলম্বন করিবেন। সপ্তাহব্যাপী উৎসব ও বাগদানের প্রত্যেকটি ঘটনা স্বামীজী বিশদভাবে ও দরদের সহিত বর্ণনা করিলেন। অতঃপর উভয়ের সুদীর্ঘ দাম্পত্যজীবন এবং অবশেষে সেই বিখ্যাত বিদায়রজনীর চিত্র বর্ণিত হইল। দেবগণ গাহিলেন,”জাগো, হে প্রবুদ্ধ! ওঠ এবং জগৎকে সাহায্য কর।” রাজপুত্রের মনের মধ্যে সংগ্রাম চলিতে লাগিল,বার বার তিনি নিদ্রিত পত্নীর শয্যাপার্শ্বে প্রত্যাগত হইলেন। “কি সেই সমস্যা—যা তাকে বিচলিত করিয়াছিল! তিনি যে তার পত্নীকেই জগতের কল্যাণের জন্য বলি দিতে উদ্যত হয়েছেন! তার জন্যই এই সংগ্রাম। নিজের কথা তিনি একেবারেই ভাবছিলেন না।”
অতঃপর তাহার জয়লাভ এবং তাহারই অনিবার্য ফলস্বরূপ বিদায় গ্রহণ, এবং অতি সন্তর্পণে রাজপুত্রীর চরণচুম্বন–এত সন্তর্পণে যে, তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল না। স্বামীজী বলিলেন, “তোমরা কি কখনো বীরদের হৃদয়ের কথা চিন্তা করনি? তাহার হৃদয় মহৎ, অতি মহৎ। সে মহত্ত্বের তুলনা নেই, আবার তাননীর মতোই কোমল!”
দীর্ঘ সাতবৎসর পরে রাজপুত্র—তখন তিনি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত কপিলাবস্তুতে প্রত্যাবর্তন করিলেন। যেদিন তিনি তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া যান, সেইদিন হইতে যশোধরাও তাহার নারীজনোচিত উপায়ে স্বামীর ধর্মজীবনের অনুবর্তনকারিণী। তাহার পরিধানে কষায় বসন, আহার কেবল ফলমূল, অনাবৃত স্থানে ভূমিশয্যায় শয়ন। বুদ্ধ প্রবেশ করিলেন, যশোধরা প্রকৃত সহধর্মিণীর ন্যায় তাহার বস্ত্রের প্রান্তভাগ স্পর্শ করিলেন। ভগবানও তাহাকে এবং তাহার পুত্রকে সত্য উপদেশ দিলেন।
উপদেশ প্রদানের পর তিনি উদ্যানে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে যশোধরার চমক ভাঙিল। তিনি পুত্রের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “শীঘ্র যাও, তোমার পিতার নিকট গিয়ে পিতৃধন চেয়ে নাও।”
শিশু যখন প্রশ্ন করিল, “মা, এদের মধ্যে আমার পিতা কে?” যশোধরা গর্বের সহিত উত্তরে কেবল এইটুকু বলিলেন, “যিনি সিংহের ন্যায় রাজপথ দিয়ে যাচ্ছেন, তিনিই তোমার পিতা!”
শাক্যবংশের ভাবী উত্তরাধিকারী কুমার তখন পিতার নিকট গিয়া বলিল, “পিতা, আমাকে আমার পিতৃধন দিন!”
বালক তিনবার বুদ্ধের নিকট ঐরূপ ভিক্ষা করিলে বুদ্ধ আনন্দের দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘ওকে দাও! তখন বালককে গৈরিক বস্ত্র প্রদান করা হইল।
তারপর যশোধরাকে দেখিয়া এবং স্বামীর নিকট থাকিবার জন্য তাহার আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করিয়া প্রধান শিষ্য ভগবানকে বলিলেন, “ভগবান, স্ত্রীলোকেরাও কি সঙ্গে প্রবেশ করিতে পারেন? আমরা কি এঁকেও গৈরিক বস্ত্র প্রদান করব?”