অতীতে ভারতীয় ঋষিগণ ভারতবাসীর নিকট যে ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন, উদারহৃদয় স্বামীজী পাশ্চাত্যগণের নিকট সেই ধর্মই প্রচার করেন, উহা হইল, মানবের অন্তর্নিহিত দেবত্ব, এবং যে কোন আকারের নিষ্ঠাপূর্ণ সেবার মাধ্যমে উহার উপলব্ধি—ইহাই তাহার প্রচারিত ধর্মের মর্মকথা। বাহ্য জগতের যে জীবনে ইন্দ্রিয়জ অনুভূতিকে সার জ্ঞান করিয়া তাহাতেই নিবিষ্টচিত্ত হওয়া—স্বামীজীর মতে উহা কেবল সম্মোহন বা স্বপ্নমাত্র; কোনক্রমেই মহৎ ভাবযুক্ত নহে। প্রাচ্যবাসীর ন্যায় পাশ্চাত্যবাসীরও আত্মার আকাঙক্ষা—এই স্বপ্ন ভাঙিয়া ফেলা, এক গভীরতর এবং অধিকতর শক্তিশালী বাস্তব সত্তায় জাগ্রত হওয়া। সকল মানবের ভিতরেই প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে সেই অনন্ত শক্তি—তাহার এই বিশ্বাস তিনি ক্রমাগত নূতন নূতন ভাবে প্রকাশ করিতে চাহিতেন। একবার তিনি বলেন, “সত্য বটে, আমার নিজের জীবন এক মহাপুরুষের প্রতি প্রগাঢ় ভাবাবেগের অনুপ্রেরণায় পরিচালিত, কিন্তু তাতে কি? অতীন্দ্রিয় তত্ত্বগুলি শুধু এক ব্যক্তির মধ্য দিয়েই প্রচারিত হয় না!”
তিনি আবার বলেন, “সত্য বটে, আমি বিশ্বাস করি যে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন একজন আপুরুষ—ঐশীশক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত। কিন্তু, আমিও ঐশীশক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং তুমিও ঐরূপ অনুপ্রাণিত। আর তোমার শিষ্যেরাও ঐরূপ হবে, তারপরে তাদের শিষ্যেরাও-এইভাবে অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবে!”
পরীক্ষা দ্বারা যাহারা উপযুক্ত প্রমাণিত হইবে, তাহাদেরই কেবল সত্যের উপদেশ প্রদান করা হইবে—প্রাচীনকালে আচার্যদের এই নিয়ম সম্পর্কে এক ব্যক্তি তাহাকে প্রশ্ন করিলে স্বামীজী অসহিষ্ণুভাবে বলিয়া ওঠেন, “দেখতে পাচ্ছ না, রহস্যব্যাখ্যার নাম করে সত্যকে জনকয়েক লোকের মধ্যে আটকে রাখবার যুগ চলে গেছে? ভালোর জন্যই হোক, অথবা মন্দের জন্যই হোক, সেদিন বিলীন হয়ে গেছে, আর কখনো ফিরবে না। ভবিষ্যতে সত্যের দ্বার সকলের নিকট উদঘাটিত থাকবে!”
ইউরোপীয়দের প্রবর্তিত ধর্মভাব ও সম্প্রদায়সমূহের দ্বারা ভারতবর্ষকে প্লাবিত করিবার প্রচেষ্টা সম্পর্কে স্বামীজী অপূর্ব কৌতুক সহকারে বলিতেন যে, উহা এক জাতির কল্যাণকল্পে অপর এক জাতির উচ্ছেদসাধন বা শোষণের এক সুদীর্ঘ উদ্যমের চরম পরিণতিমাত্র। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে ঐরূপ ইউরোপীয় নেতৃত্বকে তিনি কদাপি গুরুত্ব প্রদান করিতেন না।
সর্বোপরি, খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অশোক কর্তৃক দেশবিদেশে প্রেরিত ধর্মপ্রচারকগণের প্রতি মহান ভার অর্পণের ন্যায় তাঁহার স্বজাতির ইতিহাসের আর কোন ঘটনাই তিনি বারংবার উল্লেখ করিতেন না। যাহারা বিভিন্ন দেশে বুদ্ধের ধর্ম বহন করিয়া লইয়া যাইবেন, তাহাদের প্রতি সেই পরাক্রমশালী সম্রাট বলিয়াছিলেন, “মনে রাখবেন, সকল স্থানেই ধর্ম ও সদাচারের কিছু বীজ আপনারা দেখতে পাবেন। দেখবেন, আপনারা যেন ঐ-সকল পোষণ করেন এবং কখনো নষ্ট না করেন।” এইরূপে অশোক স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন যে, সমগ্র জগৎ একদিন বিভিন্ন ভাবরাশির দ্বারা একসূত্রে গ্রথিত হইবে—যে-সকল ভাব সর্বদাই চরম সত্যলাভ ও আদর্শ চরিত্রের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের প্রচেষ্টায় পরিচালিত ও অনুপ্রাণিত। কিন্তু অশোকের ঐ স্বপ্ন সফল হইবার পথে অন্তরায় ছিল, যাহাদের পরস্পরের মধ্যে বিরাট ব্যবধান এইরূপ অজানিত বিশাল বিভিন্ন দেশ ও জাতিগুলির সহিত যোগাযোগ স্থাপন ও গমনাগমনের জন্য প্রাচীনকালের পথ ও যানবাহনের অসুবিধা। সুতরাং তাহার সঙ্কল্পিত সংযুক্ত জগৎ গঠনের প্রাথমিক ধাপগুলি সম্পন্ন করিতেই স্বভাবতঃ এত দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল যে, বিশ্বাস ও শক্তির যে প্রথম আবেগ ঐ কার্যের সূত্রপাত করে, ইতিমধ্যে তাহার হয়তো বিলোপ ঘটিবে। সম্ভবতঃ এই সকল বিষয়ের আলোচনা করিয়াই আমরা যখন কাঠগুদাম পার হইয়া উপরে অবস্থিত গিরিবর্গে প্রবেশ করিলাম, তখন একদিন দীর্ঘকাল গভীর চিন্তার পরে সহসা উর্ধ্বে তাকাইয়া স্বামীজী বলিয়া উঠিলেন, “বৌদ্ধদের যে কল্পনা ছিল আধুনিক জগৎই কেবল তার উপযুক্ত হয়েছে। আমাদের পূর্বে আর কেহই ঐ কল্পনাকে প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ পায়নি।”
———-
(১) গ্রন্থমভ্যস্য মেধাবী জ্ঞানবিজ্ঞানতত্ত্বতঃ।
পলালমিব ধান্যার্থী ত্যজে গ্রন্থমশেষতঃ ॥—অমৃতবিন্দু উপনিষদ
শাস্ত্রানাধীত্য মেধাবী অভ্যস্য চ পুনঃ পুনঃ।
পরমং ব্ৰহ্ম বিজ্ঞায় উল্কাবৎ তান্যথোৎসুজেৎ ॥—অমৃতদোপনিষদ্
১৮. স্বামীজী বুদ্ধকে কি চক্ষে দেখিতেন
স্বামীজীর জীবনে বুদ্ধের প্রতি ভক্তিই ছিল সর্বপ্রধান বিচারমূলক অনুরাগ। সম্ভবতঃ ভারতের এই মহাপুরুষের জীবনের ঐতিহাসিক প্রামাণ্যই তাহাকে ঐ বিষয়ে আনন্দ প্রদান করিত। তিনি বলিতেন, “ধর্মাচার্যগণের মধ্যে কেবল বুদ্ধ ও মহম্মদ সম্পর্কেই আমরা প্রকৃত ইতিহাস জানি, কারণ সৌভাগ্যক্রমে তাহাদের শত্রু মিত্র দুই-ই ছিল।” তাহার আদর্শ পুরুষের (বুদ্ধের) চরিত্রে যে পূর্ণ বিচারবোধের পরিচয় পাওয়া যায় বার বার তিনি সে-প্রসঙ্গ উল্লেখ করিতেন। তাহার নিকট বুদ্ধ কেবল আর্যগণের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ নহেন, পরন্তু জগতে যত লোক জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সম্পূর্ণ স্থির-মস্তিষ্ক ছিলেন। তিনি কেমন পূজা গ্রহণে অস্বীকার করেন? কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে যে তাহাকে পূজা করা হইয়াছিল, সে বিষয়ে স্বামীজী কোন উচ্চবাচ্য করেন নাই। তিনি বলিতেন, “বুদ্ধ ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়, এক উচ্চ অবস্থা বিশেষ। এস, সকলেই ঐ অবস্থা লাভ কর। এই নাও তার চাবি!”