খ্রীস্টধর্মের বর্তমান কার্যাবলীর জন্য তাহাকে ক্ষমা করা কঠিন। হিন্দুধর্মের অপর প্রতিযোগী ধর্ম, অর্থাৎ মুসলমান ধর্ম কিন্তু সেরূপ নহে। ঐ ধর্মের নাম শ্রবণমাত্র আমাদের আচার্যদেবের মনে সর্বদাই এক আগ্রহপূর্ণ ভ্ৰাতৃভাবের চিত্র উদয় হইত–যে ধর্ম সাধারণ ব্যক্তিগণকে সর্ববিধ স্বাধীনতা প্রদানে এবং উচ্চপদস্থগণকে সর্বসাধারণের পর্যায়ে রাখিতে তৎপর। স্বামীজী মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হইতে পারিতেন না যে, মুসলমানগণ এদেশে অনধিকার প্রবেশ করিলেও বর্তমান ভারতের ক্রমোন্নতির মূলে যে সকল উপাদান বর্তমান, তাহাদের অন্যতম হইল, মুসলমান কর্তৃক প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও রাজ্যশাসন পদ্ধতি গ্রহণ। নীচবংশে যাহারা জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের কেবল উচ্চ সামাজিক অধিকারপ্রদানপূর্বক উন্নত করা নহে, পরন্তু এই অতি শান্তজাতির মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধভাবে আত্মরক্ষার জন্য উদ্যম এবং বাধাপ্রদানের প্রচেষ্টা এই উভয় আদর্শের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন দ্বারা তাহারা যে উপকার সাধন করিয়াছেন, তাহাও স্বামীজীর নিকট উপেক্ষণীয় ছিল না। তিনি সর্বদা দেখাইয়া দিতেন, মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ, পাঠান, মোগল ও শেখ—এই চারিটি শ্রেণী আছে, এবং ইহাদের মধ্যে ভারতের মাটি ও অতীত-স্মৃতিতে শেখদের উত্তরাধিকারস্বত্ব রহিয়াছে। ঐ স্বত্ব হিন্দুদের মতোই প্রাচীন এবং ঐ সম্পর্কে কোন বিতর্কের স্থান নাই। অবিবেচনাপূর্বক লিখিত একটি শব্দ প্রসঙ্গে তিনি জনৈক শিষ্যকে বলিয়াছিলেন, “সাজাহান নিজেকে ‘বিদেশী’ নামে অভিহিত হতে শুনলে কবরের ভিতর থেকে ফিরে দেখবেন, কে তাকে ঐ রকম বলছে।” সর্বোপরি, মাতৃভূমির কল্যাণকল্পে স্বামীজীর শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা ছিল—ভারত যেন ‘ইসলামীয় দেহ ও বৈদান্তিক হৃদয়’ এই দ্বিবিধ আদর্শকে প্রকাশ করিতে পারে।
এইরূপে, এই সকল ঘটনার রাজনীতিক গুরুত্বের সহিত তাহার কোন সম্পর্ক না থাকিলেও সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল তাহার নিকট এক, অখণ্ড এবং গভীরভাবে তলাইয়া দেখিলে উপলব্ধি হইবে যে, ঐ একতা মনের দিক দিয়া নহে, ঐ একতা হৃদয়ের। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন, জগতে তাহার কার্য তাঁহার গুরুদেবের বার্তা আচণ্ডালে বিতরণ করা। কিন্তু তাহার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও আকাঙক্ষা স্বদেশের কল্যাণসাধনের অদম্য কামনার সহিত বিশেষভাবে জড়িত ছিল। তিনি নিজে কখনও নিছক জাতীয়তা প্রচার করেন নাই; কিন্তু তিনি স্বয়ং ছিলেন জাতীয়তাশব্দে যাহা বুঝায়, তাহার জীবন্ত প্রতিমূর্তিস্বরূপ। ভারতের জাতীয় আদর্শ যে পরস্পরের মধ্যে প্রগাঢ় প্রীতি, আমাদের গুরুদেব নিজের জীবনেই তাহা প্রদর্শন করিয়া গিয়াছেন।
মনে রাখিতে হইবে, ভারতের অতীতের কেবল পুনরুজ্জীবন অথবা পুনঃসংস্থাপন স্বামীজীর একেবারেই অভিপ্রেত ছিল না। যাহারা ঐরূপকরিতে প্রয়াস পাইতেন, তাহাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলিতেন, “মিশর দেশের পুরাতত্ত্ব আলোচনায় রত ব্যক্তিগণের যেমন ঐ দেশের প্রতি একটা স্বার্থজড়িত অনুবাগ থাকে, তেমনি ভারতের প্রতি এদের অনুরাগও সম্পূর্ণ স্বার্থজড়িত।এঁদের পড়া বইগুলিতে, চর্চায় এবং কল্পনারাজ্যে যে ভারতের চিত্র মনের মধ্যে রয়েছে, সেই অতীত যুগের ভারতকেই আবার দেখবার জন্য এরা লালায়িত।” তিনি নিজে চাহিতেন, ভারতের প্রাচীন শক্তির নূতন প্রয়োগ, এই নূতন যুগে তাহার কল্পনাতীত বিকাশ। তিনি ‘ডাইনামিক রিলিজন অর্থাৎ প্রচণ্ড শক্তিশালী এক ধর্ম দেখিবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করিতেন। ধর্মের মধ্যে যতপ্রকার নীচতা, অধঃপতিত অবস্থা, এবং উন্নতির পরিপন্থী অংশ বিদ্যমান, কেবল সেগুলিকেই বাছিয়া লইয়া লোকে তাহাদের প্রাচীনপন্থী বা ‘গোড়া’ আখ্যায় অভিহিত করিবে কেন? প্রাচীনপন্থী’ শব্দ এত মহান, এত শক্তিশালী, প্রাণপ্রদ যে কিছুতেই উহার ঐভাবে প্রয়োগ চলে না। যে পরিবারে সকল পুরুষই পাণ্ডব বীরগণের তুল্য, সকল নারীই সীতার ন্যায় মহীয়সী, বা সাবিত্রীর ন্যায় নির্ভীক, সেই পরিবার সম্পর্কেই কেবল ঐ শব্দের যথার্থ প্রয়োগ হইতে পারে। রক্ষণশীল অথবা সংস্কারমূলক সকলপ্রকার বিশেষ সমস্যা হইতেই তিনি দূরে অবস্থান করিতেন। তাহার কারণ ইহা নহে যে, একদল অপেক্ষা অন্যদলের প্রতি তিনি অধিকতর সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন; প্রকৃত কারণ, তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইতেন যে, উভয়ের পক্ষেই প্রকৃত প্রশ্ন হইল আদর্শটিকে ঠিক ঠিক ধরিতে পারা, এবং ভারতের সহিত উহার একাত্মতা সাধন। নারীজাতি ও নিম্নশ্রেণীর ব্যক্তিগণ—এই উভয়ের জন্য তাহার অভিমত ছিল যে, তাহাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য সমাজের বর্তমান ব্যবস্থাগুলির পরিবর্তনসাধন নহে, পরন্তু তাহাদের জন্য শিক্ষার দ্বারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করা, যাহাতে তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করিয়া লইতে পারে।
অজ্ঞতার প্রতি তাহার যেমন বিদ্বেষ ছিল, জগতে অলৌকিক রহস্য নামে পরিচিত বস্তুর সহিত ভারতের অভিন্নতাবোধও তাহার নিকট ছিল তেমনই উৎকট ভীতিস্বরূপ। এ বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিগণের যে স্বাভাবিক ঔৎসুক্য ও কৌতূহল, তাহা তাঁহারও ছিল, এবং জলের উপর দিয়া হাঁটিয়া যাওয়া, আগুনে হাত দেওয়া প্রভৃতি শুনিলে উহা পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য অসুবিধা স্বীকার করিতেও তিনি সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু আমরা সকলেই অবগত আছি যে, বিশেষ অনুসন্ধান করিলে এইসকল ব্যাপার শেষে প্রায়ই অত্যন্ত অবিশ্বাস্য শোনা কথায় পর্যবসিত হয়। যাহা হউক, এইরূপ কোন ক্ষেত্রে ঐ-সকল ঘটনা কেবল ইহাই নির্দেশ করে যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গোচর বস্তুগুলির বর্তমান শ্রেণীবিভাগ অসম্পূর্ণ, এবং উহার সংশোধন অবশ্যই করা উচিত, যাহাতে সচরাচর দৃষ্টিতে পড়ে না, অথচ সম্ভবপর, এরূপ ব্যাপারগুলি উহার অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে। উহারা আমাদের এই সরল উপদেশটুকু দেয়, ইহা ব্যতীত উহাদের আর কোন তাৎপর্য তাহার নিকট ছিল না। তাঁহার নিকট ঐ-সকল ঘটনা কোনক্রমেই অলৌকিক বলিয়া বিবেচিত হইত না। ঐরূপ অতিপ্রাকৃত কার্যের জন্য ভগবান বুদ্ধ কোন ভিক্ষুর সন্ন্যাসের পরিচ্ছদ কাড়িয়া লইয়াছিলেন এবং এই গল্পটি তাহার নিকট বুদ্ধজীবনের অপরাপর ঘটনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মর্মস্পর্শী বোধ হইত। খ্রীস্টান বাইবেলে যে মহাপুরুষের লীলাসমূহ বর্ণিত হইয়াছে, তাহার সম্বন্ধে তিনি বলিতেন, কতকগুলি অদ্ভুত কর্মের দ্বারা লোকের বিশ্বাস উৎপাদনের চেষ্টা না করিলে, ঐ চরিত্র তাহার নিকট অধিকতর সর্বাঙ্গসুন্দর বলিয়া বোধ হইত। এই বিষয়ে পরবর্তী কালে স্বামী সদানন্দ আমাকে যাহা দেখাইয়া দেন, সম্ভবতঃ তাহাই সত্য—অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিমে এশিয়ার মধ্যে বৌদ্ধিক পার্থক্যের ন্যায় একটা মানসিক ধাতুগত পার্থক্যও আছে। পশ্চিম এশিয়া চিরকাল শক্তি অথবা সিদ্ধাই-এর একটা নিদর্শন চায়, কিন্তু পূর্ব এশিয়া উহা বরাবর ঘৃণা করে। স্বামী সদানন্দের মতে, এই বিষয়ে মোঙ্গলীয় ও সেমিটিকদিগের ধারণা বিশেষরূপে পরস্পরবিরোধী; আর আর্যগণ এই উভয়ের মধ্যস্থলে অবস্থান করিয়া উহার ঔচিত্য সম্পর্কে বিচার করিয়া থাকেন। যাহা হউক, আমাদের অনেকেই স্বীকার করিবেন যে, তথাকথিত অলৌকিক ব্যাপারে আধুনিক কালের আগ্রহই অনেক পরিমাণে এই অনিষ্টকর ধারণার সৃষ্টি করিয়াছে যে, প্রাচ্য মানব এক দুর্বোধ্য প্রকৃতির জীব, মানবজাতির সাধারণ ইচ্ছা অনিচ্ছার সহিত তার যেন কোন সম্পর্ক নাই এবং তাহাদের শরীর যেন অলৌকিক শক্তির গুপ্ত বৈদ্যুতিক আধার। স্বামীজীর নিকট এ-সকল ছিল ঘৃণার বস্তু। তাঁহার আকাঙক্ষা ছিল, সকলে বুঝুক যেভারতবর্ষ মানুষের দ্বারাই অধুষিত; ভারতবাসীদের চরিত্র প্রকৃতই গভীরভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ; এবং তাহাদের সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র-সূচক, কিন্তু সকল মানুষের ন্যায় তাহারাও সর্বতোভাবেই মানুষ, এবং সাধারণ মানুষের ন্যায় সকল কর্তব্য, অধিকার বোধ ও সুখদুঃখ তাহাদেরও আছে।