১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ভারতে প্রত্যাবর্তনের পরেই, স্বামীজী তাঁহার স্বদেশবাসীর চিন্তাধাবায় তাহার দান দার্শনিক আকারে প্রদান কবেন। ভাবতের সকল যুগপ্রবর্তকেরই উহা দিবার প্রয়োজন হয়, একথা পূর্বেই অন্যত্র বলা হইয়াছে। এতদিন ধরিয়া অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, এই তিনটি দর্শন জীবাত্মার মুক্তির তিনটি বিভিন্ন আদর্শ প্রদর্শন করিতেছে, এইরূপ বিবেচনা করা হইত। এই বিভিন্ন মতবাদের পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় স্থাপনের কোন চেষ্টা ইতিপূর্বে হয় নাই। কিন্তু ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে মাদ্রাজে উপনীত হইয়া স্বামী বিবেকানন্দ সাহসপূর্বক ঘোষণা করেন যে, দ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের চরম অনুভূতিও অদ্বৈতবাদেরই নিম্নতর বিভিন্ন অবস্থামাত্র, এবং সকলের পক্ষেই চরম আনন্দ সেই একমেবাদ্বিতীয় তত্ত্বে বিলীন হইয়া যাওয়া। শোনা যায়, তাহার কোন এক মধ্যাহ্নকালীন প্রশ্নোত্তর-ক্লাসে জনৈক শ্রোতা জিজ্ঞাসা করেন, ইহা সত্য হইলে, পূর্ববর্তী আচার্যগণের কেহ এ বিষয়ে কখনও উল্লেখ করেন নাই কেন? উপস্থিত পণ্ডিতগণের মধ্যে যাহারা ইংরেজী জানিতেন না, তাহাদের সুবিধার জন্য ক্লাসে নিয়ম ছিল, ঐ সকল প্রশ্নের উওর প্রথমে ইংরেজীতে এবং পরে সংস্কৃতে দেওয়া হইবে। বর্তমান ক্ষেত্রে সেই বৃহৎ সভায় উপস্থিত সকলেই তাহার উত্তর শুনিয়া চমকিত হইলেন, “যেহেতু ঐজন্যই আমার জন্ম, এবং ঐ কাজ আমারই জন্য নির্দিষ্ট ছিল।”
ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের অসংখ্য শাখা-প্রশাখার কোন একটিকেও তাহার গণ্ডির বাহিরে রাখিবার কোনপ্রকার চেষ্টা স্বামীজী আদৌ সহ্য করিতে পারিতেন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে, ব্রাহ্ম অথবা আর্যসমাজভুক্ত হওয়ার জন্য কোন ব্যক্তি তাহার নিকট অহিন্দু বলিয়া গণ্য হইতেন না। তাহার মতে শিখদের বিখ্যাত খালসা সৈন্যদলের ন্যায় অতি সুন্দর, সুগঠিত সঙঘ হিন্দুধর্মেরই সৃষ্টি, এবং উহা হিন্দুধর্মেরই অপূর্ব বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। গুরুগোবিন্দ সিংহ ধর্মের জন্য তাহার শিষ্যদের প্রাণ উৎসর্গের যে আহ্বান করিতেন—সেই দৃশ্যটি তিনি কী আবেগের সহিত বারংবার আমাদের নিকট অঙ্কিত করিতেন! তাহার মতে, হিন্দু ধর্মের তিনটি পৃথক স্তরের অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন। তাহার মধ্যে প্রথম হইল—প্রাচীম, ঐতিহাসিক ধর্ম যাহা শাস্ত্রানুবর্তী। দ্বিতীয় মুসলমান রাজত্বকালে ধর্মসংস্কারকগণ কর্তৃক প্রবর্তিত সম্প্রদায়সমূহ। তৃতীয় বর্তমানকালের সংস্কারপ্রয়াসী বিভিন্ন সম্প্রদায়। কিন্তু সকল সম্প্রদায়ই সমভাবে হিন্দুধর্মভুক্ত। স্বদেশ ও নিজের ধর্মের সমস্যাগুলি বিস্তৃতভাবে অনুধাবন করিবার জন্য তাহার ঐকান্তিক আগ্রহ যে যৌবনে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য থাকাকালে প্রথম পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়, একথা তিনি কদাপি বিস্মৃত হন নাই। ঐ সদস্যপদের কথা অস্বীকার করা দূরে থাকুক, বরং একদিন আগ্রহের সহিত তিনি বলিয়া ওঠেন,”তারাই বলুন, আমি তাদেরই একজন কিনা! আমার নাম যদি তারা কেটে না দিয়ে থাকেন, তাহলে তা এখনো তাদের খাতায় আছে!” এইরূপে, কোন ব্যক্তি নিজেকে আর্য, ব্রাহ্ম বা সনাতনপন্থী-ইত্যাদি যে বিশেষণেই অভিহিত করুক, স্বামীজীর মতে সে প্রকৃতপক্ষে হিন্দুই। জৈনদের হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি তো অতি সহজেই সামাজিক আচার-ব্যবহার ও ইতিহাসের সাহায্যে প্রমাণ করা যায়। পশ্চিম ভারতের জৈনরা আজ পর্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিবেন, যদি তাহারা যথার্থ হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত কিনা এ বিষয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। এখনও পর্যন্ত তাহারা বিবাহকালে সমান শ্রেণীর হিন্দুদের নিকট কন্যা আদান-প্রদান করিয়া থাকেন, এবং আজ পর্যন্ত তাহাদের মন্দিরে সময়ে সময়ে পৌরোহিত্য করেন সাধারণ ব্রাহ্মণগণ। সকল ধর্মের মধ্যেই স্বামীজীর শিষ্য ছিল—এমনকি, মুসলমানদের মধ্যেও, এবং তাহার কয়েকজন জৈন বন্ধুর সহায়তায় তিনি এমন কতকগুলি জৈন ধর্মগ্রন্থ পড়িতে পারিয়াছিলেন, যাহা অপর সম্প্রদায়ের লোকেদের সাধারণতঃ দেওয়া হয় না। এই অধ্যয়নের ফলে জৈনদের ধর্মমত ও বংশপরম্পরা ভাবধারার প্রাধান্য সম্পর্কে এবং হিন্দুধর্মের ক্রমবিকাশলাভে জৈনধর্মের বিশেষ অবদান সম্পর্কে স্বামীজী গভীরভাবে প্রভাবিত হন। হিন্দুধর্মের প্রবল আদর্শগুলির অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য হইল, মূক পশুগণের ভিতরেও সেই বিভু বর্তমান বলিয়া তাহাদের প্রতি সদয় ব্যবহার, এবং সাধুজীবনে ত্যাগ-তপস্যার আদর্শের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। এই দুই বৈশিষ্ট্য জৈনগণ কর্তৃক পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত ও বিশেষভাবে প্রচারিত হইয়াছে। আবার জীবাণুঘটিত তত্ত্ব সম্পর্কে তাহাদের সুস্পষ্ট অভিমত হইতে এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাগণের বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়—বিশেষতঃ উহা আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণার পরীক্ষা-নিরীক্ষাদ্বারা সমর্থিত। স্বামীজী বলিতেন, “জৈনরা যে বলে থাকেন, তাদের মতগুলি প্রথমে ঋষিদের দ্বারা প্রচারিত হয়েছিল—এ অতি সত্য, এবং সহজেই বোঝা যায়।”
বর্তমানে ভারতের যে-সব জাতি খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের সম্পর্কে স্বামীজী আশা করিতেন, রাজনীতিক্ষেত্রে প্রভুত্বপ্রাপ্ত জাতির ধর্মগ্রহণ করিয়া তাহারা সামাজিক পদমর্যাদায় উন্নীত হইবে, এবং ভাবী যুগে লোকে খ্রীস্টধর্ম বিস্মৃত হইয়া গেলেও তাহারা ঐ উন্নতি বজায় রাখিতে সমর্থ হইবে। এইরূপে, আমরা আশা করিতে পারি যে, ভবিষ্যতে ঊনবিংশ শতাব্দীকে বিভেদসৃষ্টিকর শক্তি বলিয়া লোকে আর মনে রাখিবে না, এবং এই শতাব্দী তখন ভারতের সকল বিষয়ে স্থায়ী উন্নতিরূপ সুফল প্রসব করিবে। এইরূপ উন্নতির সম্ভাবনার দৃষ্টান্তস্বরূপ উত্তরভারতে চৈতন্যদেবের কার্যের উল্লেখ করা যাইতে পারে। তিনি কি তাহার অনুবর্তীদের একটি বিলক্ষণ খ্যাতি-প্রতিপত্তিশালী সমাজে পরিণত করিয়া যাইতে সমর্থ হন নাই?