স্বামীজী নিজে মনে করিতেন, এইকালে মায়াসম্বন্ধীয় বক্তৃতাগুলির মধ্যেইতাহার বুদ্ধিবৃত্তির সর্বাপেক্ষা বিকাশ ঘটিয়াছে। মনোযোগ সহকারে ঐগুলি পাঠ করিলেই ধারণা করিতে পারা যায় যে, আধুনিক ইংরেজী ভাষায় ঐসকল ভাবকে প্রকাশ করিতে গিয়া তিনি কি দুরূহ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। ঐ অধ্যায়গুলি আগাগোড়া পাঠ করিলে আমাদের মনে হয়, সুস্পষ্টভাবে অনুভূত একটি ভাবকে প্রকাশের অনুপযোগী এক ভাষায় প্রকাশ করিবার জন্য একটা প্রাণপণ চেষ্টা চলিতেছে। স্বামীজী বলেন, “মায়া’ শব্দটি ভুল করিয়া মিথ্যাজ্ঞান (delusion) অর্থে বুঝা হয়। সর্বপ্রথম উহা দ্বারা ইন্দ্রজালের (magic) মতো একটা কিছু বুঝাইত, যেমন “ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে”—ইন্দ্র (ঈশ্বর) মায়ায় নানা রূপ ধারণ করিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে এই অর্থ লোপ পায়, এবং শব্দটির এক এক করিয়া বহু অর্থান্তর ঘটে। কিরূপে এই বিভিন্ন অর্থের মধ্য হইতে একটি অর্থ চিরকালের জন্য নির্দিষ্ট হইয়া গেল, তাহার নিদর্শন নিম্নোক্ত বাক্যে পাওয়া যায়—”নীহারেণ প্রাবৃতা জল্প্যা অসুতৃপ উকথাশাসশ্চরন্তি।”—অর্থাৎ, যেহেতু আমরা বৃথা বাক্যালাপ করিয়া থাকি, ইন্দ্রিয়ের বিষয় লইয়াই সন্তুষ্ট থাকি এবং বাসনারই অনুবর্তন করি—সেই হেতু সত্য বস্তুকে যেন কুয়াসার দ্বারা আচ্ছাদিত করি। অবশেষে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্ হইতে উদ্ধৃত শ্লোকেই দেখা যায়, শব্দটি উহার সর্বশেষ অর্থ পরিগ্রহ করিয়াছে—”মায়ান্তু প্রকৃতিং বিদ্যায়িনন্তু মহেশ্বরম্”, অর্থাৎ মায়াকে প্রকৃতি বলিয়া জানিবে, আর যিনি মায়াধীশ, তাঁহাকেই মহেশ্বর বলিয়া জানিবে। স্বামীজী বলেন, বেদান্তে ‘মায়া’ শব্দ সর্বশেষ যে পরিণতি লাভ করিয়াছে তাহার অর্থ—যাহা ঘটিতেছে তাহার উল্লেখমাত্র প্রকৃতপক্ষে আমরা যাহা এবং আমাদের চতুর্দিকে যাহা দেখিয়া থাকি, তাহারই উল্লেখ।
কিন্তু এই কথাগুলি যে সংজ্ঞানির্দেশ হিসাবে ব্যবহৃত হয় নাই, তাহা যে কেহ তাহার মায়া-সম্বন্ধীয় বক্তৃতাবলী পাঠ করিয়াছেন, তিনিই বুঝিতে পারিবেন। মায়া শব্দে যে কেবল ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জগৎকে যেরূপে জানা যায়, তাহাই নির্দেশ করে না, পরন্তু ঐ জ্ঞান যে কুটিল-পথগামী, ভ্রমপূর্ণ ও স্ববিরোধী, তাহা স্পষ্টতঃ বুঝা যায়। স্বামীজী বলেন, “এই জগৎ যে ‘ধোঁকার টাটি’, ইহাতে যে সুখের লেশমাত্র নাই, কেবল পরিশ্রমই সার, আমরা যে ইহার সম্বন্ধে কিছুই জানি না, অথচ জানি না, ইহা বলিতে পারি না—ইহা কোন মতবাদ নহে, পরন্তু প্রকৃত ঘটনাসমূহের উল্লেখমাত্র। স্বপ্নের মধ্যে অর্ধনিদ্রিত, অধজাগরিত অবস্থায় সঞ্চরণ, সমগ্র জীবন এক অস্পষ্ট কুহেলিকার মধ্যে যাপন—ইহাই প্রত্যেকের অদৃষ্ট। সমগ্র ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানেরই এই পরিণতি। আর ইহারই নাম জগৎ।” তাঁহার ব্যাখ্যার অন্যান্য অংশের ন্যায় এখানেও আমরা দেখিতে পাই যে, ভারতীয় শব্দবিশেষকে সঠিকভাবে ইংরেজীতে অনুবাদ করা যায় না; এবং উহা বোধগম্য করিবার একমাত্র উপায় হইল—এখানে সেখানে এক-আধটি বাক্যের উপর সমগ্র মনোযোগ না দিয়া, বক্তা যে ভাবটি প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছেন, তাহা ধরিবার চেষ্টা করা। সুতরাং মায়া অর্থে সেই চকিতের ন্যায় প্রকাশমান, এই আছে, এই নাই, অর্ধ সত্য, অর্ধ মিথ্যা, জটিল কোন কিছু, যাহাতে বিশ্রাম নাই, তৃপ্তিও নাই, কোন চরম নিশ্চয়তা নাই, যাহা আমরা ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয় নির্ভরশীল মনের সাহায্যেই জানিতে পারি। অথচ “আর এই সকলের মধ্যে যিনি ওতপ্রোত রহিয়াছেন, তাঁহাকেই মহেশ্বর বলিয়া জানিও” —’মায়িনন্তু মহেশ্বর। পাশ্চাত্যে স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক সমগ্র হিন্দুধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা পাশাপাশি অবস্থিত এই দুইটি ভাবের মধ্যেই বিদ্যমান। অন্যান্য উপদেশ ও ভাবগুলি ইহাদের অনুবর্তী মাত্র। ধর্ম হইল ব্যক্তির ক্রমবিকাশের ব্যাপার “ক্রমাগত সত্তা ও পরিণাম (being and becoming) থাকা ও হওয়া।” কিন্তু এই ক্রমবিকাশের মূলে ঐ দুটি মুখ্য ঘটনা থাকা চাই, এবং ভরকেন্দ্রটি যেন একটি হইতে অপরটিতে—মায়া হইতে আত্মায় ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত হয়। প্রাচ্যমতে মায়াতে তন্ময় হইয়া থাকার নামই ‘বন্ধন’। আর এই বন্ধন ভাঙিয়া ফেলার নামই ‘মুক্তি’; এমনকি, উহাকে ‘নির্বাণ’ পর্যন্ত বলা হয়। এই বন্ধন যিনি ভাঙিয়া ফেলিতে চাহেন,তাহাকে সর্বদা ত্যাগের পথ অন্বেষণ করিতে হইবে—ভোগের অন্বেষণ করিলে চলিবে না। স্বামীজী বলেন, এই বিষয়ে তিনি সকল ধর্মের যাহা মূলম, তাহারই প্রতিধ্বনি করিতেছেন মাত্র। কারণ, ভারতীয় ও অন্যান্য সকল ধর্মই সুখের অন্বেষণ করিতে করিতে অবশেষে কোন এক স্থলে আর নয়’ বলিয়া নিবৃত্ত হইয়াছেন। সকল ধর্মই সংসাবকে নাচঘরে পরিণত না করিয়া সংগ্রামক্ষেত্রে পরিণত করিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। সকল ধর্মই মানবকে জীবন অপেক্ষা মৃত্যুর সম্মুখীন হইবার জন্য শক্তি দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। আমার মতে অন্যান্য আচার্যগণ হইতে স্বামীজীর পার্থক্য বোধ হয় এইখানে যে, তিনি সকল প্রকার প্রভুত্বকে ত্যাগের কোন না কোন রূপান্তর বলিয়া জ্ঞান করিতেন। তাহার জীবনের শেষপ্রান্তে আমি একদিন বলি যে, তাহার মুখ হইতে আমি শুধু ত্যাগ’ শব্দই শুনিয়াছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমার মনে হয় ‘জয় কর কথাটিই তাহার প্রকৃতির অধিকতর অনুগামী ছিল। কারণ, দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি স্টিফেনসনেব উল্লেখ করিয়া বলেন, ত্যাগের দ্বারাই তিনি বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারে সমর্থ হন—অর্থাৎ তাহার ঐ আবিষ্কারের পিছনে ছিল বহুদিনব্যাপি ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্জনে কঠিন সমস্যার সমাধানে তন্ময় হইয়া থাকা এবং সর্বপ্রকার দেহসুখ পরিহারপূর্বক ক্লেশ বরণ করিয়া লওয়া। তিনি দেখাইয়া দেন যে,প্রার্থনা বা চিন্তা দ্বারা রোগ আরাম করিবার জন্য চিত্তের যতটা একাগ্রতার প্রয়োজন, আরোগ্য-সম্পাদনের জন্য ভেষজ-বিজ্ঞানও মানবমনের ততটা একাগ্রতারই পরিচয় দেয়। তিনি আমাদের প্রাণে প্রাণে অনুভব করাইয়া দেন যে, অধ্যয়ন মাত্রেই বিশেষ কোন জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত তপস্যা। সর্বোপরি, তিনি প্রচার করেন যে, ধর্মর্ভাবের বন্যাকে স্থায়ী করিবার শক্তি একমাত্র চরিত্রেই বর্তমান। তাহার মতে অন্যায়ের প্রতিরোধ করা গৃহীর ধর্ম, আর সাধুর ধর্ম হইল অপ্রতিকার। কারণ সকলের পক্ষেই সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হইল শক্তিলাভ। তিনি বলেন, “যখন তুমি অসংখ্য দেবসেনাকেও সহজে জয়লাভ করতে পারবে, তখনই ক্ষমা করো।” কিন্তু জয় সম্বন্ধে যতক্ষণ সন্দেহ আছে, ততক্ষণ তাহার মতে কেবল কাপুরুষ ব্যক্তিই একগালে চড় খাইয়া অপর গাল ফিরাইয়া দিবে।