সুতরাং সেই শীতকালে স্বামীজী ইংলণ্ড পরিত্যাগ করিয়া আমেরিকায় গমন করিবার পর, আমি তাহার সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় স্মরণ করিয়া গভীরভাবে চিন্তা করিতাম। প্রথমতঃ তাহার উদার ধর্মবিষয়ক-শিক্ষা; দ্বিতীয়তঃ তাহার ভাবগুলির মধ্যে যে যুক্তিবিচার ছিল, তাহার অপূর্ব নূতনত্ব ও গাম্ভীর্য; তৃতীয়তঃ তাহার আহ্বান ছিল মানব-প্রকৃতির মধ্যে যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা সুন্দর তাহার প্রতি এবং কোন ক্রমেই তাহার নিকৃষ্ট ভাবগুলির প্রতি নহে।
————-
১ এই বিখ্যাত চিত্রখানির মধ্যস্থলে শিশু ঈশা ও তাহার জননী মেরীর জ্যোতির্মণ্ডিত মূর্তি, বামে সেন্ট সেন্টাসের, দক্ষিণে সেন্ট বাববাবার, এবং নিম্নে দুইটি দেব শিশুর মূর্তি অঙ্কিত আছে। বর্তমানে চিত্রটি ড্রেসডেনে।
২ পোপ প্রথম গ্রেগরি-ইনি খ্রীস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রাদুর্ভূত হন।
৩ ঈশতন্ত্র শাসন (Theocracy)—যে রাজ্য সাক্ষাৎ ঈশ্বব বা তৎপ্রতিনিধি যাজকগণ কর্তৃক পরিচালিত হয়। এ মতে রাজ্যের আইনগুলি মানব কর্তৃক প্রণীত নহে, পরন্তু সাক্ষাৎ ঈশ্ববাদেশ।
৪ John Frederich Danison Maurice (১৮০৫-১৮৭২) বিখ্যাত ইংরেজ ধর্মতত্ত্বব্যাখ্যা অধ্যাপক ও গ্রন্থকার। নিজ প্ৰখরবুদ্ধি, চবিএল ও নিযাতিতগণের প্রতি প্রগাঢ় সহানুভূতিবশতঃ ইনি লণ্ডনের সামাজিক জীবনে ও পণ্ডিতমহলে বিশে প্রভাব বিস্তাব করিয়াছিলেন–অনুঃ
০২. লণ্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ–১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে
পর বৎসর এপ্রিল মাসে স্বামীজী লণ্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেন্ট জর্জেস রোডের যে বাড়িতে তিনি তাহার সদাশয় বন্ধু মিঃ ই. টি. স্টার্ডির সহিত বাস করেন, সেখানে ও গ্রীষ্মকাশের পর পুনরায় ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটের নিকট এক বৃহৎ ক্লাসরুমে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা দেন। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তাহার বন্ধু মিঃ ও মিসেস সেভিয়ার ও মিস এইচ. এফ. মূলারের সহিত ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজর্লণ্ড ভ্রমণ করেন। ডিসেম্বর মাসে কয়েকজন শিষ্যসহ রোম হইয়া তিনি ভারত যাত্রা করেন এবং ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারী সিংহলের অন্তর্গত কলম্বো শহরে উপনীত হন।
১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে প্রদত্ত বক্তৃতাবলীর অধিকাংশ পরে প্রকাশিত হইয়াছে। ঐ বক্তৃতাগুলি পাঠ করিয়া সকলে অবগত হইতে পারেন, জগৎকে তাহার কি দিবার ছিল এবং কিরূপে উহা তিনি ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন, যাহাতে সকলের বোধগম্য হয়। ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজ করেন—হিন্দুগণের এই যে বিশ্বাস, তাহারই প্রচারকরূপে স্বামীজী আমাদের দেশে আসিয়াছিলেন, এবং তাহার প্রচারিত ধর্মের (gospel) সত্যতা নির্ণয়ের জন্য তিনি সকলকে উহা পরীক্ষা করিয়া লইতে আহ্বান করেন। তখনই বা কি, আর পরেই বা কি, আমি তাহাকে কখনও শ্রোতৃবর্গের নিকট কোন বিশেষ ধর্মমতের পক্ষ সমর্থন করিতে শুনি নাই। বক্তব্য বিষয় উদাহরণ দ্বারা বুঝাইতে গিয়া তিনি অসঙ্কোচে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের (sects) উল্লেখ করিতেন—উহাদিগকে সম্প্রদায়’ না বলিয়া বিভিন্ন ধর্মমত (churches) বলিলেই ভাল হয়। কিন্তু ভারতীয় চিন্তাপ্রণালীতে যে দর্শন সমুদয় ধর্মমতের ভিত্তিস্বরূপ, তাহা ব্যতীত তিনি অপর কিছু কদাপি প্রচার করেন নাই। বেদ, উপনিষদ্ ও ভগবদ্গীতা ব্যতীত অপর কোন গ্রন্থ হইতে কখনও কোন অংশ উদ্ধৃত করেন নাই। জনসমক্ষে তিনি কখনও তাহার গুরুদেবের উল্লেখ করেন নাই, অথবা হিন্দু পৌরাণিক আখ্যানসমূহের অংশবিশেষ সম্বন্ধে কোন সুস্পষ্ট মতামতও প্রকাশ করেন নাই।
তিনি গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করেন যে, যাহাতে পাশ্চাত্য ধর্মচেতনা আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারসমূহ সাদরে গ্রহণ ও আত্মসাৎ করিতে পারে, এবং সমগ্র জগৎ একসূত্রে আবদ্ধ হইলে তাহার অবশ্যম্ভাবী পরিণামস্বরূপ স্থানীয় পৌরাণিক আখ্যানসমূহের অবলুপ্তির পরেও টিকিয়া থাকিতে পারে, সেজন্য ভারতীয় চিন্তার প্রয়োজনীয়তা আছে। তিনি বুঝিয়াছিলেন, ধর্মমতকে (faith) এমন রূপ দিতে হইবে যাহাতে উহার অনুগামিগণ কিছুতেই সত্যকে ভয় করিবে না! এক বক্তৃতায় তিনি আবেগভরে বলেন, “বিচারমূলক ধর্মের উপরেই ইউরোপের মুক্তি নির্ভর করিতেছে।” আবার বহুবার তিনি বলিয়াছেন, “জড়বাদী ঠিকই বলেন, জগতে মাত্র একটি বস্তুই বিদ্যমান। কেবল সেই অদ্বিতীয় বস্তুকে তিনি জড় বলিতেছেন, আর আমি উহাকেই ঈশ্বর বলি।” আর একস্থলে তিনি বিস্তৃতভাবে ধর্মভাবের বিকাশ ও উহার বিভিন্ন রূপের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “প্রথমে লক্ষ্যবস্তু বহুদূরে, জড়প্রকৃতির বাহিরে, এবং উহা হইতে বহুদূরে অবস্থিত থাকিয়া আমাদের উহার প্রতি আকৃষ্ট করে। লক্ষ্যবস্তুকে ক্রমশঃ নিকটে আনিতে হয়, কিন্তু হীন বা নিকৃষ্ট করিয়া নহে। নিকটতর হইতে হইতে অবশেষে সেই স্বর্গস্থ ঈশ্বর জড়প্রকৃতির ঈশ্বররূপে পরিণত হন; জড়প্রকৃতির মধ্যগত ঈশ্বরই আবার এই প্রকৃতিরূপী ঈশ্বর হইয়া দাঁড়ান; ক্রমে যে ঈশ্বর এই প্রকৃতিরূপী, তিনিই এই দেহমন্দিরের অধিষ্ঠাতা ঈশ্বর হন; তারপর এই দেহমন্দিরই তিনি এবং সর্বশেষে তিনিই মানবাত্মা, এইরূপ হইয়া যায়। এইরূপে জ্ঞান চরমসীমায় উপস্থিত হয়। ঋষিগণ যাহাকে এই সকল স্থানে অন্বেষণ করিয়াছেন, সেই আত্মা আমাদের হৃদয়েই অবস্থিত। ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই সেই, হে মানব, তুমিই সেই।