গ্রন্থের প্রারম্ভেই সকল কথা স্পষ্টভাবে বলা কঠিন। স্বামীজীর ইংলণ্ড পরিত্যাগের পূর্বেই এমন দিন আসিয়াছিল, যখন আমি তাহাকে ‘গুরুদেব’ (Master) বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলাম। তিনি যে বীরোচিত উপাদানে গঠিত ছিলেন তাহা আমি হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলাম, এবং তাহার স্বজাতিপ্রেমের নিকট আমি সম্পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু আমার এই আনুগত্য স্বীকার শুধু তাঁহার চরিত্রের নিকটেই। আমি দেখিতে পাইলাম যে, ধর্মোপদেষ্টারূপে জগৎকে দিবার জন্য তাহার একটি স্বতন্ত্র মতবাদ আছে বটে, কিন্তু যদি তিনি অন্য কোথাও সত্যের প্রকাশ দেখেন, তাহা হইলে মুহূর্তের জন্যও তিনি ঐ মতবাদের কোন অংশ সমর্থন করিবেন না। আর এই বিষয়টি যতদূর বুঝিতে পারিয়াছিলাম, ততদূর পর্যন্তই আমি তাঁহার শিষ্য হইয়াছিলাম। বাকি যাহা কিছু, তাহার জন্য আমি তাহার উপদেশাবলী বিশেষরূপে আলোচনা করিয়া বুঝিয়াছিলাম, তাহার প্রচারিত তত্ত্বের মধ্যে কোন অসংলগ্ন ভাব নাই; কিন্তু হাতে-কলমে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাহার প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি আমি চরম সত্য বলিয়া গ্রহণ করি নাই। আর যদিও তাঁহার চরিত্র মাহাত্ম্য আমি অতীব আকৃষ্ট হইয়াছিলাম, তথাপি আমার পরিচিত যে কোন চিন্তাশীল বা প্রতিভাবান ব্যক্তির এবং তাহার মধ্যে চরিত্রবিকাশের দিক দিয়া যে বিপুল পার্থক্য আমি পরে দেখিবার সৌভাগ্যলাভ করি, ঐ সময়ে তাহা স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারি নাই।
ক্লাসের অপর সকলে আমার এই সন্দেহের ভাব বিশেষরূপে অবগত ছিলেন, এবং অপেক্ষাকৃত ভাগ্যবান এক শিষ্য বহু পরে স্বামীজীর সমক্ষে এই বিষয় লইয়া আমাকে পরিহাস করিয়া বলিতেছিলেন যে, তিনি কিন্তু বরাবরই স্বামীজীর মুখে শোনা প্রত্যেকটি কথা মানিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছেন। স্বামীজী সে সময়ে এই কথাবার্তায় কোন মনোযোগ দেন নাই বলিলেই হয়, কিন্তু পরে এক সুযোগে আমাকে একান্তে বলিয়াছিলেন, “কেহ যেন এই ভেবে দুঃখ না করে যে, তাকে বোঝাবার জন্য অপর কাউকে বিলক্ষণ কষ্ট পেতে হয়েছে। আমি দীর্ঘ ছয় বৎসর ধরে আমার গুরুদেবের সঙ্গে সংগ্রাম করেছি, ফলে পথের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি আমার নখদর্পণে।”
এই প্রথম কথাবার্তার মধ্যে দুই-একটি বিষয় স্মৃতিপটে স্পষ্টভাবে জাগ্রত আছে। এককালে খ্রীস্টধর্ম বলিতে আমি বুঝিতাম ঈশ্বরকে জগৎপিতা জ্ঞানে উপলব্ধি করা। কিন্তু বহুকাল এই ভাবের উপাসনায় বিশ্বাস হারাইবার ফলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত ছিলাম। ঐরূপ ধারণার বাস্তব সত্যতা বা অসত্যতার দিকে দৃষ্টি . রাখিয়া কেবল ধারণা বা কল্পনা হিসাবে ইহার মূল্য কি, তাহা ভাল করিয়া বুঝিয়া দেখিতে চাহিয়াছিলাম। কারণ আমি অনুমান করিয়াছিলাম, যাহারা ঐরূপ ধারণা পোষণ করেন, তাঁহাদের চরিত্রের উপর এবং সম্ভবতঃ তাহাদের সভ্যতার উপরেও উহা নিজের একটি প্রভাব বিস্তার করিবে। তুলনা করিয়া দেখিবার উপাদানের অভাববশতঃ বিষয়টি আমি বেশি দূর অনুধাবন করিতে পারি নাই। আর, আশ্চর্যের বিষয়, এমন একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পাওয়া গেল, যিনি আমাদের নিকট পঁচরকম উপাসনা-প্রণালীর কথা বলিলেন, যাহাতে ঈশ্বরকে ব্যক্তিরূপে কল্পনা বা ধারণা করা হইয়া থাকে। তিনি এমন একটি ধর্মপ্রচার করিতেছিলেন যাহার প্রথম সোপান হইল ধর্মভাবগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাগ করা।
কয়েকটি ভারতীয় ভাবের নূতনত্ব ও গাম্ভীর্যে আমি বিশেষ আকৃষ্ট হই—ঐ সকল ভাবের সহিত আমার এই প্রথম পরিচয়। বস্তুতঃ রূপকের অন্তর্গত নূতনত্ব ও চিন্তাপ্রণালীর ভিন্ন গতি যেন সম্পদ বলিয়া মনে হইয়াছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ সেই সাধুর গল্পটি উল্লেখ করা যাইতে পারে। এক চোর ধরা পড়িয়াছে ভাবিয়া ভয়ে চুরিকরা বাসন-পত্ৰ ফেলিয়া পলাইতেছে, আর সাধুটি সেই সব লইয়া তাহার পশ্চাতে ছুটিতেছেন। অবশেষে তাহার পায়ের নিকট সমস্ত জিনিসগুলি রাখিয়া সজলনয়নে সাধু বলিলেন, “প্রভু, আমি জানতাম না আপনি ওখানে ছিলেন। এসব জিনিস আপনার, গ্রহণ করুন। সন্তানের অপরাধ ক্ষমা করুন।” সেই সাধুটির সম্পর্কেই আর একটি গল্প শুনিয়াছিলাম। গোখরা সাপের দংশন হইতে রাত্রিকালে যখন তিনি আরোগ্যলাভ করেন তখন এই বলিয়া উহার বর্ণনা দেন, “প্রিয়তমের নিকট থেকে দূত এসেছিল।” মরুভূমিতে মরীচিকা দর্শনে জগৎ সম্বন্ধে স্বামীজী অনুমান দ্বারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তাহার কথাও বলা যাইতে পারে। পনর দিন ধরিয়া মরীচিকা দর্শন করেন এবং সর্বক্ষণই উহা জল বলিয়া তাহার বোধ হয়। কিন্তু একদিন তৃষ্ণার্ত হইয়া জল ভাবিয়া উহা পান করিতে গিয়া বুঝিতে পারিলেন উহা মিথ্যা! ইহার পর পুনরায় পনর দিন ধরিয়া ঐ মরীচিকা দেখিতে পাইলেও বরাবরই তিনি উহাকে মিথ্যা বলিয়া জানিতেন। যে উপলব্ধির ফলে তাহার এই অপূর্ব জ্ঞানলাভ হয়, যে দর্শনের ফলে এই মরুভূমির মধ্য দিয়া যাত্রা ও জীবনযাত্রা এই উভয়ের মধ্যে তিনি একটা সাদৃশ্য আবিষ্কার করিতে সক্ষম হন, তাহা বুঝিতে পাবাই একটা যথার্থ শিক্ষা!
কিন্তু স্বামীজীর উপদেশের মধ্যে এই দুইটি ব্যতীত আর একটি তৃতীয় জিনিস ছিল—যাহা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং সেজন্যই আমার বিস্ময় উৎপাদন করিয়াছিল। উচ্চ উচ্চ ভাবেব ব্যাখ্যাতা বহু বক্তাকে ধর্মমন্দিরের বেদী হইতেও বক্তৃতা করিতে শুনিয়াছি-স্বামীজী ঠিক তাহাদের মতো একজন বক্তা মাত্র ছিলেন না, তাহা আমি সহজেই ধরিতে পারিয়াছিলাম। ধনী ও অলস উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিগণের তৃপ্তির জন্য তাহাদের সামনে কাব্য ও তর্কযুক্তির সৌখীন খাদ্যদ্রব্য উপস্থাপিত করা স্বামীজীর একেবারেই অভিপ্রেত ছিল না। খ্রীস্টধর্মের একজন নগণ্য প্রচারক অথবা ‘মুক্তিফৌজের’ (Salvation Army) কোন কর্মচারী যেমন জগতের সকল নরনারীকে ভগবানের রাজ্যে প্রবেশ করিবার জন্য আহ্বান করিয়া থাকেন, অন্ততঃ তাহার নিজের দিক দিয়া চিন্তা করিলে স্বামীজী ঠিক সেইরূপ একজন ধর্মপ্রচারক হিসাবেই সকল নরনারীকে ধর্মের নামে আহ্বান করিতেছিলেন। তথাপি আমাদের মধ্যে যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট তাহারই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া তিনি নিজের কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হইয়াছিলেন। ‘পাপ একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র’ তাঁহার এই ঘোষণার কথা বলিতেছি না। এইরূপ একটি মতবাদ কোন জটিল ধর্মতত্ত্ব-ব্যাখ্যার অঙ্গমাত্র হইতে পারে তাহা আমার জানা ছিল। ‘কেহ আমাদের জামা চুরি করিলে আলখাল্লাটিও তাহাকে দেওয়া উচিত’ এই মতবাদ আমাদের নিকট যতটা সত্য, বাস্তব জগতে পূর্বোক্ত মতটি উহার ব্যাখ্যাতার নিকট ততটাই সত্য। তাহার একটি দৃষ্টান্ত আমার নিকট অতীব বিস্ময়কর বোধ হইয়াছিল। শ্রোতৃবর্গের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সম্রান্তবংশীয় অল্পবয়স্কা জননী। রাস্তায় তাহাদের সামনে সহসা একটি বাঘ আসিয়া পড়িলে তাহারা কিরূপ ভীত হইয়া পলায়নে তৎপর হইবেন, সেই কথা তিনি বলিতেছিলেন। হঠাৎ কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করিয়া বলিলেন, “কিন্তু মনে কর, একটি শিশু বাঘটার সামনে পড়েছে; তখন তোমরা কোথায় থাকবে বল দেখি? বাঘের মুখে—তোমাদের প্রত্যেকেই—এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।”