তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করিলেন, ঐ সময়ে পাশ্চাত্যে বহুল প্রচলিত কয়েকটি ধর্মসম্প্রদায় কাঞ্চনাসক্তিবশতঃ অচিরে বিনষ্ট হইবে। তিনি ঘোষণা করেন–মানুষ সত্য হইতেই সত্যে অগ্রসর হইয়া থাকে, মিথ্যা হইতে সত্যে নহে।
বস্তুতঃ এই মূল সত্যটিকেই তিনি সর্বদা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি হইতে প্রচার করিতেন যে, সকল ধর্মই সমভাবে সত্য, এবং আমাদের পক্ষে কোন অবতারের বিরুদ্ধ-সমালোচনা অসম্ভব, যেহেতু অবতারগণ সকলেই সেই এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মের বিভিন্ন প্রকাশমাত্র। এই স্থলে তিনি গীতার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ শ্লোকটি উদ্ধৃত করেন–
“যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।”
অর্থাৎ, যখনই ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুদয় ঘটে, তখনই আমি আপনাকে সৃষ্টি করি। সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারিগণের বিনাশ, এবং ধর্মসংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।
এই ‘হিন্দু যোগী’-কে (লণ্ডনে তিনি যে নামে অভিহিত হইতেন) দেখিবার জন্য আমরা যে কয়জন আসিয়াছিলাম, তাহাদের কাহারও ধর্মে তেমন আস্থা বা বিশ্বাস ছিল না। স্বামীজীর বামপার্শ্বে বসিয়াছিলেন ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বংশের এক বৃদ্ধা মহিলা ফ্রেডারিক ডেনিসন মরিসের(৪) শিষ্যা ও বন্ধু। অগ্রণী হইয়া তিনিই মার্জিত শিষ্টাচারের সহিত প্রশ্নাদি করিতেছিলেন। বোধ হয়, ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা কম উদারভাবাপন্না। গৃহকর্ত্রী স্বয়ং এবং অপর দুই-একজন, মনস্তত্ত্বই যে ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্র—এই প্রচলিত আধুনিক আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়, সেদিন অপরাহ্নে আমাদের মধ্যে অনেককেই বাছিয়া নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল যেহেতু আমরা সহজে কোন ধর্মমতে আস্থা স্থাপন করিবার বিরোধী ছিলাম এবং ধর্মপ্রচার ব্যাপারে যে কিছু সত্য থাকিতে পারে, সে বিষয়ে প্রত্যয় জন্মানো ছিল কঠিন। আমার এখন মনে হয়, সেদিন সেই সাক্ষাৎকারের শেষে বক্তা সম্বন্ধে আমরা যেরূপ দম্ভ ও উদাসীনতার সহিত নিজ নিজ অভিমত প্রকাশ করিয়াছিলাম, তাহার একমাত্র কৈফিয়ৎ দেওয়া যাইতে পারে এই বলিয়া যে, অবিবেচনাপ্রসূত অনুরাগ যাহাতে হৃদয় অধিকার না করে সেজন্য সর্বদা বিচারবুদ্ধিকে বাঁচাইয়া চলিবার অভ্যাস। বিদায় লইবার পূর্বে গৃহস্বামী ও গৃহকর্ত্রীর সহিত কথা কহিতে কহিতে আমরা এক এক করিয়া অভিযোগ করিলাম, “নূতনত্ব কিছুই নেই”—কেহ না কেহ এই সব বিষয়ে পূর্বেই বলিয়াছেন।
কিন্তু আমার নিজের কথা বলিতে গেলে বলিতে হইবে যে, সেই সপ্তাহের নির্দিষ্ট কাজগুলি করিয়া যাইতে যাইতে ধীরে ধীরে আমার নিকট ইহা প্রতিভাত হইল যে, এক অপরিচিত সংস্কৃতির মধ্যে বর্ধিত, এক নূতন ধরনের চিন্তাশীল ব্যক্তি যে বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন, তাহা এইরূপে উড়াইয়া দেওয়া কেবল অনুদারতার পরিচয় নহে, পরন্তু উহা অন্যায়। আমার মনে হইল, ইনি যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহার অনুরূপ কথা পূর্বে আমি শুনিয়া অথবা ভাবিয়া থাকিতে পারি; কিন্তু এ পর্যন্ত যাহা কিছু আমার নিকট শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট বলিয়া মনে হইয়াছে, সে সমস্ত মাত্র এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে প্রকাশ করিতে পারেন, এরূপ কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির দর্শনলাভের সৌভাগ্য ইতিপূর্বে আমার জীবনে ঘটে নাই। সুতরাং স্বামীজীর লণ্ডনে অবস্থানকালে তাঁহার বক্তৃতা শুনিবার যে দুইটি মাত্র সুযোগ মিলিয়াছিল, আমি তাহার সদ্ব্যবহার করিয়াছিলাম।
অতি উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত আমাদের মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি করে, বার বার শ্রবণে তাহা বর্ধিত ও গাঢ় হয়। সেইরূপ, সেই বক্তৃতা দুইটির লিপিবদ্ধ সারাংশ এখন পড়িতে পড়িতে, তখনকার অপেক্ষা বহুগুণ বিস্ময়কর মনে হইতেছে। কারণ, তখন আমি আচার্যদেবের নিকট যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করিতাম, তাহাতে একটা বেপরোয়া ভাব ছিল, পরে তাহার জন্য আমার অনুশোচনার অন্ত ছিল না। যখন তিনি বলিতেছিলেন, “জগৎ হইল মাকড়সার জালের মতো, এবং মনগুলি সব মাকড়সা; কারণ মন এক, আবার বহু”—তখন তিনি এরূপ ভাষায় কথা বলিতেছিলেন, যাহা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য। তাহার বক্তৃতা আমি টুকিয়া লইয়াছিলাম, ভাল লাগিয়াছিল বলিয়া, কিন্তু ঐ সম্পর্কে কোন মতামত প্রকাশ করিতে পারি নাই; মানিয়া লওয়া দূরের কথা। তাহার উপদেশাবলী আমি কি ভাবে গ্রহণ করিতাম ইহাই তাহার সঠিক বর্ণনা; এমনকি, পর বৎসরেও যখন তাহার ঐবারকার সমুদয় বক্তৃতা আমি শুনিয়াছি—কেবল তাহা কেন, বলা চলে, যেদিন আমি ভারতে পদার্পণ করি, সম্ভবতঃ সেইদিন পর্যন্ত, আমার এইরূপ মনোভাবই ছিল।
স্বামীজীর উপদেশের মধ্যে এমন বহু বিষয় ছিল, যাহার সত্যতা শ্রবণমাত্রেই সকলের বোধগম্য হইত। যেমন, সাধারণতঃ যেভাবে সত্য বলিয়া দাবি করা হয়, কোন ধর্মই সেভাবে সত্য না হইলেও সকল ধর্মই এক হিসাবে সমভাবে সত্য—এই মতটিকে আমাদের মধ্যে অনেকেই তৎক্ষণাৎ স্বীকার করিতে বাধ্য হইলেন। যখন তিনি বলিলেন, ঈশ্বর প্রকৃতপক্ষে নিরাকার, কিন্তু ইন্দ্রিয়রূপ কুহেলিকার মধ্য দিয়া দেখার জন্য তিনিই সাকাররূপে প্রতিভাত হন, তখন ভাবটির সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ ও স্তম্ভিত হইলাম। যখন তিনি বলিলেন, কোন কার্যের পশ্চাতে অবস্থিত ভাবটি ঐ কার্য অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী, অথবা যখন তিনি নিরামিষ-ভোজনের প্রশংসা করিলেন, তখন আমরা ভাবিলাম, সহজেই উহা পরীক্ষা করিয়া দেখা যাইতে পারে। কিন্তু আমার নিজের কথা বলিতে গেলে তাহার সমগ্র মতবাদকেই আমি সন্দেহের চক্ষে দেখিতে লাগিলাম। জগতের কতকগুলি ধর্মমত এইরূপ যে, যদি কেহ প্রথমে ঐগুলি মানিয়া লয়, তবে পরে নিশ্চিতই তাহাকে উহাদের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া অবশেষে পরিত্যাগ করিতে হয়। আমার মনে হইল, স্বামীজীর ধর্মমতও ঐরূপ ধর্মমতের অন্যতম। আর এইভাবে মত পরিবর্তনের ফলে কতটা যন্ত্রণা ও আত্মগ্লানি উপস্থিত হয়, তাহা ভাবিলে আর কেহ ওপথে অগ্রসর হইতে চাহে না।