সে অপরাহ্নের পর আজ দশ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে, এবং সেদিনকার কথাবার্তার একটু আধটু মাত্র এখন মনে পড়িতেছে। কিন্তু সেই বিস্ময়কর প্রাচ্য সু সংযোগে যে-সকল সংস্কৃত শ্লোক তিনি আবৃত্তি করিয়া শুনাইয়াছিলেন, তাহা কখনও ভুলিবার নহে; ঐ সুরের ঝঙ্কার আমাদের গীর্জায় প্রচলিত গ্রেগরি(২)-প্রবর্তিত সুরের কথা এত মনে করাইয়া দেয়, অথচ উহা হইতে কত ভিন্ন।
.
তাহার নিজের সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করিলে তাহার উত্তর দিতে তিনি বেশ আগ্রহী ছিলেন, এবং একটি প্রশ্নের উত্তরে বুঝাইয়া দিলেন, তাঁহার পাশ্চাত্যে আগমনের কারণ হইল—তিনি বিশ্বাস করেন, বিভিন্ন জাতির মধ্যে, বর্তমানে যেরূপ পণ্যদ্রব্যের বিনিময় চলিতেছে, ঐরূপ পরস্পরের মধ্যে আদর্শের আদান-প্রদানেরও সময় আসিয়াছে। এই সময় হইতে বরাবর কথাবার্তা বেশ সহজভাবে চলিয়াছিল। তিনি প্রাচ্যের “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” রূপ অদ্বৈতবাদের ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে তিনি বিবিধ ইন্দ্রিয়জ্ঞান এক অদ্বিতীয় সত্তার বিভিন্ন বিকাশ বলিয়া বর্ণনা করিলেন, এবং গীতা হইতে শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া তাহার ইংরেজী অনুবাদ করিয়া দিলেন—”ময়ি মিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব” –সূত্রে গ্রথিত মণিসমূহের ন্যায় এই সকল আমাতে অবস্থিত।
তিনি আমাদের বলিলেন, খ্রীস্টধর্মের ন্যায় হিন্দুধর্মেও প্রেমই ধর্মভাবের চরম উৎকর্ষ বলিয়া স্বীকৃত হয়।
তিনি আরও বলিলেন, হিন্দুগণ মনে করেন, শরীর ও মন এক তৃতীয় পদার্থ আত্মার দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। এই বিষয়টি আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে, যাহার ফলে পরবর্তী শীতকালে আমি সম্পূর্ণ নূতন দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া জগৎকে দেখিতে আরম্ভ করি।
তিনি বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মের পার্থক্য বর্ণনা করিতেছিলেন এবং আমার মনে আছে, তিনি শান্তভাবে এই কয়টি কথা বলেন, “বৌদ্ধগণ ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানকেই সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন।” সুতরাং এই হিসাবে বৌদ্ধধর্ম ছিল আধুনিক অজ্ঞেয়বাদের (Agnosticism-এর) সম্পূর্ণ বিপরীত মতাবলম্বী। বরং ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান মনেরই খেয়াল মাত্র, অতএব অনুমানও তাহাই, এইরূপ সন্দেহ অজ্ঞেয়বাদের মূলমন্ত্র বলিয়া অজ্ঞেয়বাদ অনেকটা হিন্দুধর্মেরই সদৃশ।
আমার মনে আছে, তিনি বিশ্বাস (faith) শব্দটিতে আপত্তি প্রকাশ করেন এবং উহার পরিবর্তে প্রত্যক্ষানুভূতি (realisation) শব্দটি ব্যবহার করিতে বিশেষ আগ্রহান্বিত হন। সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা করিতে গিয়া তিনি ভারতের একটি প্রবাদ উদ্ধৃত করেন, “কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মানো ভাল, কিন্তু উহার গণ্ডির মধ্যেই মৃত্যু অতি ভয়ঙ্কর।”
আমার মনে হয়, সম্ভবতঃ এই প্রসঙ্গেই পুনর্জন্মবাদও আলোচিত হইয়াছিল। বোধহয় তিনি কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান—এই তিনটিকে আত্মজ্ঞান লাভেরতিনটি উপায় বলিয়া উল্লেখ করেন। আমার বেশ মনে আছে, তিনি কিছুক্ষণ ধরিয়া মানবের অনন্ত শক্তি সম্বন্ধে বলেন এবং ঘোষণা করেন, সকল ধর্মের একমাত্র শিক্ষা এই—”ত্যাগ কর, ত্যাগ কর।”
তিনি এই ভাবের দু-একটি কথাও বলিয়াছিলেন যে, ভারতবর্ষে উচ্চতম ধর্মের সহিত পুরোহিত ও মন্দিরাদির কোন সম্পর্ক নাই, এবং তাহার দেশের সর্বোচ্চ ধার্মিক ব্যক্তির নিকট স্বৰ্গকামনা ‘কতকটা নিম্নস্তরের’ বলিয়াই বিবেচিত হয়।
আত্মার মুক্ত স্বভাবরূপ আদর্শ তিনি নিশ্চয় উল্লেখ করিয়া থাকিবেন। মানব-সেবাই প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনের উদ্দেশ্য বলিয়া পাশ্চাত্যে আমাদের যে ধারণা, তাহার সহিত তাহার মতের আপাতবিরোধও ঘটিয়াছিল। কারণ আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, সেদিন অপরাহ্নে তিনি সর্বপ্রথম সোসাইটি (society) শব্দটি এমন এক অর্থে ব্যবহার করিয়াছিলেন, যাহা আমি কখনও সঠিকরূপে বুঝিতে পারিয়াছি বলিয়া মনে করি না। যতদূর মনে পড়ে, তিনি পূর্বোক্ত আদর্শটির উল্লেখ করিয়াই আমাদের দিক হইতে যে সকল প্রতিবাদ উঠিবার সম্ভাবনা তাহা অনুমান করিয়া বলেন, “আপনারা বলবেন এতে সমাজের কোন উপকার হয় না। কিন্তু এই আপত্তি স্বীকার করে নেবার পূর্বে আপনাদের প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে, সমাজের স্থায়িত্ব জিনিসটা স্বয়ং একটি উদ্দেশ্যস্বরূপ।”
ঐ সময়ে আমি মনে করিয়াছিলাম, ‘সোসাইটি’ (সমাজ) অর্থে তিনি সমগ্র মানবজাতির উল্লেখ করিতেছেন, এবং বিচার করিয়া দেখিলে শেষ পর্যন্ত জগৎনশ্বর, অতএব জগতের উপকারের জন্য যাহা কিছু করা যায় তাহাও নশ্বর—এইরূপ মতবাদ প্রচার করিতেছেন। কিন্তু এই অর্থই কি তাহার অভিপ্রেত ছিল? তাহা হইলে মানবসেবাই যে চিবকাল তাহার জীবনব্রত ছিল, তাহার সহিত এই মরে সামঞ্জস্য হয় কিরূপে? অথবা, তিনি শুধু একটি ভাবমাত্র বর্ণনা করিতেছিলেন এবং নিজে সরিয়া দাঁড়াইয়া ঐ ভাবটিকে যতদর সম্ভব সমর্থন কবিতেছিলেন? অথবা, তাহার ‘সোসাইটি’ শব্দটি সেই অদ্ভুত প্রাচ্যদেশীয় ‘সমাজ’ শব্দের একটি ভুল অনুবাদমাত্র। প্রাচ্যে ‘সমাজ’ বলিলেই তাহার সহিত ঈশতন্ত্র শাসনের(৩) কিছু কিছু বুঝায়, এবং অন্য নানা ভাবের সঙ্গে আমাদের দেশে চার্চ বা যাজকসম্প্রদায়ের শাসন সম্বন্ধে যে ধারণা আছে তাহাও ইহার অন্তর্ভুক্ত।
পরিব্রাজক আচার্য হিসাবে তাহার নিজের পদমর্যাদা কি, এই প্রশ্নেরও তিনি কিছু আলোচনা করেন, এবং বলেন, ধর্মসঙঘ সম্পর্কে অথবা একজনের কথায় বলিতে গেলে, “যে ধর্মমত সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ (পরিণতি লাভ করে), তাহার সম্পর্কে ভারতের তেমন আস্থা নাই।” তিনি বলেন, “আমাদের বিশ্বাস ‘সঙ’ থেকে চিরকালই নূতন উৎপাতের সৃষ্টি হয়ে থাকে।”