ইহার পর তাহার গতিবিধির সূত্র হারাইয়া যায়। মধ্যে মধ্যে তিনি পত্র লিখিতেন, কিন্তু সাধুরা তখন নানাদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। স্বামী সদানন্দ বলেন, স্বামীজী চলিয়া যাইবার পর তাহারা বড় নিরানন্দে দিন যাপন করিতেন। আবার প্রথম মঠ বাড়িটিও ছাড়িয়া দিবার কথা হইতেছিল। কারণ, গৃহস্বামী ঐ স্থানে নূতন বাড়ি নির্মাণ করিবেন বলিতেছিলেন। কিন্তু স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ নামে একজন সন্ন্যাসী কিছুতেই শ্রীগুরুর ভস্মাবশেষ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে সম্মত হইলেন না। অটল পর্বতের ন্যায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল, সম্পদে-বিপদে ঐ ভস্মাবশেষ ও গুরুভ্রাতাদের মাথার উপর আচ্ছাদন রাখিতেই হইবে, যতক্ষণ না তাহারা পুনরায় সকলে ঠাকুরঘরে একত্র হইতে পারেন। অতঃপর তিনি, স্বামী নির্মলানন্দ, মধ্যে মধ্যে স্বামী প্রেমানন্দ নামক একজন এবং বাসন মাজা ইত্যাদি কার্যে রত সঙ্ঘের নবাগত সদস্যের সহিত কিছুদূরে, কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের নিকটে, এক গৃহে স্থান পরিবর্তন করেন, এবং পূর্বে যে মঠ বরাহনগরে অবস্থিত ছিল, তাহা এখন আলমবাজার মঠ নামে অভিহিত হইল।
এই সময়ে স্বামী অখণ্ডানন্দ সর্বদা স্বামীজীর পশ্চাৎ অনুসরণ করিতেছিলেন। প্রায়ই মধ্যে মধ্যে তিনি শুনিতে পাইতেন, স্বামীজী অমুক শহরে রহিয়াছেন; শুনিয়াই সেখানে ছুটিতেন, কিন্তু গিয়া দেখিতেন, স্বামীজী সেইমাত্র চলিয়া গিয়াছেন; কোথায় গিয়াছেন, তাহার ঠিকানা নাই। একবার স্বামী ত্রিগুণাতীত গুজরাটের কোন এক ক্ষুদ্র দেশীয় রাজ্যে বিপদে পড়েন। এমন সময়ে এক ব্যক্তি তাহাকে বলেন, এক বাঙালী সাধু প্রধান মন্ত্রীর বাড়িতে অবস্থান করিতেছেন; তাহার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলে নিশ্চিত পাওয়া যাইবে। সাহায্য প্রার্থনা করিতে গিয়া ত্রিগুণাতীত দেখিলেন, সেই অজ্ঞাত সাধু স্বয়ং স্বামীজী। স্বামীজী কিন্তু প্রয়োজনীয় সাহায্যের ব্যবস্থা করিয়া দিয়া গুরুভ্রাতাকে গন্তব্যপথে অগ্রসর হইতে বলিলেন, এবং স্বয়ং একাকী যাত্রা করিলেন। ভগবান বুদ্ধদেবের মহান বাক্য তিনি সর্বদা আবৃত্তি করিতেন, “সিংহ যেমন সামান্য শব্দে ভীত হয় না, বায়ু যেমন কদাপি জালে আবদ্ধ হয় না, পদ্মপত্র যেমন জলে লিপ্ত হয় না, তুমিও সেইরূপ গণ্ডারবৎ একাকী বিচরণ কর।” এই কথাগুলি যেন ঐ সময়ে তাহার মূলমন্ত্রস্বরূপ ছিল।
এখন আমরা জানি, আলমোড়াতেই তিনি সংবাদ পান যে, তাহার শৈশবের প্রিয় ভগিনী অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থায় দেহত্যাগ করিয়াছেন। অতঃপর তিনি নিবিড় অরণ্যসঙ্কুল পার্বত্যপ্রদেশে চলিয়া যান, এবং তাহাব কোনপ্রকার খবর আর পাওয়া যায় না। বহু বৎসর পরে একজন স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী গভীরভাবে পর্যালোচনা করিতে গিয়া বুঝিয়াছিলেন যে, এই মৃত্যু তাহার হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করিয়াছিল, এবং উহার তীব্র যন্ত্রণা মুহূর্তের জন্যও উপশম হয় নাই। আমরা বোধ হয় সাহস করিয়া বলিতে পারি ভারতের নারীগণের শিক্ষা ও উন্নতিকল্পে তাঁহার যে প্রবল আগ্রহ দেখা যাইত, তাহার কিছুটা অন্ততঃ এই মর্মবেদনা হইতে সঞ্জাত।
এই সময়ে কয়েক মাস তিনি এক পার্বত্য গ্রামের ঊর্ধ্বদেশে গুহার মধ্যে বাস করেন। মাত্র দুইবার আমি তাহাকে এইকালের অনুভূতির বিষয় উল্লেখ করিতে শুনিয়াছি। একবার তিনি বলেন, “আমাকে কাজ করতে হবে, এই ধারণা এই সময়ে যতটা অভিভূত করে, সারা জীবনে আর কখনও তা করেনি। মনে হতো, কে যেন আমাকে জোর করে এক গুহা হতে আর এক গুহায় জীবন-যাপনে বিরত করে নিচে সমতল প্রদেশে বিচরণ করবার জন্য ফেলে দিল।” আর একবার তিনি অপর একজনকে বলিয়াছিলেন, “সাধু কি রকম জীবন যাপন করছে, সেটাই তার সাধুত্বের পরিচায়ক নয়। কারণ, গুহার মধ্যে বসে থেকেও কেউ অনায়াসে মনে মনে রাত্রির আহারের জন্য কখানা রুটি মিলবে এই প্রশ্নে নিমগ্ন থাকতে পারে।”
সম্ভবতঃ এই কালের অবসানেই এবং যে শক্তি ক্রমাগত তাঁহাকে যেন সামনেব দিকে ঠেলিয়া দিতেছে বলিয়া তিনি উল্লেখ করিতেন, তাহারই নিদর্শন-স্বরূপ তিনি কন্যাকুমারিকায় মাতা কুমারীকে পূজা করিবার সঙ্কল্প করেন। ধীরে-সুস্থে তিনি এই সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করেন, তথাপি প্রায় দুই বৎসব লাগিয়া থাকিবে। মনে হয়, এই ভ্রমণকালের শেষের দিকে তিনি ভারতীয় জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় লক্ষ্য করিয়া অনুশীলন করিয়াছিলেন। এই কালের প্রচলিত কাহিনীর আর শেষ নাই। এত বন্ধু লাভ করিয়াছিলেন যে, তাহাদের তালিকা দেওয়া সম্ভব নয়। শিখদের আমন্ত্রণ তিনি গ্রহণ করেন; মহারাষ্ট্রীয় পণ্ডিতগণের নিকট মীমাংসা-দর্শন এবং জৈনদের নিকট জৈন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন; রাজপুত রাজগণ তাহাকে গুরুরূপে বরণ করেন; মধ্যভারতে এক মেথর পরিবারে সহিত তিনি কয়েক সপ্তাহ বাস করেন; মালাবারের জাতিগত দুর্বোধ্য বিষয়গুলি স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিবার সুযোগ পান। জন্মভূমির বহু ঐতিহাসিক দৃশ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করিয়া অবশেষে যখন তিনি কন্যাকুমারিকায় পৌঁছিলেন, তখন কন্যাকুমারীর মন্দিরের অদূরে শৈলদ্বীপে যাইবার নৌকা ভাড়া দিবার সামর্থ্য পর্যন্ত তাহার ছিল না। সুতরাং সঙ্কল্পিত পূজাদানের পর, হাঙ্গর থাকা সত্ত্বেও তার দিয়া প্রণালী পার হইয়া তিনি দ্বীপে উপস্থিত হইলেন। মাদ্রাজ হইয়া উত্তর দিকে প্রত্যাবর্তন কালেই তিনি একদল অনুরক্ত শিষ্য লাভ করেন, যাহারা তাহার আমেরিকা গমনের উপলক্ষ হইয়াছিলেন। অবশেষে ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দের জুন মাসের বোধ হয় প্রথম সপ্তাহে তিনি বোম্বাই হইতে জাহাজে ঐ মহাদেশে যাত্রা করেন।