যিনি এই সব কাহিনী বর্ণনা করিতেছিলেন, তিনি উৎসাহ-প্রদীপ্ত মুখে বলিতে লাগিলেন, “সে সময়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হতো, এক মুহূর্ত বিশ্রাম ছিল না। বহু বাইরের লোক যাতায়াত করতেন, পণ্ডিতেরা তর্ক আলোচনা করতেন। স্বামীজী কিন্তু এক মুহূর্ত কাজ ছাড়া থাকতেন না। কখন কখনও তিনি কিছুক্ষণের জন্য একলা থাকবার অবসর পেতেন; সেই সময় তিনি হরিবোল, হরিবোল’! অথবা ‘মা মা’! বলতে বলতে পায়চারি করতেন। এই সব উপায়ে তিনি নিজেকে তার মহৎ কার্যের জন্য প্রস্তুত করছিলেন। আমি সর্বদা দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করতাম, এবং অবসর পেলেই বলতাম, ‘মশাই, আপনি কি খাবেন না?’ প্রত্যেকবারই তিনি কোননা-কোন কৌতুকপূর্ণ উত্তর দিতেন।” কখনও রন্ধনের সময় অথবা ঠাকুর পূজার সময় এইরূপ কথাবার্তা চলিত; এই সব কার্যে কোন প্রকার পার্থক্য না করিয়া সকলেই যোগ দিতেন। এই সময়ে সাধুদের অভাব থাকা সত্ত্বেও অনেকে তাহাদের নিকট আহারপ্রার্থী হইয়া আসিত। তাহাদের নিজেদের সম্বল ছিল অতি অল্প। মঠের বাহিরে গায়ে দিয়া যাইবার মতো একখানি মাত্র ভাল চাদর ছিল। চাদরটি দড়িতে ঝুলানো থাকিত, এবং যে কেহ বাহিরে যাইবার সময় লইয়া যাইতেন। দ্বিতীয় উত্তরীয় রাখিবার সঙ্গতি ছিল না। তথাপি যেভাবে হউক দরিদ্র ও অভ্যাগতদের জন্য আহার্য সংগৃহীত হইত। সাহায্য বা উপদেশের জন্যও অনেকে আসিতেন। তাহারা আবার অর্থ সংগ্রহ করিয়া কয়েক শত গীতা ও Imitation of Chirst (ঈশানুসরণ) ক্রয় করিয়া বিতরণ করেন। পুস্তক দুইটি ঐ সময়ে সঙ্ঘের নিকট বিশেষ আদরের ছিল। বহু বৎসর পরে ঐ দ্বিতীয় পুস্তকের যে বাক্যটি স্বামীজী যদৃচ্ছাক্রমে আবৃত্তি করিতে পারিতেন, তাহা হইল, “ওহে লোকশিক্ষকগণ, চুপ কর! আর ভবিষ্যদ্বক্তাগণ, তোমরাও থামো। হে প্রভো, একমাত্র তুমিই আমার অন্তরাত্মার সঙ্গে কথা কও!” টমাস-আ-কেম্পিসের গ্রন্থের ঐ অংশটুকুই কেবল তাহার মনে ছিল। বোধ হয়, একথা বলার আর প্রয়োজন নাই যে, শ্রীরামকৃষ্ণের এই হিন্দুসন্তানগণের মন হইতে ঐ পুস্তকখানির প্রভাব ক্রমশঃ হ্রাস পাইয়া অবশেষে স্মৃতিমাত্রে পর্যবসিত হইয়াছিল, এবং উহার পরিবর্তে গীতার সৌন্দর্য ও প্রভাব দিন দিন পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছিল।
প্রায় একবৎসর এইরূপে কাটিয়া গেল। স্বামীজী অতঃপর যোগী পওহারীবাবাকে(৩) দর্শন করিবার জন্য গাজীপুর গমন করেন। স্বামীজী চিরকাল শ্রীরামকৃষ্ণের পরেই এই যোগীকে স্থান দিতেন। সেখানে স্বামীজী যে অমূল্য সম্পদ লাভ করেন, অপর সকলের সহিত তাহা একত্র সম্ভোগ করিবার জন্য দুই মাস পরে মঠে প্রত্যাবর্তন করেন। সহসা সংবাদ আসিল, স্বামী যোগানন্দ নামে তাহাদের এক গুরুভ্রাতা বসন্তরোগে আক্রান্ত হইয়া এলাহাবাদে পড়িয়া আছেন। কয়েকজন গুরুভ্রাতা তাঁহাকে সেবা করিবার জন্য ছুটিলেন; স্বামীজীও তাহাদের অনুসরণ করিলেন।
আমরা পুনরায় স্বামী সদান-প্রদত্ত বিবরণের অনুবর্তন করিব। এলাহাবাদে বেশ কিছুদিন ধর্মচর্চায় অতিবাহিত হয়। স্বামী যোগানন্দের পীড়া যেন উপলক্ষ মাত্র; যেন তাহার মাধ্যমে সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হইল। সমগ্র শহরের মধ্যে বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা গেল। সারাদিনরাত্রি ক্রমাগত ছোট ছোট দলে লোকজন যাতায়াত করিতে লাগিল। স্বামীজীর মনও এই সময়ে সর্বদা উচ্চভাবে অবস্থান করিত। একদিন তিনি এক মুসলমান পরমহংস সাধুকে দর্শন করেন, “তার অঙ্গের প্রত্যেকটি রেখা বলে দিল যে, ইনি একজন পরমহংস।” এক পরম মুহূর্ত, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।
“দিগম্বররা বাপি চ সাম্বররা বা
গম্বররা বাপি চিদম্বরস্থ।
উন্মত্তবদ্বাপি চ বালবঘা
পিশাচবদ্বাপি চরত্যবন্যাম্ ॥”
অর্থাৎ, আত্মবিৎ পরমহংসগণ কখনও দিগম্বর, কখনও উত্তম বস্ত্রধারী, কখনও বল্কল বা চর্ম পরিহিত, আবার কখনও জ্ঞানমাত্রে আচ্ছাদিত, বালকবৎ, উন্মত্তবৎ, কখনও বা পিশাচবৎ পৃথিবীতে বিচরণ করিয়া থাকেন। শঙ্করাচার্যের ‘বিবেক চূড়ামণি’ হইতে পরমহংসের এই লক্ষণগুলি আবৃত্তি করিতে করিতে—শিষ্যের ভাষায়—উৎসাহের সহিত তাহাদের সারারাত্রি অতিবাহিত হইত। সম্ভবতঃ এইরূপ নানা প্রকার ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া এক পক্ষকাল কাটে। অতঃপর তাঁহারা এলাহাবাদ পরিত্যাগ করেন এবং দুইজন অথবা তিনজন করিয়া গঙ্গাতীরে বরাহনগর মঠে ফিরিয়া আসেন। কিন্তু ১৮৯০ খ্রীস্টাব্দের কোন এক সময়ে স্বামীজী গুরুভ্রাতাদের পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান; ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দের বিরাট সাফ্যলাভের পূর্বে আর প্রত্যাগমন করেন নাই।
এবার তিনি যাত্রা করেন স্বামী অখণ্ডানন্দ নামক জনৈক সন্ন্যাসীর সহিত। স্বামীজীকে তিনি আলমোড়া লইয়া যান এবং সেখানে এক গৃহস্থের অতিথিরূপে রাখিয়া দেন। স্বামী অখণ্ডানন্দের তিব্বত যাত্রাকালে এই গৃহস্থটি তাহাকে বন্ধুর ন্যায় সাহায্য করিয়াছিলেন। শুনা যায়, পার্বত্য পথে ভ্রমণকালে স্বামীজী একদিন ক্ষুধায় সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়েন। তাহাকে ঐ অবস্থায় দেখিয়া একজন মুসলমান একটি শশা কাটিয়া তাহাকে খাইতে দেয় এবং বলিতে গেলে উহাতেই তাহার জীবন রক্ষা হয়। কতদিন ধরিয়া ভ্রাতৃদ্বয় অনাহারে ছিলেন জানি না। সম্ভবতঃ এই সময়ে স্বামীজীর এইরূপ সঙ্কল্প ছিল যে, আহার, পানীয় প্রভৃতি অযাচিত আসিলে তবেই গ্রহণ করিবেন। অন্ততঃ পরে এক সময়ে তিনি ঐরূপ সঙ্কল্প করেন, তাহা নিঃসন্দেহ। এই ভ্রমণকালে তাহাকে জানিতেন, এইরূপ এক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজী বলেন যে, এই কঠোর সাধনার সময়ে কখনও তাহাকে পাচদিন পর্যন্ত একাদিক্রমে অনশনে থাকিতে হইয়াছে।