কারণ, যে সব সন্ন্যাসিগণ আমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন তাহাদের একমাত্র আলোচ্য বিষয় ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ এবং তাহার প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। মাত্র তের-চৌদ্দ মাস হইল স্বামীজী তাহাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন, এবং তখনও পর্যন্ত প্রথম দর্শনজনিত আনন্দ ও বিস্ময় অপনীত হয় নাই বলিলেই চলে। তাহার পূর্বে প্রায় ছয় বৎসর কাল স্বামীজী একরূপ নিরুদ্দিষ্ট ছিলেন। সত্য বটে, শেষের দিকে তাঁহাদের সহিত ঘন ঘন পত্র ব্যবহার ছিল, এবং কোন সময়ে এরূপ হয় নাই যে, তাহারা স্বামীজীর গতিবিধি সম্পর্কে একেবারে অবহিত ছিলেন না। স্বামীজীর জীবনের মহান উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁহার গুরুদেবের ভবিষ্যদ্বাণীর উপর গুরুভ্রাতাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। তাই আমেরিকায় তাহার প্রথম সাফল্যের সংবাদ শুনিবামাত্র তাহারা অনুমান করেন যে, ইনি তাহাদেরই স্বামী বিবেকানন্দ।
যাহারা কোথাও কোন মহাত্যাগীর জীবন প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তাঁহারা অবগত আছেন যে, নিজের পরিচয় সম্পূর্ণরূপে মুছিয়া ফেলিবার, অতি তুচ্ছ ও যাহাদের কেহ খোঁজ খবর রাখে না, এরূপ বস্তুর সহিত একাত্ম হইয়া যাইবার, এবং লোকসঙ্গ হইতে দূরে চলিয়া গিয়া তাহাদের স্মৃতি হইতে লুপ্ত হইয়া যাইবার এক প্রবল আকাঙক্ষা হইল আবেগময় ত্যাগজীবনের অঙ্গস্বরূপ! আমার মনে হয়, দীর্ঘকাল ব্যাপী মৌন, নির্জন গুহাবাস এবং বন হইতে বনে, গ্রাম হইতে গ্রামে ভ্রমণ করিবার সময় মৃত্তিকা ও বিভূতি অঙ্গে লেপন প্রভৃতি এই প্রকার ধর্মের যেসহস্র বৈশিষ্ট্য আছে, পাশ্চাত্য দর্শক বাহির হইতে যাহার অর্থবোধ করিতে পারেন না, ইহাই তাহার প্রকৃত ব্যাখ্যা। শ্রীরামকৃষ্ণের অদর্শনের পর কয়েক বৎসর ধন্যিা এই ভাবট স্বামীজীর মনে বিশেষভাবে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিল বলিয়া বোধ হয়। এবং একথা নিশ্চয়, কেহ যাহাতে তাহার কোন সন্ধান না পায়, এই উদ্দেশ্যেই তিনি বারবার গুরুভ্রাতাদের ছোট দলটিকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতেন। এইরূপ এক যাত্রায়, তিনি হাথরাসে পীড়িত হইয়া রহিয়াছেন শুনিয়া গুরুত্ৰাতাগণ তাহাকে আনিবার জন্য লোক পাঠান। তাহাদের পরস্পরের মধ্যে বিশেষতঃ স্বামীজীর সহিত, এরূপ ভালবাসার বন্ধন ছিল যে, তাহারা স্বয়ং তাহার সেবা না করিয়া থাকিতে পারিতেন না। স্বামীজী প্রত্যাবর্তন করিবার কয়েকমাস পরে তাহার এক শিষ্যের মঠে আগমন ঘটে। পর্যটনকালে স্বামীজী তাহাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাহার সন্ন্যাস নাম ছিল স্বামী সদানন্দ। সদানন্দের ভাঙা-ভাঙা অথচ বলিষ্ঠ ইংরেজীতে প্রদত্ত বিবরণ হইতে এইকালে স্বামীজী মঠে কিরূপ জীবন যাপন করিতেন, তাহার ইতিবৃত্ত সংগ্রহ করি। পূর্বাশ্রম ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় আসিবার পাথেয় সংগ্রহ করিবার জন্য সদানন্দকে দুই-তিন মাস রেলে চাকরি করিতে হয়। মঠে পৌঁছিয়া দেখিলেন, স্বামীজী পুনরায় বাহির হইয়া পড়িবার উদ্যোগ করিতেছেন। কিন্তু তাহার জন্য তিনি যাত্রা স্থগিত রাখেন এবং সেই সন্ধ্যায় যে যাত্রারম্ভের কথা ছিল, এক বৎসরের পূর্বে তাহা আর ঘটিয়া ওঠেনাই। এইকালের কথা উল্লেখ করিয়া স্বামীজীর প্রথম শিষ্য গর্বের সহিত বলিতেন, “স্বামীজীর জগদ্ধিতায় কর্মের আরম্ভ আমাকে নিয়ে।”
এই বৎসর স্বামীজী “একদমে চব্বিশঘণ্টা কাজ করতেন। তার এত কাজ ছিল যে, প্রায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।” অতি প্রত্যুষে অন্ধকার থাকিতে তিনি গাত্রোত্থান করিতেন, এবং “জাগো, জাগো সকলে, অমৃতের অধিকারী”, এই গানটি গাহিতে গাহিতে সকলকে উঠাইয়া দিতেন। তারপর সকলে একত্র ধ্যানে বসিতেন। অতঃপর যেন অজ্ঞাতসারেই ভজন ও সৎপ্রসঙ্গে উপনীত হইতেন এবং দ্বিপ্রহর পর্যন্ত বা তাহার পরেও উহা চলিত। স্তবপাঠ ও ভজন হইতে ক্রমে ইতিহাস-প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িত। কখনও ইগেশিয়াস লায়োলার(১) গল্প, কখনও জোয়ান অব আর্ক অথবা ঝালীর রানীর গল্প হইত। আবার কখনও স্বামীজী কালাইলের ‘ফরাসী রাষ্ট্রবিল্পব হইতে দীর্ঘ অংশ আবৃত্তি করিতেন, এবং সকলে যেন স্বপ্নবিষ্টের ন্যায় দুলিতে দুলিতে সমস্বরে পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিতেন, “সাধারণতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক”! ”সাধারণতন্ত্রের জয় হোক!” অথবা তাহারা সেন্ট ফ্রান্সিস্ অব অ্যাসিসির কথায় তন্ময় হইয়া যাইতেন। নাট্যকার যেমন নিজের অজ্ঞাতসারে স্বভাববশে নাটকের পাত্রগণের সহিত একাত্ম হইয়া যান, তেমনি তাঁহারাও উক্ত মহাপুরুষের “মৃত্যু, তোমায় স্বাগত জানাই”, এই বাক্যটি দীর্ঘকাল ধরিয়া চিন্তা করিতে করিতে আত্মহারা হইয়া যাইতেন। বেলা একটা-দুইটার সময় স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ—যিনি ছিলেন একাধারে এই সঙ্ঘের পাচক, গৃহস্থালীর তত্ত্বাবধায়ক ও পূজারী—তাহাদের বকুনি দিয়া স্নানাহার করিবার জন্য উঠাইয়া দিতেন। কিন্তু আবার তাহারা একত্র হইতেন, আবার ভজন ও সৎপ্রসঙ্গ চলিত সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর দুইঘণ্টা ধরিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের আরাত্রিক সম্পন্ন হইত। অনেক সময় তখনও তাহাদের তন্ময়তা ভঙ্গ হইত না, আবার ভজন ও শ্রীরামকৃষ্ণপ্রসঙ্গ করিতে করিতে তাহারা ধ্যানে মগ্ন হইয়া যাইতেন। অথবা ছাদের উপর বসিয়া মধ্যরাত্রি অতীত হইবার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাহারা নামগান করিতেন, ‘জয় সীতারাম!’ ‘জয় সীতারাম!’ সকল ধর্মের বিশেষ বিশেষ পর্বগুলি উহাদের উপযোগী বিশেষ অনুষ্ঠান সহকারে সম্পন্ন হইত। যেমন, বড়দিনের সময় তাঁহারা মেষপালকদের মতো মাথা কানো লম্বা ছড়ি হস্তে জ্বলন্ত কাঠের গুড়ির চারিপার্শ্বে অধশায়িত অবস্থায় অনুচ্চস্বরে আলোচনা করিতেন; কেমন করিয়া এক নির্জন স্থানে কয়েকটি মেষপালক তাহাদের মেষযুথের রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ছিল, এমন সময়ে দেবদূতগণ সেখানে শুভাগমন করেন এবং কিরূপে সেই দিনই জগতের প্রথম গ্লোরিয়া নামক(২) স্তবগানের উৎপত্তি হয়। একবার গুডফ্রাইডে উৎসব ঠাহারা কিরূপে সম্পন্ন করেন, তাহার গল্পটি কৌতুকাবহ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়া গেল এবং ক্রমে ক্রমে, ঐ উৎসব যাহারা পালন করেন তাহাদের যেমন উৎকট ভাবাবস্থা হয়, তাহারাও সেই অবস্থা প্রাপ্ত হইলেন। আহারের কথা চিন্তা করা চলিবে না। যে কয়টি আঙুর তাহারা সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহার রস বাহির করিয়া জলের সহিত মিশানো হইল। একই পাত্র হইতে সকলে উহা পান করিবেন, তাহার উদ্যোগ চলিতেছে, এমন সময়ে দরজায় একজন ইউরোপীয় অতিথির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “কে আছ, খ্রীস্টের দোহাই, দরজা খোল।” এক অবর্ণনীয় আনন্দের সঙ্গে দশ-পনের জন ছুটিয়া গিয়া অতিথির চারিদিকে জড় হইলেন। সকলেই একজন খ্রীস্টানের মুখে ঐদিনের মাহাত্ম্য শ্রবণ করিতে উৎসুক। কিন্তু তিনি বললেন, “তিনি মুক্তিফৌজের লোক, গুডফ্রাইডের কথা কিছুই জানেন না। তারা কেবল জেনারেল বুথের জন্মদিন পালন করে থাকেন।” স্বামী সদানন্দ বলিলেন, “তিনি আরও কি কি বলেছিলেন, আমার মনে নেই।” কথাগুলি বলিতে বলিতে বক্তার মুখমণ্ডল ও কণ্ঠস্বর যেরূপ বিষাদপূর্ণ হইয়া গেল, তাহাতে স্পষ্ট বোঝা গেল, সাধুরা এই আবিষ্কারে কিরূপ হতাশা বোধ করিয়াছিলেন। বোধ হয়, আশাভঙ্গের প্রথম মুহূর্তেই তাহারা, “আপনার এটা রাখবার অধিকার নেই” এই কথা বলিয়া পাত্রী বেচারার হাত হইতে বাইবেলখানা কাড়িয়া লইয়া তাহাকে দূর করিয়া দেন। যাহা হউক, শোনা যায় যে, তাঁহাদের মধ্যে একজন অন্য দরজা দিয়া চুপি চুপি তাহাকে ফিরাইয়া আনেন, এবং কিছু আহার করাইয়া গোপনে তাঁহার জিনিসটি প্রত্যর্পণ করেন।