কিন্তু এই নূতন চিন্তা-জগতে ধর্মজীবনে চিত্তের একাগ্রতার ন্যায় যে আকাঙ্ক্ষা অনুরূপ ভাবে প্রধান ও সর্বজনীন বলিয়া গণ্য হইত, তাহা হইল জীবাত্মার স্বাধীনতা। চিন্তা, মতামত এবং কর্মের ছোটখাটো অধিকারগুলি ছিল উহার অন্তর্ভুক্ত। একমাত্র এই অধিকারটি নিজস্ব মনে করিয়া সাধুরা উহা প্রাণপণে রক্ষা করিয়া থাকেন। ইহাই তাহাদের একমাত্র সম্পদ, যেখানে তাঁহারা কোন প্রকার অনধিকার প্রবেশ সহ্য করিতে পারেন না। প্রাত্যহিক জীবনে এই ভাবটি কিরূপে রূপায়িত করা হয়, তাহা লক্ষ্য করিতে গিয়া দেখিলাম, উহা একপ্রকার ত্যাগেই পরিণত। যতই সুখকর হউক, যদি উহা বন্ধন শৃঙ্খলে আবৃত থাকে, তবে কিছুতেই গ্রহণ করা চলিবে না; এক কথায়, বন্ধনের ইঙ্গিতমাত্ৰ থাকিলে তাহার সহিত সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। ইহার জন্য চিত্ত কতদূর নির্মল, ইচ্ছাশক্তি কতদূর শুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। আবার এই আদর্শই কত তথ্য উদঘাটন করিয়া দেয়! এ কথা বুঝিতে বিলম্ব হয় না, ভারতবর্ষে সঙ্ঘবদ্ধ সন্ন্যাসধর্ম যে তেমন বিকাশ লাভ করে নাই, ইহাই তাহার কারণ। অতীতে ধর্মজীবনে যে সকল মহাপুরুষ আদর্শস্থানীয় বলিয়া গণ্য হইতেন, তাহারা কুটিচক অথবা পরিব্রাজক যাহাই হউন, সর্বদা একাকী বাস করিতেন। আমাদের নিকটস্থ মঠে এমন সব ব্যক্তি ছিলেন বলিয়া শুনিতাম, যাহারা তাহাদের নেতার মেয়েদের সহিত বাক্যালাপ পছন্দ করিতেন না। কেহ কেহ ছিলেন সকল প্রকার ক্রিয়াকলাপ ও অনুষ্ঠানের বিরোধী। একজনের ধর্ম ছিল ব্যক্তি-উপাসনায় পর্যবসিত, যাহাকে প্রায় নাস্তিকতা বলা যাইতে পারে। আবার, একজনের ধর্ম তাহাকে এমন সব অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করিত, যাহা আমাদের অনেকের নিকটেই অসহনীয় মনে হইত। কয়েকজন বাস করিতেন ‘মহাপুরুষ’ ও নানাবিধ দর্শনের এবং অলৌকিক রাজ্যে; আবার কেহ কেহ এইসব অর্থহীন ব্যাপার একেবারে উড়াইয়া দিতে পারিতেন না, তবে চুলচেরা তর্কযুক্তিসহায়ে গন্তবাপথে অগ্রসর হইতেন। এই বিভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তিগণ যে ঘনিষ্ঠ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হইতে পারিয়াছিলেন, ইহা দ্বারা নির্বিবাদে প্রমাণ হয় যে, তাঁহা প্রত্যেকের নিজ নিজ পথ বাছিয়া লইবার অধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। আবার এই সূত্রেই তখন এবং পরেও আমি না ভাবিয়া থাকিতে পারি নাই যে, ইহাই ছিল কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতের প্রাচীন শাসনপদ্ধতির ব্যর্থতার কারণ। যাহাতে উচ্চস্তরের ও সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ চরিত্রের ব্যক্তিগণ রাষ্ট্র ও নগর সংক্রান্ত কর্মে নিজেদের সম্যকরূপে নিযুক্ত করিতে পারেন, সেজন্য তাহাদের আন্তরিক বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন যে, সঙ্ঘবদ্ধ কার্যই প্রশস্ততর ও সম্মানজনক। অতএব ঐ কার্য সম্পন্ন করিবার জন্য তাহাদের উদ্যম থাকা উচিত। প্রাচীন ভারতে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী আধ্যাত্মিক আদর্শ বিষয়ে অত্যধিক সচেতন থাকিতেন—বিশেষতঃ স্বাধীনতাবোধের ফলে নগর ও রাষ্ট্রসংক্রান্ত নিয়ম শৃঙ্খলার প্রতি তাহারা কোন প্রকার আগ্রহ বোধ করিতেন না। সুতরাং ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই যে, তাহাদের ক্ষমতা ও চরিত্রবল থাকা সত্ত্বেও আধুনিক বিধিব্যবস্থার সুযোগসুবিধা কার্যে রূপায়িত করিবার ভার পড়িয়াছে আধুনিক ব্যক্তিগণের উপর। তথাপি এই সকল কার্য সম্যকরূপে ধারণা ও পোষণ করিবার এবং উন্নতির অঙ্গীভূত করিয়া লইবার শক্তি যে হিন্দুধর্মে বিদ্যমান, আমার বিশ্বাস, তাহা শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাহার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব ও জাতীয় চিন্তাভাণ্ডারে তাহাদের বিশিষ্ট দান হইতেই প্রমাণিত হইয়াছে।
স্বামীজী মনে করিতেন, পাশ্চাত্য চবিত্রের এক মহাদোষ, তাহারা নিজেদের পক্ষে যাহা কল্যাণকর মনে করে, অপরের উপর বলপূর্বক তাহা চাপাইয়া দিবার চেষ্টা। গম্ভীরভাবে তিনি বারবার আমাদের ঐ দোষ পরিহার সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দিতেন। সম্ভবতঃ তাহার চির অভীপ্সিত ‘আদর্শ-বিনিময়ের’ই ইহা অন্যতম উদাহরণ। আবার সেই সঙ্গে তাহার আপনার লোকেরা যখন প্রশ্ন করেন, তিনি তো স্বদেশে ইংরেজদের দেখিয়াছেন, তাহারা কোন্ বিষয়ে সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষসাধন করিয়াছে বলিয়া তাহার বোধ হয়? তখন স্বামীজী উত্তরে বলেন, “আত্মসম্মান বজায় রেখে কিরূপে আজ্ঞাবহ হওয়া চলে, এটা তারা শিখেছে।”
কিন্তু বেলুড়ে আমরা কেবল স্বামীজীকেই দেখি নাই। সারা মঠই আমাদের অতিথি মনে করিতেন। সেইজন্য অতিথিপরায়ণ সাধুগণ কখনও আমাদের প্রতি অনুগ্রহবশতঃ, কখনও বা সেবার উদ্দেশ্যে আমাদের নিকট যাতায়াতের কষ্ট স্বীকার করিতেন। যে গাভীটি আমাদের দুধ দিত, তাহাকে তাঁহারাই দোহন করিতেন। যে ভৃত্যের উপর রাত্রে ঐ দুধ পৌঁছিয়া দিবার ভার ছিল, সে যখন একদিন পথে গোখুরা সাপ দেখিয়া ভয় পায় ও যাইতে অস্বীকার করে, তখন সাধুদের মধ্যেই একজন ঐ কার্যের ভার গ্রহণ করেন। ভারতীয় গৃহস্থালীর আমাদের অজানা সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য প্রত্যহ একজন করিয়া ব্রহ্মচারী মঠ হইতে প্রেরিত হইতেন। একজনের উপর ভার ছিল বাংলা শিখাইবার। সঙেঘর প্রাচীন সন্ন্যাসিগণ প্রায়ই সৌজন্যবশতঃ এবং অনুগ্রহপূর্বক আমাদের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন। আর যখন স্বামীজী স্বয়ং কয়েক সপ্তাহের জন্য অন্যত্র যাইতেন, তখন তাহাদের মধ্যে কেহনা-কেহ অতিথিদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য নিজেকে দায়ী মনে করিয়া প্রাতঃকালের চায়ের টেবিলে নিয়মিতভাবে তাঁহার স্থান গ্রহণ করিতেন। এইরূপ সহস্র উপায়ে আমরা সেই সব ব্যক্তির সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম যাহাদের কথাবার্তার মধ্যে স্মৃতির উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটিত। ঐ স্মৃতিই ছিল ‘টানা’ যাহার উপর ‘পড়েনে’র মতো এই সব ত্যাগীর জীবন বোনা হইয়াছিল।