-এই দেহরূপ গৃহের নির্মাণকর্তাকে অন্বেষণ করিতে করিতে আমি বহু জন্মজন্মান্তর পরিগ্রহ করিযাছি। হাস, পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ কি দুঃখদায়ক! হে গৃহনির্মাণকারিণী তৃষ্ণে, আমি তোমায় দেখিতে পাইয়াছি। আর তুমি গৃহনির্মাণ করিতে পারিবে না। তোমার গৃহের সমস্ত পার্শ্বক (চালের ‘রুয়া) ভগ্ন হইয়াছে এবং শীর্ষকাষ্ঠ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইযাছে। আমার চিত্ত সংস্কারবিহীন হইয়া সকল তৃষ্ণার ক্ষয়সাধন করিয়াছে।
০৪. স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্ঘ
গঙ্গাতীরস্থ শষ্পাবৃত ভূমি ও বৃক্ষরাজির মধ্যেই, যে লোকগুরুর কার্যে ইতিপূর্বেই আমার জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলাম, ব্যক্তিগতভাবে তাহার সম্বন্ধে জানিতে পারি। আমার ভারতে পদার্পণকালে (১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি) বেলুড়ে সবেমাত্র একখণ্ড জমি ও একটি বাড়ি ক্রয় করা হইয়াছিল; তাহাই পরে রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘের মঠরূপে পরিণত হয়। আরও কয়েক সপ্তাহ পরে আমেরিকা হইতে কয়েকজন বন্ধু আগমন করেন এবং স্বভাবগত সাহসিকতার সহিত ঐ অর্ধজীর্ণ বাড়িটি অধিকার করিয়া উহাকে সাদাসিধা অথচ স্বচ্ছন্দভাবে বাসের উপযোগী করিয়া লন। এই বন্ধুগণের অতিথিরূপে বেলুড়ে বাসকালে, এবং পরে কুমায়ুন ও কাশ্মীর ভ্রমণকালেই আমি তাহাদের সহিত ভারতবর্ষকে ভাল করিয়া চিনিতে ও স্বদেশে স্বজনগণের মধ্যে স্বামীজীর জীবনযাত্রা লক্ষ্য কবিতে প্রবৃত্ত হই।
আমাদের বাড়িটি ছিল কলিকাতা হইতে কয়েক মাইল উত্তরে, গঙ্গার পশ্চিম তীরে নিম্ন সমতলভূমির উপরে নির্মিত। জোয়ারের সময় পানসির ন্যায় ছোট ছোট নৌকাগুলি (গঙ্গাতীরে যাহারা বাস করে, এই নৌকাগুলি তাহাদের যানবাহনের কাজ করে) একেবারে সিঁড়ির নিচেই আসিয়া লাগিত। আমাদের ও অপর পারের গ্রামের মধ্যে নদীটির বিস্তার ছিল অর্ধ হইতে তিন-চতুর্থাংশ মাইল। নদীর পূর্বতীরে আরও প্রায় এক মাইল উত্তরে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চূড়া ও বৃক্ষগুলি দৃষ্টিগোচর হইত। মন্দির সংলগ্ন এই উদ্যানেই স্বামীজী ও তাঁহার গুরুভ্রাতাগণ বাল্যকালে শ্রীরামকৃষ্ণের পদপ্রান্তে বাস করিতেন। যে বাড়িটি এখন মঠরূপে ব্যবহৃত হইত, তাহা আমাদের কুটির হইতে প্রায় অর্ধ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। মঠবাড়ি ও আমাদের কুটিরের মধ্যে অনেকগুলি বাগানবাড়ি এবং অন্ততঃ একটি নালা ছিল। তালগাছের গুড়ি চিরিয়া তাহার অর্ধাংশ দ্বারা নির্মিত একটি পুলের উপর দিয়া নালাটি পার হইতে হইত; পুলটি দেখিলে সন্দেহ হইত, ভার সহিতে পারিবে কি না। আমাদের এই বাড়িতেই স্বামীজী প্রতিদিন প্রাতঃকালে একাকী অথবা কয়েকজন গুরুভ্রাতাসহ আসিতেন। এখানেই প্রাতঃকালীন জলযোগ সমাপ্ত হইবার পর বৃক্ষতলে বহুক্ষণ ধরিয়া আমরা স্বামীজীর অফুরন্ত ব্যাখ্যাপ্রবাহ শ্রবণ করিতাম। ভারতীয় জগতের কোন না কোন গভীর রহস্য তিনি উদঘাটন করিতেন। কদাচিৎ প্রশ্নোত্তর স্থান পাইত। এইকালের কথা যখনই আমার স্মৃতিপথে উদিত হয়, আমি আশ্চর্য হইয়া ভাবি, কিরূপে এই বিপুল চিন্তা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সম্ভব, আবার সঞ্চয় করিলেও উহা বিতরণ করিবার প্রবল শক্তিই বা কিরূপে আসে! কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনায় যাহারা সুদক্ষ, তাহাদের মধ্যেও এক বিষয়ে স্বামীজীর বৈশিষ্ট্য ছিল। কথাবার্তার মাঝখানে কেহ বাধা দিলে তিনি বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করিতেন না। যাহাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিতেন, সেই শ্রোতাদের মনোভাব সম্পর্কে উদাসীন থাকিতেন না। সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা লইয়া যাহারা আলোচনায় যোগদান করিতেন, কেবল তাহাদের উপস্থিতিকালেই তাহার গভীরতম উক্তিগুলি শোনা যাইত; বস্তুতঃ তিনি স্বয়ং এ বিষয়ে সচেতন থাকিতেন বলিয়া বোধ হয় না। বহুবার তিনি উত্তেজিত হইতেন, কিন্তু যেমন কোন অজ্ঞাত কারণে মনে মধুর ভাবের উদয় হইত, তৎকালীন মানসিক উত্তেজনাও তেমন সম্পূর্ণ সাধারণ কোন অজ্ঞাত কারণেই প্রকাশ পাইত; কোন ব্যক্তি বিশেষের সহিত উহার যোগ থাকিত না।
এখানেই আমরা জানিতে পারি, ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের মূলমন্ত্র কি, এবং কোন্ আদর্শ দ্বারা উহা নিয়ন্ত্রিত। কারণ, কথাবার্তার মধ্যে বিভিন্ন আদর্শেরই ব্যাখ্যা করা হইত। একথা সত্য, ঘটনা ও দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করা হইত ইতিহাস, সাহিত্য ও অন্যান্য সহস্র উপকরণ হইতে; কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল সর্বদাই এক আধ্যাত্মিক পূর্ণত্বলাভ সম্পর্কে ভারতীয় আদর্শকে স্পষ্টতর করা। যেরূপ মনে হইত, আদর্শগুলি বস্তুতঃ সকল সময়ে সেরূপ সহজবোধ্য ছিল না। এই ভারতীয় জগতে সহজাত পরোপকার বৃত্তির পুষ্টিসাধনের জন্য যতটা প্রয়োজন, তাহা অপেক্ষা চিনের একাগ্রতা সম্পাদনে অধিক মনোযোগ দেওয়া হইয়া থাকে। কিন্তু উহা ভারতের পক্ষে কল্যাণকর কি না, তাহা তর্কযুক্তিসহায়ে প্রমাণ করিবার সময় এখনও আসে নাই। ব্যক্তিগত ব্যাপারে স্বামীজীর নির্ভীক উপদেশ ছিল, ব্যক্তিত্বের সীমা অতিক্রম করিতে হইবে (বা নৈর্ব্যক্তিক অবস্থালাভই লক্ষ্য)। শত্রুর জন্য প্রার্থনা করিতে হইবে, এই তত্ত্বের পরিবর্তে ‘সাক্ষিস্বরূপ হও’ এই উপদেশ অধিক শোনা যাইত। কারণ,জগতে আমার কোন শত্রু আছে, তাহার মতে এই চিন্তা দ্বেষবুদ্ধিব প্রমাণ। প্রেম যদি ‘অহেতুক’ না হয়, তবে উহা কোনক্রমেই প্রেম বলিয়া অভিহিত হইতে পারে না—একথা দৃঢ়তার সহিত উচ্চারিত হইত। পাশ্চাত্য বক্তা হয়তো ‘উদ্দেশ্যবিরহিত’ শব্দদ্বারা ঐ ভাবটিকে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিবেন, কিন্তু তাহাতে অত জোর প্রকাশ পাইবে না। ব্রহ্মচর্য ও ত্যাগের বিশ্লেষণে কখনও তাহার ক্লান্তি ছিল না। আমাদের সকল চিন্তার মধ্যে বিরাজ করিতেন শ্রীমহাদেব—যিনি নিজের সৃষ্ট ত্রৈলোকের রাজত্ব অথবা পিতৃত্ব, ঐশ্বর্য অথবা সুখ—কোন কিছুর দ্বারাই প্রলুব্ধ নন, বরং সাংসারিক দৃষ্টিতে ঠিক বিপরীত একজন অতি ‘সাদাসিধা ব্যক্তি কোন কৌতূহল নাই, সহজে প্রতারিত—যিনি প্রতিদিন দ্বারে দ্বারে একমুষ্টি তণ্ডুল ভিক্ষা করিয়া বেড়ান। তিতিক্ষা অথবা অন্যায়ের প্রতিকার না করাই হইল ধর্মজীবনের চিহ্ন। পাশ্চাত্যে আমরা ইহার উদাহরণ সেই কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত সাধুর মধ্যে পাই। আঙ্গুলের গাট হইতে কৃমিকীট পড়িয়া গেলে তিনি হেঁট হইয়া তাহাদের পুনর্বার যথাস্থানে রাখিয়া দিয়া বলিতেন, “ভাই সব, খাও।” জীবের অন্যতম সিদ্ধিলাভ হইল রঘুনাথেরদর্শনপ্রাপ্তি যে সাধু সম্মুখস্থ কয়েকটি বলদকে প্রহৃত হইতে দেখিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়েন, এবং তাহার পৃষ্ঠে চাবুকের দাগগুলি ফুটিয়া ওঠে, তিনি ঐ সিদ্ধাবস্থা লাভ করিয়াছিলেন। ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের পূর্ব ধারণা হইতে সম্পূর্ণ বিজাতীয় একটি ভাবকে হৃদয়ঙ্গম করিবার জন্য স্বামীজী আমাদের আহ্বান করেন। তাহার মতে দেহবোধের একান্ত অভাবই পূর্ণ সাধুত্বের লক্ষণ। ঐ দেহবোধের অভাব এত গভীর, সাধু যে উলঙ্গ অবস্থায় রহিয়াছেন; সে সম্বন্ধে তাহার কোন বোধই নাই। নগ্নতার মধ্যেও বিশেষ স্থলে উচ্চতর ভাব উপলব্ধি করিবার যে সূক্ষ্মবিচারবোধ–পাশ্চাত্যে তাহার প্রকাশ ললিতকলায়; ভারতে উহার বিকাশ ধর্মে। কোন গ্রীক প্রতিমূর্তির সম্মুখে আমরা যেমন সৌন্দর্যের আদর্শ হিসাবে একটা শ্রদ্ধার ভাব উপলব্ধি করি, হিন্দুরা তেমনি নগ্ন সাধুর মধ্যে মাহাত্ম ও শিশুসুলভ পবিত্রতা দেখিয়া থাকেন।