সর্পিল-কুণ্ডলীর (spiral) উপরেব বেড়গুলি যেমন ঘুরিয়া ঘুরিযা ছোট হইতে হইতে অবশেষে এক বিন্দুতে পর্যবসিত হয়, স্বামীজীর স্বদেশ-ভক্তির আবেগও ছিল সেইরূপ এক বিরাট বস্তু। স্বদেশের মাটির প্রতি ভালবাসা ও নিসর্গপ্রেম ছিল যেন উহার সর্বনিম্ন বেড়গুলি; জাতি, অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও চিন্তা সম্পর্কীয় অপর যাহা কিছু সমস্তই ছিল উহার পরবর্তী বেড়গুলির অন্তর্গত। আর সমগ্র বেড় ক্রমশঃ সরু হইয়া অবশেষে এক নির্দিষ্ট বস্তুতে কেন্দ্রীভূত-ইহাই ছিল তাহার দেশপ্রেমের স্বরূপ। ঐ কেন্দ্রস্থানীয় বিন্দু হইল ভারত সম্পর্কে তাহার দৃঢ় বিশ্বাস। ভারতের সমালোচকগণ যেরূপ অনুমান করেন, ভারত ঐরূপ স্থবির বা জরাজীর্ণ নহে, পরন্তু নবযৌবন-সম্পন্না, ভাবী সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ এবং এই বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে, অতীতে যাহা ছিল তাহা অপেক্ষা মহত্তর এক বিকাশের পথে পদার্পণ করিয়াছে—ভারত সম্বন্ধে ইহাই ছিল তাহার দৃঢ় বিশ্বাস। আমার মনে পড়ে, একবার মাত্র তাহাকে কথার মধ্যে ঐ চিন্তা প্রকাশ করিতে শুনিয়াছি। এক গভীর শান্ত মুহূর্তে তিনি বলিয়াছেন, “বহু শতাব্দীর পর আবির্ভূত বলে নিজেকে অনুভব করছি। প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি, ভারত নবীন।” কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁহার প্রত্যেক কথায় এই উপলব্ধির পরিচয় পাওয়া যাইত, তাহার প্রতি গল্পে ইহার স্পন্দন অনুভূত হইত। যাহা কিছু ভারতীয়, তাহার জন্য কোন প্রকার কৈফিয়ৎ দেওয়া অথবা তাহার ত্রুটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা তিনি সর্বান্তঃকরণে ঘৃণা করিতেন। আর, যখন তিনি কোন মিথ্যা অপবাদ বা অবজ্ঞাসূচক সমালোচনার তীব্র প্রতিবাদ করিতেন, অথবা কিরূপ বিশ্বাস ও ভালবাসা লইয়া দেশসেবায় প্রবৃত্ত হওয়া উচিত, এই বিষয়ে অপরকে শিক্ষা দিতেন (অবশ্য ঐ বিশ্বাস ও ভালবাসা তাহার নিজের বিশ্বাস ও ভালবাসার ক্ষীণ প্রতিচ্ছায়া ব্যতীত আর কিছু হইতে পারিত না), তখন কতবারই না বোধ হইত, তাঁহার সন্ন্যাসীর পরিচ্ছদ খসিয়া গিয়াছে, এবং ভিতরকার যোদ্ধার বর্ম বাহির হইয়া পড়িয়াছে!
কিন্তু তাই বলিয়া কেহ যেন অনুমান না করেন যে, ঐ সকলের সহিত কতটা প্রলোভন যে আসিয়া যায়, সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন না। যখন তিনি সবেমাত্র শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন, সেই সময়ে তাহার গুরুদেব বলিয়াছিলেন, “সত্য বটে, তার মনের উপর অজ্ঞানের একটা পর্দা আছে। সেটুকু আমার বহ্মময়ী মা-ই বেখে দিয়েছেন, তার কাজ হবে বলে। কিন্তু ওটা ফিনফিনে কাগজের মতো পাতলা,
কোন মুহূর্তে ছিঁড়ে ফেলা যায়। যে ব্যক্তি গৃহপবিজন ত্যাগ করিয়াছে, সে যেন তাহাদের সম্বন্ধে সর্বপ্রকাব চিন্তা দমন করিবার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম কবে, সেইরূপ তিনিও বার বার দেশ ও ইতিহাস সম্পর্কিত সকল চিন্তা সংযত ও রুদ্ধ রাখি, প্রবাস পাইতেন, যাহাতে সকল দেশ ও সকল জাতির প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন, নিঃসম্বল, পবিব্রাজকমাত্র হইতে পাবেন, তাহাবই চেষ্টা কবিতেন! কাশ্মীরে অবস্থানকালে জীবনের এক মহান অভিজ্ঞতালাভের পর প্রত্যাবর্তন করিয়া ৩ন শিশুব নয় সরলভাবে বলেন, “আর এভাবে রাগ করা চলবে না। মা বললেন, যদিই বা ম্লেচ্ছ আমার মন্দিরে ঢুকে আমার মূর্তি অপবিত্র করে, তাতে তাব কি তুই আমাকে বক্ষা করিস, না আমি তোকে রক্ষা করি’?”
.
তাঁহার নিজের আদর্শ ছিলেন সিপাহী-বিদ্রোহকালের সেই সন্ন্যাসী, যিনি এক ইংরেজ সৈনিক কর্তৃক ছুরিকাঘাতে আহত হইয়া পনর বৎসরের মৌন ভঙ্গ করিয়া হত্যাকারীকে বলেন, “তুমিও তিনিই–তত্ত্বমসি।”
.
সর্বদা শ্রীরামকৃষ্ণের পদানুগ হইয়া তাঁহার প্রতি বিশ্বস্ত থাকিতেই তিনি চেষ্টা করিতেন। নিজের কোন বাণীর উল্লেখ তাহার নিকট অপরাধ বলিয়া বোধ হইত। ইহা ব্যতীত, তিনি বিশ্বাস করিতেন, আবেশ প্রবণতায় শক্তির অষণ অপব্যয় হয়, শক্তিকে সংযত করিলেই তাহা সঞ্চিত হইয়া কর্মরূপে প্রকাশ পায়। তথাপি, যথাসর্বস্ব দান করিয়া দিবার প্রবল বাসনা তাহাকে অভিভূত করিত, আবার উহা জানিবার পূর্বেই তিনি পুনরায় নিজের দেশ ও স্বজাতি সম্পর্কে আশা ও প্রেমপূর্ণ চিন্তাধারা চারিদিকে ছড়াইতে থাকিতেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হইত, তাহার অজ্ঞাতসারেই ঐ সকল চিন্তাবীজ উপযুক্ত ক্ষেত্রে পতিত হইয়াছে, এবং ইতিমধ্যেই ভারতের দূরদূরান্তর প্রান্তে তাহাদের অঙ্কুর দেখা দিয়াছে। মাতৃভূমির প্রতি ভক্তিতে যে সকল ব্যক্তি তাহার প্রতি সমর্পিতপ্রাণ, তাহারাই ঐ অঙ্কুর। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন কোন পুস্তকাদি পাঠ না করিয়াও বেদান্তের জীবন্ত বিগ্রহ ছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন তেমন জাতীয় জীবনের মূর্তিমান বিগ্রহ; কিন্তু ইহার বিচারমূলক ব্যাখ্যা সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানিতেন না। তাঁহার গুরুদেব সম্পর্কে তিনি যে উক্তি প্রয়োগ করিতেন, তাহা উল্লেখ করিয়াই বলিতে হয়, “তিনি শুধু সেই মহৎ জীবন যাপন করেই খুশি ছিলেন; তার ব্যাখ্যা অপরে খুঁজে বার করুক!”
————
(১) Lent–ভগবান ঈশার উপবাসের স্মরণার্থে খ্রীস্টানদিগের মধ্যে প্রচলিত চল্লিশ দিনব্যাপী উপবাস।–অনুঃ
(২) অনেকজাতি-সংসারং সন্ধ্যাবিসম্ অনিব্বিসং।
গহকারকং গবেষস্তো দুখা জাতি পুনপ্প নং।।
গহকারক দিট্ঠোসি পুন গেহং ন কাহসি।
সব্বা তে ফাসুকা ভগ্গা গৃহকুটং বিসংখিতং।
বিসংখারগতং চিত্তং তন্হানং খরমজ্ ঝগা।-