কিন্তু আচার্যদেবের প্রকৃতিতে আর একটি জিনিস বদ্ধমূল ছিল। তিনি নিজেই জানিতেন না, কিরূপে উহার সামঞ্জস্য করিবেন।উহা হইল তাহার স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশের দুর্গতির জন্য ক্ষোভ। ঐ সময়ে কয়েক বৎসর আমি প্রায় প্রত্যহ তাহাকে দেখিতে পাইতাম। দেখিতাম, ভারতের চিন্তা তাহার নিকট শ্বাসপ্রশ্বাসস্বরূপ। একথা সত্য, তিনি ছিলেন একেবারে মূল ধরিয়া কাজ করিবার পক্ষপাতী। ‘জাতীয়তা’ শব্দটিও তিনি ব্যবহার করিতেন না,অথবা ‘জাতিগঠনে’র যুগ বলিয়াও ঘোষণা করিতেন না। তিনি বলিতেন, তাঁহার কাজ হইল ‘মানুষ তৈরি করা’। কিন্তু প্রেমিকের হৃদয় লইয়া তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, আর তাঁহার আরাধ্য দেবতা ছিলেন জননী জন্মভূমি। একটি ঘণ্টাকে যদি চারিদিকের ভার সমান করিয়া নিপুণভাবে ঝুলাইয়া রাখা হয়, তাহা হইলে উহা যেমন কোন শব্দ দ্বারা আহত হইবামাত্র ঝকৃত ও স্পন্দিত হইয়া ওঠে, তাহার জন্মভূমিসংক্রান্ত সল ব্যাপারেই তাঁহার হৃদয়ও অনুরূপভাবে ঝকৃত হইয়া উঠিত। ভারতের চারিপ্রান্তের মধ্যে উখিত যে কোন কাতরধ্বনি তাঁহার হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হইত। ভারতের প্রত্যেকটি ভীতিসূচক ক্রন্দন, দুর্বলতাজনিত কম্পন, অপমানহেতু সঙ্কোচবােধ-তিনি জানিতেন এবং বুঝিতেন। ভারতের অন্যায় আচরণের তিনি ছিলেন কঠোর সমালোচক, তাহার সাংসারিক অনভিজ্ঞতার উপর খগহস্ত; কিন্তু সে কেবল ঐ দোষগুলিকে তিনি নিজেরই মনে করিতেন বলিয়া। পক্ষান্তরে, তাহার ন্যায় কেহই আবার ভারতের ভাবী মহিমার কল্পনায় অভিভূত হইতেন না। তাঁহার দৃষ্টিতে ভারতই ইংরেজী-সভ্যতার প্রসূতিরূপে প্রতিভাত হইত। কারণ, তিনি বলিতেন, আকবরের ভারতের তুলনায় এলিজাবেথের ইংলণ্ড কি ছিল? আর, ভারতের সম্পদ পশ্চাতে না থাকিলে ভিক্টোরিয়ার ইংলণ্ডেরই বা কি ঘটিত ? কোথায় থাকিত তাহার মার্জিত সভ্যতা ? তাহার অভিজ্ঞতাই বা কোথায় থাকিত ? তাহার মুখ হইতে স্বদেশের ধর্ম, ইতিহাস, ভূগোল ও জাতিতত্ত্ব অবিরল ধারায় নির্গত হইত। ভারতীয় প্রসঙ্গ সমগ্রভাবে অথবা উহার বিশদ বর্ণনা—উভয়ই তাহার নিকট সমান আনন্দের ছিল–অথবা তাহার শ্রোতৃবর্গের নিকট ঐরূপ বোধ হইত। এমনকি, সময়ে সময়ে এরূপও ঘটিত যে, যদি কেহ স্বামীজী পূর্বে যাহা বলিয়াছেন তাহা মনে রাখিতে ইচ্ছা করিতেন, তবে তাহার পক্ষে আরও অধিক শোনার সামর্থ্য থাকিত না। আবার কেহ যদি আনুপূর্বিকভাবে ঐসব মনে না রাখিতেন, তাহা হইলে তিনি দেখিতে পাইতেন, আরও দুই ঘণ্টাকাল ধরিয়া অবিশ্রান্তভাবে তিনি নারীজাতির উত্তরাধিকার বিষয়ক আইন, অথবা বিভিন্ন প্রদেশের জাতিগত আচার ব্যবহারের খুঁটিনাটি, কিংবা কোন জটিল অধ্যাত্মবাদ বা ধর্মতত্ত্বের বিশ্লেষণ করিয়া চলিয়াছেন।
তাহার এই সকল প্রসঙ্গের মধ্যে রাজপুতজাতির বীরত্ব, শিখদের বিশ্বাস, মারাঠাজাতির শৌর্য, সাধুগণের ঈশ্বরভক্তি এবং মহীয়সী নারীগণের পবিত্রতা ও নিষ্ঠা যেন পুনজীবন লাভ করিত। মুসলমানকেও তিনি এই প্রসঙ্গে বাদ পড়িতে দিতেন না। হুমায়ুন, শের শা, আকবর, সাজাহান—ইহাদের প্রত্যেকের এবং আরও শত ব্যক্তির নাম তিনি কোন-না-কোন দিন, যাহাদের নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠা উজ্জ্বল করিয়া রাখিয়াছে তাহাদের আবৃত্তি প্রসঙ্গে যথাস্থানে উল্লেখ করিতেন। এই হয়তো তিনি আকবরের সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে তানসেন রচিত গানটি, যাহা আজ পর্যন্ত দিল্লীর পথে পথে গীত হইয়া থাকে, তানসেনেরই সুর-লয় সহযোগে আমাদের গাহিয়া শুনাইলেন; আবার আমাদের বুঝাইয়া দিলেন যে, মোগলবংশে বিবাহিতা নারীগণ বিধবা হইলে কখনও পুনরায় বিবাহ করিতেন না। পরন্তু হিন্দুনারীর নয় পূজাপাটে মগ্ন থাকিয়াই জীবনের নিঃসঙ্গ বৎসরগুলি অতিবাহিত করিতেন। আবার অন্য এক সময়ে তিনি সেই মহান জাতীয়গৌরব, প্রতিভাশালী আকবরের কথা বলিতেন—যিনি বিধান দিয়াছিলেন যে, ভারতীয় সম্রাটগণের জন্ম হওয়া উচিত মুসলমান পিতা ও হিন্দু মাতা হইতে। এক সময়ে তিনি আমাদের নিকট সিরাজুদ্দৌলার উজ্জ্বল কিন্তু গ্ৰহবৈগুণ্যে ক্ষণস্থায়ী রাজত্বের বর্ণনা করেন। রুদ্ধশ্বাসে আমরা শুনিলাম, কিরূপে সেই হিন্দু সেনাপতি মোহনলাল পলাশী প্রান্তরে বিশ্বাসঘাতকতাপূর্বক প্রদত্ত এক আদেশ শ্রবণ করিয়া আক্ষেপ সহকারে বলিয়া উঠেন, “তাহলে আজকের যুদ্ধে জয়ের আশা নেই!” এবং তারপর অশ্বসহ গঙ্গায় ঝাপ দেন। আর সিরাজের সাধ্বী স্ত্রীর কথাও আমরা শুনিলাম, যিনি বৈধব্যের শ্বেতবাস পরিধান করিয়া আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অবস্থানপূর্বক দীর্ঘদিন ধরিয়া বৎসরের পর বৎসর পরলোকগত স্বামীর কবরের উপর দীপ জ্বালাইয়া দিতেন। তাহার মুখে ঐ সকল কথা শুনিবার সময় দৃশ্যগুলি যেন প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিত।
কখন কখনও কথাবার্তা অপেক্ষাকৃত কৌতুক পরিহাসময় হইত। সামান্য ঘটনা উপলক্ষেই প্রসঙ্গ উঠিত। কোন মিষ্টান্নপ্রাপ্তি, অথবা মৃগনাভি বা জাফরাণের মতো দুর্লভ বস্তুলাভ, অথবা ইহা অপেক্ষাও সামান্যতম ঘটনাই উহা আরম্ভ করিবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। একবার তিনি আমাদের কাছে গল্প করেন যে, যখন তিনি পাশ্চাত্যে অবস্থান করিতেছিলেন, তখন একদিন সন্ধ্যায় ভারতের কোন গ্রামের বাহিরে কিছু দূরে দাঁড়াইয়া ক্রীড়ারত বালকবালিকাদের তন্দ্রাজড়িত কলরব, সন্ধ্যারতির কাসরঘণ্টা, রাখাল বালকগণের চিৎকার এবং স্বল্পকালস্থায়ী গোধূলির আধ-অন্ধকারে শ্রুত অস্ফুট কণ্ঠস্বর—এইসব শুনিবার জন্য তিনি কতই না ব্যাকুল হইয়াছিলেন! বাংলাদেশে শৈশব হইতেশ্রুত সেই আষাঢ় মাসের বৃষ্টির শব্দশুনিয়া স্বদেশের জন্য তাহার কতই না মন কেমন করিয়াছিল! বৃষ্টি, জলপ্রপাত, অথবা সমুদ্রের জলের শব্দ তাঁহার নিকট কত বিস্ময়কর বোধ হইত! একবার তিনি দেখিয়াছিলেন, জনৈকা জননী এক পাথর হইতে অপর পাথরে পা দিয়া পার্বত্য নদী পার হইবার সময় এক একবার মুখ ফিরাইয়া পৃষ্ঠস্থিত শিশুটিকে খেলা দিতেছেন ও আদর ওরিতেছেন। এই দৃশ্যটি তাহার সর্বাপেক্ষা সুন্দর বলিয়া মনে পড়িত। তাহার চক্ষে হিমালয়ের গভীর অরণ্যে পর্বতপৃষ্ঠে শয়ন করিয়া নিম্নে স্রোতস্বিনীর অবিরাম ‘হর ‘হর’ ‘মুক্ত’ ‘মুক্ত’ ধ্বনি শ্রবণ করিতে করিতে শরীর ত্যাগ করাই আদর্শ মৃত্যু।