তাহার দৃষ্টি ছিল যেমন ব্যাপক, তেমনি গভীর। ভারতের উন্নতি প্রবর্তনের উপাদানগুলিকে তিনি বিশ্লেষণ করিয়া দেখিয়াছিলেন। ভারতকে এক অভিনব আজ্ঞাবহতার আদর্শ শিক্ষা করিতে হইবে। সুতরাং মঠটি সংঘবদ্ধতার ভিত্তির উপর স্থাপিত হইল, যাহা ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রচলিত সর্বপ্রকার আদর্শের প্রতিকূল। হাজার রকমের নূতন ও নিত্যব্যবহার্য জিনিসকে ধীরে ধীরে আত্মসাৎ করিয়া লইতে হইবে। অতএব যদিও তিনি নিজে অত্যন্ত সাদাসিধাভাবে থাকিতে অভ্যস্ত ছিলেন, দুই-তিনটি ঘর আসবাবপত্রে সাজানো হইল। মাটি-খোঁড়া, বাগান করা, দাঁড়টানা, ব্যায়াম ও পশুপালন প্রভৃতি ক্রমে ক্রমে তাহার নিজের এবং নবীন ব্রহ্মচারিগণের জীবনের অঙ্গরূপে পরিণত হইল। কূপখনন অথবা পাউরুটি প্রস্তুত করার সমস্যা সমাধানের জন্য পূর্ণ উৎসাহের সহিত তিনি দীর্ঘদিন ধরিয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে যোগদান করিতেন। তাহার জীবনের শেষ চড়কপূজার দিনে একটি ব্যায়াম সমিতি মঠে ক্রীড়া প্রদর্শন ও পুরস্কার লাভের জন্য আসে। ঐ উপলক্ষে স্বামীজী বলেন, তাহার ইচ্ছা এই হিন্দুপাৰ্বণটি (খ্রীস্টানদের লেন্ট স্থানীয়)(১) অতঃপর বিশেষ বিশেষ ব্যায়াম প্রদর্শন দ্বারা যাপন করা উচিত। তাহার মতে, যে শক্তি এতদিন ধরিয়া শরীর-নিগ্রহে ব্যয়িত হইয়া আসিয়াছে, অতঃপর বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উহাকে পেশীসমূহের উন্নতিকল্পে নিযুক্ত করিলে যথার্থ সদ্ব্যবহার হইবে।
পাশ্চাত্যমনের নিকট ইহা অনায়াসেই প্রতীয়মান হইবে যে, স্বামীজীর জীবনে ইহা অপেক্ষা প্রশংসাহ আর কিছুই হইতে পারিত না। বহুপূর্বে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উচ্চতম আদর্শের অনুধাবন ও উহাদের আদান-প্রদান রামকৃষ্ণ মিশনের বিশেষ ব্রত (mission) বলিয়া নির্দেশ করেন। নিশ্চিতভাবে তিনি নিজের শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানের সামর্থ্য দ্বারা প্রমাণ করেন যে, ঐরূপ ধরনের কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার ক্ষমতা তাহার আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে ইহাও অনিবার্য ছিল যে, সময়ে সময়ে তিনি নিজেই নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিবার মমর্যাতনা ভোগ করিবেন। হিন্দুর ধর্মজীবনের আদর্শ হইল, যে শুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব, সদাসাক্ষিস্বরূপ, অচল-অটল অস্পর্শ, পরম ব্যোমে অবস্থিত দেবাদিদেব—এই মর্তলোক হারই প্রতিফলিত প্রতিচ্ছায়া। এই ধারণা র্তাহাদের মনে এত সুস্পষ্ট ও দৃঢ় বদ্ধমূল যে, মানসিক দ্বন্দ্বরূপ বিপুল ক্ষতি স্বীকার করিয়াই কেবল উহাকে নূতন পথে প্রবর্তিত করা সম্ভব। কোন নূতন আদর্শ প্রবর্তন করিতে গিয়া ভাস্করকে যে কি মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করিতে হয়, তাহা কেহ অনুভব করিয়াছেন কি? তাহার কার্য সাধনের জন্য যে ভাবপ্রবণতা, সূক্ষ্ম অনুভূতিবোধ প্রয়োজন, যে নৈতিক উচ্চাদর্শ তাঁহার হাতের বাটালিস্বরূপ, অবসর মুহূর্তে তাহারাই সন্দেহ ও দায়িত্ববোধের আতঙ্ক হইয়া তাহাকে চাপিয়া ধরে। সুতরাং এরূপ ব্যক্তির নিকট, যাহাদের জীবন অতি কঠোর কিন্তু জনসাধারণের নৈতিকবোধের দ্বারা অনুকরণের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত ও প্রমাণিত হইয়াছে, তাহাদের জীবনও কত সুখময় বলিয়া মনে হয়! বহু অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে আমি লক্ষ্য করিয়াছি, উহারা যেন দুইটি সূতায় বোনা—একটি সূতা আমাদের নিজেদের নির্বাচিত, অপরটি, আমরা সহ্য করিয়া যাই। কিন্তু এক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব দুই পৃথক আদর্শের মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাতের আকার ধারণ করে। ইহাদের প্রত্যেকটিই নিজের জগতে সর্বোচ্চ, আবার প্রতিপক্ষ মতাবলম্বীর নিকট মহাপাপ বলিয়া গণ্য।
.
মধ্যে মধ্যে কোন সঙ্গীর নিকট অন্যমনস্কভাবে তিনি দু-একটা কথা বলিয়া ফেলিতেন এবং তাহাতেই অন্তরের এই সংঘর্ষ ধরা পড়িয়া যাইত। একদিন খেতড়িরাজের সহিত অশ্বারোহণে যাইবার সময় তিনি দেখিতে পান, রাজার হাত কাটিয়া গিয়া প্রচুর রক্ত পড়িতেছে; এবং জানিতে পারেন যে, তাঁহার যাইবার রাস্তা হইতে একটি কাটা ডাল সরাইতে গিয়াই রাজার হাত ঐরূপভাবে কাটিয়া যায়। স্বামীজী মৃদু ভৎসনা করিলে রাজপুত ব্যাপারটি হাসিয়া উড়াইয়া দিয়া বলেন, “স্বামীজী, আমরা কি চিরকালই ধর্মের রক্ষাকর্তা নই?” গল্পটি বলিয়া স্বামীজী বলিলেন, “দেখ, তারপর আমি তাকে বলতে যাচ্ছিলাম, একজন সন্ন্যাসীকে আপনাদের এত সম্মান প্রদর্শন করা উচিত নয়’, এমন সময়ে হঠাৎ আমার মনে হলো, হয়তো তারা ঠিকই করেছেন। কে জানে! হয়তো আমিও তোমাদের এই আধুনিক সভ্যতার ক্ষণস্থায়ী অত্যুজ্জ্বল ছটার মধ্যে পড়ে গেছি!” একজন তাহাকে বলিয়াছিলেন, “আমার মতে, যিনি চারদিকে জ্ঞান বিস্তার করতে করতে যদৃচ্ছা ভ্রমণ করতেন এবং একস্থান থেকে স্থানান্তরে যাবার সময় নাম পরিবর্তন করতেন,সেই ‘রমতা সাধু’ই বহু চিন্তা ও কার্যভারপীড়িত বেলুড় মঠের মহন্ত অপেক্ষা বড় ছিলেন।” উত্তরে তিনি শুধু বলিয়াছিলেন, “আমি জড়িয়ে পড়েছি।” আমেরিকার জনৈকা মহিলা যে গল্পটি বলেন, তাহাও আমার মনে আছে। তার স্বামী এই অদ্ভুত অতিথিকে বুঝাইয়া বলেন যে, তাহাকে শিকাগো যাইতে হইবে, এবং তাহার মুখে ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা শুনিবার জন্য তাঁহাকে প্রয়োজনীয় অর্থ সানন্দে দেওয়া হইবে। ঐ মুহূর্তে তাহার মুখের অবস্থা এরূপ হইয়াছিল যে, মনে করিতেও কষ্ট বোধ হয়। মহিলাটি বলিতেন, “এই কথায় মনে হলো, তার শরীরের মধ্যে যেন কোন কিছু ছিঁড়ে গেল, যা আর কখনো জোড়া লাগবার নয়।” পাশ্চাত্যে একদিন তিনি মীরাবাঈ-এর গল্প বলিতেছিলেন। উচ্চদরের সাধিকা মীরাবাঈ একসময়ে চিতোরের রানী ছিলেন। তাহার স্বামী তাহাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে চাহিয়াছিলেন, শুধু তাহাকে রাজ অন্তঃপুরে থাকিতে হইবে। কিন্তু তাহাকে বাধিয়া রাখা গেল না। শ্রোতৃবর্গের মধ্যে একজন বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করেন, “কিন্তু কেন তিনি ঐভাবে থাকবেন না?” স্বামীজী প্রত্যুত্তরে বলিলেন, “কেনই বা থাকবেন? তিনি কি জগতের এই পচা পাকের মধ্যে পড়ে থাকবেন?” শ্রোতাও সহসা বুঝিতে পারিলেন যে, বহুপ্রকার অবান্তর সম্পর্ক এবং ঘাত-প্রতিঘাত সহ সমগ্র সামাজিক জীবন স্বামীজীর নিকট অসহ্য বন্ধন ও তীব্র যন্ত্রণাস্বরূপ বলিয়া মনে হয়। এইরূপে, ধর্মাচার্য হিসাবে স্বামীজী রৌদ্রোজ্জ্বল অনাবিলতা ও শিশুসুলভ শান্তি দ্বারা পরিবৃত থাকিলেও তাহার স্বদেশে আসিয়া সঙ্গে সঙ্গে দেখিতে পাইলাম, আর এক দৃষ্টিভঙ্গি হইতে দেখিলে তিনি সম্পূর্ণ মানবভাবাপন্ন। আর, এক্ষেত্রে যদিও তাহার সকল প্রচেষ্টার ফল আমাদের অনেকের অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর অথবা অধিকতর স্থায়ী হইত, কিন্তু ঐজন্য তাহাকেও ঠিক আমাদেবই মতো অন্ধকার ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়া দীর্ঘকাল পরিশ্রম স্বীকার করিতে হইত। কদাচিৎ আলোক দেখা যাইত। প্রায়ই তিনি ব্যর্থতার হতাশা হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে পারিতেন না। যে দেহযন্ত্রসহায়ে তাহাকে কার্য করিতে হইতেছে এবং যাহাদের তিনি মানুষ করিয়া তুলিতে চাহিতেছেন, উভয়েরই সীমিত ক্ষমতা প্রায়ই তাহার চিত্তে বিরক্তি উৎপাদন করিত—এবং এইভাবে বৎসরের পর বৎসর অতিবাহিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করিবার অথবা অজ্ঞাত কোন বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলিবার সাহসও তাহার ক্রমশঃ কমিয়া যাইতে লাগিল। একবার তিনি বলিয়াছিলেন, “সবদিক ভেবে দেখলে, সত্যই আমরা কি জানি? মা-ই সব জিনিস নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করছেন। আমরা শুধু আনাড়ির মতো হাতড়ে বেড়াচ্ছি।” সম্ভবতঃ মহাপুরুষগণের জীবনের এই অংশটি তাহাদের জীবনচরিতকারেরা বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করিতে চাহেন নাই। তথাপি শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে জগদীশ্বরীর প্রতি তাহার নিম্নোক্ত অনুযোগপূর্ণ বাক্য হইতে আমরা ইহার কিছুটা আভাস পাই, “মা, এ কি করলি? আমার সব মনটা যে এই ছেলেগুলোর উপর পড়ছে মা!” আর চতুর্বিংশতি শতাব্দী অতীত হইবার পরেও আর এক জন ধর্মাচার্যের চিত্ততটে ‘ধম্মপদের’ একাদশ অধ্যায়ের অনুরূপ ঝঞ্ঝার তরঙ্গাঘাতের চিহ্ন দেখা যায়।(২)