কিন্তু এই সংঘর্ষ বাস্তবিক কিসের জন্য? উহা কি যাহাকে তিনি ‘মনোবুদ্ধির অগোচর বলিতেন, তাহাকেই সাধারণ জীবনে লইয়া আসার প্রাণান্তকর চেষ্টার ফল? একথা নিঃসন্দেহ—যে-কার্যের জন্য তাহার জন্ম, তাহা এতই কঠিন যে, কেবল বীরের পক্ষেই তাহা সাধ্য। প্রচলিত আদর্শসমূহের নিরাপদ পস্থা পরিত্যাগ করিয়া, পুরাতন উপায়ের সহিত আপাত বিরোধশীল কোন প্রণালী অবলম্বন দ্বারা নূতন কোন আদর্শকে কার্যে পরিণত করিতে যাওয়ার মতো দুরূহ কার্য আর নাই। তাহার বাল্যকালে একবার শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্র’কে (স্বামীজী তখন ঐ নামেই অভিহিত হইতেন) জিজ্ঞাসা করেন, “তোমার জীবনের সর্বোচ্চ অভিলাষ কী?” তিনিও তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন, “সর্বদা সমাধিস্থ থাকা।” শুনা যায়, এই কথায় তাহার গুরুদেব ঈষৎ হাসিয়া উত্তরে শুধু বলেন, “বাবা, আমি মনে করেছিলাম, তুমি আরও কোন বড় অধিকার লাভের জন্য জন্মেছ।” আমরা ধরিয়া লইতে পারি যে, উক্ত মুহূর্তটি শিষ্যের জীবনে এক নূতন যুগের সূচনা করিয়াছিল। একথা নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে, বিশেষতঃ তাহার স্বদেশবাসীর প্রতি শ্রেষ্ঠ দানস্বরূপ শেষের সাড়ে পাঁচ বৎসর তিনি নিষ্কাম কর্ম অথবা পরার্থে কর্মই ধর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ বিকাশ বলিয়া প্রচার করিয়া গিয়াছেন; এবং ভারতের ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম এক সন্ন্যাসী-সম্প্রদায় নিজেদের সঙঘবদ্ধ করেন, যাহার মুখ্য উদ্দেশ্য হইল, নূতন ধরনের সামাজিক কর্তব্যের প্রবর্তন ও তাহার বিকাশ সাধন। ইউরোপে, যেখানে প্রাচ্যের তুলনায় প্রত্যক্ষ ধর্মানুভূতি লাভ অতি বিরল, এবং প্রাচ্য অপেক্ষা লোকের উহা বুঝিবার ক্ষমতা কম, সেখানে সাধারণের চক্ষে এইরূপ পরার্থে কর্ম পুণ্যকর্ম বলিয়াই বিবেচিত হয়। কিন্তু ভারতে সন্ন্যাসিসঙ্ঘের নিকট লোকে প্রধানতঃ এই আশা পোষণ করে যে, ঐ সঙেঘ মহাপুরুষগণের আবির্ভাব ঘটিবে। আর যে সন্ন্যাসী, পরম্পরাগত সমাধিমূলক জীবনের মহান ভাবধারা বজায় রাখিবার জন্য নিজেকে নিযুক্ত রাখিবার পরিবর্তে সমাজকে উন্নত করিবার প্রয়াস পান, তাহার মূল্য প্রাচীনকালের লোকেরা সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতেন না।
স্বামীজীর পরিকল্পনায় কিন্তু বোধ হইল, যে-সকল সাধন-প্রণালী পূর্বে আধ্যাত্মিক শিক্ষায় স্থানলাভ করিত, এই ধরনের সৎকার্যই যেন তাহাদের স্থান অধিকার করিয়াছে। অদ্বৈতবাদীর অথবা ভারতীয় বেদান্তদর্শনের চরমপন্থীর নিকট ‘একমেবাদ্বিতীয়’ অবস্থালাভই আদর্শ। এই অবস্থায় যিনি উপনীত হইয়াছেন, তাহার পক্ষে উপাসনা অসম্ভব, কারণ, তাহার নিকট উপাস্য বা উপাসক কেহই নাই; এবং সকল কর্মই সেই সর্বব্যাপী একত্বের তুল্য বিকাশ বলিয়া কোন কর্মকেই বিশেষভাবে উপাসনার যোগ্য বলিয়া পৃথক করা যায় না। তাহার নিকট উপাস্য, উপাসক ও উপাসনা সবই এক; তথাপি অদ্বৈতবাদীও স্বীকার করেন যে, ভগবদ্গুণবর্ণনা ও প্রার্থনা দ্বারা সাধকের চিত্তশুদ্ধি হয়। কারণ, স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, অন্য কোন উপায় অপেক্ষা ঈশ্বর-চিন্তা দ্বারা অহংজ্ঞান সহজে দমন করা যায়। এই কারণে, উপাসনা উচ্চতর আধ্যাত্মিক বিকাশের প্রথম সোপান বলিয়া বিবেচিত হয়। কিন্তু স্বামীজী কর্ম বা মানবসেবাকেও অনুরূপ স্থান দিতেন বলিয়া বোধ হয়। চিত্তশুদ্ধির অর্থ–স্বার্থপরতা নিঃশেষে দগ্ধ হইয়া যাওয়া। উপাসনা ব্যবহার করা বা কাজে লাগানোর বিপরীত। কিন্তু সেবা বা দানও ইহার বিপরীত ভাব। এইরূপে, তিনি অপরকে সাহায্যদান ব্যাপারটি পবিত্রতামণ্ডিত তো করিলেনই, অধিকন্তু মানবের নামও পবিত্র করিলেন। এমনকি, আমি একজন শিষ্যের কথা জানি, সঙ্ঘ-জীবনের প্রথমদিকে যাহার হৃদয় ভক্তিভাবে এরূপ পূর্ণ হইয়াছিল যে, তিনি কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত লোকদের যন্ত্রণা উপশম করিবার জন্য তাহাদের ক্ষতস্থান চুষিতেন। পীড়িতের শুশ্রুষা ও দরিদ্রকে আহার্যদান বস্তুতঃ প্রথম হইতেই শ্রীরামকৃষ্ণ সন্তানগণের স্বাভাবিক কার্য ছিল। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিবার পরে ঐ কার্যগুলি বিপুল আকার ধারণ করে। অতঃপর ঐসব কার্য জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হইত। দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে সাহায্য দিবার জন্য, কোন শহরে স্বাস্থ্যবিধি পালন সম্বন্ধে নির্দেশ দিবার জন্য, অথবা কোন তীর্থস্থানে পাড়িত ও মুমূর্ষুগণকে সেবা-শুশ্রুষা করিবার জন্য মঠ হইতে লোক পাঠানো হইতে লাগিল। একজন মুর্শিদাবাদে একটি অনাথাশ্রম ও শিল্প বিদ্যালয় খোলেন; অপর একজন দাক্ষিণাত্যে একটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। স্বামীজী বলিতেন, ইহারা হইল ধর্মবাহিনীর জঙ্গল-সাফ করা ও রাস্তা-তৈয়ারি-করার দল (sappers and miners)। তাহার পরিকল্পনা কিন্তু ইহা অপেক্ষা অনেক ব্যাপকতর ছিল। ভারতীয় নারীগণের শিক্ষাবিধান এবং দেশের মধ্যে শিল্পশিক্ষা বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা তাহার সমগ্র মনপ্রাণ অধিকার করিয়াছিল। পরার্থে কর্ম করিবার প্রবৃত্তি যে কতগুণ দুঃখবৃদ্ধি করে, তাহা ভুক্তভোগীরাই বুঝিতে পারেন। যে ‘ত্রিশকোটি টাকা’ পাইলে তিনি ভারতবর্ষকে তাহার পায়ের উপর দাঁড় করাইয়া দিতে পারিতেন বলিতেন, সেই টাকা হাতে না আসায় সত্যসত্যই কি তাহার জীবনের উদ্দেশ্য বিফল হইয়াছিল? সময়ে সময়ে তাহার ঐরূপই মনে হইত। অথবা উচ্চতর কোন বিধান অলক্ষ্যে কাজ করিতেছিল—যাহার ফলে একজীবনে যে সাফল্য লাভের সম্ভাবনা, ভবিষ্যতে তাহা অপেক্ষা বহুগুণ সফলতা অর্জিত হইতে পারে?