তাঁহার সম্মুখে সর্বদা যেসব কার্য আসিয়া উপস্থিত হইত, তাহাদের খাতিরে ১৯০২ খ্রীস্টাব্দের বসন্তকালে স্বামীজী একবার তাহার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের বিশেষ চেষ্টা করেন, এমনকি, তিনি কবিরাজী চিকিৎসা শুরু করেন, যাহার জন্য এপ্রিল, মে ও জুন এই তিনমাস ধরিয়া তিনি একবিন্দু ঠাণ্ডা জল পান করিতে পারেন নাই। ইহার ফলে শরীরের কতদুর উপকার হইয়াছিল বলা যায় না; তবে ঐকঠোর পরীক্ষার মধ্য দিয়া যাইবার সময় তাহার ইচ্ছাশক্তির বল অব্যাহত আছে দেখিয়া তিনি অতিশয় প্রীত হন।
জুন মাস শেষ হইলে কিন্তু তিনি বিলক্ষণ বুঝিতে পারিলেন, অন্তিমকাল নিকটবর্তী। দেহত্যাগের পূর্ব বুধবারে তিনি নিকটস্থ একজনকে বলেন, “আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। একটা মহা তপস্যা ও ধ্যানের ভাব আমাকে আচ্ছন্ন করেছে, এবং আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।”
আর আমরা যদিও স্বপ্নেও ভাবি নাই যে, অন্ততঃ তিন-চার বৎসরের পূর্বে তিনি আমাদের ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন, তথাপি জানিলাম, কথাগুলি সত্য। জগতের খবরাখবর শুনিয়া তিনি নামমাত্র উত্তর দিতেন। সাময়িক কোন সমস্যা সম্বন্ধে আর তাহার মতামত জিজ্ঞাসা করা অনর্থক। শান্তভাবে তিনি বলিতেন, “তোমার কথা ঠিক হতে পারে, কিন্তু এসব ব্যাপার আমি আর আলোচনা করতে পারি না। আমি মৃত্যুর দিকে চলেছি।”
কাশ্মীরে অবস্থানকালে একবার পীড়া হইতে আরোগ্যলাভের পর তাহাকে দুইখণ্ড পাথর উঠাইয়া বলিতে শুনিয়াছিলাম, “যখনই মৃত্যু কাছে আসে, আমার সব দুর্বলতা চলে যায়। তখন আমার ভয় বা সন্দেহ, বা বাহ্য জগতের চিন্তা, এ-সব কিছুই থাকে না। আমি শুধু নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করতে ব্যস্ত থাকি। তখন আমি এইরকম শক্ত হয়ে যাই”—তিনি দুই হাতে পাথর দুইখানিকে পরস্পর ঠুকিলেন—”কারণ, আমি শ্রীভগবানের পাদস্পর্শ করেছি।”
নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি সম্পর্কে তিনি কদাচিৎ উল্লেখ করিতেন, সেজন্য ঐ কথাগুলি আমরা কখনও বিস্মৃত হই নাই। আবার সেই ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মকালেই অমরনাথ গুহা হইতে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি হাসিতে হাসিতে বলিয়াছিলেন যে, তিনি অমরনাথের নিকট ইচ্ছামৃত্যুবর লাভ করিয়াছেন। এই বরলাভের ফলে মৃত্যু তাহাকে সহসা আক্রমণ করিবে না, ইহা যেন নিশ্চিত ছিল এবং উহার সহিত ও নিজেকে জানতে পারলে আর এক মুহূর্তও দেহ রাখবে
শ্রীরামকৃষ্ণের এই ভবিষ্যদ্বাণীর এত চমৎকার ঐক্য ঘটিয়াছিল যে, এ সম্পর্কে সকল চিন্তা আমাদের মন হইতে এককালে দূর করিয়া দিয়াছিলাম। এমনকি, এই সময়ে তাহার নিজ মুখের গম্ভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলিও আমাদের উপরি-উক্ত কথা মনে করাইয়া দিতে পারে নাই।
অধিকন্তু তাহার যৌবনকালের সেই অদ্ভুত নির্বিকল্প সমাধিলাভের কথাও আমাদের মনে ছিল। ইহাও জানিতাম, উক্ত সমাধি-অন্তে তাহার গুরুদেব বলিয়াছিলেন, “এই তোমার আম। আমি এটা বাক্সে চাবি দিয়ে রাখলাম। তোমার কাজ শেষ হলে আবার তুমি এটা আস্বাদ করতে পারবে।”
যে সাধুআমাকে এই গল্পটি বলেন, তিনি ঐ প্রসঙ্গে আরও বলিয়াছিলেন, “আমরা এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারি। সময় এগিয়ে এলে আমরা ঠিক জানতে পারব। কারণ, তিনি আমাদের বলতেন যে, পুনরায় তিনি তার আম আস্বাদন করেছেন।”
ঐ সময়ের কথা স্মরণ করিয়া এখন কতই আশ্চর্য মনে হয় যে, কতভাবেই না প্রত্যাশিত ইঙ্গিত আসিয়াছিল। কিন্তু তখন আমরা শুনিয়াও শুনিতে চাহি নাই, বুঝিয়াও বুঝিতে পারি নাই।
বস্তুতঃ সর্ববিধ দুর্বলতা ও আসক্তি দূরে পরিহার করিলেও একটি বিষয়ে যেন ব্যতিক্রম ছিল। যাহা চিরকাল তাহার নিকট প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর ছিল, তাহা এখনও তাঁহার হৃদয়তন্ত্রী স্পর্শ করিতে পারিত। দেহান্তের অব্যবহিত পূর্বে রবিবারে জনৈক শিষ্যকে তিনি বলেন,”দেখ,এই-সব কাজই আমার চিরকাল দুর্বলতার জায়গা! যখন ভাবি, এ-সব নষ্ট হয়ে যাবে, তখন একেবারে হতাশ হয়ে পড়ি।”
ঐ সপ্তাহের বুধবারে—সেদিন একাদশী—স্বামীজী সম্পূর্ণ উপবাস করিয়াছিলেন, কিন্তু পূর্বোক্ত শিষ্যকে প্রাতঃকালীন আহার্য স্বহস্তেপরিবেশন করিবেন বলিয়া জেদ করিতে লাগিলেন। আহারের মধ্যে ছিল কাঠালের বিচিসিদ্ধ, আলুসিদ্ধ, সাদা ভাত এবং বরফ দিয়া ঠাণ্ডা করা দুধ। প্রত্যেকটি জিনিস পরিবেশন করিবার সময় সেগুলি সম্বন্ধে স্বামীজী হাস্য-পরিহাস করিতে লাগিলেন। সর্বশেষ আহারান্তে তিনি নিজেই শিষ্যের হাতে জল ঢালিয়া দিলেন এবং তোয়ালে দিয়া হাত মুছাইয়া দিলেন।
স্বভাবতই শিষ্য প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, “স্বামীজী, এ-সব আমারই আপনার জন্য করা উচিত, আপনার আমার জন্য নয়।”
কিন্তু তাহার উত্তর ছিল অতি বিস্ময়জনক গাম্ভীর্যপূর্ণ—”ঈশা তার শিষ্যদের প। ধুইয়ে দিয়েছিলেন।” শিষ্যের মুখে উত্তর আসিতেছিল, “কিন্তু সে তো শেষ সময়ে!” কথাগুলি যেন কিরূপে বাধিয়া গিয়া অনুচ্চারিত রহিয়া গেল। ভালই হইয়াছিল। কারণ, এখানেও শেষ সময় আসিয়া গিয়াছিল।
এই কয়দিন স্বামীজীর কথাবার্তা ও চালচলনে কোন বিষাদগম্ভীর ভাব ছিল না। পাছে তিনি অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করেন—এই আশঙ্কায় ইচ্ছাপূর্বক কথাবার্তা যতদূর সম্ভব লঘু বিষয়ে নিবদ্ধ রাখা হইত। তাঁহার পালিত পশু, বাগান, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গ্রন্থ, দূরদেশে অবস্থিত বন্ধুবর্গ—এই সকল প্রসঙ্গ আলোচিত হইত। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমরা তাহার মধ্যে এক জ্যোতির্ময় সত্তার আবির্ভাব অনুভব করিতাম, বোধ হইত তাহার স্থূল দেহ যেন উহার একটি ছায়া বা প্রতীক মাত্ৰ তথাপি কেহই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন নাই, এত শীঘ্র শেষ সময় আসিয়া যাইবে—বিশেষতঃ—সেই ৪ জুলাই, শুক্রবারে—কারণ, সেদিন বহুবৎসর ধরিয়া তিনি যেমন ছিলেন, তাহার অপেক্ষা তাহাকে অধিকতর সুস্থ ও সবল দেখাইতেছিল, এবং সেজন্যই ঐ দিনটিকে মনে হইয়াছিল আনন্দময়।