অপরদিকে তাহার স্বদেশীগণকে সর্বদা ‘নেটিভ’ বলিয়া অভিহিত হইতে শুনিয়া এবং নিজেকে ঐ সময়ে তাহাদের পরিবর্তে বরং বিদেশীর সহিত সমপর্যায়ভুক্ত হইতে দেখিয়া তিনি মর্মাহত হন। বস্তুতঃ এই দিক দিয়া তিনি যেন মিশর অপেক্ষা কষ্টান্টিনোপল বিশেষ উপভোগ করেন, কারণ জীবনের শেষভাগে তিনি বারংবার এক বৃদ্ধ তুর্কীর উল্লেখ করিতেন। ঐ ব্যক্তির একটি হোটেল ছিল এবং সে এই বিদেশী যাত্রিদলকে—যাহাদের মধ্যে একজন ছিল ভারত হইতে আগত—কোনরূপ পয়সা না লইয়া আহার করাইবার জন্য বিশেষ জি প্রকাশ করিয়াছিল। সত্য সত্যই আধুনিক বিষয়বুদ্ধিবর্জিত প্রাচ্যবাসীর নিকষ্ট সকল পর্যটকই তীর্থযাত্রী, এবং সকল তীর্থযাত্রীই অতিথিরূপে গণ্য।
পরবর্তী শীতকালে তিনি ঢাকায় গমন করেন এবং বিরাট দলবলসহ ব্ৰহ্মপুত্র নদ দিয়া আসামের একটি তীর্থে স্নান করিতে যান। যাহারা তাহার অতি নিকটে থাকিতেন, তাহারাই কেবল জানিতেন, স্বামীজীর স্বাস্থ্য এই সময়ে কত দ্রুত ভাঙিয়া পড়িতেছিল। আমরা দুরে ছিলাম বলিয়া ঐ সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহ হয় নাই। ১৯০১ খ্রীস্টাব্দের গ্রীষ্মকাল তিনি বেড়ে যাপন করেন এই আশা লইয়া যে, বাল্যকালে বৃষ্টিপড়ার যে শব্দ শুনিতেন, পুনরায় উহা শুনিবেন। আবার যখন শীত আসিল, তিনি এত অসুস্থ হইয়া পড়িলেন যে, তাহাকে শয্যা গ্রহণ করিতে হইল।
তথাপি ১৯০২ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আরও একটি তীর্থযাত্রা সম্পন্ন করেন। প্রথমে বুদ্ধগয়া এবং তারপর বারাণসী। উহা যেন তাহার সকল পর্যটনের উপযুক্ত পরিসমাপ্তি। শেষ জন্মদিনের প্রভাতে তিনি বুদ্ধগয়ায় উপনীত হন। মহন্তজীর আদর-আপ্যায়নের কথা বলিয়া শেষ করা যায় না। এখানে এবং পরে কাশীতেও নিষ্ঠাবান হিন্দুসম্প্রদায়ের নিকট তিনি এত অধিক পরিমাণে সমাদর ও বিশ্বাস অর্জন করেন যে, লোকের হৃদয় তিনি কতটা অধিকার করিয়াছেন বুঝিতে পারিয়া নিজেই বিস্মিত হন।
বুদ্ধগয়া এখন যেমন তাহার শেষ তীর্থযাত্রা, তেমন উহাই ছিল তাহার সর্বপ্রথম তীর্থদর্শন। আর ঐ প্রথম তীর্থদর্শনের কয়েক বৎসর পরে তিনি কাশীধামেই একজনের নিকট বিদায়গ্রহণকালে বলিয়াছিলেন, “যতদিন না আমি সমাজের উপর বজ্রের মতো পড়ছি, ততদিন আর এখানে আসব না।”
স্বামীজীর কলিকাতায় প্রত্যাবর্তনের পর দূর দূর দেশ হইতে বহু শিষ্য তাহার নিকটে সমবেত হন। যদিও তাহাকে পীড়িত দেখাইতেছিল, তথাপি কেহই সম্ভবতঃ অনুমান করিতে পারেন নাই যে, অন্তিমকাল কত নিকটে আসিয়া গিয়াছে। তথাপি সাগরবক্ষে অর্ধপৃথিবী অতিক্রম করিয়া লোকের যাতায়াত, দেখা-সাক্ষাৎ এবং পরস্পরের নিকট বিদায় সম্ভাষণ চলিতে লাগিল। আশ্চর্যের বিষয়, কাশী হইতে প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, যাহারা তাহার নিকটে অবস্থান করেন, তাহাদের স্বাধীনভাবে কার্য করিতে দিবার জন্য তাহার কিছুদিন দূরে সরিয়া থাকা আবশ্যক।
তিনি বলেন, “কতবার দেখা যায় যে, মানুষ দিনরাত তার শিষ্যদের কাছে থেকে তাদের নষ্ট করে ফেলে! একবার তাদের তৈরি হয়ে যাবার পর এটা বিশেষ প্রয়োজন যে, নেতা তাদের কাছে থেকে দূরে থাকবেন, কারণ তাঁর অনুপস্থিতি ব্যতীত তারা নিজেদের বিকাশসাধন করতে পারে না।”
বিদেশিগণের সহিত যে সংস্পর্শ তাহার পরিণত জীবনে অবিচ্ছিন্নভাবে চলিয়া আসিতেছিল, তাহারই সর্বশেষ ফলস্বরূপ যেন ধর্মের মধ্যে গার্হস্থ্য জীবনের নিষ্ঠারূপ উচ্চ আদর্শের কী মূল্য তাহা তিনি সহসা উপলব্ধি করেন। কেবল কথায় ও কার্যে নহে, পরন্তু অধিকতর আন্তরিকতা ও আবেগের সহিত এবং প্রাণপণ চিন্তার দ্বারা সন্ন্যাসিগণ নিজেদের ব্রতগুলি সকল বস্তুর উর্ধ্বে অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টা করেন বলিয়া সামাজিক জীবনের আদর্শসমূহ তাহাদের নিকট সচরাচর নিতান্ত অসাররূপে প্রতীয়মান হইয়া থাকে। স্বামীজী সহসা হৃদয়ঙ্গম করেন, যে-জাতি বিবাহিত জীবনের সম্বন্ধকে পবিত্র জ্ঞান করে না, সে-জাতির মধ্যে কখনও নিষ্ঠাবান যাজককুল অথবা উচ্চস্তরের সন্ন্যাসিসম্প্রদায় উদ্ভূত হইবার আশা নাই।
যেখানে বিবাহবন্ধন অবিচ্ছেদ্য বলিয়া সম্পূর্ণরূপে গৃহীত, কেবল সেখানেই দাম্পত্যজীবনের বাহিরের পথেও লোকে নিষ্ঠার সহিত চলিতে পারে। সামাজিক আদর্শকে পবিত্র জ্ঞানকরিলেই সমাজবন্ধনের উর্বে অবস্থিত সন্ন্যাসজীবনকে পবিত্র জ্ঞান করা সম্ভব।
এই অনুভূতিই তৎপ্রচারিত দর্শনের শীর্ষবিন্দুস্বরূপ। ইহাই ‘মহামায়ার খেলা’র শেষ চিহ্ন সূচিত করে। সন্ন্যাসজীবনের সম্ভাবনা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন সমগ্র সমাজে উন্নতিলাভের প্রচেষ্টা ও উহার প্রাপ্তি। সনাতন ধর্মে নিষ্ঠাবান সাধুর যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন নিষ্ঠাবান গৃহস্থের। বিবাহবন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা এবং সন্ন্যাসব্রত অক্ষুণ্ণ রাখা—উভয়ই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সমাজে উন্নতচরিত্র গৃহস্থ না থাকিলে শক্তিশালী সন্ন্যাসীবৃন্দের উদ্ভব হইতে পারে না। গার্হস্থ্য ব্যতীত সন্ন্যাস জীবন হয় না, ঐহিক কল্যাণ ব্যতীত পারমার্থিক জীবন সম্ভব নয়। সুতরাং দেখা যাইতেছে, সবই এক, তথাপি ইচ্ছাপূর্বক কাহারও বিন্দুমাত্র অঙ্গহানি হইতে দেওয়া চলিবে না; কারণ প্রত্যেক পরমাণুর মধ্য দিয়া প্রকাশ পাইতেছেন সেই ভূমা। বস্তুতঃ ইহা তাহারই পুরাতন বাণী নূতন আকারে মাত্র। তিনি এবং তৎপূর্বে তাহার গুরুদেব যেমন বার বার বিশেষভাবে বলিয়া গিয়াছেন—ভাবোন্মত্ততা অপেক্ষা চরিত্রের বিশুদ্ধতাই ভগবৎ সেবার পক্ষে অধিকতর উপযোগী। কোন জিনিস ধরিয়া রাখিবার শক্তি না থাকিলে শুধু ত্যাগেও কোন বাহাদুরি নাই।