সুতরাং অবিরাম ভক্তিই ছিল তাহার অবিচ্ছিন্ন একাগ্রতা রক্ষা করিবার উপায়। তিনি সর্বক্ষণ যে-সব অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের আভাস দিতেন, ধ্যানই তাহাদের মূল কারণ। তাহার কথাবার্তায় যোগদান ছিল, কোন ব্যক্তি কর্তৃক এক গভীর কূপে পাত্র ডুবাইয়া সেখান হইতে স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ ও শীতল বারি আনয়ন করা। তাহার চিন্তারাশির সৌন্দর্য অথবা গভীরতার ন্যায় উহাদের গুণ-বৈশিষ্ট্যও ইহাই প্রকাশ করিত যে, ঐ সকল চিন্তা আধ্যাত্মিক উপলব্ধিরূপ চিরতুষারাবৃত পর্বতশিখর হইতে প্রাপ্ত।
তাহার বক্তৃতাকালীন অনুভূতিসমূহের যে-সব গল্প তিনি করিতেন, তাহা হইতে এই তন্ময়তার কিছুটা আভাস পাওয়া যাইত। তিনি বলিতেন, পরদিন বক্তৃতায় তিনি যে-সব কথা বলিবেন, রাত্রে তাহার নিজের ঘরে কে যেন উচ্চৈঃস্বরে তাহা বলিয়া দিত এবং পরদিন তিনি দেখিতেন যে, বক্তৃতামঞ্চে উঠিয়া সেই কথাগুলিই তিনি আবৃত্তি করিতেছে। কখন কখনও তিনি দুইজনের কণ্ঠস্বর শ্রবণ করিতেন, তাহারা পরস্পরের সঙ্গে তর্ক বিতর্ক করিতেছে। আবার কখনও বোধ হইত ঐ কণ্ঠস্বর যেন বহুদুর হইতে আসিতেছে—যেন একটি দীর্ঘ পথের অপর প্রান্ত হইতে কেহ তাহার সহিত কথা কহিতেছে। অতঃপর ঐ স্বর যেন ক্রমশঃ নিকটবর্তী হইয়া অবশেষে চিৎকারে পরিণত হইত। তিনি বলিতেন, “ঠিক জেনে রেখো যে, পুরাকালে ঈশ্বরীয় বাণী (inspiration) বলতে লোকে যাই বুঝে থাকুক, তা নিশ্চয় এই ধরনের একটা কিছু হবে।”
কিন্তু এইসব ব্যাপারের মধ্যে তিনি অতিপ্রাকৃত কিছু দেখিতে পাইতেন না। উহা মনেরই স্বয়ংক্রিয় কার্যমাত্র; মন যখন চিন্তাপ্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট নিয়মে পরিপূর্ণভাবে আবিষ্ট হইয়া যায়, তখন ঐ চিন্তাগুলির প্রয়োগ ব্যাপারে আর কাহারও সাহায্যের অপেক্ষা করে না, আপনা হইতেই তাহাদের সংসাধন ঘটে। যে অবস্থাকে লক্ষ্য করিয়া হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন, ‘শেষে মনই গুরু হইয়া দাঁড়ায়’—সম্ভবতঃ উহা সেই অনুভূতিরই একটা চরম আকার। ইহা হইতে আরও আভাস পাওয়া যায় যে, তাহার দুইটি শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয় অর্থাৎ দর্শন ও শ্রবণ ইন্দ্রিয়দ্বয় প্রায় সমভাবে বিকাশলাভ করিলেও দর্শনেন্দ্রিয় অপেক্ষা শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রাধান্য কিঞ্চিৎ অধিক ছিল। তাহার শিষ্যদের মধ্যে একজন যেমন বলিয়াছিলেন, “নিজের মনের বিভিন্ন অবস্থা তিনি সম্পূর্ণ যথাযথভাবে বর্ণনা করতে পারতেন। কিন্তু ঐ সবল কণ্ঠস্বর স্বসংবেদ্য ব্যাপার ব্যতীত অন্য কিছু বলিয়া অনুমান করিবার বিন্দুমাত্র আশঙ্কা তাহার ছিলনা।
আর একটি অনুভূতি সম্পর্কে, যাহা আমি স্বয়ং তাহার নিকট শুনিয়াছি, তাহাতে মনের ঐরূপ স্বতঃপ্রবৃত্তক্রিয়াই প্রকাশ পায়, হয়তো ততখানি বিকাশপ্রাপ্ত নয়। যখনই কোন অপবিত্র চিন্তা ও আকৃতি তাহার সম্মুখে আসিত, তিনি তৎক্ষণাৎ অনুভব করিতেন,যেন ভিতর হইতে মনের উপর একটা ধাক্কা আসিয়া পড়িত-ও তাহাকে চুর্ণ-বিচূর্ণ, অসাড় করিয়া দিত! অর্থাৎ-”না ওরকম হতে পারবে না।”
অপরের মধ্যে যে কাৰ্যগুলি প্রথমে মনে হয় সহজাতপ্রবৃত্তি দ্বারা সাধিত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অতীন্দ্রিয় উপলব্ধিগত, উচ্চতর জ্ঞান দ্বারা নিয়মিত–তাহাদের তিনি অতি সহজে ধরিতে পারিতেন। যে বস্তু যথার্থ ঠিক, কেন তাহার কারণ কেহ নির্দেশ করিতে পারে না, অথচ যাহা সাধারণ মাপকাঠিতে বিচার করিলে ভুল বলিয়া বোধ হয়, এইরূপ স্থলে তিনি এক উচ্চতর শক্তির প্রেরণা দেখিতে পাইতেন। তাঁহার দৃষ্টিতে সকল অজ্ঞান সমান অন্ধকারময় বলিয়া বোধ হইত না।
নির্দিষ্ট কার্য শেষ হইলে স্বামীজী আবার তাহার নির্বিকল্প সমাধিরূপ আর্ষের আস্বাদন করিতে পারিবেন, গুরুদেবের এই ভবিষ্যদ্বাণী তাহার যৌবনের সঙ্গিগণ কদাপি বিস্মৃত হন নাই। কেহই জানিত না, কোন্ মুহূর্তে তাহার ঐকার্য সমাপ্ত হইবে, এবং চরম অনুভূতি যে আসন্ন, কেহ কেহ তাহা সন্দেহও করিয়াছিলেন। জীবনের শেষ বৎসরে কয়েকজন সঙ্গী অতীত দিনের আলোচনা করিতেছিলেন, ঐ প্রসঙ্গে সেই ভবিষ্যদ্বাণীর কথাও উঠিল, “নরেন যখনই জানতে পারবে, সে কে এবং কি, তখন তার শরীর রাখবে না।” তাহাদের মধ্যে একজন কতকটা হাস্যচ্ছলে তাহার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “স্বামীজী, তুমি কি এখন জানতে পেরেছ তুমি কে?” অপ্রত্যাশিত উত্তর আসিল, “হাঁ, এখন জেনেছি।” এস্ত হইয়া সকলে গম্ভীর ও নীরব হইয়া গেলেন। ঐ বিষয়ে তাহাকে আর কোন প্রশ্ন করিতে কাহারও সাহস হইল না। শেষ সময় যতই নিকটতর হইতেছিল, ধ্যান ও তপস্যা অধিকাংশ সময় তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছিল। যে-সকল বস্তু তাহার অত্যন্ত প্রিয় ছিল,তাহারাও এখন আর তাহার চিত্তকে তেমন করিয়া আকৃষ্ট করিতে পারিত না। অবশেষে শেষ মুহূর্তে যখন তিনি মহাসমাধিতে মগ্ন হইয়া গেলেন, তখন ঐ বিরাট অতীন্দ্রিয় শক্তির ছটা যেন নিকটে ও দূরে যাহারা তাহাকে ভালবাসিতেন, তাহাদেরও স্পর্শ করিয়াছিল। একজন স্বপ্নে দেখিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ যেন পুনরায় সেই রাত্রে দেহত্যাগ করিয়াছেন। প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে শুনিলেন, সংবাদবাহক দ্বারে অপেক্ষারত। তাহার অন্তরঙ্গ বন্ধুগণের অপর একজন দেখিয়াছিলেন, তিনি যেন উল্লাসের সহিত নিকটে আসিয়া বলিতেছেন, “শশী, শশী, শরীরটাকে থু থু করে ফেলে দিয়েছি।” আরও একজনকে সেই সন্ধ্যাকালে কে যেন জোর করিয়া ধ্যানের ঘরে লইয়া গিয়াছিল; তিনি দেখিলেন, তাহার আত্মা এক অসীম জ্যোতির সম্মুখীন, তাহার কণ্ঠ হইতে উচ্চারিত হইল ‘শিব গুরু’ এবং ঐ জ্যোতির সম্মুখে তিনি সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন।
২৬. স্বামীজীর মহাসমাধি
১৯০০ খ্রীস্টাব্দের শেষভাগে স্বামীজী যে-সকল বন্ধুর সহিত মিশরে ভ্রমণ করিতেছিলেন, সহসা তাহাদের নিকট হইতে বিদায় লইয়া তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। এই সময়ে যাহারা তাহার সঙ্গে ছিলেন, তাহাদের মধ্যে একজন বলেন, “তাকে খুব ক্লান্ত বোধ হতো।” যখন তিনি কাইরোর নিকটবর্তী পিরামিডসমূহ, নারীমুখবিশিষ্ট সিংহমূর্তিটি (the sphinx) এবং অন্যান্য বিখ্যাত দৃশ্যগুলি দেখিতেছিলেন, তখন প্রকৃতপক্ষে তিনি যেন জানিতে পারিয়াছিলেন যে, তিনি অভিজ্ঞতারূপ মহাগ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠাগুলি উল্টাইতেছেন। ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্নসমূহ আর তাহার হৃদয়তন্ত্রী স্পর্শ করিতে পারিতেছিল না।