কিন্তু স্বামীজীর আপনজন সম্পর্কে এই উল্লেখগুলি ছিল নিতান্ত ব্যক্তিগত এবং সেজন্য উহারা তাঁহার নিকট সম্পূর্ণ গৌণস্থান অধিকার করিত। তাঁহার ক্লাসগুলিতে এবং উপদেশসমূহে মানুষকে অজ্ঞানের হস্ত হইতে রক্ষা করাই তাঁহার একমাত্র আকাঙক্ষা বলিয়া বোধ হইত। যাহারা তাহার কথা বা বক্তৃতাদি শ্রবণ করিয়াছেন, তাহারা এরূপ প্রেম, এরূপ অনুকম্পা আর কোথাও দেখেন নাই। তাহার নিকট সকল শিষ্যই শিষ্যমাত্র; সেখানে ভারতীয় অথবা ইউরোপীয় বলিয়া কোন ভেদ ছিল না। আবার তিনি নিজের প্রচারকার্যের ঐতিহাসিক অর্থ বা গুরুত্ব সম্পর্কে বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন। লণ্ডনে তাহার শেষ বক্তৃতায় (১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর, রবিবার, অপরাহ্নে ‘রয়েল সোসাইটি অব পেন্টার্স ইন ওযাটার কলার্স নামক চিত্রশিল্পি-সঙ্ঘ-মন্দিরে)তিনি দেখাইয়া দেন যে, ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইয়া থাকে, এবং রোমরাজ্যে শান্তি বিরাজ করার ফলেই খ্রীস্টধর্ম সংস্থাপন সম্ভবপর হইয়াছিল। দূরদৃষ্টির ফলে তাহার হির ধারণা ছিল, তিনি যে বীজ বপন করিয়া গেলেন, ভবিষ্যতে বিরাট একদল ভারতীয় প্রচারক পাশ্চাত্যে আগমন করিয়া তাহার ফল উপভোগ করিবেন, এবং তাহারাও আবার ভাবী উত্তরাধিকারীর জন্য নূতন নূতন বীজ বপন করিয়া যাইবেন। সম্ভবতঃ, তাহার চালচলনে বুদ্ধের ন্যায় যে প্রশান্ত-গম্ভীর ভাব আমাদের এত মুগ্ধ করিয়াছিল, উহা তাহার ঐ দূরদৃষ্টি ও স্থির ধারণারই বহিঃপ্রকাশমাত্র।
—————
১ বাইবেল-সেন্ট ম্যাথু, ৯ম অধ্যায়।-অনুঃ
০৩. বিভিন্ন আদর্শের সংঘর্ষ
স্বামী বিবেকানন্দ তাহার গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্পর্কে একবার এইরূপ বলেন, “তিনি বেদান্তের অথবা নানা তত্ত্বের ধার ধারতেন না। তিনি শুধু সেই মহৎ জীবন যাপন করতেন এবং তার ব্যাখ্যার ভার অন্যের উপর ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন।” কোনও মহাপুরুষের জীবনে এমন কোন অংশ থাকিতে পারে, যাহার অর্থ তিনি নিজেই বুঝিতে পারেন না—স্বামীজীর নিজ জীবনালোচনা-প্রসঙ্গে এই অর্থে ঐ কথাগুলি আমার বহুবার মনে পড়িয়াছে।
পাশ্চাত্যে আমাদের নিকট স্বামীজী শুধু ধর্মাচার্যরূপেই প্রকাশিত হইয়াছিলেন। এখনও ক্ষণকাল চিন্তা করিলেই আমরা তাহাকে সেই পুরাতন বক্তৃতাগৃহে ছাত্রমণ্ডলীর অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উচ্চ আসনে উপবিষ্ট দেখিতে পাই; দেখিতে পাই, তিনি বুদ্ধের ন্যায় প্রশান্তভাবে সেই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, এবং তাঁহার শ্রীমুখ হইতে আর একবার এই আধুনিক জগৎ সুদূর অতীতের সেই বাণী শ্রবণ করিতেছে। ত্যাগ, মুক্তি-পিপাসা, বন্ধনক্ষয়, অগ্নিতুল্য পবিত্রতা, সাক্ষিস্বরূপ হইবার আনন্দ, নিরাকারে সাকারের পর্যাবসান—কেবল এইগুলিই ছিল সেই আলোচনার বিষয়। সত্য বটে, চকিতের ন্যায় এক-আধবার আমরা তাঁহাকে মহাদেশপ্রেমিকরূপে দেখিয়াছি। তথাপি নিয়তি আহ্বান করিলে গোপন ইঙ্গিতমাত্রই যথেষ্ট, এবং যে-সব মুহূর্ত একজনের জীবনের গতি পরিবর্তিত করিয়া দেয়, তাহারা শতজনের চোখের সামনে দিয়া চলিয়া গেলেও কেহ ধরিতে পারে না। পাশ্চাত্যে আমরা স্বামীজীকে হিন্দুধর্মের প্রচারকরূপেই দেখিয়াছি, ভারতের উন্নতিকামী কর্মিরূপে নহে। আবেগভরে তিনি বলিয়া উঠিয়াছিলেন,”আহা! মানবের দেবত্ব যিনি প্রকৃত উপলব্ধি করেছেন, তার কাজ কতই না শান্তিপূর্ণ! কারণ, এরূপ ব্যক্তির পক্ষে মানুষের চোখ খুলে দেওয়া ব্যতীত আর কিছুই করবার নেই; বাকি সব আপনা থেকেই হয়ে যায়।” সন্দেহ নাই, তাহার সম্বন্ধে আমরা যাহা কিছু দেখিয়াছিলাম ও শুনিয়াছিলাম, তাহা এইরূপ কোন অগাধ শান্তিরই ফলস্বরূপ।
কিন্তু আমার ভারতে পদার্পণের মুহূর্ত হইতে এই সকল ব্যাপারের অন্তরালে নিহিত সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক বস্তু দেখিতে পাইলাম। এইরূপ অদ্ভুতভাবে যে জ্ঞান লাভ হয়, তাহা শ্রীরামকৃষ্ণ অথবা তাহার সম্পর্কিত কোন বিষয় নহে; উহা আমার গুরুদেবের ব্যক্তিত্ব—যাহা জালবদ্ধ সিংহের ন্যায় পুনঃ পুনঃ ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছে এবং সেজন্য দুঃসহ ক্লেশ বোধ করিতেছে। কারণ, যেদিন জাহাজ হইতে অবতরণকালে জেটিতে তাহাকে দেখি, সেদিন হইতে সেই শেষ শান্ত মুহূর্ত পর্যন্ত—যখন গোধূলি সময়ে দেহটিকে ভাজকরা পোশাকের ন্যায় ফেলিয়া রাখিয়া তিনি এই জগৎরূপ গ্রামখানি চিরদিনের মতো পরিত্যাগ করিয়া যান—এই ভাবটি যে তাহার জীবনের অপর ভাবের সহিত অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত ছিল, সে বিষয়ে আমি সচেতন ছিলাম।
কিন্তু কোথায় এই সংঘর্ষের মূল? কেন তিনি নিজেকে উদ্দেশ্যসাধনে বার বার বিফলপ্রযত্ন ও বাধাপ্রাপ্ত বোধ করিতেন? এক মহান উদ্দেশ্যের ধারণা যতই তাহার নিকট স্পষ্টতর হইয়া উঠিতেছিল, তাহার শারীরিক দুর্বলতাবোধও ততই বাড়িতেছিল—ইহাই কি তাহার কারণ? ভারতে তাহার বিজয়সূচক অভ্যর্থনার যে প্রতিধ্বনি ইংরেজ বন্ধুদের নিকট পৌঁছায়, তাহার সহিত আমি এই বিষয়টিই একজনের নিকট শুনিতে পাই। যে মুহূর্তে তাহার ক্ষমতা চরম সীমায় আরোহণ করে, ঠিক সেই মুহূর্তেই ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া হিমালয়ে নির্বাসিত স্বামীজী তাঁহার বন্ধুকে এক পত্র লেখেন। ঐ পত্রে ছিল হতাশার কাতর ক্রন্দন। আমাদের মধ্যে কয়েকজন তাহাকে যে-কোন উপায়ে ভারতের কার্যভার অপরের স্কন্ধে অর্পণপূর্বক পাশ্চাত্যে প্রত্যাবর্তনে সম্মত করিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়েন। ঐরূপ ব্যবস্থা করিবার সময়, তাহার আরব্ধ কার্য কি প্রকারের এবং উহা সম্পন্ন করিবার জন্য কত কঠিন এবং জটিল শিক্ষার প্রয়োজন, তাহা আমরা অতি অল্পই হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলাম।