০১. লণ্ডনে, ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দে
ভগিনী নিবেদিতার অমর গ্রন্থ ‘The Master as I saw Him’-এর স্বামী মাধবানন্দকৃত বঙ্গানুবাদ ‘আচার্য শ্রীবিবেকানন্দ (যেমনটি দেখিয়াছি) এই নামে উদ্বোধন-এর ১৩২২, আষাঢ় হইতে ১৩২৪, চৈত্র পর্যন্ত সংখ্যাগুলিতে ধারাবাহিকভাবে প্রথম প্রকাশিত হয়। নানা কারণে উহা এতদিন পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় নাই। বর্তমান গ্রন্থখানি সেই অনুবাদেরই ঈষৎ সংশোধিত পুনর্মুদ্রণ। কেবল ইহার নূতন নামকরণ হইল, ‘স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি’।
প্রকাশক
০০. পাশ্চাত্য পাঠক–পাঠিকাগণের প্রতি নিবেদন
বৌদ্ধধর্মের প্রচারযুগের অবসান হইবার পর হইতে ১৮৯৩ খ্রীস্টাব্দে যেদিন স্বামী বিবেকানন্দ গৈরিকধারী সন্ন্যাসীর বেশে শিকাগো প্রদর্শনীর অন্তর্গত ধর্মমহাসভার মঞ্চে দণ্ডায়মান হন, সেদিন পর্যন্ত হিন্দুধর্ম নিজেকে প্রচারশীল ধর্ম বলিয়া ভাবে নাই। হিন্দুধর্মের শিক্ষকতা কার্যই যাহাদের নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল, সেই ব্রাহ্মণগণ ছিলেন নাগরিক ও গৃহস্থ এবং সেজন্য হিন্দুসমাজেরই এক অঙ্গস্বরূপ ছিলেন, ফলে সমুদ্রযাত্রার অধিকার হইতেও তাহারা বঞ্চিত ছিলেন। আর সিদ্ধপুরুষ বা অবতার পুরোহিত ও পণ্ডিতগণ অপেক্ষা যতটা উচ্চে অবস্থিত, হিন্দুধর্মের অন্তর্গত পরিব্রাজক সন্ন্যাসিগণের মধ্যে যাহারা উচ্চতম অধিকারী, প্রামাণ্য হিসাবে যদিও তাহাদের স্থান ব্রাহ্মণজাতি অপেক্ষা ঠিক ততটাই উচ্চে-তথাপি তাঁহারা স্বাধীনতার ঐ প্রকার ব্যবহারের কথা আদৌ ভাবিতে পারেন নাই। স্বামী বিবেকানন্দও নিজ বিশ্বস্ততাজ্ঞাপক কোন পরিচয়-পত্র লইয়া শিকাগোর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন নাই। যেমন তিনি ভারতের এক গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে ভ্রমণ করিতে পারিতেন, ঠিক তেমনভাবেই তাহার মাদ্রাজের জনকয়েক অনুরাগী ও শ্রদ্ধাবান শিষ্যের আগ্রহে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারে আগমন করেন। আমেরিকাবাসিগণও স্বজাতিসুলভ আতিথ্য ও সরলতাগুণে তাহাকে সমাদরে গ্রহণপূর্বক বক্তৃতা দিবার সুযোগ দেন। যেমন বৌদ্ধপ্রচারকগণের ক্ষেত্রে, তেমন তাহার ক্ষেত্রেও এক মহাপুরুষের শক্তিই তাহাকে জোর করিয়া বিদেশে প্রেরণ করে—যে মহাপুরুষের চরণপ্রান্তে বহু বৎসর বাস করিয়া তিনি তাহার জীবনের সঙ্গিস্বরূপ হইয়াছিলেন। তথাপি পাশ্চাত্যদেশে তিনি কোন বিশেষ আচার্যের কথা বলেন নাই, কোন এক সীমাবদ্ধ সম্প্রদায়ের মত ঘোষণা করেন নাই। “হিন্দুগণের ধর্ম সম্বন্ধীয় ধারণাবলী”—ইহাই ছিল তাহার শিকাগো বক্তৃতার বিষয়; এবং ইহার পরেও, যে সকল তত্ত্ব বহু অংশে বিভক্ত সনাতন হিন্দুধর্মের সাধারণ সম্পত্তি এবং বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক, কেবল সেইগুলিই তাহার বক্তৃতায় স্থান পাইত। সুতরাং ইতিহাসে এই প্রথম একজন অতি উচ্চদরের মনীষাসম্পন্ন হিন্দু, অন্য সকল বিষয় পরিহারপূর্বক হিন্দুধর্মকেই বিশ্লেষণ ও উহার বিশ্লিষ্ট-অংশগুলির সাধারণ ধর্ম আবিষ্কার করিতে যত্নপর হন।
স্বামীজী ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দের আগস্ট মাস পর্যন্ত আমেরিকায় অবস্থান করেন এবং তারপর প্রথমবার ইউরোপে আগমন করেন। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ইংলণ্ডে উপনীত হন এবং প্রায় একমাস পরে লণ্ডনে শিক্ষা দিতে আরম্ভ করেন।
প্রথম পরিচ্ছেদ
লণ্ডনে, ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দে
মনে কবিলে আশ্চর্য বোধ হয়, কিন্তু নিশ্চিতই আমার সৌভাগ্য বলিতে হইবে যে, আমার গুরুদেব শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতাবলী তাহার ১৮৯৫ ও ১৮৯৬ খ্রীস্টাব্দে ইংলণ্ড-আগমনকালে—উভয়বারই আমি শ্রবণ করিয়াছিলাম, তথাপি ১৮৯৮ খ্রীস্টাব্দের প্রথম দিকে ভারতে আসিবার পূর্বে তাহার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অতি অল্পই জানিতাম; এমনকি কিছুই জানিতাম না বলিলেও চলে। সৌভাগ্য, কেন না এই পূর্ব পরিচয় না থাকার ফলেই আমি মানসনেত্রে স্বামীজীর ব্যক্তিত্বেব যে স্বতঃ প্রকাশ ঘটিত তাহার প্রতি পদে, ভারতীয় অরণ্য, নগর ও রাজপরূপ যথার্থ পরিবেশের মধ্যেই তাহাকে দেখিতে পাই—প্রাচ্য আচার্যকে প্রাচ্য জগতের আবেষ্টনীর মধ্যেই দেখিয়া থাকি। এমনকি সুদূর লণ্ডনেও যখন আমি তাহাকে প্রথম দেখি, এখন ঐ ঘটনা স্মরণ করিয়া আমার চিত্ত যেরূপ আলোড়িত হয়, সূর্যালোকমণ্ডিত স্বদেশের বহু স্মৃতিপরম্পরা তাহার চিত্তও সেইরূপ আলোড়িত করিয়া থাকিবে। সময়টি ছিল নভেম্বর মাসের এক রবিবারের শীতল অপরাহু। স্থান ওয়েস্ট-এণ্ডের এক ড্রইংরুম। অর্ধবৃত্তাকারে উপবিষ্ট শ্রোতৃমণ্ডলীর দিকে মুখ করিয়া তিনি বসিয়াছিলেন। তাঁহার পশ্চাতে ছিল কক্ষের অগ্নি রাখিবার স্থানে প্রজ্বলিত অগ্নি। আর যখন তিনি প্রশ্নের পর প্রশ্নের উওর দিতেছিলেন, এবং মধ্যে মধ্যে উত্তরটি উদাহরণ দ্বারা ব্যাখ্যা করিতে গিয়া কোন সংস্কৃত গ্রন্থ হইতে সুব করিয়া আবৃত্তি করিতেছিলেন, তখন গোধূলি ও অন্ধকারের মিলন-সদ্ভুত সেই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই ভারতের কোন উদ্যানে, অথবা সূর্যাস্তকালে কূপের নিকটে, কিংবা গ্রামের উপকণ্ঠে বৃক্ষতলে উপবিষ্ট সাধু এবং তাহার চারিদিকে সমবেত শ্রোতৃবৃন্দ—এইরূপ এক দৃশ্যেবই কৌতুককর রূপান্তর বলিয়া তাঁহার বোধ হইয়া থাকিবে। ইংলণ্ডে আচার্য হিসাবে স্বামীজীকে আমি আর কখনও এমন সাদাসিধা ভাবে দেখি নাই। পববর্তী কালে তিনি সর্বদাই বক্তৃতা দিতেন; অথবা প্রশ্নাদির উত্তর দিতেন। প্রশ্নগুলি সমাগত বহু সংখ্যক শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে কেহ কেহ নিয়মমাফিক উত্থাপন করিতেন। কেবল এই প্রথমবারেই আমরা মাত্র পনর-ষোল জন অভ্যাগত ছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেকেই আবার ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বামীজী আমাদের মধ্যে উপবিষ্ট ছিলেন—তাহার পরিধানে ছিল গৈরিক পরিচ্ছদ ও কোমরবন্ধ—যেন তিনি আমাদের নিকট কোন্ এক দূর দেশের বার্তা বহন করিয়া আনিয়াছেন। মধ্যে মধ্যে তিনি এক অদ্ভুত অভ্যাস মত ‘শিব! শিব!’ বলিয়া উঠিতেছিলেন। তাহার প্রশান্ত আননে বিরাজ করিতেছিল কোমল ও মহত্ত্বব্যঞ্জক ভাবের সংমিশ্রণ—যাহা সাধারণতঃ ধ্যানপরায়ণ ব্যক্তিগণের মুখমণ্ডলে দেখা যায়। সম্ভবতঃ ঐ ভাবই র্যাফেল তাহার দিব্য শিশুর (Sistine Child-এর(১)) ললাটে অঙ্কিত করিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন।