এ কথাতেই হেসে উঠল হইয়ু।
খুব ভাব হয়ে গেল তাদের, সেকী হাসাহাসি দুজনের। আর হইয়ুর ডিগবাজি খাওয়ার ঘটা যদি তোমরা দেখতে নীলুকে খুশি করার জন্যে সে বাতাসের মধ্যে হেঁটে বেড়ালো খানিকক্ষণ। তারপর দুজন দুটি কোলবালিশ নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলল। কিন্তু নীলুর হলো মুশকিল। সে কোলবালিশ দিয়ে হইয়ুকে মারতে যায় আর সে বাতাস হয়ে মিলিয়ে যায়। নীলু রাগ করে বলল, উহুঁ, বাতাস হওয়া চলবে না।
নীলু তাকে দেখাল তার ছবির বই। ফুফু তাকে যে রঙপেন্সিল দিয়েছেন তা দিয়ে সে হইয়ুর চমৎকার একটি ছবি আঁকল। লাল কমল আর নীল কমলের গল্প বলল। তারপর বলল
ভাব ভাব ভাব
ভাব ভাব ভাব
নীল রঙের সিন্ধু
আমি তুমি বন্ধু
অর্থাৎ দুজন সারা জীবনের বন্ধু হয়ে গেল।
হইয়ুর বাবা যখন এলো তখন দুজনে হাত-ধরাধরি করে বসে আছে। হইয়ুর বাবা খুব খুশি হয়ে বলল, নীলু, আমার লক্ষ্মী মা কোথায়?
এই তো, এখানে। খুব ভালো খবর এনেছি তোমার জন্যে। তোমার মা ভালো হয়ে গেছেন। এখন ঘুমুচ্ছেন দেখে এসেছি।
নীলুর মনে হলো আনন্দে সে কেঁদে ফেলবে। হইয়ুর বাবা আপন মনে খানিকক্ষণ হেসে বলল, তোমার একটা ফুটফুটে ভাই হয়েছে নীলু। সেও শুয়ে আছে তোমার মার পাশে।
নীলুর কী যে ফুর্তি লাগল! এখন সে একা থাকবে না। এখন তার একটা ভাই হয়েছে। ভাইকে নিয়ে নীলু শুধু খেলবে।
দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো। গাছে কাক ডাকতে শুরু করেছে।
হইয়ুর বাবা বলল, ও হইয়ু, লক্ষ্মী মনা, ভোর হয়ে আসছে। চল আমরা যাই।
কিন্তু হইয়ু কিছুতেই যাবে না। সে ঘাড় বাকিয়ে বলতে লাগল, আমি যাব না। আমি মানুষের সঙ্গে থাকব। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
হইয়ুর বাবা দিল এক ধমক।
হইয়ু কাঁদতে কাঁদতে বলল, তেঁতুলগাছে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। আমি নীলুর সঙ্গে থাকব, আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
কিন্তু সকাল হয়ে আসছে। হইয়ুর বাবাকে চলে যেতেই হবে। সে হইয়ুকে কোলে করে নিয়ে গেল আর হইয়ুর সেকী হাত পা ছোঁড়াছুড়ি, সেকী কান্না!
আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
আমি নীলুর সঙ্গে থাকব।
নীলুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। কান্না পেতে লাগল।
তারপর কী হয়েছে শোনো। নীলুর মা কয়েক দিন পর একটি ছোটমতো খোকা কোলে করে বাসায় এসেছেন। মা হাসি মুখে বললেন, ভাইকে পছন্দ হয়েছে নীলু?
হয়েছে।
বেশ, এবার ছোট ভাইকে দেখাও, জন্মদিনে কী উপহার পেয়েছ। যাও নিয়ে। এসো।
নীলু কী আর করে, নিয়ে এলো তার মাথা নেই পুতুল। মা ভাঙা পুতুল দেখে খুব রাগ করলেন। নীলুকে খুব কড়া গলায় বললেন, নতুন পুতুলটির এই অবস্থা! দুদিনেই ভেঙে ফেলেছ? ছি ছি বলো নীলু, কী করে ভেঙেছ বলো?
নীলু কিছুতেই বলল না, চুপ করে রইল। কারণ সে জানে হইয়ু আর হইয়ুর বাবার কথা বললে মা একটুও বিশ্বাস করবেন না। শুধু বলবেন, এইটুকু মেয়ে কেমন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলছে।
বড়রা তো কখনো ছোটদের কোনো কথা বিশ্বাস করেন না।
নীল হাতী
নীলুর যে মামা আমেরিকা থাকেন তাকে সে কখনও দেখেনি। নীলুর জন্মের আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। নীলুর এই মামার কথা বাসার সবাই বলাবলি করে। মা প্রায়ই বলেন, আহ সঞ্জুটা একবার যদি দেশে আসত।
কিন্তু নীলুর সেই মামা নাকি আর দেশে ফিরবেন না। কোনো দিন না। একবার নানিজানের খুব অসুখ হলো। টেলিগ্রাম করা হলো সঞ্জু মামাকে। সবাই ভাবল এবার বুঝি আসবে। তাও এলো না। নীলুর বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, মেমসাহেব বিয়ে করে ফেলেছে এখন কি আর আসবে?
নীলুর খুব ইচ্ছে করে সেই মামাকে আর তার মেমসাহেব বৌকে দেখতে। কিন্তু তার ইচ্ছে হলেই তো হবে না। মামা তো আর ফিরবেই না দেশে। কাজেই অনেক ভেবেটেবে নীলু এক কাণ্ড করল। চিঠি লিখে ফেলল মামাকে। চিঠিতে বড় বড় করে লিখল–
মামা,
আপনি কেমন আছেন? আমার নাম নীলু। আপনাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। আর মেমসাহেব মামীকে দেখতে ইচ্ছে করে।
ইতি–
নীলু।
সেই চিঠির উল্টোপিঠে সে আঁকল পাখি আর সূর্যের ছবি। আর আঁকল মস্ত বড় নদী। সেই নদীতে পাল তুলে নৌকা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ভারি সুন্দর হলো ছবিটা! নীলু ভাবল, এইবার মামা নিশ্চয়ই আসবে।
মামা কিন্তু এলো না। একদিন দুদিন হয়ে গেল, তবু না। মামা চিঠির জবাবও পর্যন্ত দিল না। অপেক্ষা করতে করতে নীলু ভুলেই গেল যে, সে মামাকে চিঠি লিখেছিল। তারপরই এক কাণ্ড।
সেদিন নীলুর খুব দাঁতব্যথা সে স্কুলে যায়নি। গলায় মাফলার জড়িয়ে একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। টিপ টপ করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। এমন সময় ভিজতে ভিজতে পিয়ন এসে হাজির।
এই বাড়িতে নীলু নামে কেউ থাকে?
নীলু আশ্চর্য হয়ে বলল–
হ্যাঁ। আমার নাম নীলু।
পিয়নটি গম্ভীর হয়ে বলল, নীচে নেমে এস খুকী। তোমার জন্যে আমেরিকা থেকে কে একজন একটা উপহার পাঠিয়েছে। নাম সই করে নিয়ে যাও। নাম লিখতে পারো খুকী?
হ্যাঁ। পারি।
নীলু উপহারের প্যাকেটটি খুব সাবধানে খুলল। পিয়ন তখনও যায়নি, পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। প্যাকেটের ভেতর থেকে বেরুল নীল রঙের একটা হাতী। গলায় রুপোর ঘণ্টা বাজছে, টুন টুন করে। হাতীর শুড় আপনা থেকেই দুলছে। মাঝে মাঝে আবার কান নাড়াচ্ছে।
এত সুন্দর হাতী নীলু এর আগে আর কখনও দেখেনি। শুধু নীলু নয়, তার আব্বাও এত সুন্দর হাতী দেখেনি। অফিস থেকে ফিরেই তিনি দেখলেন তার টেবিলে নীল হাতী শুড় দোলাচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, আরে, কে আনল এটা বড় সুন্দর তো!