- বইয়ের নামঃ জলকন্যা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ ছোট গল্প, গল্পের বই
আঙুল
দেখি হাত দেখি।
এক হাত মেললেই হয়–মোবারক দুহাত মেলে ধরল। মোবারকের কেমন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে ডাক্তারকে হাত দেখাচ্ছে। বামুনদের মত বেঁটে যে ভদ্রলোক হাত দেখছেন–তিনি কোন ডাক্তার না। ফিল্মের ডাইরেক্টার। ফিল্মের নাম শেষ প্রতিশোধ।
মোবারক লক্ষ্য করল উত্তেজনায় তার হাতের আঙুল কাঁপছে। দশটা আঙুল কাঁপার কথা, তার কাঁপছে সাতটা। কারণ ডান হাতের পাঁচটা আঙুলের মধ্যে তিনটা তার নেই, লেদ মেশিনে কাটা পড়েছে। মেশিনে কাটা বলেই সুন্দর করে কাটা। দেখতে খুব খারাপ লাগে না।
ডাইরেক্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে কাটা আঙুল দেখছেন। তার পছন্দ হচ্ছে কিনা মোবারক বুঝতে পারছে না। ভদ্রলোকের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হয় খুঁতখুঁতে স্বভাবের। বেঁটে লোক খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়।
আপনার নাম কি বললেন যেন?
স্যার, আমার নাম মোবারক।
আমরা আসলে চেয়েছিলাম চারটা আঙুল কেটেছে এমন লোক। এক হাতে শুধু একটাই আঙুলের অন্য এক ধরনের বিউটি আছে। যাই হোক, আপনাকে দিয়েও চলবে। অভিনয় করেছেন কখনো?
জ্বি না স্যার।
অভিনয় না করলেই ভাল। যা বলব ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে তাই করবেন। পারবেন না?
জ্বি স্যার, পারব।
গুড। খুব সহজ দৃশ্য। এক অত্যাচারী লোক তোমাকে ধরেছে। সে ছড়তা দিয়ে কচ কচ করে তোমার হাতের তিনটা আঙুল কেটে ফেলবে। এক একবার কাটবে আর তুমি আঁ বলে এক চিৎকার দিবে।
মোবারকের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। ডাইরেক্টার সাহেব একটু আগে তাকে আপনি করে বলছিলেন, এখন তুমি বলছেন। শুরু থেকে তুমি করে বললে অস্বস্তি লাগত না। প্রথম কিছুক্ষণ আপনি বলায় লাগছে। ছড়তা দিয়ে আঙুল কাটার ব্যাপারটাও সে বুঝতে পারছে না। আঙুল তো কাটাই আছে, আবার নতুন করে কাটবে কি?
তোমার বুকে লোম আছে?
মোবারক লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জ্বি না স্যার।
ডাইরেক্টার সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, পুরুষের বুকে লোম আজকাল উঠেই গেছে। কারণটা বুঝলাম না। যাই হোক, তুমি শার্টটা খুলে ফেল। খালি গায়েই ভাল লাগবে। খোল, শার্ট খোল।
এত লোকের মাঝখানে শার্ট খুলতে মোবারকের লজ্জা লাগছে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন পুরুষ মানুষের উদোম হওয়ার দৃশ্য তারা আগে দেখেনি। এদের মধ্যে মেয়েছেলেও আছে। একটা মেয়ে তো একেবারে লাল টুকটুক, গদি দেয়া চেয়ারে বসে আছে। নায়িকা-টায়িকা হবে। নায়িকা না হলেও নায়িকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী কিংবা ছোট বোন। মেয়েটা একটু পরপর বিশ্রী ভঙ্গিতে হাই তুলছে। তার মুখটা ছোট তবে হা করার সময় বিশাল হয়ে যাচ্ছে, জিভ দেখা যাচ্ছে। কালো রঙের একটা জিভ। মোবারকের মনে হল, মেয়েটার জিভটা রঙ করে দেবার দরকার ছিল। লাল টুকটুক চেহারার সঙ্গে কাল জিভ মিশ খাচ্ছে না।
ডাইরেক্টার সাহেব বললেন, তোমার নাম যেন কি বললে?
স্যার, মোবারক।
শোন মোবারক, তুমি চুপ করে বসে থাক। তোমার শট কখন নেব বুঝতে পারছি। প্রডাকশনের কেউ আছে? মোবারককে চা-বিস্কুট দে।
.
মোবারক লজ্জিত মুখে বসে আছে। সামান্য কয়টা টাকার জন্যে এই ঝামেলায়। আসাটা ঠিক হয়েছে কি না, বুঝতে পারছে না। মোবারক শুধু যে নিজে লজ্জা পাচ্ছে তা না, তার ধারণা তার ডান হাতটাও লজ্জার মধ্যে পড়েছে। আগে যেখানে আঙুল ছিল সেই জায়গা চুলকাচ্ছে। আঙুল নেই অথচ চুলকাচ্ছে–যাকে বলে ভৌতিক অবস্থা। এরকম তার মাঝে মাঝে হয়। লজ্জা বা অস্বস্তির মধ্যে পড়লে বেশি হয়। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না বলে মোবারক ব্যাপারটা কাউকে বলেনি, শুধু লতিফাকে বলেছে।
লতিফা গম্ভীর গলায় বলেছে, চুলকালে কি করেন? চুলকান?
হুঁ।
আঙুল তো নাই। কই চুলকান?
বাতাসের মধ্যে চুলকাই। এতে আরাম হয়।
লতিফা মোবারকের ছোট ভাই আবদুল করিমের স্ত্রী। দেড় বছর হল বিয়ে হয়েছে। এখনো ছেলেপুলে হয়নি বলে স্বভাব-চরিত্র নতুন বৌয়ের মত। লাল শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ঘুরঘুর করে, দেখতে ভাল লাগে। নতুন বৌ হল বাড়ির শোভা। মোবারকের প্রায়ই মনে হয়, প্রতিটি বাড়িতে একটা করে নতুন বৌ থাকা দরকার। সেজে-গুঁজে থাকবে, নতুন শাড়ি পরে ঘুরঘুর করবে।
মোবারকের এই মেয়েটাকে বড়ই পছন্দ। মেয়েটার সবই ভাল, শুধু হাসি-রোগ আছে। সব কিছুতেই হাসি। মোবারক হল তার ভাসুর। ভাসুরের সামনে হাসা খুব বড় ধরনের বেয়াদবি। এই মেয়ে সেটা জানে, জেনেও হাসে। তবে এই অপরাধ ক্ষমা করা যায়। সব ভাল জিনিসে খুঁত থাকে। সোনায় থাকে গিল্টি, চন্দ্রে কলঙ্ক। কি আর করা!
এই যে পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে তার কাছেই চেয়ারে বসে আছে, তার জিভটা তো। কালো।
খালি গায়ে বসে থেকে মোবারক তার অদৃশ্য আঙুল চুলকায়। এক ঘন্টার উপর হল সে বসে আছে। ডাইরেক্টার সাহেব চা দিতে বলেছিলেন, সেই চা তাকে এখনো কেউ দেয়নি। তবে অনেকেই চা-বিস্কুট খাচ্ছে। মোবারক খুব ভাল করে চারদিকে দেখার চেষ্টা করছে। বাসায় গিয়ে এক ফাঁকে লতিফাকে বলতে হবে। বেচারী ছেলেমানুষ এইসব জিনিসে মজা পাবে। অতি ভাল একটা মেয়ে। ভাসুরের সামনে দুই একটা ছোটখাট বেয়াদবি করে ফেলে। বয়স কম বলেই করে। সব কিছু ধরলে সংসার। চলে না। কিছু ধরতে হয়, কিছু ছাড়তে হয়। তাছাড়া এই জামানায় কয়টা মেয়ে তার ভাসুরকে খাতির করে? সেই ভাসুর কাজের ভাসুর হলেও একটা কথা ছিল। মোবারক হল অকাজের ভাসুর। ছোট ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাচ্ছে-দাচ্ছে-ঘুমাচ্ছে। তাকে খাতির করার কি আছে? এই সব ক্ষেত্রে উল্টোটা হয়। ছোট ভাইকে এবং তার স্ত্রীকে খাতির করে চলতে হয়। সব সময় খেয়াল রাখতে হয় এরা যেন বেজার না হয়। আবদুল করিমের ব্যাপারে মোবারক যে তা করে না, তাও না। করে, নিজের অজান্তেই করে। করার পর মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিজের উপর রাগে গা জ্বলে যায়।
গত সোমবারে রহমানিয়া হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে সে সিগারেট টানছিল। হঠাৎ দেখে আবদুল করিম বাজার করে ফিরছে। দেখামাত্র সে হাতের সিগারেট ফেলে দিল। কি কাণ্ড! নিজের ছোট ভাই। তাকে দেখে সে সিগারেট ফেলবে কেন? ভাগ্যিস আবদুল করিম ব্যাপারটা দেখেনি। দেখলে একটা লজ্জার ব্যাপার হত।
দীর্ঘদিন চাকরি-বাকরি না থাকলে মন ছোট হয়ে যায়। তখন মানুষ ছোট ভাইকে দেখে সিগারেট ফেলে দেয়ার মত কাণ্ড-কারখানা করে বসে। তার মন যে ছোট হয়ে গেছে এটা মোবারক জানে। কিছুটা ছোট হয়ে থেমে গেলে হত। থামছে না। যতই দিন যাচ্ছে ততই ছোট হচ্ছে। বিশ্রী ব্যাপার। আবদুল করিমকে দেখলে ইদানীং তার কেমন জানি ভয় ভয় করে। চোখের উপর চোখ পড়লে নিজের অজান্তেই চোখ নামিয়ে নেয়। অবশ্যি আবদুল করিমের কথা-বার্তার ধরনও এখন বদলে গেছে। আগে গলার স্বর চিকন ছিল, এখন মোটা হয়ে গেছে। কথা বলার সময় ভুল তালে পা নাচায়। কিছুদিন হল চোখে আবার চশমা পরেছে। মোবারকের ধারণা, এইসব হয়েছে বিয়ের কারণে। বিয়ে করলে পুরুষমানুষ বদলাবেই। তার উপর বউ যদি সুন্দরী হয় তাহলে তো কথাই নেই। নতুন বিয়ে করা পুরুষদের প্রধান কাজই হল বউকে দেখানো যে সে একটা বিরাট কিছু। কাজেই যে পুরুষের গলা চিকন সে অনেক কষ্ট করে মোটা গলায় কথা বলে। আশপাশের সবার দিকে এমন করে তাকায় যেন তারা কেউ মানুষ না, সে একাই মানুষ। শুধু মানুষ না, জ্ঞানী মানুষ।
সেদিন খাবার টেবিলে বসে আবদুল করিম জ্ঞানীদের মত কথা বলল। প্রথম কিছুক্ষণ পা নাচাল। প্রথমে ডান পা, তারপর বাঁ পা, তারপর দু’টাই একসঙ্গে। পা নাচানোর পর গলা খাঁকারি দিল। গলা পরিষ্কার করে নিল। অপরিষ্কার গলায় তো আর জ্ঞানের কথা বলা যায় না। গলা পরিষ্কার হবার পর বলল, লতু চশমটা দেখি। আদর করে লতিফাকে লতু ডাকা। স্ত্রীকে আদর করে ডাকবে না তো কাকে ডাকবে? লতু ফতু যা ইচ্ছা ডাকুক, কিন্তু বড় ভাইয়ের সামনে ডাকবে কেন? আদব-কায়দার একটা ব্যাপার আছে না? তাছাড়া স্ত্রীর সামনে যে ভঙ্গিতে সে কথা বলছে সেটা তো আদবের বড় খেলাফ। চশমা চোখে দিয়ে চশমা’র ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে কথা বলা। আরে ব্যাটা, তুই কি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নাকি? তুই হলি সাবরেজিস্টার অফিসের কেরানী। চশমা’র ফাঁক দিয়ে তোর কথা বলার দরকার কি? আর গলা মোটা করারও-বা দরকার কি? তোর যেমন গলা তুই তেমন গলায় কথা বলবি। এরকম মোটা গলায় বেশিদিন কথা। বললে তো গলায় ক্যানসার-ফ্যানসার হবে। মোবারক অবশ্যি ভাইয়ের সব কথা মাথা নিচু করে শুনল।
ভাইজান, আর কতদিন এই ভাবে বসে বসে থাকবেন? কিছু একটা করা দরকার?
মোবারক বলল, হুঁ।
তিনটা আঙুল কাটা গেছে, তার জন্যে তো আপনি অচল হয়ে পড়েননি। হাত নেই এমন মানুষও কাজ করে খাচ্ছে।
মোবারক মনে মনে বলল, ভিক্ষা করে খাচ্ছে। তুই কি তাই চাস? তোর বড় ভাই ভিক্ষা করলে তোর মান থাকবে?
বেঙ্গল টুলস যে আপনাকে দশ হাজার টাকা কমপেনসেশান দিবে বলেছিল, তার কি হল? সেই টাকাটা পেলেও তো একটা ব্যবসা-ট্যবসা শুরু করতে পারতেন। ওরা টাকাটা কবে দেবে কিছু বলেছে?
দিন-তারিখ কিছু বলে নাই।
দিবে তো? নাকি দিবে না?
দিবে।
গা ছেড়ে বসে থাকলে কি আর দিবে? ওদের তাগদা দিতে হবে। রোজ গিয়ে বসে থাকতে হবে। দিন-রাত ঘরে বসে থাকায় কোন লাভ নাই। লতু, পান দাও তো।
লতিফা পান আনতে যাচ্ছে এই ফাঁকে মোবারক উঠে পড়ল। পান খাওয়ার সময় সে সামনে থাকতে চায় না। তখন আবদুল করিম একটা বিশ্রী ব্যাপার করে। সেই বিশ্রী ব্যাপার দেখতে খারাপ লাগে। লতিফা যখন পান এনে দেয় তখন গদগদ ভঙ্গি করে আবদুল করিম হা করে। আবদুল করিমের মুখ ছোট, কিন্তু মুখের কাটা বিরাট বড়। হা করা মুখ বড় বিশ্রী দেখায়। লতিফাকে সেই হা করা মুখে পান ঢুকিয়ে দিতে হয়। এই। ব্যাপারগুলি আগে সে আড়ালে করত। ইদানীং মোবারকের সামনেই করছে। মোবারকের ধারণা, আজকাল তাকে তার ছোট ভাই মানুষ হিসেবেই গণ্য করছে না। কুকুর-বিড়াল ভাবছে। কুকুর-বিড়ালের সামনে মানুষ লজ্জা করে না। আবদুল করিমই বা কেন করবে?
ভাইজান, আপনি টাকাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করেন।
আচ্ছা।
টাকাটা পেলে আমিও কিছু দিব। দু’টা মিলায়ে একটা দোকান-টোকান দেন। আপনার বয়সও তো কম হয় নাই। থিতি হয়ে ঘর সংসার করতে হবে না।
মোবারক মনে মনে বলল, চুপ থাক হারামজাদা। বক্তৃতা দিস না। বসে বসে পান খা। পা নাচা।
পান চলে এসেছে। আবদুল করিম চোখ বন্ধ করে হা করল। লতিফা মুখে পান ঢুকিয়ে দিল। পান খেতে খেতে বলল, বুঝলেন ভাইজান, আপনার যদি মেট্রিকটাও পাশ থাকত আমাদের অফিসে একটা ব্যবস্থা করে দিতাম। অফিসে এই জুনে লোক নিচ্ছে। আমাদের সাবরেজিস্ট্রার সাহেব বলতে গেলে আমার কথায় উঠেন বসেন। মুন্সিগঞ্জ বাড়ি। অতি অমায়িক।
মোবারক বুঝতে পারে সবই বউকে শোনানোর জন্যে চাল দেয়া কথা। কতবড় লায়েক হয়ে গেছে! মুখের কথায় চাকরি হয়ে যায়! সাবরেজিস্ট্রার তার কথায় উঠে বসে। সাবরেজিস্ট্রারের তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই। কেরানীর কথায় উঠ-বোস করাই। একমাত্র কাজ। তুই হলি ড্রিল মাস্টার, তোর কথায় উঠ-বোস করবে? ফাজিলের ফাজিল।
ভাইজান, আপনি বেঙ্গল টুলসকে চাপ দিয়ে ধরবেন। কমপেনসেশান দেবে না মানে? তার বাপ দেবে। তেমন ঝামেলা করলে আমার লোক আছে, মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। শুধু তক্তা না, প্রয়োজনে তক্তায় বানিশ দিয়ে দেবে। হা হা হা।
এটা হল আবদুল করিমের রসিকতা। বিয়ের পর সে আবার রসিকও হয়েছে। রসিকতা করে নিজেই হা হা হি হি করে হাসে। তার মান রক্ষার জন্যে লতিফাকেও হাসতে হয়। মায়া লাগে মেয়েটার জন্যে। তক্তায় বার্নিশ দিয়ে দেবে এটা কি কোন হাসির কথা? এই কথা শুনে বেকুব ছাড়া কেউ হাসবে? অথচ মেয়েটাকে হাসতে হচ্ছে।
আবদুল করিম আবার হা করল। আরেকটা পান খাবে। এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখাও শাস্তির মত। মোবারক চলে যেতে ধরেছে, আবদুল করিম বলল, ভাইজান, একটা কাজ করেন। আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দেন। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। লতু, টাকা এনে দাও। পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দাও। ফাইভ ফাইভ আনবেন।
মোবারক জানে, সংসারে কাঁচা পয়সা আসতে শুরু করেছে। কেরানী ফাইভ ফাইভ সিগারেট খায় না। আবদুল করিম ইদানীং খাচ্ছে একটা ক্যাসেট প্লেয়ারও কেনা হয়েছে। নীল কাপড়ের ঢাকনি দিয়ে সেটা ঢাকা থাকে। অদ্ভুত অদ্ভুত সময়ে সেই ক্যাসেট প্লেয়ার বেজে ওঠে। কয়েকদিন আগে রাত তিনটার সময় ক্যাসেট প্লেয়ার। বেজে উঠল–পায়েল বাজে ঝম ঝম…
ছোট ভাইয়ের জন্যে সিগারেট কিনতে দোকানে যাবার মধ্যে এক ধরনের অপমান আছে। মন ছোট হয়ে যায়। কিন্তু উপায় কি? মোবারক জানে, সিগারেট কেনার মধ্যেই অপমানের শেষ না, আরো খানিকটা বাকি আছে। সিগারেট কেনার পর পঞ্চাশ টাকা থেকে দু’টাকা ফেরত আসবে। আবদুল করিম উদাস ভঙ্গিতে বলবে, টাকা ফেরত দিতে হবে না, রেখে দেন। তাকে দেখে দেখে লতিফাও শিখবে। সকালে বাজার করে আনার পর বলবে, বাড়তি পয়সা ফেরত দিতে হবে না, রেখে দেন।
তার টাকাপয়সার দরকার অবশ্যই আছে। এক-দুই টাকাও কম কিছু না। দুই টাকায় এক প্যাকেট আকিজ বিড়ি পাওয়া যায়। তারপরেও লজ্জা লাগে।
এই যে সে খালি গায়ে বসে আছে এটাও একটা লজ্জারই ব্যাপার। কখন না কখন ক্যামেরার সামনে নিয়ে যাবে তার জন্য সকাল থেকে খালি গায়ে বসে থাকার দরকার কি? এমন তো না যে তার শার্ট খুলতে এক ঘন্টা লাগে। বলবে আর সে ফট করে খুলে ফেলবে। অনেক বেলা হয়েছে। খিদে জানান দিচ্ছে। এক জায়গায় বসে থাকলে খিদে বেশি লাগে। কাজের মধ্যে থাকলে খিদেটা ভুলে থাকা যায়। কাজ আর কোথায়? মোবারকের মনে হচ্ছে সিনেমা লাইনের একমাত্র কাজই হল বসে থাকা। বেশিরভাগ মানুষই বসে আছে। পুতুলের মত লাল টুকটুক মেয়েটাও তার মতই সকাল থেকে চেয়ারে বসা। এরা মনে হয় এক ফাঁকে খেয়ে এসেছে। অনেকের মুখেই পান। পুতুল পুতুল মেয়েটাও পান খাচ্ছে। পান খাওয়ার জন্যে তার জিভটা লাল হবে কি না কে জানে। এক ফাঁকে দেখতে হবে। মেয়েটার নাম এখন মোবারক জানে। নাম হল কুমকুম। মেয়েটার স্বামী তাকে আদর করে কি ডাকবে–কুম? মোবারকের ডান হাতের কাটা পড়ে যাওয়া আঙুল চুলকাচ্ছে। কোন একজন ডাক্তারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলে হয়। পাড়ার সতীশ ডাক্তার আছে, এলএমএফ হলেও ভাল ডাক্তার। এমবি ডাক্তারের চেয়ে ভাল। তাকে বললে সে কি চুলকানির কোন ট্যাবলেট –ফ্যাবলেট দেবে? সতীশ ডাক্তারের সঙ্গে তার আলাপ আছে। রাস্তায় দেখা হলে জিজ্ঞেস করেন–কি মোবারক, খবর কি? তোমার ভাইয়ের এসিডিটি কমেছে? ভাজা-পোড়া কম খেতে বলবে। মোবারক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলে–জ্বি আচ্ছা, বলব। যদিও সে ভালমতই জানে বলার প্রশ্নই আসে না। সব ছোট ভাইদের উপদেশ দেয়া যায় না। কিছু কিছু ছোট ভাই আছে, যাদের কাছ থেকে শুধু উপদেশ শুনতে হয়। কিছু কিছু ছোট ভাই আছে যাদের তুমি করে বলতেও অস্বস্তি লাগে। মোবারক তো একবার আপনি বলেই ফেলেছিল। কি লজ্জার ব্যাপার। তবে আবদুল করিম অন্যমনস্ক ছিল বলে বুঝতে পারেনি। হয়েছে কি, আবদুল করিম ইউরিন টেস্ট করাবে। পেচ্ছাব ভর্তি শিশি মোবারকের হাতে দিয়ে বলল, সাবধানে নিয়ে যান। রাস্তায় যেন না ভাঙে। মোবারক ঘাড় কাত করে বলল, জ্বি আচ্ছা। ছোট ভাইকে আপনি করে বলা লোকে শুনলে ছিঃ ছিঃ করবে। তবে দিনে দিনে অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে তাতে মনে হয় খুব শিগগিরই সে আপনি বলা শুরু করবে। কেলেঙ্কারি কাণ্ড হবে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে গেলে কেমন হয়? বিছানা-বালিশ নিয়ে হাঁটা দেয়া? কিছু ব্যবস্থা কি আর হবে না? রেল স্টেশনে গিয়ে শুয়ে থাকা। সরকারি জায়গা, কারো কিছু বলার নেই। তবে তোক জানাজানি হবে। তাতে আবদুল করিমেরই অপমান। নিজের ছোট ভাই, তার অপমান হতে দেয়া যায় না। ভাই তেমন খারাপ কিছুও না। তিন বছর ধরে তো তার ঘাড়ে বসেই খাচ্ছে। এখনো তো বাড়ি থেকে বের করে দেয়নি। দুজনের আলাদা সংসারের কত মজা। মোবারকের কারণে তাদের সেই মজা হচ্ছে না। ওদের দিকটাও তো দেখতে হবে।
রাত দশটার পর থেকে ক্ষুধায় মোবারক চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। তার মনে হচ্ছে গত কয়েক বছর এমন খিদে তার লাগেনি। খিদের চোটে মাথার ভেতরে পর্যন্ত। ভো ভো শব্দ হচ্ছে। তার পাশে রাখা সবুজ শার্টটায় কেউ লবণ মাখিয়ে দিলে সে সজি। মনে করে খেয়ে ফেলতে পারে এমন অবস্থা। লাল টুকটুক মেয়েটাও চলে গেছে। মোবারকের অংশটা কখন হবে সে বুঝতে পারছে না। ডাইরেক্টার সাহেব একবার কিছুক্ষণের জন্যে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে ইচ্ছা করলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারত। সাহসে কুলায়নি, কারণ তাকে দেখাচ্ছিল পাগলের মত। তার নাকি প্রেশারের সমস্যা আছে। কিছুক্ষন আগে মাথায় পানি ঢেলেছেন। চুল বেয়ে এখনো ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। চোখ লাল। এরকম অবস্থায় কিছু জিজ্ঞেস করা যায় না।
মোবারকের বাথরুমও পেয়েছে। মনে হচ্ছে পেতলের বড় কলসিতে এক কলসি পানি পেটে জমা হয়েছে। জায়গা ছেড়ে যেতে সাহসে কুলাচ্ছে না। কখন তার ডাক পড়বে কিছু বলা তো যায় না। বারশ টাকা নগদানগদি পাওয়ার কথা। যে তাকে এনে দিয়েছে সে তাই বলেছে। বারশ টাকা পেলেও দুশ টাকা তাকে কমিশন দিতে হবে। হাতে থাকবে এক হাজার, সেটাও কম কি? একটা লোক সারাদিন মাটি কেটে পায় ষাট টাকা। আর সে আঁ বলে একটা চিৎকার দিয়ে পাবে বারশ টাকা। বিশ্বাস হতে চায় না। তবে ফিল্মের সব ব্যাপারই তো অবিশ্বাস্য। হতেও পারে। দেখা যাক। টাকাটা পেলে লতিফাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে। বিয়েতে কিছু দেয়নি অথচ সে হল ভাসুর। হাজারখানিক টাকায় সোনার কিছু পেলে তাই দিত। শাড়ি তো আর থাকবে না। সোনাটা থাকবে। নিজের মেয়েদের গল্প করতে পারবে–এটা আমার ভাসুর দিয়েছেন। মেয়েরা এই জাতীয় গল্প করতে খুব পছন্দ করে। কোন্ গয়না কে দিয়েছে এটা তাদের একশ বছর পরেও মনে থাকে।
রাত সাড়ে বারটার সময় ডাইরেক্টার সাহেব তার কাছে এসে বললেন, কি যেন নাম তোমার?
স্যার, মোবারক।
শোন মোবারক, তোমার অংশটা আজ হচ্ছে না।
কবে হবে স্যার?
বলা যাচ্ছে না। নাও হতে পারে। বিগ স্ক্রিনে আঙুল কাটাকাটি ভাল লাগবে না। যাই হোক, তুমি তোমার ঠিকানা রেখে যাও। প্রয়োজনে খবর দিব। প্রডাকশনের কে আছে এখানে? মোবারককে রিকশা ভাড়া দিয়ে দে।
.
স্টুডিওর গেট থেকে বেরুতে বেরুতে একটা বেজে গেল। টাউন সার্ভিস বন্ধ। হেঁটে বাসায় ফেরা ছাড়া উপায় নেই। রিকশা ভাড়া পাওয়া যায়নি। যার দেবার কথা সে গম্ভীর মুখে বলেছে, সব বড় নোট। ভাংতি নাই। আরেক দিন এসে রিকশা ভাড়া নিয়ে যাবেন।
মোবারকের পকেটে দু’টা মাত্র টাকা। হাঁটা ছাড়া উপায় কি? প্রায় চার মাইল পথ। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা। এত রাতে ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। আবদুল করিমের আবার ঘুমের অনেক নিয়ম-কানুন আছে। একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না। রাত তিনটায় বাড়ি ফেরাটা সে কিভাবে নেবে সেটাও একটা কথা। রেল স্টেশনে রাতটা কাটিয়ে ভোরবেলা বাড়ি ফেরাই সবচেয়ে ভাল। কিন্তু খিদেটা অসম্ভব। কষ্ট দিচ্ছে। বাসায় ফিরে চারটা ভাত না খেলেই না। লতিফা ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত দেবে না। ভাত তরকারি সব গরম করবে। লেবু থাকলে লেবু কেটে দেবে। একবার সে কাঁচামরিচ চেয়েছিল। ঘরে কাঁচামরিচ ছিল না। সে শুকনো মরিচ পুড়িয়ে তেল দিয়ে মেখে দিয়েছে। এটা কোন মেয়ে করে না। লতিফা করে। তার জন্যে শাড়িটা কেনা গেল না। এটা একটা আফসোস।
গেটের সামনে এসে মোবারক অবাক। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। আবদুল করিম বসে আছে বারান্দায়। তার পাশে লতিফা। মোবারককে দেখে আবদুল করিম কিছু বলল না। উঠে ভেতরে চলে গেল। লতিফা বলল, আপনি কোথায় ছিলেন ভাইজান? সে চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। দুশ্চিন্তা করলে তার হাঁপানির টান উঠে। আমি তো আর সেটা জানি না। রাত একটা থেকে হাঁপানির টান উঠেছে। বারান্দায় বসে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। আমি ভয়ে অস্থির।
মোবারক লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল।
লতিফা বলল, ভাত খেয়ে এসেছেন?
না।
হাত-মুখ ধুয়ে আসেন ভাত দেই। কোথায় ছিলেন বলেন তো!
ভাত খাওয়ার সময় লতিফা সামনে থাকে। আজ নেই। না থাকলেই ভাল। আরাম করে খাওয়া যায়। অন্যের সামনে বিশ্রী ভঙ্গিতে দুআঙুলে নলা করে ভাত মুখে তুলতে ভাল লাগে না।
হাত ধোয়ার সময় লতিফা শুকনো মুখে সামনে দাঁড়াল।
ভাইজান, ওর হাঁপানির টানটা তো কমছে না। কেমন কেমন করে যেন শ্বাস নিচ্ছে। আমার তো খুব ভয় লাগছে। আপনি একটু এসে দেখে যান।
আসতেছি। তুমি কোন চিন্তা করবা না। ওর এইটা পুরানা অসুখ। ছোটবেলায় কত হয়েছে। একবার হল কি, ইস্কুলের কিছু দুষ্ট ছেলে আমাকে ধরে খুব মা’র দিল। নাক দিয়ে রক্ত-টক্ত বের হয়ে বিশ্রী অবস্থা। তাই দেখে করিমের হাপানির টান উঠে গেল। এখন-তখন অবস্থা, তাকে নিয়ে গেলাম সদর হাসপাতালে। চিন্তা কর অবস্থা! ভাইয়ে ভাইয়ে রক্তের বন্ধন তো। এই কারণে এরকম হয়।
আবদুল করিমের অবস্থা আসলেই খারাপ। শোঁ শোঁ শব্দ করে শ্বাস নিচ্ছে। মোবারককে দেখে সে চি চি করে ডাকল–ভাইজান!
মোবারক বলল, কথা বলিস না। চুপ করে শুয়ে থাক। আমি সতীশ ডাক্তারকে নিয়ে আসি।
অনেকদিন পর ভাইকে তুই বলল। তুই বলতে গিয়ে তার গলা ব্যথা করতে লাগল।
রাস্তাঘাট ফাঁকা। ফাঁকা রাস্তায় মোবারক এগুচ্ছে। তার কাটা আঙুলের চুলকানিটা এখন নেই। সতীশ ডাক্তারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে হয়। বড়ই রহস্যময় ব্যাপার। জগৎটাই রহস্যময়।
.
এই অঞ্চলের সবকটা স্ট্রিট লাইট নষ্ট। শেষ রাতের চাঁদের আলোয় চারদিক আবছা আবছা দেখাচ্ছে। কলঙ্ক ভরা চাঁদের আলো এত সুন্দর কেন? এই ধরনের উচ্চ শ্রেণীর দার্শনিক চিন্তা করতে করতে মোবারক লম্বা লম্বা পা ফেলছে। দার্শনিক চিন্তার কারণেই বোধহয় তার চোখ একটু পরপরই জলে ভিজে যাচ্ছে।
একজন শৌখিনদার মানুষ
সুলায়মানকে আজ বড় সুন্দর লাগছে।
আসমানী যতবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই মমতায় তার চোখ ছলছল করে উঠছে। গলার কাছে শক্ত কি একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। অথচ এ রকম হবার কোন কারণ নেই, সুলায়মান এমন কোন দূরে যাচ্ছে না। চার পাঁচ মাইল পথ। ইচ্ছা করলেই সে ছেলেকে দেখে আসতে পারে। আর ধরা যাক সে যদি যেতে না পারে সুলায়মানতো চলেই আসবে। তিনমাসের চুক্তি। তিনমাস কোন ব্যাপারই না।
সুলায়মান উঠানে একটা জলচৌকির উপর বসে ছিল। তার মুখ বিষণ্ণ। দেখলেই মায়া লাগে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে ইচ্ছা করে। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলে ছেলে রাগ করে তারপরেও সকাল থেকে আসমানী বেশ কয়েকবার ছেলেকে আদর করেছে। শেষবারে সুলায়মান ঝটকা মেরে মায়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলেছে–দিক করবা না। খবর্দার দিক করবা না।
আসমানী দুঃখিত গলায় বলেছে, রাগ করস ক্যান?
শইল্যে হাত দিলে ভাল লাগে না।
সুলায়মানের বয়স বারো। রোগা বলে তার বয়স আরো কম মনে হয়। বড় বড় চোখ, খাড়া নাক। গলার স্বরও চিকন। বাইরে থেকে দেখলে তাকে খুব নরম স্বভাবের। ছেলে বলে মনে হয়। মনে হয় সে চোখ মেলে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। কিন্তু মা’র সঙ্গে সে বড় খারাপ ব্যবহার করে। আসমানীর মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয়। তিন। মাসের জন্যে যে ছেলে চলে যাচ্ছে তাকে আদর করতে গেলে সে কঠিন হয়ে যাবে ধাক্কা দিয়ে মা’র হাত সরিয়ে দেবে এটা মনে হলেই চোখে পানি এসে যায়। আসমানীর চোখে পানি এসে গেলেও সে চোখের পানি সামলেছে। মা’র চোখে পানি দেখলেও ছেলে রাগ করে। কর্কশ গলায় বলে, ক্যান কান্দ? তার কর্কশ গলাটাও ঠিক কর্কশ শোনায় না। মিষ্টি গলার মানুষ কর্কশ কথা বললেও মিষ্টি শোনায়।
আসমানী আদুরে গলায় ডাকল, ও সুলায়মান।
সুলায়মান ঘাড় ঘুরিয়ে মা’র দিকে তাকাল। তার ভুরু কুঁচকে আছে–মনে হচ্ছে মা’র ডাকেও সে বিরক্ত।
রইদে বইয়া আছস। ছেমা’র মইদ্যে আয়।
দিক করবা না মা।
কার্তিক মাসের রইদ ভালা না। জ্বর হয়।
হউক জ্বর।
কিছু খাইবি বাপধন?
না।
নাইরকেল দিয়া মুড়ি মাইখ্যা দেই?
সুলায়মান হ্যাঁ না কিছু না বলে মুখ ফিরিয়ে নিল। সে খাবে কি খাবে না বোঝ যাচ্ছে না। আসমানী নারকেল কুরানি নিয়ে বসল। নারিকেল মুড়ি সুলায়মানের খুব প্রিয়। খেজুর গুড় থাকলে ভাল হত। ঘরে গুড় নেই। সুলায়মানের বাবা হাটে গেছে। তাকে খেজুর গুড়ের কথা বলা হয়েছে। আনবে কি আনবে না কে জানে। হয়ত আনবে। সুলায়মানের কথা বলে সে গুড় আনতে বলেছে। ছেলের কথা মনে করে সে হয়ত আনবে। তাছাড়া তার কাছে টাকা আছে। তিনমাসের চুক্তিতে সুলেমান কাজ করতে যাচ্ছে। অগ্রিম দুহাজার টাকা তাকে দেয়া হয়েছে। তিন মাসের চুক্তি শেষ হলে বাকি তিন হাজার টাকা পাওয়া যাবে। অনেকগুলি টাকা। মাত্র বার বছর বয়সে এতগুলি টাকা রোজগার সহজ কথা না। টাকা ছাড়াও ব্যাপার আছে। এই তিনমাস সুলেমান সুখে থাকবে। হাশেম মিয়া সুলেমানকে নিচ্ছেন। তিনি বড় শৌখিনদার মানুষ। তার কাছে সুলেমানের আদর যত্ন এবং খাওয়া-খাদ্যের অভাব হবে না। কাপড় চোপড়েরও অভাব হবে না। শৌখিনদার মানুষ সব ব্যাপারেই শৌখিন। সুলেমান থাকবে সুখে।
হাশেম মিয়ার গান বাজনা খুব পছন্দ। যৌবনকালে যাত্রার দলও করেছিলেন—নিউ সালেহা বানু অপেরা পার্টি। সালেহা বানু তার প্রথম স্ত্রীর নাম। যাত্রা দল বেশী দিন টেকে নি। তবে তার উৎসাহে কোন ভাটা পড়ে নি। যাত্রাদল না থাকলেও স্থানীয় গান বাজনার যে কোন দলকেই তিনি টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। গানের আসরে প্রয়োজনে তবলার ঠেকা দেন। ব্যাঞ্জো নামের একটা যন্ত্র তিনি একসময় বেশ ভালই। বাজাতেন।
শৌখিনদার মানুষ এইসব করবেই। এটা দোষের কিছু না। শৌখিনদার মানুষ না থাকলে সাধারণ মানুষরা বিনোদন পাবে কোথায়? সাধারণ মানুষের শখ আছে–শখের পেছনের অর্থ কোথায়? আসর সাজিয়ে হ্যাজাক বাতি জ্বালাবে শৌখিনদার, তারা শুধু গভীর বিস্ময় ও গভীর আনন্দ নিয়ে গোল হয়ে বসবে চারদিকে। বার বার রোমাঞ্চিত হবে।
হাশেম মিয়া তিন মাস সুলেমানকে নিজের বাড়িতে রাখবেন। এক ধরনের সাহায্য। গান বাজনায় সাহায্য। সাধারণ মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে এই জাতীয় সাহায্য তিনি প্রতি বছরই করেন। এবারো করছেন। গ্রামে ঘেঁটু গানের দল হয়েছে। ছয় জন বালক নিয়ে দল। ছয়জনের ভেতর তিনজন মেয়ে সাজবে। তিন কিশোরী ও তিন বালকের দল। এরা নাচবে, গান গাইবে। আসরের ভেতর জড়াজড়ি করবে, নানান অঙ্গ ভঙ্গি করবে।
অঙ্গ ভঙ্গিগুলি ভাল না। গানের কথাগুলিও ভাল না। তাতে কি? ঘেঁটু নাচের বিষয়টাই এ রকম। গভীর রাতে দেখতে ভাল লাগে। যারা দেখে তাদের বুকের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য হয়। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। এইটাইতো মজা। ভাল ভাল মজার মধ্যে কিছু নোংরামী থাকবেই।
শৌখিনদার মানুষরা সাহায্য না করলে দরিদ্র গ্রামের পক্ষে এইসব দল করা সম্ভব না। হাশেম মিয়া ভালই সাহায্য করছেন। দু’টা ছেলেকে নিজের বাড়িতে খরচ দিয়ে রাখছেন। ড্যান্স মাষ্টারকেও রাখছেন। দশ হাজার টাকা তার গেছে শুধু ছেলে দু’টার জন্যে। ড্যান্স মাষ্টারের জন্যে তিন হাজার–সিগারেটের খরচ আলাদা। ড্যান্স মাষ্টার মকবুল খাঁ মাসে সিগারেটই খাচ্ছে হাজার টাকার।
.
নারকেল কোরা শেষ করে আসমানী উঠে দাঁড়াল। গুড় আসুক তখন ভালমত মেখে ছেলেকে খেতে দেবে। এখন সংসারের অন্য কাজকর্ম দেখতে হবে। সুলেমান ছাড়াও তার চারটা সন্তান আছে। বড়টা নেত্রকোনায় এক চায়ের দোকানে কাজ করে। মাসের শেষে সত্তর টাকা হাত খরচ পায়। আর দু’টা যমজ। বাড়িতে থাকে না। সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, শুধু ভাত খাবার সময় উঁকি দেয়। ভাত সব সময় থাকে না। তারা তাতে বিচলিত হয় না, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যায়। আসমানীর সর্ব কনিষ্ঠ সন্তানটিই মেয়ে। সে সারা বৎসর রোগে ভুগে। এখনও জ্বর উঠেছে। শুয়ে আছে বিছানায়। সুলেমানের ব্যাপারে সে অস্থির বলে মেয়ের খোঁজ সারাদিনে একবারও নেয়া হয়নি। জ্বর বেড়েছে কিনা সে জানে না। হয়ত বেড়েছে। বাড়লেও মেয়ে কিছু বলবে না। তার ছেলেমেয়েরা বড়ই লক্ষ্মী। শুধু সুলেমানের মেজাজ ভাল না। সে অল্পতেই রেগে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি করে। তার স্বভাব চরিত্র অদ্ভুত।
আসমানী ছেলের দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে ডাকল, ও সুলেমান।
সুলেমান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আহারে কি সুন্দর চেহারা। কি সুন্দর চোখ। চোখের দিকে তাকালেই মায়ায় মনটা উদাস হয়। আসমানী বলল, কার্তিক মাসের রইদ বালা না রে বাপধন।
সুলেমান কিছু বলল না, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। আসমানী স্বস্তি বোধ। করল। সে ভেবেছিল ছেলে আবারো রেগে যাবে।
মুড়ি খাবি?
দেও।
গুড় নাই, খালি নাইরকেল আর মুড়ি।
আইচ্ছা।
আসমানী এক বাটি মুড়ি সামনে রাখল। সুলেমান মুড়ি চিবুচ্ছে। কুট কুট করে খাচ্ছে। আহারে কি সুন্দর লাগছে।
মা।
কি রে ময়না।
আমি বাড়িত থাকমু। গানের দলে যামু না।
আসমানী মনে মনে বলল, আইচ্ছা।
লোকে আমারে নিয়া কুকথা কয়, হাসে।
আমি বলব তোর বাপরে।
বলেই মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। উপায় নেই। সুলেমানকে যেতেই হবে। বায়নার দুহাজার টাকা নেয়া হয়ে গেছে। আরো টাকা আসবে। সংসার টাকাগুলির জন্যে হা করে আছে।
আসমানী ছেলের মাথায় হাত রাখল। ছেলে ঝটকা মেরে মা’র হাত সরিয়ে দিল। আসমানী সাহস পেয়ে ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। সুলেমান তখনো কিছু বলল। তার বড় বড় চোখ শুধু ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করল। আসমানীর মনে হল ছেলে তার কথা বিশ্বাস করে ফেলছে। সে হয়ত ভাবছে মা তাকে পাঠাবে না।
.
হাশেম মিয়া সুলেমানকে দেখে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। ঘেটু দলের জন্যে এরকম সুন্দর ছেলেই দরকার। ড্যান্স মাষ্টার সুলেমানকে মেয়েদের পোষাক পরিয়ে দিয়েছেন। ঠোঁট লিপস্টিক দিয়ে লাল টুকটুক করা হয়েছে। নারকেল মালা দিয়ে বুক উঁচু করা। সুলেমানের লম্বা চুল বেণী করা। বুক দু’টা কেমন উঁচু হয়েছে। আরেকটু কম হলে মানানসই হত। তবু সুন্দর লাগছে। খুব সুন্দর। এমন সুন্দর লাগছে যে চোখ ফেরানো যায় না। হাশেম মিয়া ড্যান্স মাষ্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, গলা কেমুন?
গলা খুবই চমৎকার। সুলেমান, দেখি একটা গান শুনা।
সুলেমান রিনরিনে গলায় গান ধরল,
কোথায় তোমার ঘর বান্ধই
কোথায় তুমি থাক?
তোমার শাড়ির অঞ্চলে বান্ধই
কারে গোপন রাখ?
বলব না বলব না বান্ধই
আমার গোপন কথা।
শাড়ি খুইল্যা দেখামু বান্ধই
……. (মুদ্রণ যোগ্য নয়)
গান গাইতে গাইতে সুলেমান শাড়ি খোলার ভঙ্গি করল। হাশেম মিয়া বললেন, মধু মধু। কাছে আয়।
সুলেমান কাছে এগিয়ে গেল। হাশেম মিয়া তার গাল টিপে আদর করলেন।
. হাশেম মিয়ার স্ত্রী সন্ধ্যা থেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে। ঘেঁটু নাচের ছেলে বাড়িতে থাকতে এলে বাড়ির মেয়েরা চোখের জল ফেলে। এই নিয়ম ঘেটু নাচের মতই প্রাচীন নিয়ম। হাশেম মিয়ার সুন্দরী স্ত্রী কেঁদে নিয়ম রক্ষা করে। কারণ শৌখিনদার মানুষরা ঘেঁটু নাচের বালকদের বড়ই পছন্দ করে। শৌখিনদার মানুষ যখন রাতে স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমুতে আসে তখন ঘেঁটু বালককেও সঙ্গে নিয়ে আসে। সেই বালক রাতে স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে ঘুমায়।
কবর
ফুলির মা ক্ষীণ গলায় বলল, আফা চাচাজান কি ফিরিজের ভিতরে থাকব?
মনিকা দু’টা রিলাক্সিন খেয়ে শুয়েছিল। ফুলির মা’র কথা শুনে উঠে বসলো। চট করে তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। রিলাক্সিন মানুষের নার্ভ ঠাণ্ডা করে, তারটাও করেছিল, ঝিমুনির মত এসে গিয়েছিল-ফুলির মা’র কথায় ঝিমুনি কেটে গেল। এই বোকা কাজের মহিলাটা তাকে বিরক্ত করে মা’রছে। অসহ্য। অসহ্য।
মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কি বললে?
ফুলির মা প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করার সাহস পেল না। যদিও একজন মৃত মানুষকে ফ্রীজে রেখে দেয়ার ব্যাপারটা তাকে খুব ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। একটা মানুষ গত তিন দিন ধরে ফ্রীজে ঠাণ্ডা হচ্ছে। এটা কেমন বিচার?
ফুলির মা চলে যেতে ধরেছিল। মনিকা তাকে ফিরাল। কঠিন গলায় বলল, যেও না তুমি, দাঁড়াও। একই প্রশ্ন তুমি বার বার করছ কেন? তোমাকে কি আমি বুঝিয়ে বলিনি?
জ্বে বলছেন।
তুমি বুঝতে পারনি?
জ্বে পারছি।
তাহলে কেন বার বার বিরক্ত করছ?
মানুষটা ফিরিজের মইধ্যে থাকব।
মনিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, শোন ফুলির মা। ব্যাপারটা সেরকম না। আমার ভাই বোনরা সব দেশের বাইরে। সবাই বাবার ডেড বডি শেষ বারের মত দেখতে চাচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। সবাই দূরে দূরে থাকে। কেউ আমেরিকা কেউ জাপান। ইচ্ছা করলেই ছুটে আসতে পারে না। অনেক সময় প্লেনের টিকিট পাওয়া যায় না। বুঝতে পারছতো ব্যাপারটা? ওরা যেন শেষ দেখা দেখতে পারে সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। বাবাকে বারডেমের একটা ঠাণ্ডা ঘরে রাখা হয়েছে। যাতে ডেড বডি নষ্ট না হয়। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
সবাই যখন বাবাকে শেষ দেখা দেখে ফেলবে তখন তাঁকে যথারীতি গোর দেয়া হবে। বুঝতে পেরেছ?
জ্বি পারছি।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, চলে যাও। নাকি তোমার আরো কিছু বলার আছে? বলার থাকলে বল। কিন্তু এরপর আর বিরক্ত করতে পারবে না।
জ্বে না। কিছু বলার নাই। কিন্তু আফা ফিরিজের মইধ্যে গোর আজাব ক্যামনে হইব।
কি বললে?
মিত্যুর পরে গোর আজাব হয়। মানকের নেকের আয়। আল্লাপাকের দুই ফিরিশতা। ফিরিজের মইধ্যে…..
তুমি আমার সামনে থেকে যাও ফুলির মা। তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ। হোয়াট এ নুইসেন্স।
বিরক্তিতে মনিকার ঠোঁট বেঁকে গেল। তার ভাবতেই খারাপ লাগছে এরকম নির্বোধ একজন মহিলার হাতে শেষ সময়ে তার বাবার দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল। সে নিশ্চয়ই কিছু বুঝতেই পারে নি। শেষ সময়ে শ্বাস কষ্ট হয়, অক্সিজেন দেয়ার দরকার পড়ে। বুদ্ধিমান একজন মানুষ ছুটাছুটি করে ব্যবস্থা করতো। ফুলির মা নিশ্চয়ই সেই ভয়াবহ সময়ে পান খেতে খেতে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
ফুলির মা তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমাকে না যেতে বললাম।
আফা আপনের শাড়ি ঠিক করেন, হাঁটুর উপরে উইঠ্যা গেছে।
আমার শাড়ি কোথায় উঠেছে না উঠেছে তা তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি তোমার কাজে যাও।
ফুলির মা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, মরা বাড়িত তিন দিন কাজ কাম করা নিষেধগো আফা। তিন দিন, তিন রাইত চুলা জ্বলে না।
টেলিফোন বাজছে। মনিকা টেলিফোন ধরার জন্যে প্রায় ছুটে গেল। আমেরিকায় কল বুক করা হয়েছে। লাইন অসম্ভব বিজি। কিছুতেই লাইন পাওয়া যাচ্ছে না।
হ্যালো হ্যালো।
কে মনিকা আপু?
হা। টিকিট পেয়েছিস?
পেয়েছি তবে কনফার্মড না। এয়ারপোর্টে বসে থাকতে হবে।
সবাই আসছিস?
পাগল হয়েছ। পাপ্পু গেছে সামা’র ক্যাম্পে, পাপ্পুর বাবা একুশ তারিখ যাবে বেলজিয়াম। ওর কনফারেন্স।
বেলজিয়ামের কোথায় যাবে?
লীয়েগে না–কি যেন নাম। ও আচ্ছা তুমিও তো বেলজিয়াম গিয়েছিলে জায়গাটা কেমন আপা?
সুন্দর। খুব সুন্দর। শহর থেকে বের হলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
পাপ্পুর বাবার সঙ্গে আমারো যাবার কথা ছিল…. এর মধ্যে এই খবর।….
টেলিফোন লাইনে কি একটা গন্ডগোল হচ্ছে, কটু করে একটা শব্দ হল। লাইন কেটে গেল।
মনিকা বিরক্ত মুখে রিসিভার নামিয়ে রাখার সময় দেখল, ফুলির মা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। টেলিফোনে কি কথাবার্তা হচ্ছে হা করে শুনছে। মনিকা আঁঝালো গলায় বলল, তোমাকে না বললাম চলে যেতে।
কই যামু?
যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও। সব সময় গা ঘেঁসে থাকবে না।
জ্বি আইচ্ছা। আফা আপনের শাড়ি হাঁটুর উপরে উইট্টা রইছে।
একবারতো বললাম, আমার শাড়ি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। জ্বি
আইচ্ছা।
আমার জন্যে চা বানিয়ে আন। দুধ চিনি কিছুই দেবে না, আমি দিয়ে নেব।
মরা বাড়িত চূলা জ্বালা নিষেধ আছে আফা। তিনদিন চুলা বন থাকব।
তুমি এক্ষুনি গিয়ে চুলা জ্বালাবে। চা করবে। আজে বাজে কথা বলবে না, মোটেও তর্ক করবে না। আজে বাজে কথা এবং তর্ক দু’টাই আমি অপছন্দ করি।
জ্বি আইচ্ছা।
কথা বলে বলে তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ। এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন।
শাড়িটা ঠিক করেন আফা।
মনিকা শাড়ি ঠিক করল। তার মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ছে। টেনশান ঘটিত যন্ত্রণা। সব তাকে একা করতে হচ্ছে।
এমন কেউ নেই যাকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তার ধারণা এই কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষদের স্বভাবে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। সবাই দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী। দায়িত্ব নেয়া পর্যন্তই। একবার দায়িত্ব নিয়ে নেবার পর আর কোন খোঁজ পাওয়া যাবে না।
বারডেমে ডেডবডি রাখার দায়িত্ব নুরুদ্দিন নামের এক লোক (মনিকার দূর সম্পর্কের মামা) নিয়েছিল। খুব আগ্রহের সঙ্গে নিয়েছিল। বারডেমের ডিরেক্টর সাহেব -কি তার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। একসঙ্গে উঠা-বসা। টেলিফোন করা মাত্র ব্যবস্থা হবে।
মনিকা বলেছিল, জায়গা থাকলে তবেই না ব্যবস্থা হবে। শুনেছি মাত্র তিনটা ডেডবডি রাখার ব্যবস্থা ওদের আছে। তিনটাই যদি অকুপায়েড থাকে?
অকুপায়েড থাকলেও ব্যবস্থা হবে। দরকার হলে অন্য ডেডবডি ফেলে দিয়ে ব্যবস্থা হবে। এই ব্যাপারটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও তো।
মনিকা ছেড়ে দিয়েছিল। নুরুদ্দীন সাহেব সকাল নটার সময় দায়িত্ব নিয়ে হাসিমুখে চলে গেলেন। যাবার সময় বলে গেলেন তিনি এক ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা করছেন। এই যে তিনি গেলেন–গেলেনই। আর ফিরলেন না। শেষ পর্যন্ত মনিকার নিজেরই যেতে হল।
এই অবস্থায় মিনিটে মিনিটে মাথা ধরবে নাতো কি? প্রতিটি কাজ তাকে নিজেকে দেখতে হচ্ছে। আত্মীয় স্বজনদের টেলিফোন করা। প্লেনে আসবে তাদের আনার জন্যে এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠানো। কে কোথায় থাকবে সেই ব্যবস্থা করা। বিছানা, বালিশ, মশারী….
আফা আপনের চা।
দুধ চিনি দিয়ে নিয়ে এসেছ?
জি।
তোমাকে না বলেছিলাম দুধ চিনি ছাড়া চা আনতে। তুমি কি ইচ্ছা করেই আমাকে বিরক্ত করছ?
ফুলির মা হাই তুলল। মনিকার কথাকে সে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মনিকা চায়ে চুমুক দিল। আশ্চর্যের ব্যাপার চা খারাপ হয়নি। দুধ চিনি সবই পরিমাণ মত হয়েছে।
আফা, টেলিফোনে কার সাথে কথা কইতেছিলেন?
তা দিয়ে তোমার দরকার আছে?
আফনের ছোড ভইন?
হা আমার ছোট বোন মৃন্ময়ী। ও সিয়াটলে থাকে।
ছোড আফা কি আইতাছে?
হ্যাঁ, আসছে। ভাল কথা, ও যে এসে থাকবে–কোথায় থাকবে? ব্যবস্থা আছে। কোন?
ফুলির মা দাঁত বের করে হাসল।
মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, হাসছ কেন?
সব ব্যবস্তা আছে আফা। খালুজান সব ব্যবস্তা রাখছে। আফনের জইন্যে আলাদা ঘর, মেজো আফার জইন্যে আলাদা ঘর, ছোড আফার ঘর, ভাইজানের ঘর। আফা ভাইজান আসতাছে না?
তোমার এত খবরের দরকার নেই। তুমি ঘর গুছিয়ে ঝাড়পোছ করে রাখ।
ভাইজান কি খবর পাইছে আফা?
কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছ ফুলির মা। সামনে থেকে যাও।
ফুলির মা গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। কারণ টেলিফোন বাজছে। টেলিফোনে কেউ যখন কথা বলে ফুলির মা’র শুনতে ভাল লাগে। টেলিফোন করেছে মৃন্ময়ী। তার গলার স্বরে স্পষ্ট বিরক্তি—
আপা, বাংলাদেশের টেলিফোনের একি অবস্থা। এই যে লাইন কেটে গেল তারপর থেকে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটা সামান্য টেলিফোনের জন্যে যদি এত সময় নষ্ট হয় তাহলে দেশ চলবে কি ভাবে।
দেশ চলছে না, এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
আমার তাই ধারণা।
দেশে আয়, এলে দেখবি দি কান্ট্রি ইজ গোয়িং টু দ্যা ড্রেইন।
মনিকা আপু, ভাইয়া কি খবর পেয়েছে?
ও খবর পেয়েছে সবার আগে। ওর কাছ থেকে আমি জানলাম।
ভাইয়া আসছে?
হ্যাঁ আসছে। আগামীকাল সকালে এসে পৌঁছাবে।
ভাইয়া একা আসছে?
তার স্ত্রীও আসবে।
তাহলেতো খুব ভাল হয়। ভাইয়ার বিদেশী বউ এখনো দেখিনি। অবশ্যি টেলিফোনে অনেকবার কথা হয়েছে। কেমন যেন হাস্কি ভয়েস।
ঠিকই বলেছিস–থমথমে গলা। এখন অবশ্যি মেয়েদের হাস্কি ভয়েসই সবার পছন্দ।
আপা ভাইয়ার পারিবারিক জটিলতার কথা কি সব শুনেছিলাম, তুমি কিছু জান?
জানি।
বলতো শুনি।
মনিকা মাউথপিস হাত দিয়ে চেপে কাটা গলায় বলল, ফুলির মা। তুমি শুধু শুধু দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও বললাম সামনে থেকে।
কার সাথে কথা কন আফা?
কার সঙ্গে কথা বলি তা জেনে তোমার কি হবে?
এম্নে জিগাইছিলাম।
যাও বললাম। যাও।
ফুলির মা নিতান্ত অনিচ্ছায় রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। মনিকা মাউথপিস থেকে হাত সরিয়ে বলল, হ্যালো হ্যালো।
মৃন্ময়ী বলল, কার সঙ্গে কথা বলছিলি–আপা?
ফুলির মা।
ফুলির মাটা কে?
আর বলিস না–শি ইজ এ পেস্ট। শেষ সময়ে বাবার দেখাশোনা করেছে। বুদ্ধির বংশটা নেই, সারাক্ষণ কথা বলে। ওর কথাবার্তা থেকে মনে হয় বাবা তাকে যথেষ্ঠ লাই দিয়েছেন। লাই না পেলে এত কথা বলার সাহস হত না। এমনভাবে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন এ বাড়ির সেই মালিক।
বয়স কত আপা?
কে জানে বয়স কত। আমিতো আর বয়স জিজ্ঞেস করিনি। পঁয়ত্রিশ ছয়ত্রিশ হবে। বেশীও হতে পারে। বয়স জিজ্ঞেস করছিস কেন?
এম্নি জিজ্ঞেস করলাম। আপা ঢাকায় এখন টেম্পারেচর কত?
জানি না কত। তবে বেশ গরম। শেষ রাতের দিকে একটু অবশ্যি ঠান্ডা পড়ে তবে ফ্যান ছেড়ে রাখতে হয়।
আপা মেয়েটার স্বাস্থ্য কেমন?
কার স্বাস্থ্য কেমন?
ফুলির মা।
মনিকা বিস্মিত গলায় বলল, তার স্বাস্থ্য কেমন এটা জানতে চাচ্ছিস কেন?
মৃন্ময়ী অস্বস্তির সঙ্গে বলল, শেষ বয়সের বুড়োদের মধ্যে নানান ধরনের পারভারসান দেখা দেয়। এই জন্যেই জিজ্ঞেস করা।
কি আজে বাজে কথা বলছিস?
সরি আপা। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। তবে অসুস্থ অবস্থায় দেখা শোনার জন্যে কাজের মেয়ে না রেখে বাবা অনায়াসে একজন নার্স রাখতে পারতো। এমনতো না যে বাবার টাকার অভাব।
চব্বিশ ঘন্টার জন্যে নার্স হয়ত পাওয়া যায় না।
পাওয়া যায় না কেন? টাকা দিলে সবই পাওয়া যায়।
রান্নাবান্নার জন্যেতো লোক দরকার। রান্নাবান্নাতো আর নার্স করে দেবে না।
তাও ঠিক। আপা মেয়েটা কত দিন ধরে আছে?
জিজ্ঞেস করিনি।
টেলিফোনে কট কট কট শব্দ হতে লাগল। মৃন্ময়ীর গলা খুবই অস্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে। মনিকা রিসিভার নামিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। মৃন্ময়ীর কথাগুলি সে মন থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারছে না।
ফুলির মা, ফুলির মা?
ফুলির মা দরজার ওপাশ থেকে বলল, জ্বি। সে যায়নি, দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। মনিকা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। এই মহিলার স্বাস্থ্য ভাল, বয়স কত হবে, চল্লিশ না-কি তারচেও কম? পুরুষ্টু ঠোঁট। বেঁটে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছে। পুরুষরা পুরুষ্টু ঠোঁট পছন্দ করে। ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে?
ফুলির মা।
জ্বী।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি সামনে থেকে যাও।
কি বলতে চাইছেন বলেন।
না-কিছু বলব না, তুমি সামনে থেকে যাও।
ফুলির মা গেল না। সামনে দাঁড়িয়ে রইল। মনিকা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, যাচ্ছ না কেন?
ফুলির মা বলল, খালি যাও যাও করেন ক্যান আফা? আফনের আব্বার ছিল উল্টা স্বভাব, এক মিনিটের জন্যে সামনে না থাকলে অস্থির হইয়া পড়ত। রোগ শোকে মাইনষের মাথা যায় আউলাইয়া।
ফুলির মা, তুমি সামনে থেকে যাও।
অনিচ্ছায় ফুলির মা ঘর থেকে বের হল। মনিকা সঙ্গে সঙ্গে ডাকল, ফুলির মা শুনে যাও। তুমি বরং এক কাজ কর। তুমি দেশের বাড়িতে চলে যাও। তোমার মেয়ে ফুলির কাছে যাও।
ফুলির কাছে যাব ক্যামনে? সেতো বাইচ্যা নাই।
তাহলে অন্য কোথাও যাও। তোমাকে আমরা রাখব না।
আমি কি করলাম?
তুমি কিছুই করনি–তারপরেও রাখব না। তুমি চলে যাও। শেষ সময়ে বাবার দেখাশোনা করেছ। তার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
দোষ ঘাট কি কিছু করছি আফা?
না, দোষ কিছু করনি। কিন্তু তোমাকে আমার পছন্দ হচ্ছে না।
আফনের পিতা আমায় বড়ই পছন্দ করতেন।
যিনি পছন্দ করতেন, তিনিতো নেই বুঝতে পারছ?
জ্বি।
তোমাকে টাকা পয়সা হিসাব করে দিচ্ছি–তুমি চলে যাও।
ফুলির মা বারান্দায় চলে এল। তার মনটা খারাপ লাগছে। বাড়ি ছেড়ে যেতে হচ্ছে সে জন্যে খারাপ লাগছে না, চিরকাল এক বাড়িতে তাদের মত মানুষ থাকে না। কলমি শাকের মত তাদের জায়গা বদল করতে হয়। তবে তার খুব শখ ছিল সবাইকে চোখের দেখা দেখা। বুড়ো মানুষটার কাছে এদের কথা এত শুনেছে। একটা সুযোগ পাওয়া গেছে দেখার।
বুড়ো মানুষটার শেষকালে কথা বলার রোগে পেয়ে গিয়েছিল। সারাক্ষণ কথা বলত। একটা গল্প শেষ করে আবার সেই গল্প শুরু করত। মনেই থাকত না, এই গল্প সে একটু আগেই বলেছে। বুড়ো হবার কত যন্ত্রণা।
সে ঘুমাতো বুড়ো মানুষটার ঘরে মেঝেতে বিছানা পেতে। ঘুম হত না। মিনিটে মিনিটে ডাকলে কি ঘুম হয়। একেবারে শেষের দিকে লোকটার মনে মৃত্যুভয় ঢুকে গেল। বিছানায় একা ঘুমুতে পারে না। ছেলেমানুষের মত কাঁদে আর বলে, ও ফুলির মা ভয় লাগছে। ও ফুলির মা, ভয় লাগছে।
ভয় কাটানোর জন্যে ফুলির মা শেষ সময়ে বুড়ো মানুষটার বিছানায় উঠে এসেছিল। তার হাত ধরে বসে থাকতো। একটু পর পর বলতো, আমি আছি কোন ভয় নাই। আরাম কইরা ঘুমান।
এইসব কথা মেয়েগুলিকে বলা যাবে না। মেয়েগুলি মনে কষ্ট পাবে। কি দরকার কষ্ট দিয়ে?
ফুলির মা সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ছেড়ে নিজের গ্রামের দিকে রওনা হল। তার চেহারা সুখি সুখি। দু’টা পান মুখে দেয়ায় ঠোঁট লাল। কিন্তু তার মনটা বিষণ্ণ। যে লোকটা একা ঘুমুতে ভয় পেত আজ সে একা একা ঠান্ডা একটা ফ্রীজে পড়ে আছে। গোর আজাব শুরু হয়েছে কিনা কে জানে? মানকের নেকের কি এসেছে?
প্রশ্নের জবাব বুড়ো মানুষটা দিতে পারবেতো?
বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে মানকের নেকেরের প্রশ্ন এবং উত্তর সম্পর্কে ফুলির মা বুড়ো মানুষটাকে অনেকবারই বলেছে। জীবিত অবস্থায় শেখা বিদ্যা কি মৃত্যুর পর কাজে আসে? কে জানে? জগৎ বড়ই রহস্যময়।
চোখ
আজ বাদ-আছর খেজুর কাঁটা দিয়ে মতি মিয়ার চোখ তুলে ফেলা হবে চোখ তুলবে নবীনগরের ইদরিস। এই কাজ সে আগেও একবার করেছে।
মতি মিয়াকে আটকে রাখা হয়েছে বরকত সাহেবের বাংলা ঘরে। তার হাত-পা বাঁধা। একদল মানুষ তাকে পাহারা দিচ্ছে। যদিও তার প্রয়োজন ছিল না, পালিয়ে যাওয়া দূরের কথা, মতি মিয়ার উঠে বসার শক্তি পর্যন্ত নেই। তার পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। ডান হাতের সব কটা আঙুল থেতলে ফেলা হয়েছে। নাকের কাছে সিকনির মত রক্ত ঝুলে আছে। পরনের সাদা পাঞ্জাবি রক্তে মাখামাখি হয়ে গায়ের সঙ্গে লেগে গেছে। ঘন্টাখানেক আগেও তার জ্ঞান ছিল না। এখন জ্ঞান আছে, তবে বোধশক্তি ফিরেছে বলে মনে হয় না। তার চোখ তুলে ফেলা হবে এই খবরেও সে বিচলিত হয়নি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে, নয়ন কখন তুলবেন?
এই পর্ব বাদ-আছর সমাধা হবে শুনে সে মনে হল নিশ্চিন্ত হল। সহজ গলায় বলল, পানি খামু, পানি দেন।
পানি চাইলে দিতে হয়। না দিলে গৃহস্থের দোষ লাগে। রোজ হাশরের দিন পানি পিপাসায় বুক যখন শুকিয়ে যায় তখন পানি পাওয়া যায় না। কাজেই এক বদনা পানি এনে মতির সামনে রাখা হল। মতি বিরক্ত গলায় বলল, মুখের উপরে পানি ঢাইল্যা না দিলে খামু ক্যামনে? আমার দুই হাত বান্ধা, আপনেরার এইটা কেমুন বিবেচনা?
যে বদনা এনেছে সে মোড়ায় বসে থাকা একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, পানি ঢাইল্যা দিমু হাসান ভাই?
হাসান আলী মতিকে কেন্দুয়া বাজার থেকে ধরে এনেছে। মতির ওপর এই কারণেই তার অধিকার সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। মতির বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হলে হাসান আলীর মতামত জানা দরকার। হাসান আলী পানি বিষয়ে কোন। মতামত দিল না, বিস্মিত হয়ে বলল, হারামজাদা কেমন টং-এ কথা কয় শুনছেন? তার চউখ তোলা হইব এইটা নিয়া চিন্তা নাই। ক্যাটক্যাট কইরা কথা বলতেছে। কি আচানক বিষয়! ঐ হারামজাদা, তোর মনে ভয়-ডর নাই?
মতি জবাব দিল না, থু করে থুথু ফেলল। থুথুর সঙ্গে রক্ত বের হয়ে এল। তাকে ঘিরে ভিড় বাড়ছে। খবর ছড়িয়ে পড়েছে। একজন জীবিত মানুষের চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে তুলে ফেলা হবে এমন উত্তেজক ঘটনা সচরাচর ঘটে না। আশা করা যাচ্ছে, আছর ওয়াক্ত নাগাদ লোকে লোকারণ্য হবে। মতিকে দেখতে শুধু যে সাধারণ লোকজন আসছে তা না, বিশিষ্ট লোকজনও আসছেন। কেন্দুয়া থেকে এসেছেন রিটায়ার্ড স্টেশন মাস্টার মোবারক সাহেব। নয়াপাড়া হাই স্কুলের হেডমাস্টার সাহেবও এসেছেন। হাসান আলী নিজ চেয়ার ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দিল। তিনি পাঞ্জাবির পকেট থেকে চশমা। বের করতে করতে বললেন, এরই নাম মতি?
হাসান আলী হাসিমুখে বলল, জ্বে হেডমাস্টার সাব, এই হারামজাদাই মতি। বাদ আছর হারামজাদার চউখ তোলা হইব।
এরে ধরলা ক্যামনে?
সেইটা আপনের এক ইতিহাস।
পানদানিতে পান চলে এসেছে। হেডমাস্টার সাহেব পান মুখে দিতে দিতে উৎসাহে সঙ্গে বললেন, ঘটনাটা বল শুনি। সংক্ষেপে বলবা।
হাসান আলী এগিয়ে এল। মতিকে ধরে আনার গল্প সে এ পর্যন্ত এগারোবার বলেছে। আরো অনেকবার বলতে হবে। বিশিষ্ট লোকজন অনেকেই এখনো আসেন নি। সবাই আলাদা আলাদা করে শুনতে চাইবেন। তাতে অসুবিধা নেই। এই গল্প এক লক্ষবার করা যায়। হাসান আলী কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল।
ঘরে কেরাছি ছিল না। আমার পরিবার বলল, কেরাছি নাই। আমার মিজাজ গেল খারাপ হইয়া। হাটবারে কেরাছি আনলাম, আর আইজ বলে কেরাছি নাই, বিষয় কি! যাই হউক, কেরাছির বোতল হাতে লইয়া রওনা দিলাম। পথে সুলেমানের সাথে দেখা। সুলেমান কইল, চাচাজী, যান কই?…
.
মতি নিজেও হাসান আলীর গল্প আগ্রহ নিয়ে শুনছে। প্রতিবারেই গল্পের কিছু শাখা-প্রশাখা বের হচ্ছে। সুলেমানের কথা এর আগে কোন গল্পে আসেনি। এইবার এল। সুলেমানের ভূমিকা কি কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
হাসান আলী গল্প শেষ করল। হেডমাস্টার সাহেব মুগ্ধ গলায় বললেন, বিরাট সাহসের কাম করছ হাসান। বিরাট সাহস দেখাইছ। কামের কাম করছ। মতির সাথে
অস্ত্রপাতি কিছু ছিল না?
জ্বে না।
আল্লাপাক তোমারে বাঁচাইছে। অস্ত্রপাতি থাকলে উপায় ছিল না। তোমারে জানে শেষ কইরা দিত।
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, চউখ তোলা হইব কথাটা কি সত্য?
জ্বে সত্য। এইটা সকলের সিদ্ধান্ত। চউখ তুললেই জন্মের মহ অচল হইব। থানা পুলিশ কইরা তো কোন ফয়দা নাই।
অতি সত্য কথা, কোন ফয়দা নাই। তবে থানাওয়ালা ঝামেলা করে কিনা এইটা বিবেচনায় রাখা দরকার।
আছে, সবই বিবেচনার মইধ্যে আছে। মেম্বার সাব থানাওয়ালার কাছে গেছে।
মতি লক্ষ্য করল, হেডমাস্টার সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হেডমাস্টার সাহেবের চোখে শিশুসুলভ বিস্ময় ও আনন্দ। মনে হচ্ছে, চোখ তোলার ঘটনা দেখার জন্যে তিনি আছর পর্যন্ত থেকে যাবেন। মতি তেমন ভয় পাচ্ছে না। প্রাথমিক ঝড় কেটে গেছে এটাই বড় কথা। প্রথম ধাক্কায় চোখ চলে যেতে পারত। সেটা যখন যায়নি তখন আশা আছে। আছরের আগেই কেউ-না-কেউ দয়াপবশ হয়ে বলে ফেলবে-থাউক, বাদ দেন। চউখ তুইলা লাভ নাই। শক্ত মাইর দিয়া ছাইড়া দেন। একজন বললেই অনেকে তাকে সমর্থন করবে। তবে একজন কাউকে বলতে হবে। মতি নিজে ক্ষমা চাইলে হবে না। এতে এরা আরো রেগে যাবে। সে দুর্বল হলে সর্বনাশ। দুর্বলকে মানুষ করুণা করে না, ঘৃণা করে। মতি ঠাণ্ডা মাথায় ভাবে। চোখ বাঁচানোর পথ বের করতে হবে। হাতে অবশ্যি সময় আছে। আছরের এখনো অনেক দেরি। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করাও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা শরীরে যন্ত্রণা। পিপাসায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির বদনা সামনে আছে কিন্তু কেউ মুখে ঢেলে না দিলে খাবে কিভাবে?
.
হেডমাস্টার সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, কি রে মতি, সিগ্রেট খাবি?
সবাই হো-হো করে হেসে ফেলল। মতি চিন্তিত বোধ করছে। এটা ভাল লক্ষণ। এরা তাকে দেখে মজা পেতে শুরু করেছে। মানুষ মজা পায় জন্তু-জানোয়ার দেখে। এরা তাকে জন্তু-জানোয়ার ভাবতে শুরু করেছে। হাত-পা বাঁধা একটা ভয়াবহ প্রাণী। ভয়াবহ প্রাণীর চোখ ওঠানো কঠিন কিছু না। তাছাড়া দূর দূর থেকে লোকজন মজা পাবার জন্যে আসছে। মজা না পেয়ে তারা যাবে না। মতি হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার পানি খাব। একজন বদনার পুরো পানিটা তার মুখের উপর ঢেলে দিল। সবাই আবার হো-হো করে হেসে উঠল। মতির বুক ধক করে উঠলো। অবস্থা ভাল না। তাকে দ্রুত এমন কিছু করতে হবে যেন সে পশুস্তর থেকে উঠে আসতে পারে। কি করা যায় কিছুই মাথায় আসছে না। চোখ দু’টা কি আজ চলেই যাবে? মায়া-মমতা দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন তার মত লোকের শাস্তি ছিল মাথা কামিয়ে গলায় জুতার মালা ঝুলানো। তারপর এল ঠেং ভাঙা শাস্তি, ঠেং ভেঙে লুলা করে দেয়া। আর এখন চোখ তুলে দেয়া। একটা খেজুর কাঁটা দিয়ে পূট করে চোখ বের করে আনা। এতগুলি লোক তাকে ঘিরে আছে, কারো চোখে কোন মমতা নেই। অবশ্যি হাতে এখনো সময় আছে। মমতা চট করে তৈরি হয় না। মমতা তৈরি হতেও সময় লাগে। মতি হাসান আলীর দিকে তাকিয়ে হাসল। মানুষের হাসি খুব অদ্ভুত জিনিস। জন্তু জানোয়ার হাসতে পারে না। মানুষ হাসে। একজন হাসন্ত মানুষের উপর রাগ থাকে না।
হাসান আলী চেঁচিয়ে উঠল, দেখ, হারামজাদা হাসে। ভয়ের চিহ্নটা নাই। কিছুক্ষণের মইধ্যে চউখ চইল্যা যাইতেছে, তারপরেও হাসি। দেখি, এর গালে একটা চড় দেও দেখি।
প্রচণ্ড চড়ে মতি দলা পাকিয়ে গেল। হাত-পা বাঁধা, নয়ত চার-পাঁচ হাত দূরে ছিটকে পড়ত। কিছুক্ষণের জন্যে মতির বোধশক্তি লোপ পেল। মাথার ভেতর ভোঁ ভো শব্দ হচ্ছে। চারদিক অন্ধকার। এরা কি চোখ তুলে ফেলেছে? মনে হয় তাই। পানির পিপাসা দূর হয়েছে। পিপাসা নেই। এটা মন্দ না। মাথার ভেতর পাক দিচ্ছে, মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞান হবার আগে আগে এরকম হয়। অজ্ঞান হওয়া খুব আনন্দদায়ক ব্যাপার। দ্রুত শরীরের ব্যথা-বেদনা চলে যায়, শরীর হাল্কা হতে থাকে।
না, চোখ যায়নি। চোখ এখনো আছে। এই তো সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মতি মনে মনে বলল, শালার লোক কি হইছে! মেলা বইস্যা গেছে। বেলা পড়ে এসেছে। আছর ওয়াক্ত হয়ে গেল না-কি? না মনে হয়। আলো খুব বেশি। তাকে বাংলা ঘর থেকে বের করে উঠোনে শুইয়ে রাখা হয়েছে। এই জন্যেই আলো বেশি লাগছে।
মতি বলল, কয়টা বাজে?
কয়টা বাজে তা দিয়া দরকার নাই। সময় হইয়া আসছে। যা দেখনের দেইখ্যা নে রে মতি।
মতি চারদিকে তাকালো। তার আশেপাশে কোন ছোট ছেলেমেয়ে নেই। মহিলা নেই। এদের বোধহয় সরিয়ে দেয়া হয়েছে। লোকজন তাকে ঘিরে গোল হয়ে আছে। তার সামনে জলচৌকির উপর নীল গেঞ্জি এবং সাদা লুঙ্গি পরে যে বসে আছে সে-ই কি চোখ তুলবে? সে-ই কি নবীনগরের ইদরিস? কখন এসেছে ইদরিস? লোকটার ভাবভঙ্গি দশজনের মত না। তাকাচ্ছে অন্যরকম করে। তার চেয়ে বড় কথা, আশেপাশের লোকজন এখন নীল গেঞ্জিওয়ালাকেই দেখছে। মতির প্রতি তাদের এখন আর কোন আগ্রহ নেই। তারা অপেক্ষা করছে বড় ঘটনার জন্যে। নীল গেঞ্জি পরা। লোকটার সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা জেনে নেয়া যায়। মতি অপেক্ষা করছে কখন। লোকটা তাকায় তার দিকে। যেই তাকাবে ওমি মতি কথা বলবে। চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বললে কোন আরাম নেই। কিন্তু লোকটা তাকাচ্ছে না।
ভাইজান, ও ভাইজান।
নীল গেঞ্জি তাকাল মতির দিকে। মতি সঙ্গে সঙ্গে বলল, আফনের নাম কি ইদরিস মিয়া? নীল গেঞ্জি জবাব দিল না। মাথা ঘুরিয়ে নিল। মতি আরো আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, ভাইজান, আফনেই কি আমার চউখ তুলবেন?
পেছন থেকে একজন বলল, হারামজাদা কয় কি! সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে উঠল। এই কথায় হাসার কি আছে মতি বুঝতে পারছে না। কথাটা কি সে বিশেষ কোন ভঙ্গিতে বলেছে? সাধারণ কথাও কেউ কেউ খুব মজা করে বলতে পারে। তার বৌ পারত। অতি সাধারণ কথা এমনভাবে বলত যে হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে যেত। ভাত বেড়ে ডাকতে এসে বলত, ভাত দিছি, আসেন। চট কইরা তিন-চাইরটা ভাত খান। না, বৌয়ের কথা ভাবার এখন সময় না। এখন নিজের নয়ন বাঁচানোর বুদ্ধি বের করতে হবে। নয়ন বাঁচলে বৌয়ের কথা ভাবা যাবে। নয়ন না বাঁচলেও ভাবা। যাবে। ভাবার জন্যে নয়ন লাগে না। বৌয়ের কথা সে অবশ্যি এম্নিতেও বিশেষ ভাবে না। শুধু হাজতে বা জেলখানায় থাকলেই তার কথা মনে আসে। তখন তার কথা ভাবতেও ভাল লাগে। মেয়েটার অবশ্যি কষ্টের সীমা ছিল না। সে জেলে গেলেই রাতদুপুরে চৌকিদার, থানাওয়ালা বাড়িতে উপস্থিত হত। বিষয় কি? খোঁজ নিতে আসছে মতি ঘরে আছে কি-না। সুন্দর একটা মেয়ে। খালি বাড়িতে থাকে। থানাওয়ালারা তো রাতদুপুরে সেই বাড়িতে যাবেই। বাড়িতে যাবে। পান খাবে। আরও কত কি করবে। ডাকাতের বৌ হল সবার বৌ। এই অবস্থায় কোন মেয়ে থাকে না। তার বৌ-টা তারপরেও অনেক দিন ছিল। মতি প্রতিবারই বাড়ি ফিরত আতংক নিয়ে। বাড়ির সামনে এসে মনে হত এইবার বাড়িতে ঢুকে দেখবে, বাড়ি খালি। কেউ নেই।
বৌ চলে গেছে গত বৈশাখ মাসে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। পাড়ার কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিল। কেউ বলতে পারে না। একজন বলল, অনেক দিন তো থাকল, আর কত? বাজারে গিয়া খোঁজ নেও। মনে হয় বাজারে ঘর নিছে। জগতের অনেক সত্যের মত এই সত্যও সে গ্রহণ করেছে সহজভাবে। চোর-ডাকাতের বৌদের শেষ আশ্রয় হয় বাজার। বাজারে তারা মোটামুটি সুখেই থাকে। মুখে রঙ-চঙ মেখে সন্ধ্যাকালে চিকন গলায় ডাকে, ও বেপারি, আহেন, পান-তামুক খাইয়া যান। শীতের দিন শইলডা গরম করন দরকার আছে।
অবসর পেলেই মতি আজকাল বাজারে-বাজারে ঘুরে। বৌটাকে পাওয়া গেলে মনে শান্তি। তাকে নিয়ে ঘর-সংসার আর করবে না। তাতে লাভ কি? বৌটা কোন এক জায়গায় থিতু হয়েছে এটা জানা থাকলেও মনে আনন্দ। মাঝে-মধ্যে আসা যাবে। আপনার মানুষের কাছে কিছুক্ষণ বসলেও ভাল লাগে। আপনার মানুষ সংসারে থাকলেও আপনার, বাজারে থাকলেও আপনার।
বৌ কেন্দুয়া বাজারে আছে এরকম একটা উড়া খবর শুনে মতি কেন্দুয়া এসেছিল। উড়া-খবর কখনো ঠিক হয় না। তার বেলা ঠিক হয়ে গেল। বৌ এখানেই আছে। নাম নিয়েছে মর্জিনা। বাজারে ঘর নিলে নতুন নাম নিতে হয়। মর্জিনার সঙ্গে দেখা করতে যাবার মুখে এই বিপদ।
.
আজান হচ্ছে। আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। মতি অনেক কষ্টে পাশ ফিরল। তারা চোখ কখন তুলবে? নামাজের আগে নিশ্চয়ই না। কিছুটা সময় এখনো হাতে আছে। এর মধ্যে কত কিছু হয়ে যেতে পারে। মহাখালি রেল স্টেশনে সে একবার ধরা পড়ল। তাকে মেরেই ফেলত। ট্রেনের কামরা থেকে একটা মেয়ে ছুটে নেমে এল। চিৎকার করে বলল, আপনারা কি মানুষটাকে মেরে ফেলবেন? খবর্দার, আর না। খবর্দার। মেয়েটির মূর্তি দেখেই লোকজন হকচকিয়ে গেল। লোকজনের কথা বাদ থাক, সে নিজেই হতভম্ব। জীবন বাঁচানোর জন্যে মেয়েটিকে সামান্য ধন্যবাদও দেয়া হয়নি। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সেই মেয়ে চলে গেছে কোথায় না কোথায়।
আজ এই যে এত লোক চারপাশে ভিড় করে আছে এদের মধ্যেও নিশ্চয়ই কেউ -কেউ আছে ঐ মেয়েটির মত। সে অবশ্যই শেষ মুহূর্তে ছুটে এসে বলবে, করেন কি! করেন কি! আর এতেই মতির নয়ন রক্ষা পাবে। এইটুক বিশ্বাস তো মানুষের প্রতি রাখতেই হবে। মতি মিয়া অপেক্ষা করে। কে হবে সেই লোকটি? না জানি সে দেখতে। কেমন। সেই লোকটির চোখ কি ট্রেনের মেয়েটির চোখের মত মমতামাখা হবে? যে চোখের দিকে তাকালে ভাল হয়ে যেতে ইচ্ছা করে? মতি মিয়া চাপা উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতে তার ভালই লাগে।
চোর
রিকশায় ওঠার সময় পায়ে কী যেন বাধলো। মবিন প্রায় উল্টে পড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে দেখে পায়ের কাছে মেয়েদের একটা বাহারি হ্যান্ডব্যাগ। অষ্টম আশ্চর্যের কাছাকাছি ঘটনা। ঢাকা শহরে রাস্তায় এমন সুন্দর একটা হ্যান্ডব্যাগ পড়ে থাকবে আর কেউ কুড়িয়ে নেবে না তা হয় না। হাত থেকেই টেনে ব্যাগ নিয়ে যায়। আর এটাতো পড়ে আছে রাস্তায়। মবিন নিচু হয়ে ব্যাগ হাতে নিলো। বেশ ভারি ব্যাগ। ঈদের বাজার শুরু হয়েছে। মেয়েরা এখন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে বের হয়। হাইজ্যাকারের ভয়ে গায়ের গয়না টয়নাও খুলে ব্যাগে রাখে। ভারি হওয়াই স্বাভাবিক। মবিন বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রিকশায় উঠে বসলো। নিজেকে খানিকটা চোর চোর লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি তীক্ষ্ণ মেয়েলী গলায় কেউ একজন চেঁচিয়ে বলবে–আপনি আমার। ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
কেউ কিছু বলল না। যার জিনিস সেকি দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে? অবাক হয়ে দেখছে নিতান্ত ভদ্র চেহারার একটা ছেলে ব্যাগ নিয়ে রিকশা করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছে। সে বিস্ময়ে হতভম্ব বলে কিছু বলতে পারছে না। হতভম্ব ভাবটা কাটলেই চোর চোর বলে চেঁচিয়ে উঠবে। মেয়েদের ভীত গলার চিৎকার সাইরেনের চেয়েও ভয়াবহ। নিমিষের মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে।
সময়টা ভর সন্ধ্যা। সন্ধ্যা হচ্ছে অস্থির ধরনের সময়। এই সময় লোকজন এক ধরনের অস্থিরতার ভিতর থাকে। চারপাশে তেমন করে দেখে না। মবিন মোটামুটি নিশ্চিত হলো, যার ব্যাগ সে আশপাশে নেই। থাকলে এতক্ষণে চেঁচিয়ে উঠতো। চুপচাপ অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য কোনো মেয়ের নেই। মবিনের ধারণা, শুধু শিশু পালনের ক্ষেত্রেই মেয়েরা ধৈর্যশীলা–অন্য কোনো ক্ষেত্রে নয়।
রিকশাওয়ালা বলল, যাইবেন কই?
মবিন ঠিক মনে করতে পারল না কোথায় যাওয়ার জন্যে সে রিকশায় উঠেছে। মনে হচ্ছে টেনশানে তার ব্রেইন শর্টসার্কিট হয়ে গেছে। সে বলল, সামনে চলো—সামনে। রিকশা সামনে এগুচ্ছে না। চেইন পড়ে গেছে। রিকশাওয়ালা চেইন নিয়ে ঘটঘট করছে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়া উচিত। সরে পড়া যাচ্ছে না। একটা
সামান্য চেইন ঠিক করতে রিকশাওয়ালা দেখি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। মবিন আশপাশে। তাকালো। তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেউ তাকে অস্বাভাবিক চোখে দেখছে কিনা তা লক্ষ্য করা। সবার চোখই তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। মবিনের তীব্র ইচ্ছা করছে। রিকশা থেকে নেমে লম্বা লম্বা পা ফেলে। যাকে বলে ক্রাইম স্পট থেকে পগার পাড়।
মবিন রাগি গলায় বলল, রিকশায় কী হয়েছে?
চেইন ছিলিপ কাটছে।
ছিলিপ কাটলে ছিলিপ ঠিক কর।
করতাছি।
যে সময় নিচ্ছ এই সময়ে তো একটা প্রমাণ সাইজের চেইন বানিয়ে ফেলা যায়।
বানাইতে পারলে বানান।
অন্য সময় হলে ফাজলামি ধরনের কথার কারণে রিকশাওয়ালা কঠিন ধমক খেতো। আজ মবিন ধমক দিতে পারল না। অপরিচিত একজনকে ধমক দিতে হলে রাগের একটা বিশেষ মাত্রা পর্যন্ত উঠতে হয়। রাগ সেই মাত্রায় উঠছে না। চোররা সহজে রাগ করতে পারে না। চোর টাইপের সব লোকই এই কারণে বিনয়ী। অত্যন্ত অপমানসূচক কথা শুনলেও তারা দাঁত কেলিয়ে হাসবে। ভাবটা এ রকম–যেন। অপমানটা সে ধরতে পারছে না।
রিকশার চেইন ঠিক হয়েছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। এখনো কেউ চোর চোর বলে চেঁচাচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপারতো। মবিন কপালে হাত দিয়ে দেখলো তার কপাল ঘামছে। রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই শরীর হালকা লাগছে। ফুরফুরে ভাব চলে আসছে। বৈশাখ মাসের দারুন গরমের পর হঠাৎ যেন দক্ষিণ দিক থেকে খানিকটা হাওয়া চলে এসেছে। এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই হাইজ্যাকারদেরও হয়। তাদের আরো বেশি হওয়ার কথা। হাইজ্যাকিং এর সময় ওদের টেনশান নিশ্চয়ই মবিনের টেনশানের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। টেনশান মুক্তির আনন্দও সে কারণেই বেশি হবার কথা।
.
ট্রাফিক সিগন্যালে রিকশা থেমেছে। রাস্তার মোড় বলে আলো বেশি। ট্রাফিক পুলিশের পাশে একজন সার্জেন্টকে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মবিনের বুকের ভেতর কোনো এক জায়গায় সিরসির করে উঠলো। পুলিশ দেখার কারণে বোধ হয়। তার কোলে ভ্যানিটি ব্যাগ চকচক করছে। চাদর গায়ে থাকলে ভালো হত। চাদরের নিচে ব্যাগ লুকিয়ে ফেলা যেত। লাল বাতি নিভে গিয়ে সবুজ বাতি জ্বলছে। রিকশাওয়ালা তবু রিকশা টানছে না। মবিন বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন? চলো।
রিকশাওয়ালা বলল, যাইবেন কই?
মবিন বলল, কোথাও যাব না। খানিকক্ষণ ঘুরব।
রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। যে সব যুবক রিকশায় করে অকারণে ঘুরতে চায় তাদের বিষয়ে সব রিকশাওয়ালাই সাবধান। দিনকাল ভাল না।
সব রিকশা গাড়ি চলছে আর তারটা দাঁড়িয়ে আছে। অস্বস্তিকর অবস্থা। ট্রাফিক পুলিশ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এইবার সার্জেন্টও তাকাচ্ছে। তাদের দৃষ্টি যেন কেমন কেমন। মবিন রিকশাওয়ালাকে বলল, কী হলো?
রিকশাওয়ালা নির্বিকার গলায় বলল, চেইন ছিলিপ কাটছে।
মনে হচ্ছে চেইন ছিলিপ কাটায় সে আনন্দিত। পুলিশ সার্জেন্ট এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। সে কি মবিনের দিকে তাকিয়ে সন্দেহজনক ভঙ্গিতে বলবে–আপনার হাতে মেয়েদের ব্যাগ কেন?
বলার কোনো কারণ নেই। পুরুষের হাতে মেয়েদের ব্যাগ থাকা নিষিদ্ধ কিছু না, থাকতে পারে। সে যদি মেয়েদের মতো ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বসে থাকতো তাহলে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হতো। পুরুষ মানুষ ভাজ করা শাড়ি হাতে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু শাড়ি পরে যেতে পারে না।
সার্জেন্ট এসেই রিকশাওয়ালার গালে ওজনদার এক চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, হারামী চেইন ফেলনের জায়গা পাও না। রিকশা নিয়া দূরে যাও।
সার্জেন্ট অতঃপর যে কান্ডটি করলো তার জন্যে মবিন ঠিক প্রস্তুত ছিল না। সার্জেন্ট রিকশার পেছনে গিয়ে আচমকা একটা ধাক্কা দিলো। মবিন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। দু’টা কাজই ঘোরতর অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে। পুলিশ ব্রুটালিটি। মবিনের উচিত সার্জেন্টের সঙ্গে কিছু উত্তপ্ত কথাবার্তা বলা। পুলিশের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করলে মানবিক দিক দিয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায়। মনে হয় একটা সকাজ করা হয়েছে। মবিন সে রকম কিছুই করলো না। বরং সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে এমন ভঙ্গিতে হাসলো যার অর্থ, স্যার খুব ভালো করেছেন। ঢাকা শহরটা রিকশাওয়ালারা নষ্ট করে ফেলছে। ব্যাটাকে আরো চড় দেন। এক চড়ে ওর শিক্ষা হবে না। গোটা পাঁচেক চড় দরকার।
মবিনের রিকশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। রিকশাওয়ালা গেছে ইটের সন্ধানে। ইট দিয়ে বাড়ি না দিলে নাকি চেইন ঠিক হবে না। মবিন অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে, কারণ সার্জেন্ট কাছেই দাঁড়িয়ে। কয়েকবার দেখলো মবিনকে। সরু চোখে দেখা। তার মনে কি কোনো রকম সন্দেহ দেখা দিয়েছে? মবিনের চেহারায় কি চোর চোর ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে? যে ছাপ শুধু পুলিশের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। ঈদের বাজারে প্রচুর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তার হাতে মেয়েদের ব্যাগ দেখে পুলিশের সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে সে ব্যাগ ছিনতাই করে রিকশা নিয়ে পালাচ্ছে। সার্জেন্ট যদি কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, আপনার হাতের ব্যাগটা কার? তাহলে সে কি বলবে? এমনো তো হতে পারে যে, ব্যাগে প্রচুর টাকা পয়সা গয়না-টয়না ছিল। যার ব্যাগ সে ব্যাগের বর্ণনা দিয়ে থানায় ডাইরী করিয়েছে। ওয়াকিটকির মাধ্যমে সে খবর সব পুলিশ সার্জেন্টের কাছ চলে গিয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশ বড় চোর ধরতে পারে না। ছোট চোর চট করে ধরে ফেলে। তাছাড়া মবিন আয়নায় নিজেকে না দেখেই পরিষ্কার বুঝতে পারছে, তার চেহারায় একটা কাচুমাচু ভাব চলে এসেছে।
মাসখানেক আগে এ রকম একটা ব্যাপার হলো। দুপুর বেলা তার ঘরে কয়েক বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ আড্ডা দিল। বন্ধুদের মধ্যে ছিল রশীদ। বিরাট মালদার। বাপের কন্ট্রাকটারিতে নেমে ভাল পয়সা কামাচ্ছে। আটমাসের গর্ভবতী মেয়েদের মতো পেট মোটা মানিব্যাগ পকেটে নিয়ে সে ঘোরে। কৃপণের হাড্ডি। একটা পয়সা বের করে না। বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে মবিন দেখলো রশীদের গর্ভবতী মানিব্যাগ মেঝেতে পড়ে আছে। সে ইচ্ছা করলেই রাস্তা থেকে ডাক দিয়ে রশীদকে। নিয়ে আসতে পারতো। তা করলো না। মানিব্যাগ খুলে ভেতরটা দেখলো। কাগজপত্রে ঠাসা, আসল জিনিস তেমন নেই। চারটা ৫০০ টাকার নোট, একটা ১০০ টাকার। নোট। তিনটা অতি ময়লা দু টাকার নোট। মবিন মানিব্যাগটা তোষকের নিচে ঠেলে দিল। তার প্রায় ঘন্টা খানিক পর রশীদ এসে উপস্থিত। মুখ চোখ শুকনা।
দোস্ত, তোর এখানে মানিব্যাগ ফেলে গেছি।
মবিন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, কই? না তো।
মবিনের চেহারায় তখন নিশ্চয়ই কাচুমাচু ভাব কিংবা চোর ভাব ছিল। কারণ রশীদ বলল, দোস্ত টাকা পয়সা কোনো ব্যাপার না। জরুরি কিছু কাগজপত্র ছিল।
অত্যন্ত অপমানসূচক কথা। প্রকারান্তরে বলে দেয়া–টাকাগুলো রেখে মানিব্যাগ ফেরত দাও। এ রকম কঠিন অপমানও মবিন গায়ে মাখলো না। সে ক্ষীণ গলায় বলল, এখানে ফেলিসনি–বাইরে কোথায় ফেলেছিস।
খুব জরুরি কিছু কাগজ ছিল।
তুই নিজেই পরীক্ষা করে দেখ। থাকলে তো মেঝেতেই থাকবে।
এই বলেই মবিন মাথা নিচু করে মেঝেতে মানিব্যাগ খুঁজতে লাগলো। মবিনের বুক এমন ধক ধক করছিল যে মবিনের মনে হলো রশীদ তার বুকের ধক ধক শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে।
.
এখনো মবিনের বুকে ধক ধক শব্দ হচ্ছে। এটা তার বুকের শব্দ, না রিকশাওয়ালা যে ইট দিয়ে চেইন বাড়ি দিচ্ছে তার শব্দ, মবিন ঠিক বুঝতে পারছে না। সার্জেন্টটা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। মবিনের, অস্বস্তি লাগছ। একটা সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো হতো। সঙ্গে সিগারেট আছে। ধরাতে গেলে হ্যান্ডব্যাগটা খুলে রিকশার সিটে রাখতে হয়। তাতে ব্যাগটার উপর সার্জেন্টের নজর পড়ার সম্ভাবনা। তা করা ঠিক হবে না।
শেষ পর্যন্ত চেইন ঠিক হয়েছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে। মবিন সিগারেট ধরালো। ভালো সিগারেট। বেনসন। রশীদের মানিব্যাগ পাওয়ায় রক্ষা। কিছুদিন ভালো সিগারেট খাওয়া গেল। ক্ষতি একটা হয়েছে–রশীদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। সে ঠিক সন্দেহ করেছে। ভুলেও আর মবিনের বাসায় আসে না। সেদিন তার বাসায় কী একটা খাওয়া দাওয়া ছিল। বন্ধু বান্ধব সবাইকে বলেছে, মবিনকে বলেনি। পথে ঘাটে দেখা হলে এমনভাবে তাকায় যেন চিনতে পারছে না।
রশীদের মানিব্যাগ না নিয়ে তার উপায় ছিল না। প্রতিটি পয়সা বাবার কাছে চেয়ে নিতে হয়। চুল কাটতে হবে, ১০ টাকার কমে চুল কাটা যায় না। মবিন যদি তা মা’র কাছে চায় তিনি খুবই অবাক হয়ে বলেন, আমার কাছে টাকা চাচ্ছিস কেনরে? আমি টাকা পয়সার কী জানি? তোর বাবার কাছে থেকে নে। ক্লাস থ্রী ফোরে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে চুল কাটার টাকা চাওয়া যায়। কিন্তু তিন বছর আগে এম, এ পাস করে বসে থাকা একজনের পক্ষে বাবার কাছে চুল কাটার টাকা চাওয়া ভয়াবহ ব্যাপার।
মবিন চুল কাটার জন্যে টাকা চাইলে তিনি টাকা দেন। তবে চাওয়া মাত্র দেন না। অনেক জেরাটেরা করেন।
চুল কাটতে দশ টাকা লাগবে কেন? এয়ার কন্ডিশন্ড সেলুনে বসে চুল কাটবি? দু টাকা দিলেই তো চুল কেটে দেয়।
টাকা দেয়ার পর শুকনো গলায় বলেন, আর কত দিন এভাবে চলবে? ডু সামথিং ইয়াং ম্যান। শো মি সাম ফায়ার।
ফায়ার দেখানোর চেষ্টা মবিন করছে না তা না। তিন বছর ধরে করছে। তার কাঠ ভেজা। তিন বছরেও আগুন জ্বলছে না, শুধু ধোয়া বেরুচ্ছে। সে করবে কি?
.
মবিনের বাবা মোবারক হোসেন ঢাকার একটা মেয়ে কলেজের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। সাহিত্যের অধ্যাপক মানেই আবেগ টাবেগ আছে বলে ধারণা। করা হয়। এ ধারণা যে কত ভুল তা মোবারক সাহেবকে না দেখলে বোঝা মুশকিল। বাসায় তিনি কখনো হাসেন না। পরিবারের সবার সঙ্গে যে ব্যবহার করেন তা শুধু ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য কেন যে কোনো বিষয়ের অধ্যাপকের জন্যেই মানান সই নয়। তরকারীতে তেল বেশি হয়ে গেলে স্ত্রীকে ডেকে শান্ত গলায় বলেন, এক মাসের তেল একদিনে খরচ করার জন্যে কেনা হয়নি। তোমার হাতে তেল মশলা বেশি খরচ হয় এই কথা আমি এ পর্যন্ত এক লাখ বার বলেছি। আর বলব না। আবার তেল বেশি হলে ঘর থেকে বিদায় করে দেব। স্ট্রেইট ইন দি স্ট্রিট। অ্যান্ড দিস ইজ ফাইন্যাল।
মোবারক হোসেন সাহেবের রোজগার খারাপ না। কলেজের বেতন ছাড়াও প্রাইভেট টিউশানি করে ভালো টাকা পান। সপ্তাহে তিনদিন বিকেলে তার বাসায় রীতিমতো ক্লাস বসে–রবি, সোম আর মঙ্গল। শুধু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একজন ছাত্রী পড়তে আসে। বড়লোকের কোনো মেয়ে হবে। লাল রঙের গাড়িতে করে আসে, গাড়ি করে যায়।
তিনি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরে হাসি মুখে ছাত্রীদের পড়ান। এই সময় তিনি গায়ে খানিকটা সেন্টও মাখেন। পড়াতে গিয়ে মাঝে মাঝেই মজার মজার কিছু কথাও বলেন বলে মনে হয়। কারণ প্রায়ই তার ছাত্রীদের কুটিকুটি হাসি শোনা যায়। যতক্ষণ পড়ান ততক্ষণই তার স্ত্রী পর্দার ওপাশের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করেন। স্বামীর হাসির কথায় ছাত্রীরা হাসে, তিনি হন বিস্মিত। তিনি কখনো স্বামীর কোন কথায় হাসতে পারেননি।
মবিন বাসায় ফিরে দেখে গেটের কাছে লাল গাড়ি। বসার ঘরে আলো জ্বলছে। তার মানে আজ বৃহস্পতিবার। বাবার কাছে ছাত্রী এসেছে। বাবার এই ছাত্রীর নাম মীরা। সে অসম্ভব রূপবতী। এই সময় তাদের সামনে দিয়ে ঘরে ঢোকা যাবে না। মোবারক হোসেন সাহেব তাকে দেখলেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাবেন এবং অতি অবশ্যই বলবেন–কোত্থেকে ফিরলি? ডু সামথিং ইয়াংম্যান। শো মি সাম ফায়ার। রূপবতীদের সামনে অপমানিত হতে ভাল লাগে না।
মবিন বাড়ির পেছনে রান্নাঘরের কাছের দরজা দিয়ে চুপিচুপি ঘরে ঢুকলো। বাসায় কোনো চোর ঢুকলে এভাবেই হয়তো ঢুকতো। মবিনের মা রান্নাঘরের বারান্দায় বসেছিলেন। তাকে পাশ কাটিয়ে মবিন নিজের ঘরে চলে গেল। একজন কেউ যে ঘরে ঢুকেছে মবিনের মা বুঝতেও পারলেন না।
মবিনের ঘর বসার ঘরের পাশে। সে বাতি জ্বালালো না। বাতি জ্বালালেই উপস্থিতি জানান দেওয়া হবে। দরকার কি? মেয়েদের বাহারী হ্যান্ডব্যাগটা সে খাটের নিচে লুকিয়ে ফেলল। ভিতরে কী আছে তা এখনি দেখার দরকার নেই। এক সময় দেখলেই হবে। কিছু না কিছু তো থাকবেই। কপাল ভালো থাকলে বেশ কিছুদিন বাবার কাছে সেলুনে চুল কাটার টাকা চাইতে হবে না। বাবা তাকে বলতে পারবেন না–শো মি সাম ফায়ার, ইয়াং ম্যান।
মবিন তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে। পাশের ঘরে বাবা ছাত্রী পড়াচ্ছেন। বাবার গলার স্বর পরিষ্কার। ঝন ঝন করে বাজছে। তিনি বলছেন–শোন মীরা, এক্সপ্রেশনিস্টরা কাজ করে ডিস্টরশন আর এক্সাজারেশন নিয়ে। এক্সপ্রেশনিজম হলো জার্মানদের আন্দোলন। ফিউচারিজম হলো ফরাসীদের। বাঙালী কবিদের কেউ কেউ এক্সপ্রেশনিস্ট ধারায় কবিতা লিখেছেন। যেমন ধর আমাদের জীবনানন্দ। আট বছর আগের একদিন কবিতাটার কথা মনে আছে?
শোনা গেলো লাশ কাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে…
মোবারক হোসেন সাহেব কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন। বাবার ছাত্রীর সঙ্গে মবিনও কবিতা শুনছে। তার কবিতা শুনতে বেশ ভালো লাগছে।
ছুনু মিয়া
আমার নাম ছুনু মিয়া–গলার স্বরে বিস্মিত হয়ে তাকালাম। চাপা হিসহিসে গলা। সর্পকূলের কথা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়ত এভাবেই কথা বলত। তবে আমার পাশে যে দাঁড়িয়ে সে সাপ না, মানুষ। ছোটখাট একজন মানুষ। গায়ে চকচকে শার্ট। সেই শার্ট প্যান্টের ভেতর ইন করানো। পায়ে অবশ্যি স্পঞ্জের স্যান্ডেল। লক্ষ্য করলাম, পায়ের বুড়ো আঙুলে নেল পলিশ দেয়া হয়েছে। হাতের কনিষ্ঠ আঙুলেও নেল পলিশ। মাথার চুল তেলে চপচপ করছে। চোখে সানগ্লাস। কিছুক্ষণ আগে পান খেয়েছে, পানের রস গড়িয়ে পড়ছে।
আমার জন্যে এট্টু খাস দিলে দোয়া রাখবেন স্যার।
এই বলে ছুনু মিয়া আমাকে কদমবুসি করতে এগিয়ে এল। আমার পাশের চেয়ারে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গনি সাহেব বসে আছেন। তিনিও ছুনু মিয়ার মতই ছোটখাট মানুষ। তবে গলায় অসম্ভব জোর। তিনি প্রচণ্ড ধমক লাগালেন, খবর্দার উনার গায়ে হাত দিবি না। খবর্দার বললাম।
ছুনু মিয়া হেসে ফেলল। মনে হল ধমক খেয়ে সে বড়ই আনন্দ পাচ্ছে। গনি সাহেব আবারো ধমক দিলেন, দূরে গিয়া দাঁড়া ছুনু।
ছুনু একটু সরে গিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল। ধমক খেয়ে এত আনন্দিত হতে এর আগে কাউকে দেখিনি। সে পকেটে হাত দিয়ে রুমাল বের করে বেশ কায়দা করে মুখ মুছতে লাগল। ফুল তোলা বাহারী রুমাল। রুমালে আতর ছিল বোধহয়। চারদিক সস্তা আতরের গন্ধে ভরে গেছে।
গনি সাহেব বললেন, ছুনু, তুই দশ হাত দূরে গিয়া বস। চশমা’র ফাঁক দিয়া উনারে দেখবার চেষ্টা করবি না। চশমা’র ফাঁক দিয়া দেখনের চেষ্টা করছস কি তোরে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলব। উনি অতিথ মানুষ। উনার বিপদ হইলে তোর রক্ষা নাই।
আমি এদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা কিছুই বুঝলাম না। তবে খুব ব্যস্তও হলাম। আমি জানি, যথাসময়ে আমাকে বলা হবে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যেই ছুনুকে আনা হয়েছে। এখন তাকে নিয়ে খানিকটা নাটক করা হচ্ছে। গ্রামের লোকজন নাটক করতে পছন্দ করে।
গনি সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, ছুনু মিয়ার চোখ খুবই খারাপ। চোখে নজর লাগে। তার চোখের নজর এই অঞ্চলে বিখ্যাত। এই জন্যেই কালো চশমা। ইউনিয়ন বোর্ডের খরচে চশমা কিনে দেয়া হয়েছে। তবে হারামজাদা বদের হাড্ডি। চশমা’র ফাঁক দিয়া দেখার চেষ্টা করে। একটু আগে আপনেরে দেখার চেষ্টা করতেছিল। সময়মত বুঝতে পারছি বইল্যা রক্ষা।
নজর লাগা ব্যাপারটা আমার অজানা নয়। কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটাতে এরা এমন বিশিষ্টতা আরোপ করবে, ইউনিয়ন বোর্ডের পয়সায় নজর লাগা ঠেকানোর জন্যে সানগ্লাস কিনে দেয়া হবে, তা ভাবিনি। সানগ্লাস পরিয়ে নজর লাগা ঠেকানো যায় তাও জানা ছিল না।
যার নজর লাগবে বলে সবাই মনে করে সে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভুগবে এটাই স্বাভাবিক। ছুনু মিয়ার মধ্যে সেরকম কিছু দেখা গেল না, বরং তাকে তার ক্ষমতায় বেশ আনন্দিত মনে হল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর রুমালে মুখ মুছছে।
গনি সাহেব বললেন, এই ছুনু, স্থির হইয়া বস। অত কিসের নড়াচড়া?
ছুনু মিয়া আবারো দাঁত বের করে হাসল। সবাই তার দিকে লক্ষ্য রাখছে এটাই মনে হয় তার আনন্দের মূল কারণ। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ছুনু নামের অর্থ কি?
ছুনু মিয়া হাসি মুখে বলল, নামের অর্থ জানি না। পিতা-মাতা নাম রাখছিল ছানোয়ার, গেরামের লোকে ডাকে ছুনু। বড় নামে ডাকতে গেরামের লোকের কষ্ট হয়। গেরামের লোকের জিহ্বা থাকে মোটা।
আমি ছুনু মিয়ার রসিকতায় অবাক হলাম। তারচেয়েও অবাক হলাম তার গলার স্বরে। আগে যেমন সাপের গলায় কথা বলছিল এখন তা বলছে না। স্বাভাবিক গলা। মনে হয় প্রথম পরিচয়ের সময় সাপের মত গলা সে ইচ্ছা করেই করে। শুরুতেই ভয় দেখানোর চেষ্টা। আমি বললাম, তোমার বয়স কত ছুনু?
ছুনু কিছু বলার আগে চেয়ারম্যান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, স্যার, আপনে এরে তুমি কইরা বলতেছেন কেন? তুমি বলায় লাই পাইতেছে। এরে তুই কইরা বলেন।
ছুনু উদাস গলায় বলল, তুইয়ের নিচে কিছু থাকলে হেইডাও বলতে পারেন। অসুবিধা কিছু নাই। বয়স জিগাইছেন, বয়স ভালই হইছে। অধিক বয়সে বিবাহ করছি বইলা পোলাপান ছোট ঘোট। বড় মাইয়া কেলাস সিক্সে পড়ে। আপনাদের দশজনের দোয়ায় সরকারি বৃত্তি পাইছে।
আমি বিস্মিত হয়ে গনি সাহেবের দিকে তাকালাম। গনি সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কথা সত্য। এই হারামজাদার ছেলেমেয়ে প্রত্যেকটা লেখাপড়ায় ভাল। বড় মেয়েটা তো অত্যধিক ভাল। ময়মনসিং ডিসট্রিক্টে সেকেন্ড হয়েছে।
বলেন কি?
গনি সাহেব উদাস গলায় বললেন, গোবরে পদ্মফুল যে বলে এই জিনিস, আর কিছু না। গোবর তো না, একেবারে গুয়ের মধ্যে পদ্মফুল।
ছুনু বলল, বেয়াদবী না নিলে একটা সিগারেট দেন স্যার। খাইয়া দেখি। বিড়ি টানতে টনতে কইলজার কাম শেষ।
আমি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করলাম। গনি সাহেব হা হা করে উঠলেন, হাতে দিবেন না স্যার। হাতে দিবেন না। মাটিতে ফিক্যা মারেন, বলে তিনি অপেক্ষা করলেন না। আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিজেই ছুনুর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। ছুনু সেই সিগারেট শূন্য থেকে লুফে নিল। গনি সাহেব বললেন, এই হারামজাদার কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। হারামজাদার চোখ শয়তানের চোখের চেয়েও খারাপ।
আমি বললাম, কি রকম খারাপ?
গনি সাহেব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ধরেন একটা লকলকা লাউ গাছ, ছুনু যদি সেই গাছ দেখে বলে, আহা কি সুন্দর, তা হইলেই কাম সারা। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গাছের মৃত্যু।
ছুনু আপত্তির গলায় বলল, কিছু না বললেও হয়, বলা লাগে না।
আমি সন্দেহের গলায় বললাম, এটা কি পরীক্ষিত?
আমার সন্দেহে গনি সাহেব আহত হলেন। ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, অবশ্যই পরীক্ষিত। গাছপালা, গরু-ছাগল, মানুষ সবেতেই তার চোখ লাগে।
ছুনু উদাস গলায় বলল, কলকজার মধ্যেও লাগে। গনি চাচা, বজলু ভাইয়ের সাইকেলের গফটা স্যাররে বলেন। স্যার মজা পাইব।
বজলুর সাইকেলের গল্প শুনলাম। বজলু স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক, নতুন সাইকেল কিনেছে। প্রিন্স সাইকেল। অনেকের সঙ্গে ছুনুও সাইকেল দেখতে গেল এবং ফস করে মনের ভুলে বলে বসল, জবর সাইকেল খরিদ করছেন বজলু ভাই। এমুন সাইকেল লাখে এক।
এই বলাই কাল হল। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে পিছনের চাকা বার্স্ট। শব্দ হয়েছিল দুনলা বন্দুকের গুলির মত।
গল্প শুনে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করব কি না বুঝতে পারছি না। আমি বিস্মিত হলে গনি সাহেব খুশি হন। তিনি গত তিনদিন ধরে আমাকে নানানভাবে বিস্মিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গতকাল এক গায়ক নিয়ে এসেছিলেন, যার গলা নাকি অবিকল হেমন্তের মত–কোন উনিশ-বিশ নেই। গায়কের গলা আসলেই ভাল। তবু গণ্ডগ্রামের লুঙ্গি পরা। খালি গায়ের গায়কের গলায় তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বিস্তি এল শুনতে ভাল লাগে না। ঝাড়া দুঘন্টা হেমন্তের গান শুনলাম। গায়কের ধৈর্য যেমন অসীম, মুখস্থ গানের সংখ্যাও অসীম। গান শুনে আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত। তারপরেও বিস্মিত, অভিভূত হবার ভঙ্গি করে বলতে হল, অদ্ভুত। এরকম শুনিনি। গনি সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বড়ই আফসোস! কত বড় বড় প্রতিভা পল্লীগ্রামে নষ্ট হইতেছে।
কে জানে ছুনু মিয়াও হয়তো এদের চোখে বিরাট প্রতিভা। পল্লীগ্রামে অনাদরে নষ্ট হচ্ছে। আমাকে দেখিয়ে সেই প্রতিভার খানিক স্বীকৃতিও যদি পাওয়া যায়! গনি সাহেব আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললেন, ভাই সাহেব, ছুনুর চোখ বড়ই ডেঞ্জারাস। ভেরী ভেরী ডেঞ্জারাস।
গ্রামের মানুষদের এই আরেক অভ্যাস, কানে কথা বলা। ছুনুর চোখ ডেঞ্জারাস এই তথ্য আমার কানের ভেতরে দিয়ে দেয়ার দরকার নেই। এটা তেমন গোপন তথ্যও না। এমন না যে ছুনু এই গোপন সংবাদ দিয়ে দেয়ায় আহত হবে। ছুনু এই খবরে খুশি হয় বলেই আমার ধারণা। সে যে একজন ডেঞ্জারাস ব্যক্তি তা প্রমাণ করার জন্যে ছুনুর নিজের ব্যস্ততাও কম না। গনি সাহেবের চেয়ে বেশি বলেই তো মনে হচ্ছে।
ছুনু বলল, বিয়া বাড়ির গফটা করেন, স্যার মজা পাইব। বড়ই মজার গফ।
মজা পাবার জন্যে আমি তেমন অস্থির ছিলাম না। তারপরেও বিয়ে বাড়ির গল্প শুনতে হল। তিন বছর আগের ঘটনা। এই গ্রামেরই এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। বর। আসছে পাল্কিতে। পথে ছুনুর সঙ্গে দেখা। ছুনু পাল্কি দেখে মুগ্ধ হয়ে (মনের ভুলে) বলে ফেলল, মেলা দিন পরে পাল্কি দেখলাম। বড়ই সৌন্দর্য। ছুনুর কথা শেষ হবার আগেই পাল্কি ভেঙে ধান ক্ষেতে পড়ে গেল। সেখানে আবার এক হাঁটু পানি। নতুন বর কাদায় পানিতে মাখামাখি। কনেবাড়ির লোকজন খবর শুনে ছুনুকে ধরে ইচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে। নীলগঞ্জ সদর হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল চারদিন।
ছুনু হাসিমুখে বলল, আরেকটু হইলে জানে মাইরা ফেলত স্যার। অল্পের জন্যে জেবন রক্ষা হইছে। সবই আল্লার ইশারা।
আমি বললাম, মার খেয়ে তুমি তো মনে হয় খুশিই হয়েছ।
ছুনু বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, মাইর তো স্যার খাওন লাগবই। অতবড় একটা ক্ষমতা।
এই ক্ষমতায় কি তুমি খুশি?
লোকজন আমারে সমীহ করে। যখন পথে হাঁটি আঙুল উঁচাইয়া দেখায়–বড় ভাল লাগে! এই যে আফনে আমারে আদর কইরা ফিলটার ছিটে দিলেন, আমি খাইলাম, এই গুলান হইল আমার ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা না থাকলে কে আমারে পুছতো?
তুমি কি নিশ্চিত তোমার ক্ষমতা আছে?
ছুনু মিয়া প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল। আনন্দিত গলায় বলল, নিজের কথা নিজের মুখে বলা ঠিক না, গুনাহ হয়। আল্লাহপাক বেজার হন। দশ জনেরে জিজ্ঞেস করেন, তারা বলব। আর যদি অনুমতি দেন তা হইলে চোউক্ষের একটা খেলা দেখাইয়া দিমু।
চোখের খেলা দেখার জন্যে আমি তেমন আগ্রহ দেখালাম না। এই সব আধিভৌতিক ব্যাপারকে প্রশ্রয় যত কম দেয়া যায় ততই ভাল। পিশাচ ও ডাইনীদের যুগ পেছনে ফেলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। চাঁদে মানুষ পৌঁছে গেছে, কিছুদিন পর পৌঁছবে মঙ্গল গ্রহে। এইসময় চোখ লাগা নিয়ে মাথা ঘামানো শুধু হাস্যকর না, অপরাধও।
পরদিন দুপুরে ছুনুর সঙ্গে আমার আবার দেখা। গনি সাহেবকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছি। হঠাৎ দেখি, খালের পাড় থেকে ছুনু কচুর লতি সংগ্রহ করছে। ছুনুর গায়ে আগের দিনের পোশাক নেই। ময়লা লুঙ্গি, খালি গা। চোখে সানগ্লাসও নেই। ছুনুর সঙ্গে বার-তের বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে। ছুনুর তুলনায় তার মেয়েটার পোশাক পরিপাটি। ফ্রকটা সুন্দর এবং পরিষ্কার। মাথার চুল বেণী করে বাঁধা। এই বোধহয় ছুনুর বৃত্তি পাওয়া মেয়ে। আমি বললাম, কে, ছুনু না?
ছুনু জিবে কামড় দিল, যেন হঠাৎ আমাকে দেখে লজ্জা পেয়েছে।
এই কি তোমার বৃত্তি পাওয়া মেয়ে?
ছুনু যেন আরো লজ্জা পেল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, নাম কি মা?
মেয়ে বিস্মিত এবং খুশি খুশি গলায় বলল, মরিয়ম।
ছুনু বলল, চাচাজানরে কদমবুসি কর মা। মুরুব্বিরে আদব করবা না এইসব আমি সহ্য করব না। মেয়ে এসে সালাম করল। আমি অবাক হয়ে দেখি, ছুনু চোখ মুছছে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছুনু বলল, আপনের মত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি আমার মেয়েরে মা ডাকল, মনটার মধ্যে বড় আনন্দ হইতেছে স্যার। বড় আনন্দ। আপনার মত মানুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা।
গনি সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, ঢং করিস না ছুনু। আজ তোর চশমা কই? চশমা ছাড়া ঘুরতাছস, তুই পাইছস কি?
গনি সাহেবের কথায় তার ভাবান্তর হল না। সে চোখ মুছতেই থাকল।
.
সন্ধ্যাবেলা গনি সাহেবের বাড়িতে ফেরার পথে ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল। পা পিছলে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক থেকে নিচের খালে পড়ে গেলাম। ব্যথা ভালই পেলাম। পা মচকে গেল। দেখতে দেখতে ফুলে ঢোল। গনি সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, এই রকম ঘটনা যে ঘটব আগেই টের পাইছি। ছুনু যখন বলছে, আপনার মত মানুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের কথা তখনই বুঝছি, হইছে কাম।
আমি বললাম, গনি সাহেব, আমি নিজের কারণে ব্যথা পেয়েছি। পা পিছলে পড়ে গেছি। বেচারা ছুনুকে এর মধ্যে জড়ানো খুবই হাস্যকর হচ্ছে।
গনি সাহেব থতমত গলায় বললেন, শুকনা খটখটা রাস্তা, এর মধ্যে আপনের পা পিছলাইল, বিষয় কি? বিষয় পরিষ্কার। ছুনু হারামজাদা নজর দিছে। তার চউখে ছিল চশমা। এটা তো সোজা হিসাব। হারামজাদার সাহস কত! চশমা ছাড়া ঘুরে। এর মীমাংসা হওয়া দরকার।
অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে তর্ক চলে না। কাজেই আর কিছু না বলে আমি গনি সাহেবের কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে ফিরলাম। আমার উপর ছুনু নজর দিয়েছে এই খবর কিছুক্ষণের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। দলে দলে লোক আমাকে দেখতে আসতে লাগল। যেই আসে, গনি সাহেব তার কাছেই নজর লাগার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। আমাকে আমার ফুলে যাওয়া পা দেখাতে হয়। দর্শনার্থীরা আহা, বিদেশী মানুষটারে কি বিপদে ফেলছে বলে সমবেদনার আর্দ্র স্বর বের করে। বিশ্রী অবস্থা!
রাতে খাবার সময় গনি সাহেব আমাকে জানালেন যে, ছুনুকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে পলাতক।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ছনু পলাতক কেন?
তার নজর লাগছে সেই খবর পাইয়া ভাগছে। ভাইগ্যা যাইব কই? ছুনুর কপালে দুঃখু আছে। বেজায় দুঃখু।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, মা’রধোর করা হবে নাকি?
দেখেন না কি হয়। আইজ তার বাপের নাম বিস্মরণ হবে।
আমি আপনার কাছে হাত জোড় করে বলছি ছুনুকে কিছুই বলবেন না। আমি পুরো ব্যাপারটায় খুবই লজ্জিত। আমার লজ্জা আর বাড়াবেন না।
গনি সাহেব উত্তর দিলেন না। গম্ভীর হয়ে রইলেন।
.
গ্রামের মানুষ একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তার প্রমাণ পেলাম শেষ রাতে। ঘুমিয়ে ছিলাম। গনি সাহেব আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, ছুনু। ধরা পড়েছে। আসেন দেখে যান। হারামজাদা কত বড় বদ! নিজের ঘরের চালের উপরে উঠে বসেছিল। তয় তার জন্মের শিক্ষা হয়ে গেছে।
আমি ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, উঠোনের মাঝখানে ছুনু পড়ে আছে। আমাকে আসতে দেখে কে একজন পাঁচ ব্যাটারির একটা টর্চ ছুনুর উপর ধরল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ছুনুর গায়ে কোন কাপড় নেই, সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সে পড়ে আছে। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। সে মাঝে মাঝে শা শা জাতীয় শব্দ করছে। আবার সেই শব্দ থেমে যাচ্ছে। কি ভয়াবহ অবস্থা!
উঠোনের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ছুনুর মেয়েটা। সে তার বাবাকে দেখছে না, দেখছে আমাকে। তার চোখে ঘৃণা নেই, রাগ নেই, তার চোখ গভীর অভিমানে আর্দ্র।
আমি ছুনুর কাছে গিয়ে বললাম, ছুনু, আমার লজ্জা আর অনুতাপের কোন শেষ নেই। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
ছুনু অনেক কষ্টে চোখ মেলল। আমি তার চোখে-মুখে একটা আনন্দের আভা দেখলাম। সে ফিস ফিস করে বলল, গরীব হইয়া জন্মাইছি। মাইর তো কপালে আছেই। স্যাররে যে ক্ষমতাটা দেখাইতে পারছি এইটাই মনে শান্তি। আপনে জ্ঞানী মানুষ। আপনে যেটা বুঝবেন, অন্য দশজনে সেইটা বুঝব না। তাছাড়া আইজের ঘটনায় নাম আরো ফাটব। এইটাও তো স্যার কম কথা না। মন্দ হউক ভাল হউক একটা ক্ষমতা পাইছি। দশজনে যদি নাই জানলো, হেই ক্ষমতা দিয়া লাভ কি? আমারে একটা সার্টিফিকেট যদি লেইখ্যা দেন বড় ভাল হয়। ঘরে টানাইয়া রাখি।
কি সার্টিফিকেট?
নজরের বিষয়ে একটা সার্টিফিকেট।
আচ্ছা যাও, দেব সার্টিফিকেট।
ছুনুর হেঁচকির মত উঠছে। দূরে দাঁড়িয়ে তার মেয়েটা কাঁদছে। কি অদ্ভুত পরিস্থিতি। কে একজন বলল, ছুনুর তওবাটা পড়ায়ে ফেলা দরকার, অবস্থা ভাল ঠেকতেছে না।
ছুনুকে বিছানায় এনে শোয়ানোর ব্যবস্থা করে ডাক্তার আনতে লোক পাঠালাম। ছুনু চোখের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল। আমি মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ফিস ফিস করে বলল, মইরা যাব কিনা বুঝতাছি না। শ্বাসকষ্ট হইতাছে। একটা গোপন কথা আফনেরে বইল্যা যাই স্যার। না বললে অফরাধি হইয়া থাকব। আমার আসলে কোন ক্ষমতা নাই। দুষ্ট লোকে গেরাম ভর্তি। ক্ষমতা থাকলে নজর দিয়া এরারে শেষ কইরা দিতাম। যেমন ধরেন, আমরার চেয়ারম্যান গনি সাহেব। কত চেষ্টা করছি তারে নজর লাগাইতে। লাগে না।
আমি তাকিয়ে আছি। কি বলব বুঝতে পারছি না।
ছুনু শ্বাস টানতে টানতে ফিসফিস করে বলল, সার্টিফিকেটটা কিন্তু স্যার দিবেন। বাইচ্যা থাকলে কামে লাগব।
জনক
মতির সম্প্রতি কফের দোষ হয়েছে। দিনে কম থাকে, রাতে বেড়ে যায়। ঘুমের মধ্যেও বিকট শব্দে সে কাশে। কাশির জন্যে মতির নিজের ঘুমের কোন অসুবিধা হয় না, অসুবিধা হয় তার শিশুপুত্রের। শিশুপুত্রের নাম মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন। মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেনের বয়স ২ মাস ১১ দিন। বাবার কাশির শব্দে সে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। যতবার মতি কাশে, ততবারই সে জেগে ওঠে কাঁদতে শুরু করে। তার শরীর অপুষ্ট কিন্তু গলায় ভাল জোর আছে। নিজের কাশির শব্দে মতির ঘুম না ভাঙলেও পুত্রের কান্নার শব্দে সে জেগে ওঠে। অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলে, সমস্যা কি? আঁ, সমস্যাটা কি? বউ, দেখোত কেঁথা ভিজা কি না।
মতির স্ত্রী জয়গুন মরার মত ঘুমায়। সে কিছুই দেখে না। সন্তান প্রসব করার প্রচণ্ড ধকল সে এখনো সামলে উঠতে পারেনি। ছেলে যত না ঘুমায়, জয়গুন ঘুমায় তারচেয়েও বেশি। কাজেই মতিকেই হাত বাড়িয়ে ছেলের কথা পরীক্ষা করতে হয়। না, কাঁথা শুকনাই আছে। হঠাৎ ছেলের বিকট কান্নায় মতি বড়ই বিস্মিত হয়। সে গভীর মমতায় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, কিরে ব্যাটা কান্দ কেন? নটি বয়। ভেরী নটি বয়। ঘরে সারা রাতই একটা হারিকেন জ্বলে। হারিকেনের আলোতে নটি বয়ের চোখ জ্বলজ্বল করে। সে বাবার কথা শুনে কান্না বন্ধ করে ঠিকই তবে ঠোঁট বাঁকিয়ে রাখে। পুত্রের বাঁকা ঠোঁট দেখতে মতির বড়ই ভাল লাগে।
ঠোঁট বাঁকা কেনরে ব্যাটা? ক্ষুধা লাগছে? হাঙ্গার?
ছেলের সঙ্গে ইংরেজীতে দুএকটা কথা বলতে মতির ভাল লাগে। অল্প কিছু ইংরেজী কথা মতি জানে। সংগ্রামের সময় শিখেছিল। বাবার ইংরেজী শুনে ছেলের বাঁকা ঠোঁট আস্তে আস্তে ঠিক হয়। সে হাত বাড়িয়ে কি যেন খোঁজে। মাকে খোঁজে বলেই মতির ধারণা। মতি চাপা স্বরে ডাকে, জয়গুন, জয়গুন। জয়গুন ঘুমের মধ্যেই পাশ ফেরে। স্ত্রীর পাশ ফেরা দেখে মতির ভয়ে শরীর কাঁপে। বেহুঁশের মত পাশ ফেরা। কোনদিন না ছেলে চাপা পড়ে। ঘুমকাতুরে মায়ের কারণে অনেক সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
ও জয়গুন। জয়গুন।
কি?
উঠ দেখি। উঠ।
কি হইছে?
মতি গম্ভীর গলায় বলে, মোহম্মদ মনোয়ার হোসেনের মুখে মাই দেও। ব্যাটার বেজায় ভুখ লাগছে।
ছেলেকে ভাল নামে ডাকতেই মতির ভাল লাগে। জয়গুন মাঝে মাঝে টুনা মিয়া ডাকে। মতি বড়ই বিরক্ত হয়। সুন্দর একটা নাম থাকতে টুনা মিয়া ফুনা মিয়া আবার। কি? কিন্তু সে স্ত্রীকে কিছু বলে না। কষ্ট করে সন্তান প্রসব করেছে। সামান্য হলেও তার একটা দাবি আছে। তবে কোন একদিন বুঝিয়ে বলতে হবে।
জয়গুন। ও জয়গুন।
কি?
মনোয়ার হোসেনের ভুখ লাগছে। মুখে মাই দেও। ব্যাটা ক্ষিধার চোটে অস্থির হইছে। কাইন্দা বাড়ি ভাঙতাছে, তোমার কোন খুঁজ নাই। তুমি কেমন মাতা, বল দেখি।
জয়গুনের ঘুম ভাঙে। সে ছেলের মুখে দুধ দেয়। মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেনের চুকচুক করে দুধ খাওয়ার দৃশ্যটা মতি মিয়া দেখতে পারে না। কারণ জয়গুন ছেলের মাথা শাড়ির আঁচলে ঢেকে দিয়েছে। মতি গজগজ করে। শাড়ি দিয়া এমন পেচাইছ ক্যান? দম-ফুটা লাইগ্যা না মরে।
জয়গুন স্বামীর কথায় অসম্ভব বিরক্ত হয়। বেআক্কেল একটা মানুষ। সে কি জানে।, মনের ভুলেও ছেলেমেয়ের মৃত্যু সংক্রান্ত কোন কথা বলা বাপমা’র জন্যে নিষেধ। কঠিন নিষেধ। জয়গুন গুজগুজ করে, ছিঃ দম ফুটা লাইগ্যা মিত্যু এইটা কেমন কথা। আল্লাহ নারাজ কথা। আল্লাহপাকের কাছে মাপ চান।
মতি লজ্জিত ও বিব্রত হয়। সে তৎক্ষণাৎ আল্লাহ পাকের কাছে মনে মনে ক্ষমা চায়।
জয়গুন।
উঁ।
দুধ খাইতেছে?
হুঁ।
তোমার বুকে দুধ আছে কেমুন?
কি সব কথা যে আফনে কন। শরমে বাঁচি না। ছিঃ!
শরমের কিছু নাই। দুধ শিশুর খাদ্য। এই নিয়া কথা বলায় কোন শরম নাই। কালা-জিরা ভর্তা বেশী কইরা খাইবা। দুধ বেশী আসবে। মায়ের দুধ ভাইটামিনে ভর্তি। প্রতি ফোঁটায় ভাইটামিন।
আইচ্ছা অখন চুপ যান। টুনি মিয়ারে ঘুমাইতে দেন।
ঘুমাইতাছে?
ঘুম ঘুম ভাব।
শাড়ির অঞ্চল সরাও, ব্যাটারে একটু দেখি।
দেখনের দরকার নাই। আফনে সইরা বসেন।
আহারে, একটু সরাও না।
জয়গুন নিতান্তই অনিচ্ছায় শাড়ির আঁচল সরালো। মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন চোখ বড় বড় করে তাকালো তার বাবার দিকে। মতি মুগ্ধ গলায় বললো, চউখ কেমন সুন্দর দেখছ বউ? জয়গুন বিরক্ত গলায় বলল, নজর দিয়েন না। বাপমা’র নজর বেশি লাগে। মনে মনে বলেন, মাশাল্লাহ। মাশাল্লাহ বললে নজর কাটা যায়।
মতি মনে মনে কয়েকবারই বলল, মাশাল্লাহ।
মোহম্মদ মনোয়ার হোসেনের দুধ খাওয়া শেষ হয়েছে। জয়গুন ছেলেকে পাশ ফিরিয়ে পিঠে চাপড় দিচ্ছে ঘুম পাড়ানোর জন্যে। চাপড়টা অনেক জোরে হচ্ছে বলে মতির ধারণা। ব্যথা পাচ্ছে হয়তো। অবোধ শিশু ব্যথার কথা বলতে পারছে না।
মতি বলল, কেঁথাটা ভিজা কিনা দেখ দেখি।
ভিজা না।
আহা হাত দিয়া দেখ না। এরা দুধের শিশু। মিনিটে মিনিটে এরার কেঁথা পরীক্ষা করা দরকার। একবার ঠান্ডা লাগলো কি, বুকে কফ বইস্যা দম শেষ।
আবার মরণের কথা? আইচ্ছা, আফনের মাথাটা কি খারাপ? তওবা করেন।
মতি মনে মনে তওবা করলো। জয়গুন ছেলের গায়ে থুক দিল। এতেও অনেক দোষ কাটা যায়। মতি বালিশের নিচ থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে বিছানা থেকে নামলো। পর পর দুবার ছেলের মৃত্যু সংক্রান্ত কথা বলে তার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে। বিড়ি ধরিয়ে মন খারাপ ভাবটা একটু যদি কাটানো যায়। বারান্দায় বসে বিড়িতে টান দিতেই কাশি শুরু হল। ভয়াবহ কাশি। ফুসফুস বের হয়ে আসতে চায়। এমন অবস্থা। কাশির শব্দে মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন আবার চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। জয়গুন না না কাঁদে না, কাঁদে না, বলে পুত্রের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। থামাতে পারছে না। মতি বিড়ি হাতে দূরে সরে গেল। হাতের বিড়িটা ফেলে দিতে ইচ্ছা করছে না। পয়সার কেনা জিনিস ফেলতে মায়া লাগে। বিড়ি শেষ করে মতি ফিরে এলো।
মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন ঘুমিয়ে পড়েছে। জয়গুনও ঘুমুবার আয়োজন করছে। স্বামীকে ফিরতে দেখে সে ক্লান্ত গলায় বলল, আফনে কাশির একটা চিকিৎসা করেন। যে কাশি হইছে, শুনলে ডর লাগে।
কাশির চিকিৎসার কথা যে মতি ভাবছে না তা না–ভাবছে। টাকা-পয়সার কথা চিন্তা করেই সময় নিচ্ছে। সংসারে শিশু এসেছে। তার কত খরচা আছে। এখন আর হুটহাট করে টাকা খরচ করা যায় না। সে কতই বা আর পায়? ইসমাইল কন্ট্রাক্টর সাহেবের সঙ্গে সে আছে গত দশ বছর ধরে। দশ বছরে ইসমাইল কন্ট্রাক্টার নেত্রকোনার বড় ধনী হয়েছে। আর মতি আগে যা ছিল এখনও তাই আছে–লেবার সর্দার। রোজ হিসাবে বেতন। কিছু টাকা জমেছিল। মনোয়ার হোসেনের জন্মের সময় ডাক্তার-হাসপাতাল করে সব শেষ। জমা কিছু টাকা ছিল বলে রক্ষা। টাকা না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যেত। শেষ বয়সে সন্তান হওয়া যে এমন জটিল, কে জানত। মতি ধরেই নিয়েছিল তাদের ছেলেপুলে হবে না। আল্লাহ পাকের কি কুদরত। তার পঞ্চাশ বছর বয়সে পুত্র সন্তান।
জয়গুন ঘুমাইছ?
না।
তোমার ছেলে কার মত হইছে বল দেখি।
জয়গুন হাই তুলতে তুলতে বলল, আফনের মত হইছে। এইটা বলাবলির কিছু। তয় স্বভাবচরিত্র কেমন হয় এইটা হইল কথা।
ইনশাল্লাহ ভাল হইব। স্বভাবচরিত্র নিয়া চিন্তা করবা না।
জয়গুন ক্লান্ত গলায় বলল, রাইত মেলা হইছে, অখন ঘুমান।
মতির ঘুম আসছে না। গল্প-গুজব করতে ইচ্ছে করছে। ছেলের জন্মের পর থেকে জয়গুনের সঙ্গে তাঁর গল্পই হয় না। জয়গুন এত ক্লান্ত থাকে। সে নিজেও অবশ্যি খুব ব্যস্ত থাকে। সকাল সাতটার সময় কাজে চলে যায়। ঘরে ফিরতে কোন দিন রাত দশটা বাজে, কোন দিন বাজে এগারোটা। কাজে যাবার সময় দেখে ছেলে ঘুমুচ্ছে, ফিরে এসেও দেখে ঘুমুচ্ছে। জয়গুন অবশ্যি ঘুম ঘুম চোখে জেগে থাকে। তাকে চারটা ভাত বেড়ে দিয়ে ছেলের কাছে চলে যায়। মতির খুব ইচ্ছা করে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে। সগ্রামের সময়ের গল্প। পনেরো বছর আগের কথা মনে হয় গতকালের ঘটনা।
মতির আবার কাশির বেগ আসছে। বহু কষ্টে সে কাশির প্রবল ঝাপটা গলা খাকারিতে এনে সামাল দিল। নরম স্বরে ডাকলো, ও জয়গুন। জয়গুন।
উঁ
তোমার ছেলে স্বাধীন দেশে জন্মাইছে, এইটা একটা ঘটনা। কি বল?
হুঁ।
স্বাধীন খুব সহজ ব্যাপার না।
হুঁ
ছেলে যখন সেয়ানা হইব স্বাধীন বিষয়টা কি বুঝাইয়া বলবা।
আইচ্ছা।
ছেলে যখন শুনব তার পিতা স্বাধীনের জন্যে যুদ্ধ করছে তখন আনন্দ পাবে। বড়ই আনন্দ পাবে। অহংকারও করতে পারে; যদিও অহংকার করা ঠিক না। তবে ছেলে মানুষ একটু-আধটু অহংকার করলে দোষ হয় না।
অখন ঘুমান, রাইত মেলা হইছে।
এই যে তোমার সঙ্গে গল্প করতেছি, এইটা আল্লাহর একটা নেয়ামত। বাঁচার কথা ছিল না। মুরাদখালি ফাইটে আমরা সতেরোজন ছিলাম। জীবন নিয়া ফিরছি মাত্র তিনজন। আমি, বাঁশখালির ইরতাজ ভাই আর গৌরাঙ্গ। গৌরাঙ্গের কথা মনে আছে? বিবাহের পরপর তোমারে দেখতে আসল। তোমার জন্যে একটা শাড়ি আনল। তারপর আমারে জড়াইয়া ধইরা কি কান্দন। সে কান্দে, আমি কান্দি। যুদ্ধের সময়ের বন্ধন। বড় কঠিন বন্ধন। রক্তের বন্ধনের চেয়েও কঠিন। ঘুমাইয়া পড়লা, ও জয়গুন, জয়গুন।
না ঘুমাই নাই।
মতি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বলল, মুরাদখালি ফাইটের ঘটনাটা শোন। সে এক বিরাট হিস্টোরী।
জয়গুন ক্লান্ত গলায় বলল, অনেকবার তো শুনছি, আর কত?
এইসব ঘটনা পুরান হয় না। লক্ষ বার শোনা যায়। ভালমত জানা থাকলে তোমার জন্যে সুবিধা। ছেলেরে ঠিকঠাক বলতে পারবা।
আফনে নিজে ঠিকমত বলবেন।
নিজের কথা নিজের বলা ঠিক না। তাছাড়া বেশী দিন বাঁচব না। শরীর হইছে নষ্ট। চিকিৎসার সামর্থ্য নাই।
দেশ স্বাধীন কইরা তাইলে আফনের লাভটা হইছে কি?
এইতো একটা ভুল কথা বলো বউ। দেশ স্বাধীন কি আর কোন ব্যবসাবাণিজ্য যে লাভ-লোকসান হইব। স্বাধীন অনেক বড় ব্যাপার। স্বাধীনের কথা বলতে গিয়া এই দেখ গায়ের লোম খাড়া হইয়া গেছে। হাত দিয়া দেখ বউ।
মতি হাত বাড়িয়ে দিল। জয়গুন স্বামীর হাতের লোম খাড়া হয়েছে কি না তা দেখতে হাত বাড়ালো না। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বড় বড় নিঃশ্বাস পড়ছে। মতি এবার কাশির বেগ সামলাতে পারল না। প্রবল বেগে কাশতে থাকলো। জয়গুনের ঘুম ভাঙল না। ঘুম ভাঙলো মোহম্মদ মনোয়ার হোসেনের। সে কাঁদতে শুরু করলো। মতি উঠে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। আশ্চর্য কাণ্ড! কোলে উঠেই ছেলে শান্ত। চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে। মতি বলল, নটি বয়। নটি বয়। আরে, ব্যাটা দেখি হাসার চেষ্টা করে।
মতি ছেলেকে কোলে নিয়ে বসলো। ছেলে যেন কেঁদে মা’র ঘুম না ভাঙায় এই জন্যেই ছেলের সঙ্গে গল্প শুরু করলো। গল্প কিছু বুঝবে না। শব্দ শুনবে, ঠোঁট নাড়া দেখবে। এতে মজা পেয়ে কান্না ভুলে থাকবে।
ব্যাটা শোন, সংগ্রামের সময়ের কথা শোন। কইলজা ঠান্ডা হইয়া যাইব অমন অবস্থা…প্রথম যুদ্ধ করলাম বোয়ালখালি বাজারে। সংবাদ আসছে চাইর-পাঁচজন রাজাকার আসছে বোয়ালখালি বাজারে। কুদ্দুসের পাট গুদামে থাকে। মদ, গাঁজা খায় আর পাবিলিকরে খুব অত্যাচার করে। আমরা দশজন নৌকা নিয়া রওনা হইলাম। আমরার কমান্ডার হইলেন মনু ভাই। ইউনির্ভাসিটির ছাত্র। কি সুন্দর চেহারা। কি ভদ্র ব্যবহার। শিক্ষার গুণ, আর কিছু না। আসছেও খুব বড় পরিবার থাইক্যা। যাই হোক, ঘটনা শোন। সইন্ধ্যাকালে বোয়ালখালি বাজারে নাইম্যা পাট গুদামের তিনদিকে পজিশান নিলাম। রাজাকার ভাইব্যা গুলি শুরু করছি। রাজাকারের মজা হইল—-গুলি শুনলেই এরা বন্দুক ফালাইয়া দৌড় দেয়। এইখানে দেখি ঘটনা অন্য। কথা নাই বার্তা নাই, পাট গুদামের ভিতর থাইক্যা মেশিনগানের গুলি শুরু হইল। ট্যাকট্যাক ট্যাকট্যাক ট্যাকট্যাক। মিলিটারি ছাড়া মেশিনগান পাইব কে? আমরার কইলজা গেল শুকাইয়া। মিলিটারির সাথে প্রথম যুদ্ধ।
রাইফেল হাতে কাঁপতাছি আর দোয়া ইউনুস পড়তাছি–তখন ডাইন পায়ে গুলি খাইলাম। আমার দুনিয়া আন্ধাইর হইয়া গেল। বুঝলি ব্যাটা, তখন মনু ভাই কি করল শুন–এই আমারে পিঠের মইদ্যে নিয়া মনু ভাই পাক্কা তিন মাইল দৌড়াইল। আমার জীবন রক্ষা হইল। মনু ভাই আমারে ফালাইয়া চইল্যা আসতে পারতো। তখন সবের ঘোর বিপদ। ফালাইয়া আসে নাই। মনু ভাইয়ের ঋণ শোধ করতে পারি নাই। এর একমাস পরে মুরাদখালি ফাইটে মনু ভাই মারা গেলেন। মনে হইলেই কইলজা কামড়ায়। বুঝলিরে ব্যাটা, মনু ভাইয়ের নামে তোর নাম রাখছি। মোহম্মদ মনোয়ার হোসেন। নামের ইজ্জত রাখন চাইরে ব্যাটা। নামের ইজ্জত রাখন চাই। বড়ই ইজ্জতদার নাম।
.
গল্প বলতে বলতে মতি মিয়ার চোখ জলে ভর্তি হয়ে আসে। চোখ ভর্তি অশ্রুর কারণেই বোধহয় শিশু পুত্রটিকে তার অন্যরকম মনে হয়। তার বড় মায়া লাগে।
মতি মিয়ার শিশুপুত্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় বাবার গল্পটা সে বুঝতে পারছে।
জলকন্যা
রাত আটটার দিকে বীনুর মনে হল সে একটা ভুল করেছে। ছোটখাটো ভুল না, বড় ধরনের ভুল–-মনিকার জন্মদিনে তার আসা ঠিক হয়নি। মনিকা তার এমন কেউ না যে তার জন্মদিনে আসতেই হবে। তাছাড়া মনিকা তাকে সেভাবে দাওয়াতও করেনি। ভদ্রতা করে বলেছে। মনিকা তার জন্মদিনের কথা নীতুকে বলছিল, সেই সময় বীনুর দিকে তাকিয়ে বলল, বীনু তুমিও এসো। বীনু তৎক্ষণাৎ হ্যাংলার মত বলেছে—আচ্ছা। এটা যে নিতান্তই কথার কথা তাও বুঝেনি।
মনিকা বলেছে, পার্টিতে যারা আসবে তাদের কিন্তু সারারাত থাকতে হবে। সারারাত আমরা হৈ চৈ করব। তোমার কোন অসুবিধা হবে না তো?
বীনু বলল, না, অসুবিধা হবে না।
অথচ তার ভয়ঙ্কর অসুবিধা হবে। তাদের বাসা এরকম না যে ঊনিশ বছর বয়েসী মেয়েকে রাতে অন্য বাড়িতে থাকতে দেবে। তার নামে বাসায় কোন চিঠিপত্র এলে তার হাতে দেয়া হয় না, আগে বীনুর মা মনোয়ারা খুলে পড়েন। পড়ার পর যদি মনে হয় সাধারণ চিঠি তবেই তার হাতে দেয়া হয়। সাধারণ চিঠিতেও সমস্যা আছে। তার এক বান্ধবী সুরমা, ক্লাস টেনে পড়ার সময়ই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সে তার স্বামীর সঙ্গে চলে গিয়েছিল সেতাবগঞ্জ নামের একটা জায়গায়। সেখান থেকে সে মাসে দু’টা তিনটা করে চিঠি লিখতো। মনোয়ারা একদিন বললেন, মেয়েটা এত চিঠি লেখে কেন? ঘন ঘন চিঠি লেখার দরকার কি?
বীনু অবাক হয়ে বলল, চিঠি লিখলে অসুবিধা কি মা?
মনোয়ারা থমথমে গলায় বললেন, অসুবিধা আছে, তোর বাবা রাগ হয়। বাবা রাগ হয়–এর উপর কথা চলে না। বীনুদের সংসার তার বাবা ইদ্রিস আলির চোখের ইশারায় চলে। ইদ্রিস আলি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। রোগা পটকা মানুষ, থুতনীতে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটার মত দাড়ি আছে। নিতান্তই সাধারণ চেহারার একজন মানুষ। অথচ সেই সাধারণ চেহারার মানুষের চোখের ইশারার বাইরে যাবার সাহস কারো নেই। বীনুর ছোট ভাই জহির কলেজে ভর্তি হবার পর একবার সাহস দেখালো, বাসায় ফিরল রাত সাড়ে এগারোটায়। তার এক বন্ধুর বাসায় নাকি দাওয়াত ছিল। বাসায় ফিরেই সে নিজের ঘরে ঢুকে তাড়াহুড়া করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। তখন ইদ্রিস সাহেব ছেলের ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। কোমল গলায় বললেন, জহির ওঠ (ইদ্রিস সাহেবের গলার স্বর খুবই কোমল)। জহির ধড়মড় করে উঠে বসলো। জহির সাহেব বললেন, কোথায় ছিলি?
বন্ধুর বাসায় দাওয়াত ছিল।
খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত করেছিস?
জ্বি।
কি খাওয়ালো?
পোলাও আর খাসির রেজালা।
বোরহানি ছিল না?
জ্বি না।
গরমের মধ্যে বোরহানি দেয়া তো উচিত ছিল। রিচ ফুড বোরহানি ছাড়া হজম হবার কথা না। খাওয়া-দাওয়ার পর মিষ্টি পান খাস নাই?
জ্বি খেয়েছি।
সিগারেট খাস নাই? মিষ্টি পানের সাথে তো সবাই সিগারেট খায়। তুই খাস নাই?
জ্বি না।
আমিতো গন্ধ পাচ্ছি। দেখি হা করতো, বড় করে হা কর। আরো বড়। এখন নিঃশ্বাস ফেল।
জহির নিঃশ্বাস ফেলল এবং কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আর কোনদিন খাব না বাবা। ইদ্রিস সাহেব মধুর গলায় বললেন–খাবি না কেন, অবশ্যই খাবি। বন্ধুবান্ধব আগ্রহ করে দেয়, না খেলে ওরা মনে কষ্ট পাবে। কারো মনে কষ্ট দেয়া ঠিক না। আচ্ছা এখন নাম বিছানা থেকে।
জহির বিছানা থেকে কাঁপতে কাঁপতে নামলো।
সার্ট গায়ে দে।
জহির সার্ট গায়ে দিল।
ইদ্রিস সাহেব বললেন, যা এখন বাসা থেকে চলে যা। তোকে আর পুষব না। তুই আমাকে বাপ ডাকবি তার জন্যে তোকে পোষার দরকার দেখি না। ঢাকা শহরে শত শত লোক আছে যাদের তিনবেলা ভাত খাওয়ালে খুশি মনে আমাকে বাপ ডাকবে।
.
জহিরকে অবশ্যই সে রাতে বাসা ছাড়তে হত যদি না ইদ্রিস সাহেবের মা ভাগ্যক্রমে বাসায় থাকতেন। এই ভদ্রমহিলার বয়স সত্তরের উপর। চোখে দেখতে পান না। কিন্তু কান খুব পরিষ্কার। হাঁটা চলা করতে পারেন। হৈ চৈ শুনে তিনি দেয়াল ধরে ধরে বের হয়ে এলেন এবং তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আবু কি হইছে?
ইদ্রিস সাহেব বললেন, কিছু না মা, ঘুমান।
বাসাত থাইক্যা কারে বাইর করতাছস?
আম্মা আপনে ঘুমান।
আমি জীবিত থাকতে তুই আমার নাতিরে রাস্তায় বাইর কইরা দিবি, তোর সাহসতো কম না। সাহস বেশি হইছে?
কাউরে বাইর করতেছি না।
এইটা ভাল কথা।
থুরথুরি বুড়ি বিছানায় শুতে গেলেন। তবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণই কথা বলতে লাগলেন–সিগারেট খাইছে তো কি হইছে? তার বয়সে তুই বিড়ি খাইচস। নিজের বাপের মাইর তোর মনে নাই। বাপগিরি ফলাস। অত বাপগিরি ভাল না।
.
বীনুর ভরসা তার দাদীজান। দাদীজান এখন তাদের বাসায় আছেন। তিনি পালা করে তার চার ছেলের বাসায় তিন মাস করে থাকেন। রোজার ঈদ পর্যন্ত বীনুদের সঙ্গে থাকার তারিখ পড়েছে। দাদীজানকে দিয়ে বাবার অনুমতি বের করে নেয়া খুব সমস্যা হবে না বলেই বীনুর ধারণা। বীনুর খুব শখ মনিকার সঙ্গে একটা রাত কাটায়। এত সুন্দর একটা মেয়ে আর এত বড়লোক। ওদের বাড়িটাও নিশ্চয়ই দেখার মত হবে। বীণুর ক্ষীণ আশা একটা রাত থাকলে মনিকার সঙ্গে তার ভাব হতে পারে। এরকম। একটা মেয়ের সঙ্গে ভাব হওয়াও ভাগ্যের কথা। মনিকা যাদের সঙ্গে ঘুরে বীনু দূর থেকে তাদের দেখে, তাদের চালচলন কথাবার্তা সবই অন্য রকম। সেদিন মনিকারা চারজন (ওরা চারজন সব সময় এক সঙ্গে থাকে। সেই জন্যে ওদের নাম হয়েছে চতুর্ভুজ)। ওয়াদুদ স্যারের ঘরে ঢুকে পড়ল। মনিকা তখন স্যারের রুমে। সে গেছে তার। পার্সেন্টেজ দিতে। দেরিতে ক্লাসে এসেছিল বলে পার্সেন্টেজ দিতে পারেনি।
ওয়াদুদ স্যার বললেন, কি ব্যাপার, চতুর্ভুজ এক সঙ্গে? মনিকা হাসি মুখে বলল, আপনি স্যার কফি বানিয়ে খান। রোজ এত সুন্দর গন্ধ পাই। আজ আমাদের কফি খাওয়াতে হবে।
বেশতো, কফি খাও।
ওয়াদুদ স্যার বেয়ারাকে কফি বানাতে বললেন। বীনু মুগ্ধ হয়ে গেল মেয়ে চারটার সাহস দেখে।
আরেকবার বীনু সাবসিডিয়ারী ক্লাসের শেষে বেরুচ্ছে। একটা বদ ছেলে ভিড়ের অজুহাতের সুযোগে বীনুর বুকে হাত দিল। বীনু লজ্জা এবং ভয়ে প্রায় জমে গেল। মনিকা ছিল তার পেছনে। সে ছেলেটার সার্ট খামছে ধরে বলল, তুমি ওর গায়ে হাত দিলে কেন? চারদিকে ভিড় জমে গেল। বীনু প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কেউ আমার গায়ে হাত দেয়নি। মনিকা, ওকে ছেড়ে দাও।
মনিকা শীতল চোখে কিছুক্ষণ বীনুর দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। মনে মনে সে নিশ্চয়ই বীনুর মুখে থু থু দিয়েছে। বীনুর দিকে তাকাতেও নিশ্চয়ই তার
ঘেন্না করছিল। করাটা স্বাভাবিক। বীনু যদি তার অবস্থাটা ব্যাখ্যা করতে পারতো তাহলে হয়তো মনিকা তাকে এতটা ঘৃণা করতো না। তাদের বাসা অন্য সব বাসার মত না। তার বাবা-মা অন্য সব বাবা-মা’র মত না। তারা আলাদা। কি রকম যে আলাদা তা মনিকা বা মনিকার মত বান্ধবীরা জানে না।
.
বীনু যখন কলেজে পড়ে তখন হঠাৎ দেখা গেল একটা ছেলে প্রায়ই তাদের বাসার। সামনে হাটাহাটি করে। জানালার দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুকে। বীনু ব্যাপারটা শুরুতে লক্ষ্যই করেনি। লক্ষ্য করলেন বীনুর মা। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বীনুর বাবাকে জানালেন। ইদ্রিস আলী ঐ ছেলেকে কিছু বললেন না। তিনি ঝিম ধরে সারা দুপুর বসে রইলেন (অফিসে গেলেন না, অফিস কামাই করলেন)। মাগরেবের নামাজের পর মিষ্টি গলায় ডাকলেন–বীনু কইরে?
বীনু সামনে এসে দাঁড়াল।
বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করে ছেলেটা কে?
বীনু অবাক এবং খানিকটা ভীত গলায় বলল, কোন ছেলে?
ইদ্রিস সাহেব আরো শান্ত গলায় বললেন, কোকরা চুলের একটা ছেলে, গলাটা লম্বা।
জানি নাতো বাবা।
জান না?
জ্বি না।
তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি তাকে চেন না জান না, এম্নি সে তোমার ঘরের সামনে ঘুরাঘুরি করে?
বীনু এই পর্যায়ে ভয়ে অস্থির হল। কারণ দাদীজান বাসায় নেই। তিনি তাঁর ছোট ছেলের বাসায়। জুলাই মাস পর্যন্ত সেখানে থাকবেন। বীনুকে রক্ষা করার এখন আর কেউ নেই।
ইদ্রিস সাহেব শান্ত গলায় বললেন, শরীরে বিষ ঢুকে গেলে মন্ত্র পড়ে বিষ নামাতে হয়। সেই মন্ত্র আমি জানি। যাও–ঘরে যাও, আমি আসছি। তোমার মাকে বল উপস্থিত থাকতে।
বীনুর খুব ইচ্ছা হল দরজা খুলে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তারপর রাস্তা ধরে দৌড়াতে থাকে। রাস্তার দু পাশে যদি কোন বাড়ি থাকে এবং তার দরজা খোলা থাকে তাহলে সে সেই খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়বে এবং বাড়ির মালিককে বলবে—-আপনাদের কোন কাজের বুয়া লাগবে?
যাই হোক বীনু সেই সব কিছুই করল না। সে তার মাকে সঙ্গে নিয়ে শোবার ঘরে খাটের উপর বসে রইল। বাতি জ্বালালো না। যথাসময়ে ইদ্রিস সাহেব এলেন এবং মেয়ের চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টান দিলেন। মেয়ে বড় হয়েছে তার গায়ে হাত দেয়া যায় না। তাকে শাস্তি দিতে হলে চুলের মুঠি ধরেই দিতে হয়। পরবর্তী আধঘন্টা ইদ্রিস সাহেব শাস্তি দিলেন। তার হাত ভর্তি মুঠো মুঠো চুল উঠে আসতে লাগলো। বীনুর মা পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্ধকারে তার মুখ দেখা গেল না। দেখা গেলে দেখা যেত। শাস্তি প্রক্রিয়ায় তাঁর অনুমোদন আছে। শাস্তির শেষে বীনু মরার মত মেঝেতে পড়ে রইলো। ইদ্রিস সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন–যন্ত্রণা ঘরে রেখে লাভ নেই। বিয়ে দিয়ে দাও। আমার দায়িত্ব শেষ হোক। হাতে ছেলে একটা আছে, বয়স সামান্য বেশি। পুরুষ মানুষের জন্যে বয়স কোন বড় ব্যাপার না। বীনুর মা বললেন–তুমি যা ভাল বোঝ কর।
সেই ছেলেটির সঙ্গে বীনুর বিয়ে হয়ে যেত। ঠেকালেন বীনুর দাদীজান। বীনু তার কাছে কেঁদে গিয়ে পড়েছিল। তিনি ছেলেকে ডেকে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, বীনুর নাকি বিবাহের কথা চলতেছে?
ইদ্রিস বললেন, জ্বী।
আলহামদুল্লিাহ। ছেলে কি করে?
ছোটখাট ব্যবসা আছে। মুগদা পাড়ায় নিজের বাড়ি আছে।
বয়স কত?
বয়স সামান্য বেশি।
অনুমান কত।
সঠিক জানি না, ত্রিশ বত্রিশ হতে পারে, কিছু বেশিও হতে পারে। পুরুষ মানুষের বয়স কোন ব্যাপার না।
গাধার মত কথা কচ ক্যান। পুরুষ মানুষের বয়স কোন ব্যাপার না তরে কে শিখাইছে? মেয়েটা ভাল লেখাপড়া করতেছে। তারে ঘাটের মরার সাথে বিয়া দিবি? তুই তিনবারে মেট্রিক পাস করছস। তোর মেয়ে মেট্রিকে বৃত্তি পাইছে। আমরার পরিবার থাইক্যা একটা মেয়ে এমএ পাস করব। এইটা দেখনের জন্যে এখনো বাঁইচ্যা আছি। বুঝছস?
লেখাপড়াতো বিয়ের পরেও হয়।
বিয়ার পর প্রত্যেক বছরে একটা কইরা বাচ্চা হয়। আর কিছু হয় না। তুইতো আইএ পাস বউ বিয়া করছিলি। বিয়ার পরে হে কি বিএ পাস দিছে? আমারে চেতাইস না। খবর্দার কইলাম। খবর্দার।
.
বিয়ে হয়নি। এবং খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার বীর্ন ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে গেল। তার দাদীজান তাকে সেদিন দুহাজার টাকা দিয়ে বললেন, যা–ভাল ভাল জামা কাপড় কিন্যা আন। যেটা পছন্দ সেটা কিনবি। আইজ-কাইলের মেয়েরা যেগুলি পরে। বুজচস?
বীনু দুটো সালোয়ার কামিজ কিনেছে। নিজে একা একা গিয়েই কিনেছে। একটা শাদার উপর গোলাপী কাজ, অন্যটা লালের উপর লাল সূতার কাজ। কামিজ দুটোর কোনটাই সে পরতে পারেনি। ইউনিভার্সিটিতে যাবার প্রথম দিন সে লাল কামিজটা পরল। বীনুর মা বললেন, প্রথম ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিস তোর বাবাকে সালাম করে তার দোয়া নিয়ে যা। বীনু তার বাবাকে সালাম করল। ইদ্রিস সাহেব বললেন, প্রথম ক্লাসতো এগারোটায়, এখন বাজে নটা চল্লিশ। এখন কোথায় যাচ্ছিস। বীনুর মা বললেন, প্রথম দিন একটু আগে আগে যাবে। কোন রুমে ক্লাস খুঁজে পাবে না।
ইদ্রিস সাহেব বললেন, খুঁজে না পাওয়ার কি আছে? তাছাড়া আমিতো সঙ্গে যাচ্ছি।
বীনুর মুখ শুকিয়ে গেল। বাবা সঙ্গে যাবেন। তার সঙ্গে ক্লাস রুম খুঁজে বের করবেন। কে জানে ক্লাস চলাকালীন সময়ে হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। সবাই। হাসাহাসি করবে।
ইদ্রিস সাহেব বীনুর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, তুই অপেক্ষা কর। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস না। সামনে থেকে যা। বলেই কঠিন গলায় ডাকলেন, সুরমা-সুরমা।
সুরমা মাছ কাটছিলেন, হাতে মাছের রক্ত নিয়েই ছুটে গেলেন। ইদ্রিস সাহেব থমথমে গলায় বললেন, মেয়ে যে জামাটা পরেছে সেই জামাটা দেখেছ? গলার কাটা কত বড় দেখেছ?
সুরমা ক্ষীণ গলায় বললেন, আজকালতো সবাই এইসবই পরে।
ইদ্রিস সাহেব বললেন, ন্যুড ক্লাবে আজকালতো অনেকে ন্যাংটাও ঘুরে বেড়ায়। তোমার মেয়েতো পড়াশোনা করার জন্যে যাচ্ছে। সেকি তার বুক দেখানোর জন্যে যাচ্ছে? সে দেখাতে চায় যে তার বুক বড়?
ইদ্রিস সাহেব কথাগুলো চাপা গলায় বললেও বিনু বারান্দা থেকে শুনে ফেলল। তার ইচ্ছা করল ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যায়। সে লাফ দিয়ে পড়ল না। যথাসময়ে সাধারণ একটা শাড়ি পড়ে বাবার সঙ্গে রিকশা করে রওনা হল। রিকশায় ইদ্রিস সাহেব মেয়েকে কয়েকটা উপদেশ দিলেন। কখনো কোন ছেলের সঙ্গে কথা বলবে না। মেয়েদের সঙ্গে মেশার ব্যাপারেও সাবধান। বেশি মেশামেশিরও দরকার নেই। ইউনিভার্সিটি কোন আড্ডাখানা না। ক্লাস করবে, ক্লাস শেষ হবে বাসায় চলে আসবে। ব্যাস।
কোন পরিবেশে বীনু বড় হচ্ছে তা মনিকা বা মনিকার বান্ধবীরা জানে না। জানলে বুঝতো একটা বদ ছেলে তার গায়ে হাত দেয়ার পরেও সে কেন বলছে–কেউ গায়ে হাত দেয়নি। এই নিয়ে কোন সমস্যা হলে বাবার কানে চলে যাবে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, যথেষ্ট হয়েছে আর না। পড়াশোনার দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে ঝামেলা মিটাও। কবুল কবুল কবুল–ঝামেলা শেষ।
মনিকার চোখে বীনু খুব ছোট হয়ে আছে। বীনু ভেবে রেখেছে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলে সে মনিকাকে তার কথাগুলো বলবে। তারা যেহেতু সারারাত থাকবে সুযোগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। সমস্যা একটাই বাবার অনুমতি। বীনু ঠিক করল সে কেঁদে দাদীজানের পায়ে পড়ে যাবে। তিনি একটা ব্যবস্থা করবেন। অবশ্যই করবেন।
.
তিনি ব্যবস্থা করলেন। কিভাবে করলেন বীনু জানে না। জানতেও চায় না। সে বিস্ময়ের সঙ্গে তার বাবাকে বলতে শুনলো–ওরা থাকে যেন কোথায়?
গুলশানে।
ওদের টেলিফোন নাম্বার জান?
জ্বি জানি।
ঐ বাড়ির ঠিকানা, টেলিফোন নাম্বার একটা কাগজে লিখে যাও। জহির তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে, বাসাটাও চিনে আসবে। আমি রাতে তোমার খালার বাসা থেকে একবার টেলিফোনে খোঁজ নেব।
তার দরকার নেই বাবা।
অবশ্যই দরকার আছে। আরেকটা কথা তোমাকে বলি, তুমি আজ যা করছ তা ঠিক না। অন্যায়। আমার মা মৃত্যুশয্যায়–তিনি একটা কথা বললেন, ফেলতে পারলাম না। মায়ের আদেশ আমি কোনদিনই অগ্রাহ্য করি নি। যতদিন বাঁচবেন অগ্রাহ্য করবো না। এখন যাও, টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা সুন্দর করে কাগজে লিখে ফেল।
বাবা তাকে তুই তুই করে বলেন, এখন তুমি করে বলছেন। বাবার মনটন যে অসম্ভব খারাপ সেটা বোঝা যাচ্ছে।
বন্ধুর জন্মদিন খালি হাতে যাওয়া ঠিক না। আমি উপহার কিনে নিয়ে আসছি। সাথে করে নিয়ে যাও।
জ্বি আচ্ছা।
ইদ্রিস সাহেব চারটা গ্লাসের একটা সস্তা সেট নিয়ে এলেন। এই উপহার মনিকার হাতে দিলে বীনা নিজেই লজ্জায় মরে যাবে এবং চারদিকে হাসাহাসি পড়ে যাবে।
.
সন্ধ্যা সাতটার সময় যাওয়ার কথা বীনু ঘড়ি ধরে ঠিক সন্ধ্যা সাতটার সময়ই উপস্থিত হল। বড়লোকের বাড়ি সবই নিশ্চয়ই নিয়ম মত হবে। গিয়ে দেখে সে ছাড়া আর কেউ আসেনি। মনিকা নিজেও সাজগোজ কিছু করেনি। গোসল করার জন্যে বাথরুমে শুধু ঢুকতে যাচ্ছে। সে বীনুকে দেখে বলল, ও আচ্ছা, তুমি চলে এসেছ। অন্যরাতত কেউ আসেনি। সারারাত থাকবে তো ধীরে সুস্থে আসছে। তুমি কি সারা। রাত থাকবে না চলে যাবে?
থাকব।
বাসায় অসুবিধা থাকলে রাত দশটা এগারোটার দিকে চলে যেতে পার। গাড়ি আছে, গাড়ি দিয়ে আসবে।
না, অসুবিধা হবে না।
অসুবিধা না হলে খুব ভাল। আমরা সারারাত ফান করব। তুমি এখন টিভি দেখ বা বই টই পড়। মজু আঙ্কেল টেলিফোন করেছেন, কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। তখন তার সঙ্গে গল্প করতে পারবে।
উনি কে?
বাবার বন্ধু। আমাদেরও বন্ধু। ম্যাজিক টেজিক অনেক কিছু জানেন। ফান করার আইডিয়াতে তার মাথা একেবারে ভর্তি।
বীনু বলল, তোমাদের বাড়িটা কি একবার ঘুরে দেখব? এত সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে দেখিনি।
দেখ, ঘুরে ঘুরে দেখ। রহিমাকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাবে। কি খাবে? চা, কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কিছু?
না।
আমাদের ডিনারের কিন্তু দেরি হবে। আজকে আমাদের ডিনার খাওয়াচ্ছেন মজু আঙ্কেল। বিশেষ একটা খাবার তৈরি হচ্ছে। সেটা আসবে রাত এগারোটার দিকে। ভাল কথা, তুমি কি সুইমিং কস্টিউম এনেছ? ও আচ্ছা, তোমাকে বোধ হয় বলা হয়নি আমাদের বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল আছে। গভীর রাতে আমরা সবাই সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে কাটতে গান শুনব। তুমি কি সাঁতার জান?
বীনু সাঁতার জানে। তার নানার বাড়ির পুকুরে দাপাদাপি করে ছোটবেলাতেই সাঁতার শিখেছে। তারপরেও বলল,–সাঁতার জানি না। তার এতগুলো মেয়ের সঙ্গে পানিতে নামতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে পানিতে মজু আংকেল নামের ভদ্রলোকও নামবেন।
.
রহিমা মধ্যবয়স্ক হাসি খুশি একজন মহিলা। তার পরনের শাড়িটা পরিষ্কার, পায়ে সুন্দর চামড়ার স্যান্ডেল। মনিকা আগে বলে না দিলে বীনা তাকে মনিকার মা বা তার কোন আত্মীয় ভেবে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলতো। রহিমা’র মা বীনাকে খুব খুশি মনেই ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখালো। লাইব্রেরী ঘর, কম্পিউটার ঘর, বার, হল ঘর, গ্যালারি, লন্ড্রি রুম। মাথা ঘুরে যাবার মত অবস্থা। রহিমা’র কাছ থেকেই বীনা জানতে পারল মনিকার বাবা মা দেশে নেই। মনিকার মা’র হার্টে স্পেসমেকার লাগানো আছে। সেখানে কি যেন সমস্যা হচ্ছে। লন্ডনে ডাক্তার দেখাতে গেছেন। মনিকার বাবাও গেছেন সঙ্গে। আজকের জন্মদিনে মনিকার আত্মীয়-স্বজন সবাইকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। আজ শুধু তার বন্ধু-বান্ধবরা থাকবে। মজু আংকেল থাকবেন কারণ ফান আইডিয়া সব তার মাথাতেই আসে।
মনিকার বান্ধবীরা এখনো আসেনি। তবে মজু আংকেল এসে গেছেন। লম্বা একজন মানুষ। গায়ের রং সাহেবদের মত দুধে আলতায়। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সর্বক্ষণ পাইপ টানছেন। তাকে ঘিরে আছে তামাকের গন্ধ। তবে সেই গন্ধ খারাপ লাগছে না। ভদ্রলোক গরমের মধ্যেও হলুদ একটা কোট পরে আছেন। কোটটা অন্য সব কোটের মত না। পাঞ্জাবির মত লম্বা। মনিকা তাকে বীনুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
মজু আংকু, এর নাম বীনু। আমার সঙ্গে পড়ে। কেউতো এখনো আসেনি, তার বোধ হয় একা একা লাগছে। আপনি তাকে একটু কোম্পানী দিন। আমার সাজগোজ কিছুই এখনো হয়নি। আর বীনু শোন, মজু আংকেলের কথাতো তোমাকে আগেই বলেছি। আর্কিটেক্ট। কনফারমড ব্যাচেলার। তার যে কি পরিমাণ টাকা আছে তিনি তা নিজেও জানেন না। দারুন ক্লোজআপ ম্যাজিক দেখাতে পারেন। আজও দেখাবেন, সেই জন্যেই হলুদ কোট পরে আছেন। তাঁর যাবতীয় ম্যাজিক কোটের ভেতরে।
মজু আংকেল মনিকার দিকে হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি সব কথাই ঠিক বলেছ তবে কনফারমড ব্যাচেলার কথাটা ঠিক বলোনি। পছন্দসই মেয়ে পাইনি বলেই ব্যাচেলার। আমি সারাক্ষণই পছন্দের মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছি। যখন কোন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় তখন প্রথমেই যে কথাটা মনে হয় তা হচ্ছে–এই কি সে? তোমার বান্ধবীকে দেখেও সেই কথাই মনে হচ্ছে এবং আমার মনে হচ্ছে এই হল সে।
মনিকা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে তো আপনার সমস্যা সমাধান হয়েই গেল।
বীনু বুঝতেই পারছে না এসব কি ধরনের কথাবার্তা। বয়স্ক একজন মানুষ কি এই ধরনের কথা বলতে পারেন? না বলা উচিত? কি করে তিনি বললেন, এই হল সেই মেয়ে। ছিঃ ছিঃ।
মনিকা চলে যাচ্ছে। যাবার আগে বলল, মজু আংকেল আপনি কিন্তু বীনুর সঙ্গে সিরিয়াস কোন রসিকতা করবেন না। সে আপনাকে প্রথম দেখছে। আপনার রসিকতা বুঝতে পারবে না। ঘাবড়ে যাবে। আপনি বরং ওকে ম্যাজিক টেজিক দেখান।
.
মনিকা চলে গেছে। একা একা এই ভদ্রলোকের পাশে বসে থাকতে বীনুর প্রচন্ড ভয় লাগছে। তার শুধুই মনে হচ্ছে তিনি বলবেন,–দেখি তোমার হাত দেখি। আমি হাত দেখতেও জানি। বীনুর ফুপাতো বোন সুরমা আপার বাসায় এরকম হল। বীনু সুরমা আপার ছেলের আকিকায় গিয়েছিল। সেখানে দেখা গেল আসর জমিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। ইঞ্জিনিয়ার। বেশ বয়স্ক, মাথার চুল সবই পাকা। তিনি নাকি খুব ভাল পামিস্ট, হাত দেখে সব বলে দিতে পারেন। সবাই হাত দেখাচ্ছে। সুরমা আপা বলল, বীনু তোর হাত দেখা না। বীনু বলল, না। ভদ্রলোক খপ করে বীনুর হাত টেনে নিলেন। তারপর হাত আর ছাড়েনই না। এইভাবে ধরেন ঐভাবে ধরেন। রীতিমত কচলানো। মজু আংকেলও কি এই রকম কিছু করবেন? বীনু ঘড়ি দেখলো, আটটা বাজে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এই প্রথম তার মনে হল ভুল হয়েছে। মনিকার জন্মদিনে আসা ভুল হয়েছে।
মজু আংকেল বোধহয় বীনুর ভয় বুঝতে পারছেন। তাঁর পাইপ নিভে গেছে। তিনি পাইপ ধরাতে ব্যস্ত। দেয়াশলাইয়ের আগুন বারবার নিভে যাচ্ছে। বীনু প্রায় মূর্তির মতই বসে আছে। ভদ্রলোকের পাশে বসেছে বলে সে ভদ্রলোকের মুখ পরিষ্কার দেখতে পারছে না। বীনুর মনে হল ভদ্রলোক হাসছেন। মজু আংকেল পাইপে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তোমার নাম হচ্ছে বীনু তাই না? বীনা থেকে বীনু।
বীনু মাথা নাড়াল। তার নাম বীনু ঠিকই তবে বীনা থেকে কি না তা জানে না।
তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?
জ্বি না।
তোমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছ। ভয় পাবার কিছু নেই।
আমি ভয় পাচ্ছি না।
তুমি থাক কোথায়?
কলা বাগানের পেছনে ভূতের গলি নামে একটা জায়গায়।
ভূতের গলি নাম কি জন্যে? ভূত আছে?
বীনু জবাব দিল না। সে আবার ঘড়ি দেখল। আশ্চর্য এখনো আটটা বাজে। ঘড়িটা কি বন্ধ হয়ে গেছে?
তোমার বাবা কি করেন?
ব্যাংকে চাকরি করেন।
কোন ব্যাংকে?
সোনালী ব্যাংকে।
কোন ব্রাঞ্চ?
নীলক্ষেত ব্রাঞ্চ।
উনার পোস্ট কি?
ক্যাশিয়ার।
উনার কাজ তাহলে পরের টাকা গোনা?
বীনু জবাব দিল না। তার মনে হল তার বাবা ক্যাশিয়ার এটা শোনার পর মজু আংকেলের উৎসাহ কমে গেছে। এবং তিনি বোধ হয় একটু বিরক্তও বোধ করছেন। কেমন যেন সরু চোখে তার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের পাইপ আবার নিভে গেছে। তিনি আবারো পাইপ ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাইপ ধরাবার পর লম্বা করে ধোয়া ছেড়ে বীনুর দিকে তাকিয়ে কি একটা বলতে গিয়েও বললেন না–উঠে হল ঘরের দিকে গেলেন। বীনু আবার ঘড়ি দেখলো। এখনো আটটা বাজে। ঘড়িটাকি নষ্ট হয়ে গেছে? মজু আংকেল ফিরে আসছেন। তার হাতে পেটমোটা লম্বা একটা গ্লাস। গ্লাসে লেবুর টুকরা ভাসছে। বীনু শিউরে উঠল। ভদ্রলোকের হাতে কি মদের গ্লাস? মদ খেলে মানুষ অদ্ভুত কাণ্ড করে বলে সে শুনেছে। মদ খাবার এক পর্যায়ে সবাই বমি করে। ইনিও নিশ্চয়ই করবেন। উনি কি করবেন কে জানে। এত কাছ থেকে সে কখনো কাউকে মদ খেতে দেখেওনি। ভদ্রলোক একবারে তার সামনে বসে আছেন।
বীনু?
জ্বি।
মনিকার সব জন্মদিনে আমি থাকি। তোমাকে এই প্রথম দেখলাম।
বীনু কিছু বলল না। ভদ্রলোক ছোট ছোট চুমুক দিয়ে গ্লাস ভর্তি জিনিসটা খাচ্ছে। খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তার খেতে ভাল লাগছে না। মজু আংকেল এবার পুরোপুরি তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, মনিকার সব জন্মদিনে আমাকে নতুন নতুন ফান আইডিয়া বার করতে হয়। আই এম রানিং আউট অব আইডিয়াস। আমি মনিকাকে বলেছি–এই শেষ, আর আমার কাছে আইডিয়ার জন্যে আসবে না। এবারের ফান আইডিয়াটা কি তুমি জান?
বীনু ক্ষীণস্বরে বলল, না।
তোমাকে দেখে আমারো মনে হচ্ছে তুমি জান না–সুইমিং পুলে গোসলের কথা তোমাকে বলেনি?
জ্বি বলেছে।
ও, তাহলেতো তুমি জান। আইডিয়া আমার দেয়া, আমি নিম্ফ সাজার আইডিয়া দিয়েছি। নিম্ফ কি জান?
জ্বি না।
নিম্ফ হচ্ছে পরী যারা জলকেলি করতে ভালবাসে—জলকন্যা। আমি বলেছি আজ পূর্ণিমা’র রাত আছে। গভীর রাতে তোমরা সব বান্ধবীরা মিলে সুইমিং পুলে নেমে যাবে। ছাদের সব বাতি থাকবে নেভাননা। চাঁদের আলো পড়বে সুইমিং পুলের পানিতে। দূরে বাজবে সিম্ফনী –মুনলিট সোনাটা। পানিতে ভেসে বেড়াবে একদল জলকন্যা। এ ওর গায়ে পানি ছিটাবে, খিলখিল করে হাসবে। তাদের গায়ে কোন কাপড় থাকবে না। কারণ জল কন্যাদের গায়ে কাপড় থাকে না। তাদের নগ্ন শরীরে চকচক করবে চাঁদের আলো। অসাধারণ একটা দৃশ্য, তাই না?
বীনু কিছু বলল না। মজু আংকেল খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, কবিতা শুনবে? বীনু না বলার আগেই ভদ্রলোক ভারী গলায় আবৃত্তি শুরু করলেন
ঘুমে চোখ চায়না জড়াতে,
বসন্তের রাতে।
বিছানায় শুয়ে আছি
একন সে কত রাত
ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর
স্কাইলাইট মাথার উপর।
আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।
বীনু কাঠ হয়ে বসে রইলো। মদ খেয়ে ভদ্রলোক কি মাতাল হয়ে গেছেন? বীনু এত কাছে থেকে কাউকে মদ খেতে দেখেনি। অনেক দূর থেকে একবার দেখেছে। যশোহরে মঞ্জু খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। রাত এগারোটার দিকে শুনে ছাদে হৈ চৈ হচ্ছে। মঞ্জু খালা কার সঙ্গে যেন খুব রাগারাগি করছেন, কান্নাকাটিও করছেন। সে মঞ্জু খালার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো, কি হচ্ছেরে? সে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলল, বাবা মদ খাচ্ছে তাই মা চেঁচামেচি করছে। বীনু আঁৎকে উঠলো। কি সর্বনাশ। সে কৌতূহল সামলাতে পারেনি। চুপিচুপি ছাদে দেখতে গিয়েছিল। ছাদে তখন খালা ছিলেন না। মেজো খালু সাহেব একা একা গ্লাস আর সবুজ রঙের একটা বোতল নিয়ে বসেছিলেন। বোতলটার রঙ কালোও হতে পারে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সে ভেবেছিল আড়াল থেকে এক নজর দেখে চলে আসবে। কিন্তু খালু সাহেব তাকে দেখে ফেললেন, এবং অত্যন্ত মিষ্টি গলায় ডাকলেন, কে বীনু মা? আয় আয়। ছাদে খুব সুন্দর গোলাপের বাগান করেছি, বাগান দেখে যা। তোর মুখটা এমন শুকনো কেনরে মা? খালু সাহেবের কথাবার্তা এত সুন্দর এত স্বাভাবিক। কথা জড়ানো না কিছু না।
মজু আংকেলও খুব সুন্দর করে কথা বলছেন। মদ খেলে লোকজন হয়তো সুন্দর করে কথা বলে। তবে ভয়ংকর কথা বলে। এই ভদ্রলোক হয়তো জানেনও না তিনি কি ভয়ংকর কথা বলছেন। নগ্ন শরীরে চকচক করবে চাঁদের আলো। কি ভয়ংকর কথা!
মজু আংকেল হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন। তিনি পাইপে টান দিতে দিতে বললেন, একদল রূপবতী তরুণী নগ্ন হয়ে সাঁতার কাটবে ভাবতেই ভাল লাগছে। ভিডিও করে রাখলে ভাল হত। এটাতে মনিকা রাজি হচ্ছে না। দেখি রাজি করানো যায় কি না। আজ থেকে কুড়ি বছর পর যখন তোমরা লোলচর্ম বুড়ি হয়ে যাবে তখন এই ভিডিও দেখে খুব ভাল লাগবে।
মজু আংকেলের গ্লাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার গ্লাস ভরতি করতে গেলেন।
মনিকার বন্ধুরা আসতে শুরু করেছে। এদের কাউকে বীনু চিনতে পারছে না। বীনু যেমন ওদের অবাক হয়ে দেখছে ওরাও বীনুকে অবাক হয়েই দেখছে। একটা অদ্ভুত পোশাক পরা মেয়ে ঘরে ঢুকেই বলল, আমাদের জলকন্যা সাজার প্রোগ্রাম ঠিক আছে তো? বীনু আবার ঘড়ি দেখলো। আটটা বাজে। তার ঘড়ি কি নষ্ট? এই প্রথম তার মনে হল সে ভুল করেছে। খুব বড় ভুল করেছে।
.
রাত কত বীনু জানে না। তার ঘড়িতে আটটা বেজে আছে। তবে রাত যে অনেক এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। সে এখন মনিকাদের ছাদের একটা বাথরুমে দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে এত সুন্দর বাথরুম সে দেখেনি। কোনদিন হয়তো দেখবেও না। ধবধবে শাদা বিশাল একটা ঘর। সেই ঘরে নীল বাথটাব, নীল কমোড, নীল বেসিন। বাথরুমে নানান মাপের তোয়ালে। সেগুলোর রঙও নীল। আর কি বিশাল একটা আয়না। নিজেকে পুরোপুরি দেখতে হলে এরকম একটা আয়না লাগে।
মনিকার সব বান্ধবী সুইমিং পুলে নেমে গেছে। সুইমিং পুলে নামা’র আগে নাকি খুব ভাল করে গায়ে সাবান মেখে গোসল করে নিতে হয়। অন্যরা তাই করেছে। সে শুধু বাকি। সেওকি অন্যদের মত করবে? না দরজা বন্ধ করে বাথরুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদবে? মনিকা তাকে বলেছে, আমাদের জলকন্যা সাজার ব্যাপারটা যদি তোমার ভাল না লাগে তোমাকে জলকন্যা সাজতে হবে না। তুমি আমার ঘরে বসে ভিসিআরে ছবি। দেখ কিংবা গল্পের বই পড়। মজু আংকেল থাকবেন। তার সঙ্গে গল্পও করতে পার। আর তুমি যদি বাসায় চলে যেতে চাও তাও করতে পার। আমাদের ড্রাইভার আছে। ও তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসবে। রাত অবশ্যি অনেক বেশি হয়ে গেছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এনজয় করছ না। তোমাকে কি নামিয়ে দিয়ে আসবে?
বীনু বলল, না। অথচ সে হ্যাঁ বলতে গিয়েছিল। তার মাথা বোধহয় এলোমেলো হয়ে গেছে।
সে জলকন্যা সাজতে চায় না। অথচ সে বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বাজনা বাজছে। বাজনাটা কি সুন্দর। কি আশ্চর্য সুন্দর। মনিকার বান্ধবীদের খিলখিল হাসির শব্দ আসছে। এরা বোধ হয় একজন আরেকজনের গায়ে পানি ছিটাচ্ছে। এদের এই আশ্চর্য জীবনের সঙ্গে তার কোন যোগ নেই। এই বাড়ির ছাদে যে চাঁদ উঠেছে সেই চাঁদ তাদের বাড়ির ছাদে কখনো ওঠে না। মনিকাদের ছাদে পা দিয়েই চাঁদটার দিকে তাকিয়ে কি যে অদ্ভুত অন্য রকম লাগলো।
বীনু কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই সে তার গায়ের কাপড় খুলছে। সে জলকন্যা সাজছে।
পাপ
ভাই আপনাকে একটা ভয়ংকর পাপের গল্প বলি। পাপটা আমি করেছিলাম। নিজের ইচ্ছায় করিনি। স্ত্রীর কারণে করেছিলাম। স্ত্রীদের কারণে অনেক পাপ পৃথিবীতে হয়েছে। মানুষের আদি পাপও বিবি হাওয়ার কারণে হয়েছিল। আপনাকে এই সব কথা বলা। অর্থহীন। আপনি জ্ঞানী মানুষ, আদি পাপের গল্প আপনি জানবেন না তো কে জানবে। যাই হোক মূল গল্পটা বলি।
আমি তখন মাধবখালি ইউনিয়নে মাস্টারী করি। গ্রামের নাম ধলা। ধলা গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। নতুন বিবাহ করেছি। স্ত্রী সঙ্গে থাকেন। আমার বয়স তখন পঁচিশের মত হবে। আমার স্ত্রী নিতান্তই বালিকা। পনেরো-যোলমত বয়স। ধলা গ্রামে আমরা প্রথম সংসার পাতলাম। স্কুলের কাছেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমার টিনের ঘর। আমরা সুখেই ছিলাম। ফুলির গাছগাছালির খুব শখ। সে গাছপালা দিয়ে বাড়ি ভরে ফেলল। ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি ফুলি আমার স্ত্রীর ডাক নাম। ভাল নাম নাসিমা খাতুন।
বুঝলেন ভাই সাহেব, ধলা বড় সুন্দর গ্রাম। একেবারে নদীর তীরে গ্রাম। নদীর নাম কাঞ্চন। মাছ খুবই সস্তা। জেলেরা নদী থেকে ধরে টাটকা মাছ বাড়িতে দিয়ে যায়। তার স্বাদই অন্য রকম। পনেরো বছর আগের কথা বলছি। এখনো সেখানকার পাবদা মাছের স্বাদ মুখে লেগে আছে। শীতের সময় বোয়াল মাছ থাকতো তেলে ভর্তি।
ধলা গ্রামের মানুষজনও খুব মিশুক। আজকাল গ্রাম বলতেই ভিলেজ পলিটিক্সের কথা মনে আসে। দলাদলি মারামারি কাটাকাটি। ধলা গ্রামে এই সব কিছুই ছিল না। শিক্ষক হিসেবে আমার অন্য রকম মর্যাদা ছিল। যে কোন বিয়ে শাদীতে আদর করে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেত। গ্রাম্য সালিসীতে আমার বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হতো। দুই বছর খুব সুখে কাটলো। তারপরই সংগ্রাম শুরু হল। আপনারা বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ। গ্রামের লোকের কাছে সংগ্রাম।
ধলা গ্রাম অনেক ভিতরের দিকে। পাক বাহিনী কোন দিন ধলা গ্রামে আসবে আমরা চিন্তাই করিনি। কিন্তু জুন মাসের দিকে পাক বাহিনীর গানবোট কাঞ্চন নদী দিয়ে চলাচল শুরু করলো। মাধবখালী ইউনিয়নে মিলিটারি ঘাঁটি করলো। শুরু করলো অত্যাচার। তাদের অত্যাচারের কথা আপনাকে নতুন করে বলার কিছু নাই। আপনি আমার চেয়ে হাজার গুণে বেশি জানেন। আমি শুধু একটা ঘটনা বলি। কাঞ্চন নদীর এক পাড়ে ধলা গ্রাম, অন্য পাড়ে চর হাজরা। জুন মাসের ১৯ তারিখ চর হাজরা গ্রামে মিলিটারির গানবোট ভিড়লো। চর হাজরার বিশিষ্ট মাতবর ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারীদের খুব সমাদর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ভাই সাহেব, আপনি এর অন্য অর্থ করবেন না। তখন তাদের সমাদর করে নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সবাইর হাত-পা ছিল বাঁধা। ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারীদের খুব আদর যত্ন করলেন। ডাব পেড়ে খাওয়ালেন। দুপুরে খানা খাওয়ার জন্যে খাসি জবেহ করলেন। মিলিটারীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলো। খানাপিনা করলো। যাবার সময় ইয়াকুব আলী সাহেবের দুই মেয়ে আর ছেলের বউকে তুলে নিয়ে চলে গেল। আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। এখন গল্পের মত মনে হয়। কিন্তু এটা বাস্তব সত্য। আমার নিজের দেখা। সেই দিনের খানায় শরিক হওয়ার জন্যে ইয়াকুব আলী সাহেব আমাকে দাওয়াত। দিয়েছিলেন। নিয়ে যাবার জন্যে নৌকা পাঠিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম।
চর হাজরার ঘটনার পরে আমরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম। গজবের হাত থেকে বাঁচার জন্যে মসজিদে কোরআন খতম দেয়া হলো। গ্রাম বন্ধ করা হল। এক লাখ চব্বিশ হাজার বার সুরা এখলাস পাঠ করা হল। কি যে অশান্তিতে আমাদের দিন গিয়েছে ভাই সাহেব, আপনাকে কি বলব। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হতো না। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। সাত মাস চলছে। হাতে নাই একটা পয়সা। স্কুলের বেতন বন্ধ। গ্রামের বাড়ি থেকে যে টাকা পয়সা পাঠাবে সে উপায়ও নাই। দেশে যোগাযোগ বলতে তখন কিছুই নাই। কেউ কারো খেজ জানে না। কি যে বিপদে পড়লাম। সোবহানাল্লাহ।
বিপদের উপর বিপদ-জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী দেখা দিল। নৌকায় করে আসে, দুই একটা ফুটফাট করে উধাও হয়ে যায়। বিপদে পড়ি আমরা। মিলিটারী এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালায়ে দিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর তখন আর কোন নাড়াচাড়া পাওয়া যায় না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন হল। মুক্তিবাহিনী তখন শুধু আর ফুটফাট করে না। রীতিমত যুদ্ধ করে। ভাল যুদ্ধ। বললে। বিশ্বাস করবেন না, এরা কাঞ্চন নদীতে মিলিটারীর একটা লঞ্চ ডুবায়ে দিল। লঞ্চ ডুবার ঘটনা ঘটলো সেপ্টেম্বর মাসের ছাব্বিশ তারিখ। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। ভাই সাহেব হয়তো শুনেছেন। বলা হয়েছিল শতাধিক মিলিটারীর প্রাণ সংহার হয়েছে। এটা অবশ্য ঠিক না। মিলিটারী অল্পই ছিল। বেশির ভাগই ছিল রাজাকার। রাজাকারগুলা সাঁতরে পাড়ে উঠেছে, গ্রামের লোকরাই তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস ভাই সাহেব। যুদ্ধ অত সাধারণ মানুষকেও হিংস্র করে ফেলে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা।
এখন মূল গল্পটা আপনাকে বলি। সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখের ঘটনা। মাগরেবের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে আছি। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। ইংরেজীতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। একা একা বৃষ্টি দেখছি। আমার স্ত্রী শোবার ঘরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। তার শরীর খুব খারাপ। দুদিন ধরে কিছুই খেতে পারছে না। যা খায় বমি করে দেয়। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। কোন কিছু না ধরে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। ডাক্তার যে দেখাব সে উপায় নেই। ডাক্তার পাব কই? মাধবখালিতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন–বাবু নলিনী কুমা’র রায়। ভাল ডাক্তার। মিলিটারী মাধবখালীতে এসে প্রথম দিনই তাকে মেরে ফেলেছে।
যে কথা বলছিলাম, আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি। মন অত্যন্ত খারাপ।
বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। একসময় প্রায় ঝড়ের মত শুরু হলো। বাড়ি-ঘর কাঁপতে শুরু করলো। আমি একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পুরানো নড়বড়ে বাড়ি। ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়ব। কাছেই মোক্তার সাহেবের পাকা দালান। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে উঠব কিনা ভাবছি। তখন ফুলি আমকে ভেতর থেকে ডাকলো। আমি অন্ধকার ঘরে ঢুকলাম। ফুলি ফিস ফিস করে বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
আমি বললাম, কি কথা?
ফুলি বলল, আমার কাছে আগে বোস। আমি বসলাম। ফুলি বলল, আমি যদি তোমার কাছে কোন জিনিস চাই তুমি কি আমাকে দিবে?
আমি বললাম, ক্ষমতার ভিতরে থাকলে অবশ্যই দিব। আকাশের চাঁদ চাইলে তো দিতে পারবো না। জিনিসটা কি?
তুমি আগে আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, প্রতিজ্ঞা করলাম। এখন বল ব্যাপার কি?
হারিকেনটা জ্বালাও।
হারিকেন জ্বালালাম। দেখি তার বালিশের কাছে একটা কোরআন শরীফ। আমাকে বলল, আল্লাহর পাক কালাম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি কথা রাখবে।
আমি ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। ব্যাপারটা কি? পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের মধ্যে অনেক পাগলামী ভর করে। আমি ভাবলাম এ রকমই কিছু হবে। দেখা যাবে আসল ব্যাপার কিছু না। আমি কোরআন শরীফে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম। তারপর বললাম, এখন বল আমাকে করতে হবে কি?
একটা মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে।
তার মানে?
একটা মানুষ আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তার জীবন রক্ষা করতে হবে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমার কাছে আশ্রয় নিল?
ফুলি থেমে থেমে চাপা গলায় যা বলল তাতে আমার কলিজা শুকায়ে গেল। দুদিন আগে মিলিটারির লঞ্চডুবি হয়েছে। একটা মিলিটারী নাকি সাঁতরে কুলে উঠেছে। আমাদের বাড়ির পেছন দিকে কলা গাছের ঝোঁপের আড়ালে বসে ছিল। ফুলিকে দেখে বহেনজি বলে ডাক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। ফুলি তাকে আশ্রয় দিয়েছে।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, দুদিন ধরে একটা মিলিটারী আমার বাড়িতে আছে? ফুলি বলল, হু।
সত্যি কথা বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি। এখন তুমি তাকে মাধবখালী নিয়ে যাও। মাধবখালীতে মিলিটারী ক্যাম্প আছে। আজ ঝড় বৃষ্টির রাত আছে। অন্ধকারে অন্ধকারে চলে যাও। কেউ টের পাবে না।
তোমার কি মাথাটা খারাপ?
আমার মাথা খারাপ হোক আর যাই হোক তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ।
আমি মিলিটারী নিয়ে রওনা হব, পথে আমাকে ধরবে মুক্তিবাহিনী। দুইজনকেই গুলী করে মা’রবে।
এই রকম ঝড় বৃষ্টির রাতে কেউ বের হবে না। তুমি রওনা হয়ে যাও।
ব্যাটা আছে কোথায়?
আস, তোমাকে দেখাই।
সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র কি আছে?
কিছুই নাই। খালি হাতে সাঁতরে পাড়ে উঠেছে।
আমি মোটেই ভরসা পেলাম না। অস্ত্র থাকুক আর না থাকুক মিলিটারী বলে কথা। জেনেশুনে এ রকম বিপদজনক শত্রু শুধুমাত্র মেয়েছেলেদের পক্ষেই ঘরে রাখা সম্ভব। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, হারামজাদা কই?
ফুলি আমাকে দেখাতে নিয়ে গেল। এমনিতে সে কোন কিছু না ধরে উঠে দাঁড়াতে পারে না। আজ দেখি হারিকেন হাতে গটগট করে যাচ্ছে।
রান্নাঘরের পাশে ভাড়ার ঘর জাতীয় ছোট একটা ঘর আছে। সেখানে চাল, ডাল পেঁয়াজ-টিয়াজ থাকে। ফুলি আমাকে সেই ঘরের কাছে নিয়ে গেল। দেখি ঘরটা তালাবদ্ধ। একটা মাস্টারলক তালা ঝুলছে। ফুলি তালা খুলল। হারিকেন উঁচু করে ধরলো। দেখি ঘরের কোনায় কম্বল বিছানো। কম্বলের উপর নিতান্তই অল্প বয়েসী একটা ছেলে বসে আছে। তার পরনে আমার লুঙ্গি, আমার পাঞ্জাবি। ঘরের এক কোনায় পানির জগ-গ্লাস। পাকিস্তানী মিলিটারীর সাহসের কত গল্প শুনেছি। এখন উল্টা জিনিস দেখলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠলো। গুটিসুটি মেরে গেল। ফুলি তাকে ইশারায় বলল, ভয় নাই।
আমি হারামজাদাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। এত কাছ থেকে আগে কোনদিন মিলিটারী দেখিনি। এই প্রথম দেখছি। লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা বলেই বোধ হয় একে দেখাচ্ছে খুব সাধারণ বাঙ্গালীর মত। শুধু রঙটা বেশী ফর্সা আর নাক মুখ কাটা কাটা। আমি ফুলিকে বললাম, এর নাম কি?
ফুলি গড়গড় করে বলল, এর নাম দিলদার। লেফটেন্যান্ট। বাড়ি হল বালাকোটে। রেশমী নামের ওদের গায়ের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে গিয়ে সে মেয়েটাকে বিয়ে করবে। রেশমী যে কত সুন্দর তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। অবিকল ডানাকাটা পরী। রেশমীর ছবি দেখবে? দিলদারের পকেটে সবসময় রেশমীর ছবি। বালিশের নিচে এই ছবি না রাখলে সে ঘুমুতে পারে না।
কারো ছবি দেখারই আমার কোন শখ ছিল না। আমার মাথা তখন ঘুরছে। একি সমস্যায় পড়লাম। ফুলি তারপরেও ছবি দেখালো। ঘাগরা পরা একটা মেয়ে। মুখ হাসি হাসি। ফুলি বলল, মেয়েটা সুন্দর কেমন, দেখলে?
আমি বললাম, হু।
এখন তুমি ওকে মাধবখালি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা কর। আজ রাতেই কর।
দেখি।
দেখাদেখির কিছুনা। তুমি রওনা হও।
মাধবখালিতো পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। নৌকা লাগবে।
নৌকার ব্যবস্থা কর। ওকে পার করার জন্যে আজ রাতই সবচে ভাল। ভয়ে বেচারা অস্থির হয়ে গেছে। পানি ছাড়া কিছু খেতে পারছে না।
আমি শুকনা গলায় বললাম, দেখি কি করা যায়।
ফুলি মিলিটারীর দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, তোমার আর কোন ভয় নাই। আমার স্বামী তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিবে। তুমি এখন চারটা ভাত খাও। মিলিটারী বাংলা ভাষার কি বুঝল কে জানে। সে শুধু বলল, শুকরিয়া বহেনজি। লাখো শুকরিয়া।
ফুলি ভাত বেড়ে নিয়ে এলো। তাকে খাওয়াতে বসলো। আমাকে বলল, তুমি দেরি করো না–চলে যাও।
.
আমি ছাতা হাতে বাড়ি থেকে বের হলাম। তখনো ঝুম বৃষ্টি চলছে। তবে বাতাস কমে গেছে। আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি। কি করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রীকে কথা দিয়েছি। আল্লার পাক কালাম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা দরকার। ছেলেটার জন্যে মায়াও লাগছে। বাচ্চা ছেলে। এরা হুকুমের চাকর। উপরওয়ালার হুকুমে চলতে হয়। তাছাড়া বেচারা জীবনই শুরু করে নাই। দেশে ফিরে বিয়ে শাদি করবে। সুন্দর সংসার হবে। আবার অন্যদিকও আছে। একে মাধবখালি পৌঁছে দিলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নৌকার মাঝিই বলে দিবে। কোন কিছুই চাপা থাকে না। তারপর রাজাকার হিসেবে আমার বিচার হবে। দেশের মানুষ আমার গায়ে থু দিবে। পাকিস্তানী মিলিটারী শুধু যে আমাদের পরম শত্রু তা না, এরা সাক্ষাত শয়তান। এদের কোন ক্ষমা নাই।
আমি নৌকার খোঁজে গেলাম না। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিলাম। রাত দু’টার সময় তারা এসে দিলদারকে ধরে নিয়ে গেল। দিলদার আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল, বহেনজি। তারপরই চুপ করে গেল। আমার স্ত্রী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দিলদারকে সেই রাতেই গুলী করে মারা হল। মৃত্যুর আগেও সে কয়েকবার আমার স্ত্রীকে ডাকল, বহেনজি। বহেনজি।
আমার স্ত্রী মারা গেল সন্তান হতে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালই হল। বেঁচে থাকলে সারাজীবন স্বামীকে ঘৃণা করে বাঁচতো। সে বাঁচা তো মৃত্যুর চেয়ে খারাপ।
.
বুঝলেন ভাই সাহেব, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধে শুধু পাপের চাষ হয়। আমার মত সাধারণ একটা মানুষ কতগুলো পাপ করলো চিন্তা করে দেখেন। রোজ হাশরে আমার বিচার হবে। আল্লাহ পাক পাপ-পূণ্য কিভাবে বিচার করেন, আমাকে কি শাস্তি দেন এটা আমার দেখার খুব ইচ্ছা।
ব্যাধি
ভদ্রলোকের নাম রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া। ভূঁইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক। কোটিপতি কিংবা কোটিপতির উপরে যদি কোন পতি থাকে সেই পতি। ভদ্রলোকের সঙ্গে কোথায় পরিচয় হয়েছিল মনে নেই। কোন পার্টি-টার্টি হবে, এই জাতীয় লোকদের সঙ্গে পার্টি ছাড়া দেখা হয় না। ভদ্রলোক বিনয়ী, কথা বলেন সুন্দর করে, তারপরেও তাকে আমার পছন্দ হয়নি। অসম্ভব বিত্তবান মানুষদের ভেতর চাপা অহংকার থাকে। তাদের বিনয়, ভদ্র ব্যবহার, সুন্দর কথাবার্তাতেও সেই অহংকার ঢাকা পড়ে না। নাটকের আবহ সঙ্গীতের মত, তাদের অহংকার সঙ্গীত সবসময় বাজতে থাকে।
এই জাতীয় লোকদের আমি দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করি। রকিবউদ্দিন ভূঁইয়াকে আমি সম্ভবত সেই কারণেই ভুলে গিয়েছিলাম। চিটাগাং নিউমার্কেটের দোতলায় তাঁর সঙ্গে দেখা হল। আমি তাকে চিনতে পারলাম না। তিনি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, চিনতে পারছেন না? আমি রকিব। রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া।
আমি বললাম, ঠিক মনে করতে পারছি না।
হোটেল শেরাটনে দীর্ঘসময় আপনার সঙ্গে কথা বলেছি।
আমি চিনতে পারার মত ভঙ্গি করে বললাম, ও আচ্ছা আচ্ছা।
তিনি আহত গলায় বললেন, এখনো চিনতে পারছেন না?
আমি বললাম, জ্বী না। আমার স্মৃতি শক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় আলজেমিয়ার ডিজিজ ফিজিজ হয়েছে। অতি পরিচিত কাউকে দেখলেও চিনতে পারি না।
ভদ্রলোক দুঃখিত গলায় বললেন, ঐ দিন আমি বেগুনী রঙের একটা টাই পরেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, টাইটার রঙটাতো খুব সুন্দর।
তখন আমার মনে পড়ল। আমি বললাম, এখন মনে পড়েছে। আপনি ভুইয়া গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক।
ভদ্রলোক হাসলেন। তাঁকে খুব আনন্দিত মনে হল। তাঁকে চিনতে পারছিলাম না এই অপমান তিনি বোধহয় সহ্য করতে পারছিলেন না। ইনি বোধহয় ধরেই নিয়েছিলেন একবার যাদের সঙ্গে তার পরিচয় হবে তারা ইহ জীবনে তাকে ভুলবে না। দেখা হওয়া মাত্র আরে রকিব ভাই বলে ছুটে আসবে।
ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, আমি ঐ বেগুনী টাইটা আলাদা করে রেখেছি। আমার স্ত্রীকে বলেছি, হুমায়ুন ভাই এই টাইটা পছন্দ করেছেন। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া আমি এই টাই আর পরব না।
আমি বললাম, ও আচ্ছা। আমার ও আচ্ছাতে খুব যে আনন্দ প্রকাশিত হল, তা না।
আপনার সঙ্গে এই ভাবে দেখা হয়ে যাবে জানলে বেগুনী টাইটা পরতাম।
আমি আবারো বললাম, ও আচ্ছা। এছাড়া আর কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভদ্রলোকের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া আমার বিশেষ প্রয়োজন। রাত এগারোটায় তূর্ণা নিশীথায় ঢাকা যাব। এখন বাজছে সাড়ে নটা। রাতের খাওয়া এখনো হয়নি। নিরিবিলি ধরনের কোন হোটেল খুঁজে বের করতে হবে। চিটাগাং-এ হোটেল টোটেলগুলি কোন অঞ্চলে তাও জানি না।
রকিব সাহেব বললেন, চিটাগাং-এ কি কোনো কাজে এসেছিলেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ। মনে মনে ভদ্রলোকের কথায় বিরক্ত হলাম। অকাজে নিশ্চয়ই কেউ ঢাকা-চিটাগাং করে না। অকারণ প্রশ্ন করার মানে কি?
ঢাকা কবে ফিরবেন?
আজই ফিরব।
তূর্ণা নিশীথায়?
জ্বী।
আমি কি আপনার কাছে একটা প্রস্তাব রাখতে পারি?
রাখুন।
আমিও আজ ঢাকায় ফিরছি, বাই রোড। রাত এগারোটার দিকে রওনা হব। আমার সঙ্গে চলুন। গল্প করতে করতে যাব।
আমি বেশ কঠিন গলায় বললাম, না।
এখন ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে এত সুন্দর হয়েছে…
যত সুন্দরই হোক, আমি ঠিক করেছি ট্রেনে যাব।
নতুন একটা লাক্সারী মাইক্রোবাস কিনেছি, ডাবল এসি, রিভলভিং সীটস, গাড়িতেই ফ্রিজ, টিভি…আপনাকে গাড়িটায় চড়াতে পারলে…
অন্য আরেক সময় আপনার গাড়িতে চড়ব। দয়া করে এই বিষয়ে আর কথা বলবেন না।
রকিব সাহেব শুকনো গলায় বললেন, আচ্ছা। ঠিক আছে।
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। ভদ্রলোকের স্বভাব চিনেৰ্জোকের মত। যা ধরেন। ছাড়েন না। তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যেভাবে চেপে ধরেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল ছাড়া পাব না। তার সঙ্গেই যেতে হবে। এবং সারা পথ শুনতে হবে জীবনের শুরুতে তিনি কেমন দরিদ্র ছিলেন। পরে কি করে বিত্ত সঞ্চয় করলেন। বিত্তবানরা এ জাতীয় গল্প অন্যদের শুনিয়ে খুব আরাম পায়, যারা ধৈর্য করে শোনে তারা যা পায় তার নাম নির্যাতন। সাধ করে নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যাবার কোনো অর্থ হয় না। অন্যের অভাবের গল্প শুনতে যেমন ভাল লাগে না, অন্যের বিত্তের গল্প শুনতেও ভাল লাগে না।
.
রকিবউদ্দিন ভূঁইয়া সাহেবের ক্ষমতা আমি ছোট করে দেখেছিলাম। তিনি যে কি পরিমাণ কলকাঠি নাড়তে পারেন সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। তিনি কলকাঠি নাড়লেন। ট্রেনে উঠে দেখি ঠিক আমার টিকিটই ডাবল ইস্যু হয়েছে। অচেনা এক লোক আমার সীটে কম্বল গায়ে শুয়ে আছে। কম্পার্টমেন্টের এটেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম সে হাই তুলতে তুলতে বিরস গলায় বলল, স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে কথা। বলেন। আমার কিছু করার নাই, টিকিটতো আর আমি ইস্যু করি নাই।
ট্রেন থেকে নেমে দেখি প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে রকিব সাহেব সিগারেট টানছেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। আমি বললাম, আপনি এখানে? তিনি বললেন, আপনাকে সি অফ করতে এসেছিলাম। সমস্যা কি?
আমি সমস্যার কথা বললাম।
তিনি বললেন, চলুন যাই স্টেশন মাস্টারের কাছে। মগের মুল্লুক নাকি? টিকিট ডাবল ইস্যু হবে? ছেলেখেলা?
স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে দেনদরবার করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দিল। বাধ্য হয়ে আমাকে রকিব সাহেবের মাইক্রোবাসে উঠতে হল। মাইক্রোবাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হল ট্রেনের পুরো ব্যাপারটা ভদ্রলোকের সাজানো। ডাবল টিকিট তাঁর কারণেই ইস্যু হয়েছে। তিনি আমাকে তার মাইক্রোবাসে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাই করছেন। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।
রকিব সাহেব।
জ্বী।
ট্রেনের পুরো ব্যাপারটা আপনার সাজানো। তাই না?
জ্বী।
এটা কেন করলেন?
আপনাকে একটা গল্প বলতে চাচ্ছিলাম। সুযোগ পাচ্ছিলাম না। কাজেই সুযোগ তৈরি করে নিয়েছি। আমার ধারণা আপনি আমার উপর খুব রাগ করেছেন। হয়তোবা কিছুটা ঘৃণাও বোধ করছেন। তারপরেও আপনাকে গল্পটা শোনাবো।
কি গল্প? কিভাবে পথের ফকির থেকে কোটিপতি হলেন সেই গল্প?
জ্বি না সেই গল্প আমি কারো সঙ্গেই করি না।
আমাকে যে গল্প করতে যাচ্ছেন সেটা কি সবার সঙ্গেই করেন?
জ্বী না। আমার স্ত্রীকে বলার চেষ্টা করেছিলাম। সে পুরো গল্প মন দিয়ে শোনেনি। গল্পের মাঝখানে চা বানাতে গেছে, তার বান্ধবীকে টেলিফোন করেছে, ড্রাইভারকে পাঠিয়েছে ডিম কিনতে। তারপর থেকে আর কাউকে গল্পটা বলার চেষ্টা করিনি। আমি এমন একজন কাউকে চাচ্ছিলাম যে আমার গল্প মন দিয়ে শুনবে। ধরে নেয়া যেতে পারে আপনি এই গল্পের প্রথম এবং হয়তোবা শেষ শ্রোতা।
শুরু করুন আপনার গল্প।
গাড়ি চলছে প্রায় আশি কিলোমিটার বেগে। রাস্তায় প্রচুর ট্রাফিক। রকিব সাহেব স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন। আমি বসেছি তাঁর পাশে। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই।
আমি বললাম, আপনি কি গাড়ি চালাতে চালাতেই গল্প বলবেন?
ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, হ্যাঁ। আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমি খুব ভাল ড্রাইভার। চোখ বন্ধ করেও গাড়ি চালাতে পারি। তারপরেও সাবধানের মা’র নেই। আপনি সীট বেল্ট বেঁধে নিন।
আমি সীট বেল্ট বাঁধলাম।
আপনার বা পাশে হ্যাংগারে চায়ের ফ্লাস্ক ঝুলছে। আপনি চা পছন্দ করেন। এই জন্যেই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চা বানিয়ে এনেছি।
রকিব সাহেব সিগারেট ধরালেন। তাঁর দুহাত স্টিয়ারিং হুইলে। এর মধ্যেই গল্প শুরু হল। ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে গল্প বলতে এই প্রথম কাউকে দেখছি।
.
আমার তখন আট বছর বয়স। নয়ও হতে পারে, ক্লাস থ্রতে পড়ি। স্কুল গরমের ছুটি হয়েছে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি বরিশাল। আমার বাবা দরিদ্র মানুষ ছিলেন। কিন্তু তাঁর নেশা ছিল ঘুরে বেড়ানো। বাংলাদেশের হেন জায়গা নেই যে তিনি না গিয়েছেন। বাবা একা বেড়াতেই পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝে আমি এবং আমার বড় ভাই তাকে এমনভাবে চেপে ধরতাম যে আমাদের সঙ্গে না নিয়ে তার উপায় থাকত না। বাবার সঙ্গে যাবার সুযোগ বেশিরভাগ সময়ই আমার বড় ভাইয়ের ঘটতো। বাবা আমাকে সঙ্গে নিতে চাইতেন না কারণ ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময়ই আমি অসুস্থ থাকতাম। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া মানে প্রচুর হাঁটা, আমি একেবারেই হাঁটতে পারতাম না। ছেলে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোয় কোনো আনন্দ নেই, কাজেই বাবা নানান অজুহাতে আমাকে বাতিল করে দিতেন।
সেবার কেন জানি নিজ থেকেই তিনি আমাকে সঙ্গে নিতে রাজি হলেন। মা ছাড়তে রাজি হলেন না–আমি মাত্র এক সপ্তাহ জ্বর থেকে উঠেছি, শরীর খুব দুর্বল। এমন রুগ্ন অসুস্থ ছেলেকে মা ছাড়বেন না। কান্নাকাটি করে মা’র অনুমতি আদায় করলাম। এবং এক সন্ধ্যায় হাসিমুখে বাবার হাত ধরে বরিশালে যাবার স্টীমারে উঠলাম। স্টীমারের নাম অসট্রিচ। বিশাল এক স্টীমা’র। যেন পানির উপর ভাসমান ছোটখাট এক শহর। স্টীমারে করে এই প্রথম আমার বাইরে কোথাও যাওয়া। আমি একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লাম। স্টীমা’র ছাড়ার পর বাবা আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখালেন। ফার্স্টক্লাস কেবিন, ডেক, রেস্টুরেন্ট, পানি ঘর, ইনজিন ঘর। ইনজিন ঘর দেখে আমি হতভম্ব। প্রকান্ড একটা ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাজার হাজার হাতুড়ির মত কি একটা যন্ত্র তালে তালে উঠছে আর নামছে–ভয়ংকর শব্দ হচ্ছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের তালিকায় স্টীমারের ইনজিন ঘরের নাম নেই কেন? এ পৃথিবীতে এরচে আশ্চর্যের আর কি হতে পারে?
স্টীমারের হোটেলে রাতের খাবার খেলাম। ইলিশ মাছ, ভাত, বুটের ডাল। কি যে ভাল রান্না শুধু খেতেই ইচ্ছা করে। ভরপেট খেয়ে ঘুম পেয়ে গেল।
খাওয়ার পর বাবা বললেন, পান খাবি? মিষ্টি পান?
আমি ঠোঁট লাল করে পান খেলাম। বাবা আমাকে কাঠের একটা বেঞ্চে শুইয়ে দিলেন। আমার মাথার নিচে দিলেন তাঁর হ্যান্ডব্যাগ, গায়ে পাতলা একটা চাদর। বাবা বললেন, আরাম করে ঘুম দে। চাঁদপুর এলে ডেকে তুলব। দূর থেকে চাঁদপুর শহর দেখতে অসাধারণ লাগে। হাজার হাজার বাতি জ্বলে। বাতির ছায়া পড়ে পানিতে। দেখলে পাগল হয়ে যাবি। চাঁদপুর আসুক আমি ডেকে তুলব। আমি বললাম, আচ্ছা।
জার্নির সময় আমার ঘুম হয় না। আমি সারাক্ষণ তোর পাশে বসে থাকব না। চা টা খাব, ডেকে ঘুরব, বুঝতে পারছিস?
পারছি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখিস আমি পাশে নেই তাহলে আবার ভয় পাবি নাতো?
না।
আমি একটু পরে পরে এসে তোর খোঁজ নিয়ে যাব।
আচ্ছা।
তোর যদি ঘুম ভেঙে যায়, এখানেই থাকবি। আমার খোঁজে বের হবি না। আমি যেখানেই থাকি তোর কাছে চলে আসব।
আচ্ছা।
বেড়াতে এসে মজা পাচ্ছিস তো বাবা?
পাচ্ছি।
বেশি মজা পাচ্ছিস, না অল্প মজা?
বেশি মজা।
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না, ঘুম ভাঙ্গলো হৈ চৈ আর চিকারের শব্দে। জেগে উঠে দেখি স্টীমা’র থেমে আছে। খুব চেঁচামেচি হচ্ছে। আতংকে অস্থির হয়ে বাবাকে খুঁজলাম–দেখি বাবা পাশে নেই। শুধু বাবা না কেউই নেই। যে ঘরে শুয়ে ছিলাম সেই ঘরটা পুরো ফাঁকা। একা একা বসে থাকতে ভয় লাগছিল, বাবার নিষেধের কথা আর মনে রইল না, বের হলাম। স্টীমারের সব লোক ডেকের এক দিকে ভিড় করেছে। মনে হচ্ছে সবাই এক সঙ্গে কথা বলছে। লোকজনের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম–একটা বাচ্চা ডেক থেকে পানিতে পড়ে গেছে। তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপর শুনলাম বাচ্চা না বয়স্ক একজন লোক। লোকটা একবার ডুবে যাচ্ছে, একবার ভাসছে। লোকটার উপর সার্চ লাইটের আলো ফেলা হয়েছে। নদীতে প্রবল স্রোত। স্রোত কেটে লোকটা আসতে পারছে না। তার কাছে মোটা দড়ি ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। দড়ি সে পর্যন্ত যাচ্ছে না, বাতাসের ঝাপটায় অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।
কখন যে আমি নিজেই লোকটাকে এক নজর দেখার জন্যে রেলিং এর কাছে চলে এসেছি এবং নদীর প্রবল স্রোতের দিকে তাকিয়েছি নিজেই জানি না। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে ঘন কালো পানি। শুধু যে জায়গাটায় সার্চ লাইটের আলো পড়েছে সে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে। সব লোক এক সঙ্গে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো–দেখা যায়, দেখা যায়। সার্চ লাইটের আলো সেইদিকে ঘুরে গেলো। আমিও দেখলাম–যে মানুষটা ডুবছে আর ভাসছে সে আর কেউ না, আমার বাবা। তখন আমার কোনো বোধশক্তি ছিল না। সিনেমা’র বড় পর্দার দিকে মানুষ যেভাবে তাকিয়ে থাকে, আমি সেই ভাবেই তাকিয়ে আছি। সিনেমা’র বড় পর্দায় অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে। সেইসব ঘটনা দেখে আমরা ভয় পাই, রোমাঞ্চ বোধ করি। কিন্তু সেই ভয়, সেই রোমাঞ্চ কখনই আমাদের গভীরে প্রবেশ করে না। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সব দেখছি, কিন্তু সেই ভয় আমার ভেতরে ঢুকছে না। বাবা শেষবারের মত পানির উপর মাথা ভাসিয়ে ডুবে গেলেন। ডুবে যাবার আগে আকাশ পাতাল চিৎকার করে ডাকলেন, বাবলু। বাবলু। ও বাবলু।
বাবলু হচ্ছে আমার ডাক নাম।
আর এই হল আমার গল্প।
.
আমি রকিব সাহেবের দিকে তাকালাম। তার কপাল বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তিনি বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। মাইক্রোবাস চলছে প্রায় একশ কিলোমিটার বেগে। রকিব সাহেব ট্রাক, নাইট কোচ সব একের পর এক ওভারটেক করে যাচ্ছেন। স্পীড আরো বাড়ছে। রকিব সাহেব এক হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে অন্য হাতে নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাতে ধরাতে শান্ত গলায় বললেন, গল্পটা আপনার কেমন লাগলো?
আমি জবাব দিলাম না। রকিব সাহেব বললেন, আপনি খুব মন দিয়ে গল্পটা শুনেছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। গল্পের শেষটা ইন্টারেস্টিং। শেষটা হচ্ছে–আমাকে অসহায় অবস্থায় রেখে বাবা মারা গেলেন, মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর মাথায় ছিলাম আমি, যে কারণে মৃত্যুর পরেও তিনি আমার সঙ্গে সেঁটে রইলেন। এবং এখনো আছেন।
আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।
অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। বুঝতে না পারারই কথা। বাবা সবসময় আমার আশেপাশে থাকেন। এই যে আমি গাড়ি চালাচ্ছি তিনি কিন্তু পেছনের সীটে বসে আছেন। যতবার আমি স্পীড দিচ্ছি ততবার বলছেন–বাবলু আস্তে চালা। আপনি তা শুনতে পারছেন না। আপনার শুনতে পারার কথাও না।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ব্যাপারটা কি সাইকোলজিকেল, না?
রকিব সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, আমি জানি আপনি তাই বলবেন। যে কোনো সেনসিবল মানুষই তাই বলবে। আমি নিজেও কিন্তু সেনসিবল মানুষ। এবং আমি জানি আসল ঘটনাটা কি। একবার কি হল শুনুন–জাপান থেকে যাচ্ছি লসএঞ্জেলেস, থাই এয়ারে। রাতের ডিনার শেষ করে ঘুমুতে যাব হঠাৎ শুনি বাবার গলা। বাবা বলছেন–বাবলু সীট বেল্ট বেঁধে নে। সামনে বিপদ।
সীট বেল্ট বাঁধার তখন কথা না। প্লেনের যাত্রীরা সবাই রিল্যাক্স করছে। বড় পর্দায় ছবি দেখছে। আমি বাবার কথা শুনে সীট বেল্ট বাঁধলাম তার কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন ভয়াবহ এক এয়ার পকেটে পড়ল। কত যাত্রী যে সীট থেকে ছিটকে পড়ল। ভয়ংকর অবস্থা। প্লেন থেকে মে ডে ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল।
আপনার বাবা তাহলে বিপদ আপদে আপনাকে সতর্ক করে দেন।
হ্যাঁ করেন।
ভাল তো।
মোটেই ভাল না। উনি আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন। অতি তুচ্ছ ব্যাপারেও উনি নাক গলান। একবার ব্যাংককে গিয়েছি। ব্যাংককের ম্যাসাজ পার্লারের এত নামডাক। ভাবলাম দেখি ব্যাপারটা কি? দু হাজার বাথ দিয়ে টিকিট করলাম। পার্লারে ঢুকতে যাচ্ছি–হঠাৎ বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, বাবলু ছিঃ বাবা। এসব কি? ম্যাসাজ না নিয়ে চলে এলাম। দুহাজার বাথ জলে গেল। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, তিনি তার স্কুল শিক্ষকের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। আমি তাঁর কাছ থেকে মুক্তি চাই। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই। তাঁকে যে এখন আমি কি পরিমাণে ঘৃণা করি তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।
ঘৃণা করেন?
অবশ্যই করি। আপনি হলেও করতেন। বাবার কারণে আমাকে গ্রামে হাই স্কুল দিতে হয়েছে। রাস্তা করে দিতে হয়েছে। এতিমখানা করতে হয়েছে। লোকে ভাবছে আমি বোধহয় ইলেকশন করব। গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করছি। আসল ব্যাপার হল আমার বাবা। সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান–স্কুল করে দে। কলেজ করে দে। এতিমখানা করে দে। অসহ্য। এখন ধরেছেন হাসপাতাল করতে হবে। একশ বেডের হাসপাতাল। একশ বেডের হাসপাতালে কত টাকা লাগে তা উনার কল্পনার মধ্যেও নেই। টাকা গাছে ফলছে না। টাকা কষ্ট করে উপার্জন করতে হচ্ছে।
হাসপাতাল করছেন?
উপায় কি, করতে তো হবেই। সাভারে নব্বই একর জমি নিয়েছি। আরো নিতে হবে।
রকিব সাহেব হঠাৎ গাড়ির গতি কমিয়ে ষাট কিলোমিটারে নিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত গলায় বললেন, স্পীড বেশি দেয়ার জন্যে বাবা দারুণ হৈ চৈ শুরু করেছেন।
তারপর তিনি আমার দিকে ঝুঁকে এসে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, যখন বাবার গলা শুনতে ইচ্ছা করে তখন আমি ইচ্ছা করে স্পীড দেই। ডেঞ্জারাস টার্ন নেই। বাবা ধমক দেন। উনার গলা শুনে ভাল লাগে।
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। রকিব সাহেব বললেন, আপনি যে বললেন সাইকোলজিকেল–সেটা হতে পারে। বাচ্চা বয়সে একটা ভয়াবহ মৃত্যু দেখেছি, আমার মাথার ভেতর সেটা ঢুকে মাথাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে চিকিৎসা করালে হয়তো সুস্থ হব। আমি কিন্তু চিকিৎসা করাতে চাই। আমি চাই এই ব্যাধি আমার থাকুক। আমৃত্যু থাকুক। এই চাওয়াটা কি অন্যায়?
না অন্যায় না।
ভাই, আপনি আমার হাসপাতালটার জন্যে খুব সুন্দর একটা নাম দেবেন। আমি আমার বাবার নামে হাসপাতাল দিতে চেয়েছিলাম। বাবার তাতে ভয়ংকর আপত্তি। রেগেমেগে এমন ধমকানো আমাকে ধমকিয়েছেন–মনে করলেই হাসি আসে-হা হা হা। হা-হা-হা।
রকিব সাহেব প্রাণ খুলে হাসছেন। ব্যাধিগ্রস্ত কোনো মানুষকে আমি এত সুন্দর করে কখনো হাসতে দেখিনি।
লাবাম্বা
মিতুর ঘর থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার–মা, আমার টাকা?
মিতুর মা আফরোজার অফিসের গাড়ি চলে এসেছে, নিচ থেকে হর্ণ দিচ্ছে। তার দাঁড়াবার সময় নেই। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কি হল?
আমার টাকা কোথায় গেল মা?
আমি কি জানি কোথায় গেল।
টেবিলের উপর রেখে বাথরুমে মুখ ধুতে গেছি….
কত টাকা?
পাঁচশ টাকার একটা নোট। আজ আমি বন্ধুদের চটপটি খাওয়াব। কে আমার টেবিল থেকে টাকা নেবে?
আফরোজা কথা বাড়াতে চাইছেন না। অফিসের মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছে। সহকর্মীরা নিশ্চয়ই বিরক্তমুখে বসে আছেন। সেদিন কথায় কথায় রমিজ সাহেব বলেছেন–তার এগারো বছরের চাকরি জীবনে এ রকম না কি কখনো হয়নি যে, গাড়ি হর্ণ দিয়েছে আর মহিলা সহকর্মী নেমে এসেছেন। শেষ মুহূর্তেও মহিলাদের না-কি কিছু কাজ বাকি থাকে।
আফরোজা মেয়ের ঘরে এসে ব্যাগ খুলে টাকা বের করলেন। মিতু বললো, তুমি ময়লা টাকা দিচ্ছ কেন? আমি ময়লা টাকা দিয়ে বন্ধুদের চটপটি খাওয়াবো না। আমি এই টাকা নেব না।
নতুন টাকা আমি এখন পাব কোথায়?
সেটা আমি জানি না। তুমি আমাকে চকচকে নতুন একটি নোট দিয়ে তারপর অফিসে যাবে। নয়তো তোমাকে আমি ঘর থেকে বেরুতে দেব না। দরজা বন্ধ করে আটকে রাখবো।
মিতু এবার ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। তার আচার আচরণ কাজকর্ম সবই এখনো স্কুলের মেয়ের মত। সে সত্যি সত্যি দরজা বন্ধ করে দেবে। নিচ থেকে ক্রমাগত গাড়ির হর্ণ ভেসে আসছে। আফরোজার কাছে ঝকঝকে টাকা নেই। যন্ত্রণায় পড়া গেল।
মিতু খাটে বসে আছে। হাসিমুখেই বসে আছে। পা নাচাচ্ছে। তার গায়ে তার বাবার একটা শার্ট।
মা, আমাকে অফিসে যেতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
হোক দেরি।
এই দুশ টাকা রেখে দে। এই নোট দুটি তো মোটামুটি পরিষ্কারই আছে।
অসম্ভব। আমি মাত্র দুশ টাকা নিয়ে যাব?
তুই বড় যন্ত্রণা করিস মিতু। আমি কি অফিসে যাব না?
না।
কী যে তুই পাগলের মত বলিস।
আমি যদি ইউনিভার্সিটিতে যেতে না পারি, তুমিও পারবে না।
ঘরে বসে থেকে আমি কি করবো?
আমার টাকা কোথায় গেল খুঁজে বের করবে।
আফরোজা কাজের মেয়ে লাইলীকে নিচে পাঠালেন। সে বলে আসবে তিনি আজ অফিসে যাবেন না। তার শরীর ভাল না। জ্বর আসছে।
মিতু পা নাচানো বন্ধ করে বলল, টাকাটা লাইলী নেয়নি তো মা? ঘরে আমরা চারজন মাত্র মানুষ। আমি তুমি লাইলী আর জিতুর মা। তুমি নিশ্চয়ই নাওনি। বাকি থাকছে লাইলী আর জিতুর মা। জিতুর মা নেবে না কাজেই কালপ্রিট হচ্ছে লাইলী।
আমার তো মনে হয় তুই-ই কোথায় রাখতে কোথায় রেখেছিস।
আমি টেবিলের উপরই রেখেছি। এই দেখ, ঠিক এইখানে। পেনসিল-কাটার দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে বাথরুমে মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি হাপিশ।
হাপিশ মানে?
হাপিশ মানে হজম হয়ে গেছে।
এই জাতীয় স্ল্যাং আমার সামনে বলবি না।
হাপিশ মা খুব ভদ্র স্ল্যাং। ভদ্র স্ল্যাং শুনেই তোমার এই অবস্থা। ভালগার স্ল্যাং শুনলে…মা একটা শুনবে?
মিতু আমি যে তোর মা এটা মনে থাকে না?
উঁহু, মনে থাকে না। আমার সব সময় মনে হয়, তুমি আমার বান্ধবী। বান্ধবীর স্ল্যাং কি জান মা? চামমি।
চামমি?
হা, চামমি। আর বান্ধবের স্ল্যাং হল চামমা।
চুপ কর।
আর প্রেমের স্ল্যাং হল–লদকা। আমি প্রেম করছি হবে–আমি লদকাচ্ছি।
প্লীজ স্টপ ইট।
মিতু খিলখিল করে হাসছে। লাইলী এসে দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। আফরোজা বললেন, বলে এসেছ?
লাইলী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
ওরা কেউ কিছু বলেছে?
জ্বে না।
আফরোজা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শোন লাইলী, মিতু একটা পাঁচশ টাকার নোট টেবিলে রেখেছিল। বাতাসে উড়ে বোধ হয় নিচে কোথাও পড়েছে। খুঁজে বের কর। মিতু তুই আমার ঘরে আয়। ও নোটটা খুঁজে বের করুক।
মিতু মা’র সঙ্গে মা’র শোবার ঘরে চলে এল। চাপা গলায় বলল, মা তোমার তো দারুন বুদ্ধি। ভাল কায়দা বের করেছে তো। আচ্ছা তোমার কি ধারণা লাইলী টাকাটা নিয়েছে….?
যেখানে সেখানে ফেলে রাখলে তো নেবেই।
ওর মুখ দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না ও নিয়েছে।
গ্রামের মেয়েদের মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না।
তোমার কি ধারণা গ্রামের মেয়েদের বুদ্ধি শহরের মেয়েদের চেয়ে বেশী?
তুই শুধু শুধু এত কথা বলিস। মাথা ধরে যায়….চুপ কর।
মিতু গম্ভীর গলায় বলল, আচ্ছা মা, এই বিষয়ে বাবার একটা মতামত টেলিফোনের মাধ্যমে জেনে নিই? তোমার আপত্তি নেই তো?
আফরোজা বিরক্তস্বরে বললেন, তুই তোর বাবার সঙ্গে কথা বলবি এতে আমার আপত্তি থাকবে কেন?
মিতু হাসল। মা রেগে গেছে এটা সে বুঝতে পারছে। হাসি দেখে আরো রেগে যাবে। মাকে রাগাতে তার ভালই লাগে।
মা, তুমি কি রেগে গেছ?
রাগব কেন?
বাবার সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম, এই জন্য… তোমার এক্স হাসবেন্ড….
তোর এই ধরনের কথাবার্তা অসহ্য।
পুরো ব্যাপারটা তুমি নরম্যালি নিতে পারছ না বলে তোমার কাছে অসহ্য লাগে। বাবা তোমাকে ফেলে চলে গেছে আর সেই দুঃখে তুমি মোটা হতে হতে মিস কিংকং…
আফরোজার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। এরকম করে কোনো মেয়ে কথা বলতে পারে? কোথায় যাচ্ছে এখনকার ছেলেমেয়েরা?
মা শোনো, বাবা তো বিয়ে করে দিব্যি সব গুছিয়ে ফেলেছে। তুমি আর দেরি করো। তোমার সাইজের কাউকে খুঁজে বের করে কিছুদিন লদকাও তারপর শুভ বিবাহ।
মেয়েকে কঠিন ধমক দেবার ইচ্ছা আফরোজা সামলালেন। কী হবে ধমক দিয়ে?
শুধু শুধু অফিস কামাই হল। সারাদিন ঘরে বসে থেকে হবেটা কি? এই সপ্তাহের বাজারটা করে রাখলে হয়। মিতুকে কি বলবেন, সে যেন তার বাবাকে বলে তার গাড়িটা আজকের জন্যে আনিয়ে নেয়? মিতু বললেই গাড়ি চলে আসবে। লোকটা মেয়েঅন্ত প্রাণ।
মিতু তার বাবাকে টেলিফোন করছে। মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল —
বাবা শোনো। তুমি তোমার মূল্যবান একটা জাজমেন্ট আমাকে দাও তো। গ্রামের মেয়েদের বুদ্ধি কি শহরের মেয়েদের চেয়ে বেশী?
মারুফ সাহেব বললেন, হঠাৎ বুদ্ধির প্রসঙ্গ কেন?
হঠাৎ না। এটা নিয়ে মা’র সঙ্গে আমার তর্ক হচ্ছে। তোমার মতামত কি?
মতামত দিতে পারছি না। গ্রামের মেয়ে তেমন দেখিনি। তুই কেমন আছিস বল। ইউনিভার্সিটিতে যাসনি?
যাব কিভাবে? আমার সব চুরি হয়ে গেছে বাবা।
সে কি।
তুমি যে চকচকে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়েছিলে, টেবিলের উপর রেখেছিলাম–হাপিশ হয়ে গেছে।
কাজের মেয়ে-টেয়ে কেউ নিয়েছে নিশ্চয়ই।
আমার ধারণা লাইলী নিয়েছে। ওর উপরই আমার ঘর গোছানোর দায়িত্ব। বাবা শোনো, তোমার এই প্রসঙ্গে কী মতামত?
তোর কথা বুঝতে পারছি না।
তোমার কি মনে হয় লাইলী টাকাটা নিতে পারে?
চোখের সামনে পড়ে থাকলে নিতেও পারে। অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়।
লাইলী কিন্তু স্বাভাবিক আচরণ করছে। মা তাকে বলেছেন টাকা খুঁজে বের করতে। ও টাকা খুঁজে যাচ্ছে।
ও, আচ্ছা।
বাবা শোনো, তুমি কি একটা বাজি রাখবে আমার সঙ্গে?
কী বাজি?
বাজি হচ্ছে–আমি বলছি ও টাকা নিয়েছে। তুমি বলছ, না। এই নিয়ে বাজি। পাঁচশ টাকা বাজি।
বাজি-টাজি না, তোর পাঁচশ টাকা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
কখন পাঠাবে?
এই এক্ষুণি পাঠাচ্ছি। ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠাচ্ছি।
ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠালে হবে না বাবা, তোমাকে নিয়ে আসতে হবে।
আমি তো এখন আসতে পারবো না মা। অফিসে খুব কাজ। আমি না হয় সন্ধ্যার পর…।
এই সব চলবে না। বাবা, তোমাকে এক্ষুণি আসতে হবে। এই মুহূর্তে না হলে…
না হলে কি…
হলে আমি ভয়ংকর কিছু করে বসব। খুবই ভয়ংকর। যেমন ধর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়া জাতীয়।
ভয়ংকর কিছু করতে হবে না, আমি আসছি।
এক্ষুণি আসছ তো?
হা।
বাবা শোনো, কিছু ফুল নিয়ে আসতে পারবে?
কী ফুল?
গোলাপ।
আচ্ছা নিয়ে আসবো।
বাবা শোনো, তুমি এলে তোমাকে নিয়ে আইসক্রীম খেতে যাব।
আচ্ছা, যাওয়া যাবে।
আমাদের সঙ্গে যদি তোমার প্রাক্তন স্ত্রীকে নেই তাহলে কি তুমি রাগ করবে?
মারুফ সাহেব হেসে ফেললেন। মিতুও হাসল।
.
লাইলী তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। তার বুক ধক ধক করছে। যদি নোটটা না পাওয়া যায়। যদি তারা মনে করে সে নোট নিয়েছে। তখন তারা কি করবে? বেগম সাহেব কি বাড়ি থেকে বের করে দেবেন? ঢাকা শহরে একটা ভাল বাড়ি পাওয়া খুব কষ্টের। এই বাড়িটা ভাল। এই বাড়ির মেয়েটা ভাল। বেগম সাহেবও ভাল। এই বাড়ি ছেড়ে যেতে। তার কষ্ট হবে।
মিতু তার ঘরে এসে দাঁড়াল। লাইলী তাকালো ভয়ে ভয়ে। মিতু বলল, পাওয়া গেছে লাইলী?
জ্বে না আফা।
থাক, আর খুঁজতে হবে না।
টাকা আমি নেই নাই আফা।
টাকা তুমি নাওনি সেটা আমি জানি। টাকা তুমি নেবে কি করে? আমি রাখলে তবে তো নেবে। আমি টাকা রাখিনি। টাকা আমার ব্যাগেই আছে।
লাইলী নির্বোধের মত তাকাচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছে না। মিতু হালকা গলায় বলল, টাকার ব্যাপারটা নিয়ে একটা নাটকের মত করে আমি মাকে আটকেছি। বাবাকেও ডেকে আনাচ্ছি, যাতে আজ সারাদিন বাবা, মা আর আমি আমরা তিনজন এক সঙ্গে থাকতে পারি।
লাইলী এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। মিতুর মনে হল গ্রামের মেয়েরা আসলে শহরের মেয়েদের চেয়ে বোকা, নয়তো ব্যাপারটা বুঝতে লাইলীর এত সময় লাগার কথা না।
মিতু তার খাটে বসতে বসতে বলল, আজ হচ্ছে আমার বাবা-মা’র ম্যারেজ ডে। তারিখটা মা’র মনে আছে কিন্তু বাবা ভুলে গেছেন। কাজেই বাধ্য হয়ে আমাকে একটা নাটক করতে হল। এখন বুঝতে পারছ?
জ্বে আফা।
আচ্ছা, তাহলে এখন তুমি চলে যাও। আমার খুব মন খারাপ লাগছে। বাবা আসার। আগ পর্যন্ত আমি কাঁদব। তুমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। বাবার গাড়ি দেখলেই আমার দরজায় টোকা দেবে। সঙ্গে সঙ্গে আমি কান্না বন্ধ করব। পারবে না?
পারুম আফা।
মিতু দরজা বন্ধ করে তার সিডি প্লেয়ারে লাবাম্বা জিপসী গান ফুল ভলমে দিয়ে দিল। হৈ-চৈ ধরনের গান ছাড়া সে কাঁদতে পারে না। পুরো ফ্ল্যাট বাড়ি কাঁপিয়ে জিপসী ব্যান্ড গাইছে–লাবাম্বা। লাবাম্বা। মিতু তার বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
শৃঙ্খলা
নসু অনেক্ষণ হল জেগেছে। চাদরের নিচ থেকে এখনো মাথা বের করছে না। এমন কিছু তাড়া নেই। এক সময় মাথা বের করলেই হল। তাছাড়া চাদরের ভেতর শুয়ে থাকতে ভাল লাগছে। শান্তি শান্তি লাগছে। নিজেকে নিরাপদ লাগছে। চাদরটা তার মাথার উপর এল কি করে তা অবশ্যি তার মনে নেই। রাতে যখন ঘুমুতে গিয়েছিল তখন কি ছিল? মনে পড়ছে না। মনে না পড়লে নেই। এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। নসু শুয়েছিল কুভুলি পাকিয়ে। সে তার ডান পা-টা ছড়িয়ে দিল। সমস্যা একটাই, এতে তার পা চাদরের ভেতর থেকে বের হয়ে পড়বে। চাদরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে পা-টা বের করা কি ঠিক হবে? জগৎটাতো খুব সহজ জায়গা না। কোত্থেকে কি হয় কে জানে। তারপরেও তার চারপাশের জগৎটা ঠিক আছে কিনা তা জানার জন্যেই কাজটা তাকে করতে হচ্ছে। নরম কোন জিনিসের সঙ্গে পায়ের ধাক্কা লাগার কথা। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে নরম জিনিসটার ঘেউ করে একটা শব্দ করার কথা। যদি উঠে তবে বুঝতে হবে সব ঠিক আছে।
পায়ের সঙ্গে নরম জিনিসটার ধাক্কা লাগল। জিনিসটা একবার ঘেউ করেই কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল। ঠিক আছে, সব ঠিক আছে। কোন অনিয়ম হয়নি। পায়ের কাছে কুকুরটা ঠিক আছে। পরিপূর্ণ নিয়ম ও শৃঙ্খলার ভেতর শুরু হতে যাচ্ছে আরেকটি দিন। নসু তার পা দিয়ে কুকুরটাকে আরেকটা ধাক্কা দিল। আবারো কুঁই কুঁই শব্দ হল। আহারে, কুকুরটা কি সুন্দর করেই না কুঁই কুঁই করে।
নসু চাদরের ভেতর থেকে মাথা বের করল। মাথার উপর ঝকঝকে নীল আকাশ। এত নীল যে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, চোখে ধাঁধা লাগে। মাথা ঝিম ঝিম করে। নসু চোখ ফিরিয়ে নিল। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে তাকালো সোজাসুজি। রাস্তায় লোক চলাচল করছে, রিকশা চলছে, হুস হাস করে গাড়ি যাচ্ছে। বাহ কি সুন্দর। চলমান জীবন দেখার আনন্দই অন্য রকম। নসু চোখে পলক পর্যন্ত ফেলে না। মনে হয় পলক ফেললেই মজাদার কিছু দেখা হবে না। এক পলকে অনেক কিছু হতে পারে।
নসু কোমরের নিচে হাত দিল। গায়ে কাপড় আছে কি না চট করে দেখে নেয়া। গায়ে কাপড় না থাকলে চাদরটা কোমরে জড়াতে হবে। নগ্ন অবস্থায় হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। শহরের কিছু লোক আছে যারা নগ্ন মানুষ পছন্দ করে না। মা’রধোর পর্যন্ত। করে। সে যতবার নগ্ন অবস্থায় বের হয়েছে ততবার মা’র খেয়েছে।
নসু হাত দিয়ে দেখল তার পরনে একটা প্যান্ট। প্যান্টের যেখানে বেল্ট থাকার কথা সেখানে দড়ি বাঁধা। বেশ শক্ত করেই বাঁধা। কেউ একজন বেঁধে দিয়েছে। বাঁধাবাঁধির কাজ সে আজকাল করতে পারে না। বড়ই বেড়া ছেঁড়া লাগে। তার নিজস্ব জগতে সে বেড়া ছেঁড়া চায় না। সে চায় শৃঙ্খলা। মেয়েদের স্কুলের সামনে আগে সে প্রায়ই গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। আজকাল যায় না। শৃঙ্খলার কারণেই যায় না। ফুটফুটে সব মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে কত ভাল লাগতো দেখতে। মাঝে মাঝে হেসে একজন আরেকজনের গায়ে গড়িয়ে পড়তো–আহা কি মধুর দৃশ্য। ওরা কথাও বলতো কি সুন্দর করে—ঐ দেখ পাগলা। ঐ যে পাগলা। ও মাগো, পাগলা হাসে। কি ভয়ংকর! পাগলা হাসছে।
নসু হাসতো ঠিকই। এরকম সুন্দর সুন্দর দৃশ্য চোখের সামনে দেখলে না হেসে পারা যায়? হাসার কারণেই শৃঙ্খলায় গন্ডগোল হয়ে গেলো। সে সবার নজরে পড়ে গেলো। মারের চোটে জীবন যাওয়ার উপক্রম। মারের সঙ্গে কি সব কঠিন কঠিন কথাবল হারামজাদা আর মেয়েছেলের দিকে নজর দিবি? জাতে পাগল তালে ঠিক। জায়গামত চলে আসে। হারামজাদা চোখ গেলে ফেলব, তখন জন্মের দেখা দেখবি।
নসু বলতে বাধ্য হয়েছে–সে আর আসবে না। সে থাকবে শৃঙ্খলার ভেতরে।
সবচে বেশী শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয় একজন পাগলকে। অন্য কেউ শৃঙ্খলা ভাঙলে কোন অসুবিধা নেই, পাগল ভাঙ্গলেই সমস্যা। দরকার কি? অন্যসব পাগলদের মত সেও ঝামেলাহীন জীবন পছন্দ করে। সারা দিন মনের আনন্দে পৃথিবীর শৃঙ্খলা দেখা। রাতে পায়ের কাছে কালো রঙের কুকুর নিয়ে সুখে দ্রিা। খাওয়া দাওয়া কোন সমস্যা না। হোটেল মালিকরা পাগল পছন্দ করে। পাগলদের খাওয়ালে বিক্রি ভাল হয়। হোটেল চালু থাকে। আয় উন্নতি হয়। কাজেই পাগলদের জন্য হোটেল ভাগ করা থাকে। একেক পাগলের জন্যে একেক হোটেল। নসুর ভাগের হোটেলটার নাম–নিউ ঢাকা কাবাব হাউস। নসু গভীর রাতে কাবাব হাউসের সামনে দাঁড়ায়। তাকে কিছু বলতে হয় না। তাকে দেখা মাত্র হোটেলের মালিক বলে–আসছেরে, নসু পাগলা আসছে। তখন বড় একটা এনামেলের গামলায় আধ গামলা খাবার তাকে দেয়া হয়। কাস্টমা’ররা প্রচুর খাবার নষ্ট করে, তার একটা অংশ নসু পায়। শিক কাবাব, নান রুটি, খানিকটা পরোটা। মুরগীর মাংস। নসুর কাছ থেকে খানিকটা পায় তার কুকুর। দুজনই মহা তৃপ্তিতে খায়। হোটেলের মালিক এই সময় তার সঙ্গে টুকটাক কিছু কথা বলেন। খাবার সময় নসুর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তবু সে বলে। তার কথা শুনতে লোকটা পছন্দ করে। কি আর করা।
কেমন আছিসরে নসু?
জ্বে, আছি ভাল।
দেশে কবে যেন যাবি?
মাথাটা ঠিক হলেই চলে যাব।
দেশে আছে কে?
বউ আছে। পুলাপান আছে।
দেশ কোথায়?
স্মরণ নাই।
স্মরণ না থাকলে যাবি কি ভাবে?
বউ আইসা নিয়া যাবে।
নসুর এই কথাতে হোটেল মালিক হো হো করে হাসে। তার সঙ্গে অন্যরাও হাসে। এর মধ্যে হাসির কি আছে নসু বুঝতে পারে না। সে পাগল হবার পর বউ এসে তাকে ঢাকায় ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। এইটাই নিয়ম–পাগল ঘরে পুষা যায় না। শহরে ছেড়ে দিয়ে আসতে হয়। বউও তাই করেছে, শহরে ছেড়ে দিয়ে গেছে। এত বড় শহর খাওয়া খাদ্যের অসুবিধা হবে না। সে সুখে থাকবে।
বউ যখন রেখে গেছে বউ নিয়েও যাবে। এটাইতো স্বাভাবিক। স্বাভাবিক কথা শুনে লোকে হাসবে কেন। নসু বড়ই বিরক্ত হয়। তবে বিরক্তি প্রকাশ করে না। পাগলদের একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। তাদের যখন তখন বিরক্তি প্রকাশ করলে চলে না।
তোর বউ দেখতে কেমনরে নসু?
আছে, সুন্দর-মুন্দর আছে।
এই কথাতেও সবাই হাসে। এর মধ্যে হাসির কি আছে তাও নসু বুঝতে পারে না। সে পাগল বলে তার বউ সুন্দর-মুন্দর হতে পারে না?
নসু ঠিক করে রেখেছে তার বউ যখন তাকে নিতে আসবে তখন এই হোটেলে তাকে নিয়ে আসবে। হোটেল মালিককে দেখিয়ে নিয়ে যাবে সে মিথ্যা কথা বলে নি।
তোর বউয়ের নাম কিরে?
নাম বলব না।
নাম বলবি না কেন? নাম স্মরণ নাই?
স্মরণ আছে বলব না। পর পুরুষরে পরিবারের নাম বলতে নাই।
বললে অসুবিধা কি?
পর পুরুষরে পরিবারের নাম বললে পরিবার অসতী হয়।
হোটেল মালিক আবারো গলা ফাটিয়ে হাসে। নসুর বিরক্তির সীমা থাকে না।
বল নসু নাম বল। নাম বললে তোকে ফাইভ ফাইভ সিগারেট খাওয়াব।
জ্বে না নাম বলব না।
নসু গম্ভীর হয়ে যায়। পাগল হলেও এইসব বিষয়ে সে খুব সাবধান। ছেলেপুলের নাম জানতে চাইলে সে বলে দেবে কিন্তু পরিবারের নাম বলবে না। মুশকিল হচ্ছে ছেলেপুলের নাম তার স্মরণ নাই। শুধু পরিবারের নামই স্মরণ আছে। তার পরিবারের নাম শরুফা।
শরুফার কথা সে দিনে কখনো মনে করার চেষ্টা করে না। সারা দিন সে শহরে ঘুরে বেড়ায়, শহরের শৃঙ্খলা দেখে। তার বড় ভাল লাগে। প্রতিদিনই চোখের সামনে কত শিক্ষনীয় ব্যাপার ঘটে যায়। নসুর নতুন নতুন জিনিস শিখতে ভাল লাগে। যেমন মাত্র কয়েকদিন আগে সে একটা নতুন জিনিস শিখল–ট্রাফিক পুলিশ যখন দুহাত তুলে তখন রিকশা এবং গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু সাইকেল চলে। কত দিন ধরে সে এই শহরে আছে কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তার আগে চোখে পড়েনি। যখন চোখে পড়ল তখন বিষ্ময় ও আনন্দে সে অভিভূত হয়ে পড়ল। কি বিচিত্র ব্যাপার! ট্রাফিক পুলিশ ট্রাক, বাস, রিকশা সব আটকাতে পারে কিন্তু সাইকেলের মত দুচাকার একটা সামান্য জিনিস আটকাতে পারে না। তখন শৃঙ্খলার মধ্যে একটা। গন্ডগোল হয়ে যায়। নসুর খুব ইচ্ছা করছিল এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা সে তার কুকুরটাকে বুঝিয়ে দেয়। সেটা সম্ভব না। আল্লাহ পাক পশুদের প্রতি তেমন দয়া। করেননি। শৃঙ্খলার ব্যাপারটা তাদের বোঝার ক্ষমতা দেননি। নসুর সেদিন তার কুকুরটার প্রতি বড় মায়া লেগেছিল। আহারে অবোধ পশু।
নসু ঠিক করে রেখেছে যেদিন সে ভাল হয়ে দেশের বাড়িতে যাবে কুকুরটাকেও নিয়ে যাবে। গ্রামদেশে শহরের মত খাওয়া খাদ্য নাই, তা কি আর করা। অবোধ একটা পশুকে সেতো আর ফেলে রেখে যেতে পারে না।
নসু সারা দিন হাঁটে। মজা করে চারপাশের শৃঙ্খলা দেখে। রাতে ফুটপাতের কোন একটা নিরাপদ কোনায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তার খুব ভাল ঘুম হয়। হঠাৎ হঠাৎ কোন কোন রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আচমকা মনে হয় শৃঙ্খলায় কোন গন্ডগোল হয়নি তো? কয়েক মুহূর্ত সে আতংকে অস্থির হয়ে থাকে। আঁ আঁ করে বিকট চিৎকার দিতে ইচ্ছা করে। তখনই কুকুরটা কুঁই কুঁই করে শব্দ করে। নসুর মনে হয়–সব ঠিক আছে। শৃঙ্খলা বজায় আছে। কুকুরটার সঙ্গে সে তখন দুএকটা কথা বলে। সে জানে মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ পাক পশুদের দেননি। তারপরেও কথা বলে। কথা বলতে তার ভাল লাগে–আমার পরিবার যখন আমারে নিতে আসবো তখন তোরেও ইনশাল্লাহ নিয়া যাব। কোন চিন্তা করিস না। আমার পরিবারের নাম হইল–শরুফা। পরিবারের নাম মুখে আনার জন্যে নসু খানিকটা লজ্জা বোধ করে। কাজটা ঠিক হয়নি। তারপরেও তার ভাল লাগে। শরুফার বিষয়ে আরো দুএকটা কথা তার বলতে ইচ্ছা করে। সে বলে না। পশুরা মানুষের জটিল কথা বুঝবে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। তাদের জগতে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরী হবে। কি দরকার?
সংসার
মজিদের বয়স সাড়ে চার বছর। এ বয়সেই সে তার বাবার প্রতিভার একজন মুগ্ধ সমঝদার। আজ তার মুগ্ধতা আকাশ স্পর্শ করেছে। কারণ তার বাবা কুদ্দুস মিয়া তাকে একটা ইঁদুর ধরে দিয়েছে। শুধু ধরে দেয়নি, হঁদুর নিয়ে সে যেন মজা করতে পারে সেই ব্যবস্থাও করেছে। লাল সুতা দিয়ে ইঁদুরের লেজ বাঁধা। সুতা ছেড়ে দিলে ইঁদুর কুট কুট করে হাঁটতে থাকে। সুতা টেনে ইঁদুর কাছে আনা যায়।
মজিদ তার সাড়ে চার বছরের ক্ষুদ্র জীবনে অনেক বিস্ময়কর জিনিস তার বাবার কাছ থেকে উপহার পেয়েছে। এমন বিস্ময়কর কিছু পায়নি। ইঁদুরের সুতা ধরে আনন্দে তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল।
কুদ্দুস মিয়া পুত্রের আনন্দ কিছুক্ষণ দেখল। তারপর উদাস ভঙ্গিতে একটা বিড়ি ধরাল। তিনটি মাত্র বিড়ি আজ তার সারাদিনের সম্বল। দিন সবে শুরু হয়েছে। এর মধ্যেই একটা অকারণে খরচ করে ফেলা নিতান্তই বেকুবি। তারপরও কুদ্দুস মিয়া বেকুবিটা করলো। কারণ ছেলের আনন্দিত মুখ দেখে তার মনটা উদাস হয়েছে। মন উদাস হলে বিড়ি সিগারেট টানতে ইচ্ছা করে।
মজিদ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা ইন্দুর কামড় দেয়?
কুদ্দুস মিয়া না সূচক মাথা নাড়ল। ছেলের সঙ্গে সে কথাবার্তা খুব কম বলে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা কম বলাই নিয়ম। বেশি কথা বললে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক না। প্রশ্রয় পেলে ভয় ভক্তি কমে যায়। কুদ্স মিয়ার ধারণা ছেলেমেয়ে মানুষ করার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো তাদের দিকে একেবারেই নজর না দেওয়া। অকারণে কথা না বলা। কিছুতেই যেন বাবার ভালবাসা এরা টের না পায়। ভালবাসা প্রকাশ করার জিনিস নয়, ভালবাসা গোপন রাখার জিনিস। যে ভালবাসা যত গোপন সেই ভালবাসা তত গভীর। এই যে মজিদ ইঁদুর নিয়ে খেলছে, খেলাটা দেখতে তার। ভাল লাগছে। সেই ভাল লাগা পুত্রের টের পাওয়া খুবই ভুল হবে। কাজেই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়ি টানতে লাগলো। তার এই ঘর থেকে আকাশ দেখা যায়, এটাও এক আনন্দের কথা। তবে এটাকে ঘর বলা ঠিক হচ্ছে না। পাইপ ঘর বলা যায়। এক মাসের উপর হলো তারা উঠে এসেছে সিউয়ারেজ পাইপে। শুরুতে কুদ্দুসের কঠিন আপত্তি ছিল। পাইপের ভেতর মানুষ থাকে? রাতে ঘুমের মধ্যে পাইপ গড়াতে শুরু করলে তখন? তার ইচ্ছা ছিল মনোয়ারার সঙ্গে সে একটা কঠিন ঝগড়া করে। শেষ পর্যন্ত ঝগড়াটা করলো না, মেয়েছেলের সঙ্গে ঝগড়া করে ফায়দা কি? এরা যুক্তি বোঝে না। আল্লাহ পাক যুক্তি বোঝার ক্ষমতা এদের দেন নাই। তাছাড়া মনোয়ারা সংসারের জন্যে খেটে মরছে। তার সামান্য কথা শুনলে সে যদি খুশি হয়, হোক। মানুষকে খুশি করার মধ্যেও সোয়াব আছে।
মিরপুর ইলেকট্রিক সাব-অফিসের মাঠে জমা করে রাখা গোটা পনেরো পাইপের মধ্যে একটার দখল তারা নিয়েছে। পাইপগুলো দূর থেকে যত ছোট মনে হয় আসলে তত ছোট না। ঝড় বৃষ্টির সময় বড়ই আরাম। বৃষ্টির একটা ফোঁটাও ভিতরে আসে না। পাইপের দুই মাথা পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিলেই হলো। সবচে বড় সুবিধা মশার যন্ত্রণা নাই। প্রথম দুই রাত ঘুমাতে একটু কষ্ট হয়েছিল দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছিল। মনোয়ারাকে সে এক সময় বলেই ফেললো, ও বৌ! মনে হইতেছে কবরের ভিতরে শুইয়া আছি। মানকের নেকের আইস্যা সোয়াল জোয়াব শুরু করব।
মনোয়ারা জবাব দেয়নি। স্বামীর অধিকাংশ কথার সে কোনো জবাব দেয় না। এটা এক ধরনের বেয়াদবি। রোজ হাশরে মনোয়ারা এই বেয়াদবির কারণে বিপদে পড়বে। কুদ্দুস ঠিক করে রেখেছে সুযোগ সুবিধা মত বিষয়টা সে স্ত্রীকে বুঝিয়ে বলবে। সে রকম সুযোগ সুবিধা হচ্ছে না। মনোয়ারার মেজাজ খুবই খারাপ যাচ্ছে।
মনোয়ারা কোনো জবাব না দিলেও মজিদ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে, মানকের নেকের কে বাপজান?
কুদ্দুস পুত্রের কৌতূহলে আনন্দিত হয়। মানকের নেকেরের সোয়াল জবাব বিশদভাবে বলতে যায়—
এরা হইল আল্লাহ পাকের দুই ফেরেশতা। এরা আইস্যা পরথমে বলে তোমার রব কে? তারপর বলে কে তোমার রসুল? তারপর বলে…. মনোয়ারা চেঁচিয়ে বলে, চুপ কইরা ঘুম যান। দিক কইরেন না।
এটাও আদবের বরখেলাপ। স্বামীকে ধমক। স্বামী বড়ই আদবের জিনিস, তারে ধমক দেওয়া যায় না। এর জন্যেও রোজ হাশরে মনোয়ারার জটিল অসুবিধা হবে।
মনোয়ারার ধমকে কুদ্দুস খানিকটা উদাস হয়, তবে বিচলিত হয় না। যে সংসারের জন্যে এতো খাটাখাঁটি করে তার কিছু ভুলত্রুটি ক্ষমা’র চোখে দেখা যায়। এই যে থাকার জন্যে পাইপে সংসার পেতেছে, মনোয়ারার জন্যেই সম্ভব হয়েছে। এই সব খোঁজ-খবর সেই রাখে। গত শীতে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে কিছু কম্বল দেওয়া হয়েছে। সংখ্যায় অতি অল্প। মনোয়ারা সেই কম্বল দু’টা জোগাড় করে ফেলল–অবিশ্বাস্য ব্যাপার। একটা তারা বিক্রি করেছে বিয়াল্লিশ টাকায়। দর ভাল পেয়েছে। অনেকে কুড়ি পঁচিশ টাকায় বিক্রি করেছে। সেই টাকা জমা আছে–একদিন রিকশা কেনা হবে। মনোয়ারার ধারণা তাদের একটা নিজস্ব রিকশা থাকলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মেয়েছেলে যে কী পরিমাণ নির্বোধ হয় এটা তার একটা প্রমাণ। রিকশা চালানোর শক্তি কি তার আছে? একটা পা বলতে গেলে–অবশ। সে যে দিন রাত ঘরে বসে থাকে–অকারণে থাকে না। উপায় নেই বলেই থাকে। কোনো কারণে পা ঠিক হলেও ঢাকা শহরে মোটর গাড়ির যে উৎপাত এর মধ্যে রিকশা চালানো সহজ কথা? জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার। বেবিট্যাক্সি হলে ভিন্ন কথা ছিল। কলের ইনজিন। চালিয়ে আরাম–চালানোর মধ্যে একটা ইজ্জতও আছে। রিকশাওয়ালাকে সবাই তুই তুমি করে। বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে বলে আপনি করে। ইজ্জত ছোট করে দেখার কোনো বিষয় না।
কুদ্দুস অবশ্যি এখনো কিছু বলছে না। সময় হোক, সময় হলে বলবে। রাগারাগি চিৎকার করবে না। মেয়েছেলে অবলা প্রাণী, এদের সঙ্গে রাগারাগি করা যায় না। বুঝিয়ে বলতে হবে। তবে কুদ্দুসের ধারণা, বুঝিয়ে বলারও দরকার হবে না। রিকশার টাকা জমানোতো সহজ কথা না। বিপদ আপদের কি কোনো শেষ আছে? হুট করে একটা বিপদ আসবে–খরচ করো টাকা। গত ভাদ্র মাসে যে রকম বিপদ এসে ঘাড়ের উপর পড়লো, মনে হলে এখনো গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। তারা তখন পাকা দালানে মোটামুটি সুখেই ছিল। কল্যাণপুরে আটতলা দালান হচ্ছিল। কি কারণে কয়েক বছর ধরে কাজ বন্ধ হয়ে আছে। ঐ বাড়ির বিভিন্ন ঘর তাদের মত মানুষরা সেলামী। দিয়ে ভাড়া নিয়ে থাকে। তারাও দুশ টাকা সেলামী দিয়ে চার তলায় উঠে গেল। সিঁড়িতে রেলিং নাই এটাই সমস্যা। অন্ধকারে উঠতে নামতে ভয় ভয় লাগে। পরিবেশও খুব খারাপ, আজেবাজে মেয়েছেলে থাকে। রাত দুপুরে হুল্লোড়। এই সব জায়গায় সংসার করা ঠিক না। তারপরেও ছিল, উপায় কি? তখন বড় মেয়েটা পড়লো অসুখে–কথা নাই বার্তা নাই আকাশ-পাতাল জ্বর। তবে চিকিৎসার ত্রুটি হয় নাই। মনোয়ারা তার জমা টাকার প্রতিটি পাই পয়সা খরচ করেছে। আজেবাজে মেয়ে যে কয়টা ছিল তারাও সাহায্য করেছে। মেয়েটার মৃত্যুর পর আজেবাজে মেয়েগুলোও গলা ফাটিয়ে কেঁদেছে। রোজ হাশরে এই মেয়েগুলোর বিচার হবে। তখন কারো সুপারিশ কাজে লাগবে না। যদি কাজে লাগতো তাহলে অবশ্যই কুদ্দুস সুপারিশ করতো। আল্লাহ পাককে বলতো, ইয়া পরওয়াদেগার ইয়া গাফুরুর রহিম, তুমি এই মেয়েগুলোরে ক্ষমা করে দিও। এরা অভাবে পড়ে মহা অন্যায় করেছে। এই অভাব তোমারই দেওয়া। তুমি অবশ্য পরীক্ষা করার জন্যেই অভাব দিয়েছে। এরা তোমার জটিল পরীক্ষায় পাস। করতে পারে নাই। কিন্তু মেয়েগুলোর অন্তর ভাল ছিল।
বড় মেয়েটার কথা কুদ্দুসের প্রায়ই মনে হয়। তখন মনটা উদাস হয়। মেয়েটা বড়ই সুন্দর ছিল। ছবি দেখার পোকা ছিল। সবসময় ঘ্যান ঘ্যান করতো, বাপজান ছবি দেখব। ছবি দেখা বিরাট খরচান্ত ব্যাপার। তাছাড়া মনোয়ারা পছন্দ করে না। লুকিয়ে লুকিয়ে কয়েকবার মেয়েকে ছবি দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। ছবির মধ্যে শিক্ষণীয় কিছু নাই। টাকা নষ্ট। তারপরেও শিশুর আব্দার বলে কথা। শিশুদের প্রশ্রয় দিতে নাই কিন্তু তাদের দুএকটা আব্দার রাখতে হয়। এই বিষয়েও নবীজির নির্দেশ আছে, নবীজি শিশুদের স্নেহ করার জন্যে কঠিন নির্দেশ দিয়ে গেছেন। নবীজী বলেছেন, যে শিশুদের স্নেহ করেনা, সে আমার উম্মত।
কুদ্দুস নবীজির নির্দেশ মেনে মেয়েটাকে স্নেহ করেছে। প্রয়োজনের বেশি করেছে। করা উচিত হয় নাই। আরেকটু কম স্নেহ করলে তার মৃত্যুতে কষ্ট কম হত।
তবে আল্লাহপাকের হিসেব ঠিক আছে। মেয়েটা বেশি সুন্দর ছিল। বড় হলে মেয়েকে নিয়ে বিপদ হত। স্নেহ দেখানোতে বিপদ আছে বলেই মজিদকে সে স্নেহ কম দেখাচ্ছে। ইঁদুরের বাচ্চা ধরে দিয়েছে। এতে অনেক খানি স্নেহ দেখানো হয়ে গেছে। কোনো এক ফাঁকে একটা ধমক দিয়ে স্নেহ কমিয়ে দিতে হবে।
বাপজান?
উঁ
ইন্দুর কী খায়?
যা পায় খায়। চিড়া গুড় মুড়ি কাগজ লোহা–খায় না এমন জিনিস নাই। ইন্দুর আর ছাগল দুইজনেই এক পদের-খাওনে উস্তাদ।
মজিদ চোখ বড় বড় করে বাবার কথা শুনে। এতে বড় ভাল লাগে কুদ্দুসের। মনোয়ারা আজকাল আর তার কথা শুনে না। কিছু বলতে গেলে বলে, চুপ যান। দিক কইরেন না।
কুদ্দুসের কথা বলতে ইচ্ছা করে। সংসার ধর্ম করতে হলে কথা বলতে হয়। কথার মধ্যেই থাকে ভাব-ভালবাসা। কথা না থাকলে ভাব-ভালবাসা আসবে কিভাবে? মনোয়ারা সহজ সত্য বোঝে না। তার শুধু রোজগারের চিন্তা। পথের ফকির হওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। আমাদের নবীজিও বলতে গেলে পথের ফকির ছিলেন।
বাপজান!
উ।
ইন্দুরটার ক্ষিধা লাগছে।
তোর নিজের লাগছে?
মজিদ লাজুক ভঙ্গিতে হাসে।
কুদ্দুসের বড়ই মায়া লাগে।
তোর মা আসুক ব্যবস্থা হইব। ক্ষিধের কথায় কুদ্দুস নিজেও খানিকটা অস্থির বোধ করে। তার নিজেরও ক্ষিধে হচ্ছে। প্রবলভাবে হচ্ছে। ঘরে খানিকটা চিড়া ছিল। দুপুরে ভিজিয়ে মজিদকে দেওয়া হয়েছে। কুদ্দুসের ধারণা ছিল মজিদ খানিকটা হলেও বাবার জন্যে রেখে দেবে। তা রাখে নাই। বড় মেয়েটা বেঁচে থাকলে অবশ্যই রাখতো। মায়ের জাত তো, চারদিকে নজর না করে এরা খেতে পারে না। এটাও আল্লাহপাকের হুকুমে হয়। আল্লাহপাকের সবদিকে খুব কঠিন নজর।
ক্ষিধে লাগছে বাপজান।
একবারতো শুনছি। এক কথা একশবার বলনে ফয়দা নাই। দিক করিস না।
মজিদ চুপ করে যায়। ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে খেলে। সুতা ধরে ঝুলিয়ে রাখে। ক্ষুদ্র প্রাণীটা ছটফট করে। মজিদ তাতে মজা পায়। কুদ্দুসও আরেকটা বিড়ি ধরায়। বিড়িটা ধরায় ক্ষিধা কমানোর জন্যে। বিড়ি সিগারেটের ধোয়া ক্ষিধার জন্যে বড় উপকারী। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, মনোয়ারা যদি খালি হাতে আসে। কি উপায় হবে? জমানো টাকা সে খরচ করবে না। বড়ই কঠিন মেয়ে। এই টাকায় সে রিকশা কিনবে। কে চালাবে তার রিকশা? কিছুই বলা যায়। না। হয়তো সে নিজেই চালাবে। বড়ই কঠিন মেয়ে। তার অসাধ্য কিছুই নাই। মেয়েটার এখন কিছুটা মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে। রোজগারের কোনো পথ দেখছে না। কুদ্দুসকে সে কিছু বলে না। কিন্তু সে বুঝতে পারে।
মনোয়ারা রাত নটার দিকে ফিরলো। মনোয়ারাকে দেখে কুদ্দুসের বুক ধক করে উঠলো। কারণ মনোয়ারার পেছনে ভদ্রলোক কিসিমের এক লোক। পরনে পায়জামা পাঞ্জাবি, হাতে রুমাল। নাকে চেপে ধরেছে। সেই লোক সন্দেহজনক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছে। খুক খুক করে কাশছে। এই দৃষ্টি, এই কাশি, নাকে চেপে ধরা এই রুমাল কুদ্দুস চিনে। সে বড় বিষণ্ণ বোধ করে।
কুদ্দুস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। বেহেশতে তার একটা সুন্দর সংসার হবে এটা সে ধরেই নিয়েছিল। মজিদ সরিফা আর তার স্ত্রী মনোয়ারাকে নিয়ে অতি সুন্দর সংসার। সেখানে ছবিঘর থাকলে মেয়েটাকে রোজ ছবি ঘরে নিয়ে যেত। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর চারজনে মিলে দাওয়ায় বসে গল্পগুজব। বেহেশতে নিশ্চয়ই চাঁদনি আছে। চাঁদনি পসরে গল্পগুজবের মজাই অন্য। এখন মনে হচ্ছে, বেহেশতের সেই সংসারে মনোয়ারার স্থান হবে না। রোজ হাশরে মনোয়ারা কঠিন বিপদে পড়বে। স্বামীর সুপারিশ সেদিন গ্রাহ্য হবে না। গ্রাহ্য হলে সে অবশ্যই বলতো, আল্লাহপাক, এই মেয়ে তার সংসার বড় ভালোবাসে। সে যা করেছে সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যেই করেছে। স্বামী হয়ে আমি তাকে ক্ষমা করেছি। তুমিও তাকে ক্ষমা করে দিও।
মনোয়ারা কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, আফনে মজিদরে লইয়া একটু ঘুইরা আহেন। কুদ্দুস মজিদকে কোলে তুলে নিল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে মনোয়ারা। তার দিকে তাকিয়ে বড় মায়া লাগে কুদ্দুসের। মজিদের হাতে ধরা সুতার মাথায় ইঁদুর ঝুলতে থাকে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় সে ইঁদুর বড়ই কাতর বোধ করে।