বাবারও একই কথা, ভূত, প্রেত, রাক্ষস, খোক্কস–এইসব মানুষের বানানো জিনিস। বুঝলে নীলু? শুধু বোকারাই এসব বিশ্বাস করে।
নীলু বলল, আজীজ চাচা কি বোকা?
না, সে বোকা নয়, সে একটা পাগল।
নীলু কিন্তু কারো কথাই বিশ্বাস করল না। পূর্ণিমার রাতে সত্যি সত্যি একটি ফুলের মালা গলায় দিয়ে বসল জানালার পাশে আর আপন মনে বলতে লাগল,
‘আকাশপরী আকাশপরী
কাঁদছে আমার মন
এসো তুমি আমার ঘরে
রইল নিমন্ত্রণ।’
নীলুর কাণ্ড দেখে বাসার সবার সেকী হাসাহাসি। মা ঠাট্টা করে বললেন, ডিমের পুডিং আছে ফ্রিজে। পরীরা আসলে খেতে দিস মনে করে।
কিন্তু নীলুর ভাগ্যটাই খারাপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন ঘুম পেতে লাগল তার যে বলার নয়। ঘুম ভাঙল ভোরবেলায়। রোদের আলোয় চিকমিক করছে। চারদিক। এত মন খারাপ হলো নীলুর যে বলবার নয়। মা এসে বললেন, কিরে নীলু, কী কথাবার্তা হলো পরীদের সঙ্গে?
নীলু চুপ করে রইল।
নাশতা খাওয়ার সময় বারা বললেন, তারপর নীলু মা, তোমার পরবন্ধুদের সঙ্গে কী আলাপ করলে, তা তো বললে না?
ছোট কাকু বললেন, সম্ভবত নীলুর সঙ্গে তাদের ঝগড়া হয়েছে। দেখছেন না,
নীলুর মন ভালো নেই!
সবাই হেসে উঠল হা হা করে। নীলুর কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। সে চুপি চুপি চলে এলো তার বাগানে। আর বাগানে পা দিয়েই সে অবাক। কত যে ফুল ফুটেছে বাগানে। তাহলে কি সত্যি আকাশপরীরা এসেছিল? সে দৌড়ে গেল আজীজ চাচা যে গাছটি দিয়েছিলেন সেখানে কী কাণ্ড! সেই গাছে বেগুনি আর নীল রঙে মেশানো অদ্ভুত একটি ফুল ফুটে রয়েছে। কী অপূর্ব তার গন্ধ! নীলুর নিমন্ত্রণে তাহলে এসেছিল তার আকাশপর বন্ধুরা। আনন্দে নীলুর চোখে জল এসে গেল।
একটি মামদো ভূতের গল্প
আজ নীলুর জন্মদিন।
জন্মদিনে খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে হয়। তাই নীলু সারা দিন খুব লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকল। ছোট কাকু তাকে রাগাবার জন্যে কতবার বললেন :
নীলু বড় বোকা
খায় শুধু পোকা
তবু নীলু একটুও রাগ কল না। শুধু হাসল। বাবা বললেন নীলু মা টেবিল থেকে আমার চশমাটা এনে দাও তো। নীলু দৌড়ে চশমা এনে দিল। হাত থেকে ফেলে দিল। কুলপি মালাইওয়ালা বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে হেঁকে ডাকল, চাই কুলপি মালাই। কিন্তু নীলু অন্য দিনের মতো বলল না, বাবা আমি কুলপি মালাই খাব–জন্মদিনে নিজ থেকে কিছু চাইতে নেই তো, তাই।
কিন্তু সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সবকিছু অন্যরকম হয়ে গেল। তখন নীলুর অঙ্ক স্যার এসেছেন, নীলু বইখাতা নিয়ে বসেছে মাত্র। পড়া শুরু হয়নি। নীলুর ছোট কাকু এসে বললেন, আজ তোমার পড়তে হবে না নীলু।
কেন কাকু?
তোমার মার খুব অসুখ। তুমি দোতলায় যাও।
নীলু দোতলায় উঠে দেখে চারদিক কেমন চুপচাপ। কালো ব্যাগ হাতে একজন ডাক্তার বসে আছেন বারান্দায়। নীলুর বাবা গম্ভীর হয়ে শুধু সিগারেট টানছেন। কিছুক্ষণ পর মস্ত গাড়ি করে একজন বুড়ো ডাক্তার এলেন। খুব রাগী চেহারা তার। এইসব দেখে নীলুর ভীষণ কান্না পেয়ে গেল। সে এখন বড় হয়েছে। বড় মেয়েদের কাঁদতে নেই, তবু সে কেঁদে ফেলল। বাবা বললেন, নীলু, নীচে যাও তো মা। কাঁদছ কেন বোকা মেয়ে? কিন্তু নীলুর এত খারাপ লাগছে যে না কেঁদে কী করবে? আজ ভোরবেলায়ও সে দেখেছে মার কিছু হয়নি। তাকে হাসতে হাসতে বলেছেন, জন্মদিনে এবার নীলুর কোনো উপহার কেনা হয়নি। কী মজা! কিন্তু নীলু জানে মা মিথ্যে বলছেন। সে দেখেছে বাবা সোনালি কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট এনে শেলফের উপর রেখেছেন। লাল ফিতে দিয়ে প্যাকেটটা বাধা। নীলু ছুঁয়ে দেখতে গেছে। বাবা চেঁচিয়ে বলেছেন এখন নয়, এখন নয়। রাত্রিবেলা দেখবে।
এর মধ্যে কী আছে বাবা? বলবে না, কার জন্যে এনেছ, আমার জন্যে?
তাও বলব না।
এই বলেই বাবা হাসতে শুরু করেছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে মাও। নীলু বুঝতে পেরেছে এখানেই লুকোনো তার জন্মদিনের উপহার। মা যদি ভালো থাকতেন তাহলে এতক্ষণে কী মজাটাই না হতো। ছাদে চেয়ার পেতে সবাই গোল হয়ে বসত। সবাই মিলে চা খেত, নীলু এমনিতে চা খায় না। কিন্তু জন্মদিন এলে মা তাকেও চা দিতেন। তারপর মা একটি গান করতেন। (মা যা সুন্দর গান করেন।), নীলু একটা ছড়া বলত। সবশেষে বাবা বলতেন, আমাদের আদরের মা, মৌটুসকী মা, টুনটুনি মার জন্মদিনে এই উপহার। এই বলে চুমু খেতেন নীলুর কপালে। আর নীলু হয়তো তখন আনন্দে কেঁদেই ফেলত। সোনালি কাগজে মোড়া প্যাকেটটি খুলত ধীরে ধীরে। সেই প্যাকেটে দেখত ভারি চমৎকার কোনো জিনিস!
কিন্তু মার হঠাৎ এমন অসুখ করল! নীলুর কিছু ভালো লাগছে না। ছোট। কাকু বললেন, এসো মা, আমরা ছাদে বসে গল্প করি।
উহুঁ।
লাল কমল নীল কমলের গল্প শুনবে না?
উহুঁ।
নীলু ফ্রকের হাতায় চোখ মুছতে লাগল।
একটু পরে এলেন বড় ফুফু। নীলু যে একা একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে তা দেখেও দেখলেন না। তরতর করে উঠে গেলেন দোতলায়। তখনই নীলু শুনল তার মা কাঁদছেন। খুব কাদছেন। মাকে এর আগে নীলু কখনো কাঁদতে শোনেনি। একবার মার হাত কেটে গেল বঁটিতে। কী রক্ত কিন্তু মা একটুও কাদেননি। নীলুকে বলেছেন, আমার হাত কেটেছে তুমি কেন কাঁদছ? বোকা মেয়ে।
আজ হঠাৎ করে তার কান্না শুনে ভীষণ ভয় করতে লাগল তার। ছোট কাকু বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন, নীলু তার কাছে যেতেই নীলুকে তিনি কোলে তুলে নিলেন। নীলু ফোপাতে ফোপাতে বলল, মার কী হয়েছে ছোট কাকু?