নীলু মুখ কালো করে বলল, আমার শুনতে ইচ্ছে করছে মা।
না, ভয়ের গল্প ছোটদের শুনতে নেই। তুমি ঘুমুতে যাও।
সেই গল্প শুনতে না পেয়ে নীলুর যে কী মন খারাপ হলো বলবার নয়। প্রায় কান্না পেয়ে গেল। সে অবশ্যি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে, যদি কিছু শোনা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে মায়ের গলার আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা গেল না। মা বলছেন, বলেন কী, সত্যি নাকি?
ওমা গো!
কী সর্বনাশ! আপনি কী করলেন?
সেদিন থেকে নীলু কতবার যে ভেবেছে, যেন আজীজ চাচা বেড়াতে এসেছেন। ঘরে আর কেউ নেই, শুধু সে একা। আর আজীজ চাচা এসেই শুরু করেছেন গল্প। কী দারুণ ভূতের গল্প।
ওমা, নীলুর কী ভাগ্য! সত্যি সত্যি একদিন এ রকম হলো। সেদিন ছিল সোমবার। সন্ধ্যাবেলা নীলুর বাবা আর মা গেলেন বেড়াতে, কোনো বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ। ফিরতে তাদের রাত হবে। নীলুর ছোট কাকু মাথাব্যথার জন্যে শুয়ে আছেন তার নিজের ঘরে। আর কী আশ্চর্য, নীলুর স্যারও আসেননি তাকে পড়াতে। নীলুর কিছু ভালো লাগছিল না। ভেবেই পাচ্ছিল না একা একা কী করবে। তখনই এলেন আজীজ চাচা। দরজার ওপাশ থেকে বললেন,
হাউ মাউ খাউ
নীলুর গন্ধ পাই।
নীলু আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তার সেকী চিৎকার, আজীজ চাচা এসেছেন, আজীজ চাচা এসেছেন!
কী রে নীলু বেটি, বাবা-মা কোথায়?
বাবা নেই, মা নেই, কেউ নেই। কিন্তু আপনি যেতে পারবেন না।
নীলু ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলল।
আজীজ চাচা হেসে বললেন, আমাকে বন্দি করে ফেললে যে নীলু মা? এখন। বলো বন্দির প্রতি কী আদেশ?
নীলু আজীজ চাচার হাত ধরে চেঁচাতে লাগল, গল্প বলুন। গল্প।
কিসের গল্প মা?
সব রকম গল্প। ভূতের গল্প, পরীর গল্প, ডাকাতের গল্প, শিকারের গল্প।
কী সর্বনাশ, এত গল্প! নীলু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, বাবার সঙ্গে যেমন গল্প করেন, সেই সব গল্প।
আজীজ চাচা হাসতে লাগলেন। নীলু বলল, তার আগে আপনার জন্যে চা। বানিয়ে আনি।
ওমা, নীলু বেটি আবার চা বানাতে পারে নাকি?
হ্যাঁ খুব পারি।
নীলু দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। তার চা অবিশ্যি বেশি ভালো হলো না। দুধ হয়ে গেল খুব বেশি। মিষ্টি হলো তার চেয়ে বেশি। তবু আজীজ চাচা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, চমৎকার! এত ভালো চা আমি সারা জীবনেও খাইনি!
এই বলেই তিনি গম্ভীর হয়ে দাড়িতে হাত বোলাতে লাগলেন। নীলু জানে এখন গল্প শুরু হবে। কারণ, আজীজ চাচা গল্প বলার আগে সব সময় গম্ভীর হয়ে দাড়িতে হাত বোলান।
বাংলাদেশের একজন অতি বড় লেখকের গল্প বলি, শোনো। তার নাম বিভূতিভূষণ।
সত্যি গল্প চাচা?
হ্যাঁ মা, সত্যি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল খুব ঘুরে বেড়ানোর শখ। একদিন ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলেন এক পুরনো রাজবাড়িতে। ভাঙা বাড়ি, দরজাজানালা ভেঙে পড়েছে। জনশূন্য পুরী। বাড়ির সামনের বাগানে আগাছা আর কাটা ঝোঁপের জঙ্গল। অবিশ্যি বাড়ির ডানপাশের পুকুরটি ভারি সুন্দর, টলটল করছে পানি শ্বেতপাথরের বাধানো ঘাট। সব মিলিয়ে অপূর্ব। তিনি সেই। বাধানো ঘাটে গিয়ে বসলেন। খুব জ্যোৎস্না হয়েছে–আলো হয়ে গেছে চারদিক। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ক্ৰমেক্রমে রাত বাড়তে লাগল। তিনি বসেই রইলেন। একসময় তার তন্দ্রার মতো হলো। আর ঠিক তক্ষুনি তার মনে হলো কে একটি মেয়ে যেন খিলখিল করে হেসে উঠেছে। তিনি চমকে চেয়ে দেখেন রাজবাড়ির বাগানে যে মার্বেল পাথরের পরীমূর্তিটি আছে, সেটি নড়তে শুরু করছে। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন। মূর্তিটি সত্যি সত্যি ডানা ঝাঁপটে খিলখিল করে হেসে উঠল। তিনি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, কে, কে ওখানে?
আমনি ডানা ঝাঁপটানো বন্ধ করে পরীটি আবার মার্বেল পাথরের মূর্তি হয়ে গেল। তার আর একা থাকার সাহস হলো না। তিনি চলে এলেন গ্রামে। গ্রামের লোক সবকিছু শুনে বলল, এ তো আমরা সবাই জানি বাবু। প্রতি পূর্ণিমা রাতে ঐ পরীটি প্রাণ পায়। নাচে গান করে। তার সঙ্গে নাচবার জন্যে আকাশ থেকে নেমে আসে আকাশপরীরা। আপনি আর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলে ওদের দেখতে পেতেন।
গল্প শেষ করে আজীজ চাচা বললেন, ভয় লাগছে নীলু?
হ্যাঁ। অল্প অল্প লাগছে।
তবে থাক আজ।
নীলু বলল, আমার খুব আকাশপরী দেখতে ইচ্ছে করছে। কী করলে আকাশপরী দেখা যায় চাচা?
আজীজ চাচা হাসিমুখে বললেন, খুব সহজ মা। পূর্ণিমা রাতে গলায় একটা ফুলের মালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় চাঁদের দিকে। আর মনে মনে বলতে হয়–
‘আকাশপর আকাশপরী
কাঁদছে আমার মন।
এসো তুমি আমার ঘরে
রইল নিমন্ত্রণ।’
শুধু এই? আর কিছু না?
না, শুধু এই।
আকাশপরীরা এসে কী করে চাচা?
ফুলের বাগানে হাতধরাধরি করে নাচে আর গান গায়। সেই গান শুনে বাগানের সব গাছে ফুল ফুটতে থাকে।
নীলু অবাক হয়ে বলল, চাচা, ওরা যদি আমার বাগানে আসে তাহলে আমার বাগানেও ফুল ফুটবে?
নিশ্চয়ই ফুটবে মা।
আর চাচা, আপনি যে গাছটি দিয়েছেন, একশ বছর পর ফুল ফুটে সে। গাছেও বেগুনি ফুল ফুটবে?
আজীজ চাচা ইতস্তত করে বললেন, ফোঁটাই তো উচিত।
নীলু আনন্দে হাততালি দিয়ে ফেলল।
এর পর থেকে বাড়ির মানুষ অস্থির। নীলু সবাইকে জ্বালিয়ে মারছে, কবে পূর্ণিমা হবে? কবে পূর্ণিমা হবে? এত দেরি কেন পূর্ণিমার?
মা রেগেমেগে অস্থির। নীলুকে বললেন, কী মাথামুণ্ডু বলেছে তোমার আজীজ চাচা, তাই বিশ্বাস করে বসে আছ। পরী আবার আছে নাকি পৃথিবীতে?