- বইয়ের নামঃ নীল হাতী
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ দিব্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আকাশপরী
নীলুদের বাসায় মাঝে মাঝে একজন হেডমাস্টার সাহেব বেড়াতে আসেন। তিনি নীলুর বাবার বন্ধু আজীজ সাহেব। হেডমাস্টাররা সাধারণত যে রকম হন, উনি কিন্তু মোটেই সে রকম নন। খুব হাসিখুশি স্বভাব। আর এমন মজার মজার ধাঁধা জিজ্ঞেস করেন নীলুকে, যে নীলু হেসেই বাচে না। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, বলো দেখি মা, তিন আর এক যোগ করলে কখন পাঁচ হয়?
নীলু ভেবেই পায় না। তিন আর এক যোগ করলে সব সময় চার হয়। পাঁচ আবার হবে কী করে?
কি পারলে না? ভেবে দেখো, কখন তিন আর এক যোগ করলে পাঁচ হয়। নীলু বলতে পারে না, শুধু মাথা চুলকায়। শেষে আজীজ চাচা হেসে বললেন, যখন অঙ্কে ভুল হয় তখনই তিন আর একে পাঁচ হয়। এই সহজ জিনিসও পারলে না বোকা মেয়ে ছিছি!
আরেক দিন বললেন, বলো দেখি মা কে ফর ফর করে ওড়ে।
কুট কুট করে কামড়ায়?
নীলু বলতে পারে না। আজীজ চাচা হা হা করে হেসে বলেন, পিপীলিকা! পিপীলিকা!!
নীলু অবাক হয়ে বলে,
পিপড়ের বুঝি পাখা থাকে? খুব থাকে। পড়েনি কবিতায়, পিপীলিকার পাখা হয় মরিবার তরে। তখন তারা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেন?
আজীজ চাচা গম্ভীর হয়ে বলেন, আগুন তখন তাদের ডেকে বলে, আমি কী সুন্দর আসো তোমরা আমার কাছে। ভয় কী ভাই। আজীজ চাচাকে নীলুদের বাসার সবাই খুব ভালোবাসেন। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন নীলুর বাবা। আজীজ সাহেব এসেছেন শুনলেই তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন–হেডু এসেছে, হেডু এসেছে, ও নীলু, তোর আজীজ চাচা এসেছে। বাসায় একটি হুলস্থল পড়ে যায়। মা একটা কেটলি চাপিয়ে দেন চুলায়। আজীজ চাচার আবার মিনিটে মিনিটে চা চাই কিনা!
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আজীজ চাচা পা তুলে আরাম করে বসেন সোফায়। দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে শুরু করেন গল্প। নীলু তো ছোট, কাজেই তাকে ভূতের গল্প শুনতে দেয়া হয় না।
নীলু শুনতে চাইলেই মা বলেন,
উহুঁ উহুঁ, তুমি যাও নীলু। অল্প বয়সে এসব গল্প শুনলে ছেলেমেয়ে ভীতু হয়।
আজীজ চাচা তখন তর্ক করেন, ভীতু হবে কেন ভাবি? আমি যে ছেলেবেলায় এত ভূতের গল্প শুনেছি, আমি কি ভীতু?
মা তবু রাজি হন না। ঘাড় বাকিয়ে বলেন, না না, নীলুর এসব গল্প শুনে কাজ নেই।
নীলুর খুব ইচ্ছে করে ভূতের গল্প শুনতে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কে আর তাকে গল্প শুনতে দেবে? এমন মন খারাপ লাগে তার, একেকবার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয়।
গল্প বলা ছাড়াও আজীজ চাচা মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব জিনিস নিয়ে আসেন। একবার নিয়ে এলেন হিজিবিজি লেখা কী একটা কাগজ। নীলুর মাকে বললেন, ভাবি, এই তাবিজটি বালিশের নীচে রেখে ঘুমুলে স্বপ্নে দেখবেন আকাশে পূর্ণচন্দ্র। আর সেই পূর্ণচন্দ্রের জ্যোৎস্নায় আকাশপরীর দল নাচছে আর গান গাইছে।
মা শুনে হেসেই বাঁচেন না। আজীজ চাচা রেগে গিয়ে বললেন, আপনার বিশ্বাস না হলে আজ মাথার নীচে রেখে ঘুমান। পরীক্ষা হয়ে যাক।
মা আঁতকে উঠে বললেন, সর্বনাশ, আমি নেই এর মধ্যে।
নীলু তখন থাকতে না পেরে বলল, আমাকে দিন চাচা। আমি পরী দেখব।
আজীজ চাচা নীলুকে দিতে যাচ্ছিলেন কাগজটা। কিন্তু মা তার আগেই ছো মেরে কাগজটা নিয়ে ফেলে দিলেন বাইরে। নীলুকে ধমক দিয়ে বললেন,
যা শুনবে তাই চাইবে, কী যে বাজে স্বভাব হয়েছে নীলুর।
আজীজ চাচা আরেকবার নিয়ে এলেন ছোট্ট একটা ফুলের গাছ। লম্বা লম্বা কালো তার পাতা। বাবাকে বললেন, এই নাও, সেনচুরিয়ান ফ্লাওয়ারের চারা। একশ বছর পর ফুল ফুটবে। অপূর্ব বেগুনি রঙের ফুল! অদ্ভুত সুন্দর।
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, তোমার ঐ বেগুনি ফুল দেখবার জন্যে একশ বছর কে বেঁচে থাকবে? উঠোনে দুদিন ধরে অযত্নে পড়ে রইল সেই ফুলের গাছ। তারপর নীলু সেই গাছটি যত্ন করে লাগাল তার বাগানে। নীলু যদি একশ বছরেরও বেশি দিন বাচে, তাহলে সে দেখবে বেগুনি ফুল।
এই জন্যেই আজীজ চাচাকে এত ভালো লাগে নীলুর। তা ছাড়া মাঝে মাঝে তিনি শিকারের গল্পও করেন। সেইসব গল্প নীলুকে শুনতে দেয়া হয়। একটা গল্পের কথা নীলুর খুব মনে পড়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে রামু পাহাড়ের কাছে একবার একটা ছাগল চরছিল। ছাগলটা দড়ি দিয়ে বাধা। তার পাশেই প্রকাণ্ড একটা গাছ। জায়গাটা জংলামতো। হঠাৎ দেখা গেল মস্ত একটা সাপ গাছের ডালে লেজ জড়িয়ে দোল খেতে শুরু করেছে। সাপটিকে দেখেই ছাগলটি ছটফট করতে শুরু করল। দড়ি ছিঁড়ে পালিয়ে যাবার তার কী চেষ্টা সাপটি দোল খেতে খেতে একেবারে ছাগলটির খুব কাছে চলে এলো। আর অমনি ছাগলটি চুপ। সাপটি প্রকাণ্ড বড় হা করে তাকিয়ে রইল ছাগলটির দিকে। ছাগলটির নড়বার শক্তি যেন আর নেই। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল হা করা সাপের দিকে।
গল্প শুনে নীলু ভয়ে বাঁচে না। আজীজ চাচা বললেন, সাপ খুব সহজেই হিপনটাইজ করতে পারে।
আজীজ চাচার কথা শুনে বাবা বললেন, যত আজগুবি গল্প। তোমার। সাপ আবার হিপনটাইজ করবে কী?
আজীজ চাচা খানিকক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, এই গল্পে তোমার বিশ্বাস হলো না। বেশ, আমার নিজের জীবনের গল্প বলি, শোনো। কিসের গল্প, ভূতের নাকি?
ঠিক ভূতের না হলেও ভূতের।
সঙ্গে সঙ্গে মা বললেন, নীলু মা, তোমার এসব গল্প শুনে কাজ নেই। যাও, ঘুমুতে যাও।