O-r-o-o-n অর O-r-u-n? অরুণ তখন বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে বলেছিল, কোনোটাই না। ওটা A-r-u-n। আর যখন অরু লিখবে লিখো A-r-u, ক্লিয়ার?
কথাটা মনে পড়তে অরুণের একটু হাসি পেল। হঠাৎ পাশ থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল— হাসছ? এনিথিং ফানি?
অরুণ চমকে উঠে ওপরে চাইতে দেখল আলো-আঁধারির মধ্যে একটা ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ডরোথি। বলিরেখায় বলিরেখায় সুন্দর মুখটা কাহিল হয়ে আছে। কাঁচার সঙ্গে পাকা মিশে কেমন ধূসর একটা বর্ণ হয়েছে কোঁকড়া চুলে। গায়ের হালকা নীল গাউনটারও বয়স হয়েছে। পায়ের কার্পেট স্লিপারটার তো এখনই অবসর নেওয়া উচিত। শুধু এই বয়সেও এই চেহারাতেও ডরোথির সেই রুপোলি হাসি-সুকের ভাষায় ডর’স সিলভার স্মাইল এখনও যে-কে-সেই।
অরুণ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ডরোথি, তুমি আজও এত সুন্দর হাসতে পার? তারপর এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো ধরে বলল, কত বছর হল বলো তো?
ডরোথি অরুণকে আপাদমস্তক নজর করে কীরকম স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করল, তুমিও কত বড়ো হয়ে গেলে অরু?
অরুণ একটু অন্যমনস্ক হয়ে ভাবতে লাগল সেইসব দিনগুলোর কথা যখন এক তীক্ষ্ণ বিদ্যুতের মতো এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়েটি মিন্টো রো দিয়ে হেঁটে যেত সারাপাড়াকে স্তব্ধ করে। ও রাস্তার মোড় বাঁকলে হয়তো ফের গুঞ্জন শুরু হত ওকে নিয়ে, কিন্তু যতক্ষণ ও দৃষ্টির মধ্যে ততক্ষণ মানুষ কীরকম নির্বাক।
সিঁড়ি, বারান্দা বা ছাদ থেকে ডরোথিকে দেখলে ওই বালকবয়সেও একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যেত অরুণও। সেই দৃশ্য আজও ভোলার নয়। ভোলার নয় আঁতোয়ান সুকের শেষ চলে যাওয়ার দৃশ্যটাও। গ্রীষ্মের মাঝদুপুরে, কাঠফাটা রোদুরে একটা ট্যাক্সির ডিকিতে সুক এক এক করে দুটো সুটকেস তুলল; কী মনে করে রাস্তার এপ্রান্তে ওপ্রান্তে দু-বার চোখ চালাল, পকেট থেকে বার করে একটা চারমিনার ধরাল, তারপর নিজেদের ফ্ল্যাটটার দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইল, শেষে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কী একটা বলে পিছনের সিটে গা এলিয়ে বসল।
আসলে ডরোথিকে দেখবে বলেই এই বিশ্রী গরমেও ছাদে এসে আলসেতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল অরু। ভাগ্যিস ওদের বাড়ির গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে ঢ্যাঙা লম্বা বেনেবাড়িটা, যার লম্বা ছায়াতে ওদের ছাদ এখন রোদ থেকে গা বাঁচাচ্ছে! একটা নিরাপদ দূরত্ব আর ছায়া থেকে সারাপাড়ার চেহারা দেখে দেখে লম্বা দুপুর কেটে যায় অরুর। মিসেস স্মিথ, মিসেস হোয়াইট ও মিসেস সালদানা-র কেক-প্যাটিজের পেল্লায় বাক্স নিয়ে ফেরিওয়ালা হাঁক দিলে ডরোথি গোটা একটা থালা হাতে বেরিয়ে আসে, কখনো-সখনো সঙ্গে সুকও। তখন ছাদ থেকে অরু হাঁক তোলে—আমিও আছি, ডর।
কেক-প্যাটিজ তো বটেই, ছাদে দাঁড়ানোর বড়ো টান ডরোথির নিজেরও। ওকে দেখেও চোখের আশ মেটে না। চন্দন বলছিল সেদিন, এ তেষ্টাটা তোর চোখের নয়, মনের। সেটা বুঝিস তুই?
সুকের ট্যাক্সি মৌলালির বাঁকে উধাও হতেই খালি পায়ে দুদ্দাড় করে রাস্তা অবধি ছুটে এল ডরোথি। একবার এধার, একবার ওধার চোখ চালিয়ে দেখল সব শুনশান। একটা দীর্ঘশ্বাসই ফেলল বুঝি নীচের দিকে তাকিয়ে। তারপর সিমেন্টের থামটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল স্কুলের বাচ্চা মেয়েদের মতো।
বাচ্চা মেয়েদের মতোই একটা সূর্যমুখী হলুদ হাতকাটা গেঞ্জি ওর পরনে। স্কার্টের জায়গায় ছোট্ট নীল হাফপ্যান্ট। যে পোশাকে ওকে দেখলে পাড়ার বয়স্করা একটাই শব্দ উচ্চারণ করেন,
–অসভ্য!
তার ওপর খালি পা।
চাপা রঙের সুন্দরীটির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে দাঁড়িয়েছিল অরু। ওর মনে হল চন্দন কথাটা মিথ্যে বলেনি—ডরোথিকে দেখার তেষ্টাটা ওর চোখের নয়।
ঠিক তক্ষুনি চোখের জল মুছল ডরোথি।
ধড়াস করে উঠেছিল অরুর বুক, ডরোথি কাঁদছে?
কী এক নিশির টানে ছাদ থেকে নেমে গুটি গুটি বাড়ির গেট পেরিয়ে ওপারের বাড়ির থামে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ডরোথির পাশে গিয়ে দাঁড়াল অরু। কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ডর?
হাত দিয়ে চোখ চাপা ছিল ডরোথির। সে হাত না সরিয়েই বলল, টোনি আমায় ছেড়ে চলে গেল।
ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য খুব বিজ্ঞের মতো বলেছিল অরু, সে তো কতবারই তোমায় ছেড়ে গেল আর ফিরে এল। এ নিয়ে ভাবছ কেন? আজ তো শনিবার, দেখো, সামনের শনিবারে ফিরে এল বলে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ থেকে হাত নামিয়ে ডরোথি বলল, মনে হয় না। এবার একটা ভয়ে দুরু দুরু কাঁপতে লাগল অরুর বুক আর ঠোঁট, কে.কে…কেন?
তখন হঠাৎ একটা বিকট কান্নায় ভেঙে পড়ে ডরোথি বাড়ির ভেতরে ছুটল মুখে শুধু একটাই কথা—আমি জানি না! আমি কিছু জানি না!
কীরকম বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে অরু, একবার ভাবল ভেতরে গিয়ে দুটো-একটা সান্ত্বনার কথা বলে ডরোথিকে, পরক্ষণেই মনে পড়ল কাকে নিয়ে যেন বেদম ঝামেলা সুক-ডরোথির মধ্যে হপ্তা দুয়েক আগে। অরু আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এল।
আজও ডরোথির পাড়া বেয়ে হেঁটে যাওয়ার মতো সুকের সেই চলে যাওয়াটা ভর করে আছে অরুণের মনে। ওর মনে পড়ল বার বার চেষ্টা করেও ওদের শেষ ঝগড়া নিয়ে মুখ খোলাতে পারেনি ডরোথির।
যখনই অরুণ জিজ্ঞেস করেছে, হোয়াট রিয়েলি হ্যাপেনড, ডর? ডরোথি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেছে, না, না, তুমি বড্ড বাচ্চা। তুমি কিসসু বুঝবে না।