লেনার্ড আরও উপরে ছুড়ে দিল ছুরিটা। বনবন করে পাক খেতে খেতে ছুরি উঠল উপরে। লেনার্ড চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল মাটিতে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছি আমিও। খানিক পরে ফটাস আওয়াজ করে ছুরি পড়ল চোখ বুজে পড়ে থাকা লেনার্ডের গলার একসুতো দূরে।
লেনার্ড তখনও চোখ খোলার সময় পায়নি, আমি ছুট্টে গিয়ে ছুরিটা কুড়িয়ে ছুড়ে দিলাম ছাদ থেকে অনেকদূরে পারসিবাড়ির বাগানে। লেনার্ড বলে উঠল, এ কী করলে? এ কী করলে, ডিপু? খেলাটা নষ্ট করে দিলে।
আমি ফিরে এসে নীচু হয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, দ্যাটস ও-কে লেনি। লেনি, আই লাভ ইউ! আমার কিছু মনে নেই, সে-দিন কী ঘটেছিল। নো কোয়েশ্চেন অব ফরগিভিং, আই সিম্পলি লাভ ইউ। তুমি যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে যাব লরাকে ফিরিয়ে আনতে। তুমি প্লিজ আর কখনো ছুরি খেলো না।
আমার চোখের জল পড়েছে লেনার্ডের কপালে। ও আমার মুখটা ধরে কপালে চুমু দিল। চাঁদের আলোয় পাগলটাকে এখন আমার লরার মতো নিস্পাপ মনে হচ্ছে।
একবুক ক্লান্তির সঙ্গে লেনার্ড বলল, আহ, স্লিপ! কতদিন ঘুমোইনি…
ও ঘুমিয়ে পড়ল। আমি ওর পকেটে হাত গলিয়ে ওর নিজের ওই রক্তচোষা ভয়ংকর ছুরিটা বার করে চাঁদ লক্ষ করে আকাশে ছুড়ে দিলাম…
বুঝতে পারলাম না সেটা আর মাটিতে ফিরে এল কি না আদৌ।
আঁতোয়ান সুকের ডায়েরি
এতখানি বুড়িয়ে গেছে বাড়িটা অ্যাদ্দিনে? কীরকম, কীরকম শুকিয়ে ছোটো হয়ে গেছে কি? ‘১৯’ লেখা নীল-সাদা এনামেলের সাইনটাই বা কোথায় গেল? ফ্ল্যাটের দরজার সামনের স্পেসটাতেও কেমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। দরজার গায়ে কলিং বেল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অরুণ অগত্যা ঠক ঠক করে আওয়াজ করল দরজায়। তারপর দরজা থেকে একটু পিছিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অন্ধকারে।
কিন্তু কোথায় কে? দরজা খোলা দূরে থাক ভেতরে কোনো গলা বা নড়াচড়ার আওয়াজও নেই। ডরোথি কিন্তু ফোনে বলেছিল, আই উইল ওয়েট ফর ইউ ফ্রম সিক্স। আর এখন তো প্রায় সাড়ে ছটা।
অরুণ ফের এগিয়ে নক করল দু-বার। একটু থেমে আরও দু-বার, শেষের বারটা একটু ধাক্কার চালে। অমনি কোঁ কোঁ ক্যাঁচ ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দরজাটা হাট করে খুলে গেল। অরুণ দেখল কমলা রঙের সিল্কের শেডের হল ল্যাম্পের আলোয় মনোরম এক আলস্যের মধ্যে শুয়ে আছে ডরোথির বসার ঘর।
দু-পা ভেতরে ঢুকে অরুণ দেখল ঘরে কেউ নেই। এক মলিন, ধ্বস্ত চেহারা ঘরের। পোড়া সিগারেটের গন্ধে ম ম করছে। রেডিয়োগ্রামে একটা রেকর্ড চাপানো আছে সেই কবে থেকে কে জানে। সে রেকর্ডেও ধুলো পড়েছে। ডালাটা হাঁ করে খোলা।
অরুণের চোখ গেল কোণের ভেঙে পড়া রেকর্ডের তাকটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে গুনগুনোতে লাগল ছেলেবেলার এই ঘরে বসেই শোনা সেই সব গান, সেই সব কণ্ঠ। ন্যাট কিং কোল, বিং ক্রসবি, ফ্রাঙ্ক সিনাট্রা, এলভিস প্রিসলে, পল অ্যাঙ্কা, জিম রিভস, প্যাট বুন…
সব রেকর্ডেই ধুলোর জামা, মেঝের লাল কার্পেটে ঝাঁট পড়েনি বহুকাল। অরুণ দেওয়ালে সুইচ খুঁজে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে একটা সোফায় বসল। কিন্তু বসার জায়গা করতে সোফা থেকে একটা এলপি ডিস্ক সরিয়ে পাশে রাখতে হল। ডিস্কটা তুলতে তার কভারে দেখল হাসি-হাসি মুখের ইভ মত; পাশে ঝাপসা হয়ে আসা কলমের আঁচড়—’টু ডিয়ারেস্ট ডর, উইথ আ কিস–টোনি।
কোনো তারিখ নেই বলে ভাবতে বসল ঠিক কবেকার উপহার হতে পারে রেকর্ডটা। মনের মধ্যে বছরগুলো কীরকম তালগোল পাকিয়ে গেল। এটা..এটা কি তাহলে ডরোথিকে দেওয়া আঁতোয়ান সুকের শেষ উপহার?
ডিস্কটা বাজাবার একটা চাড় হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু অরুণের এই ধারণাও ছিল যে, ধূলিধূসর ওই রেডিয়োগ্রাম থেকে আর কোনোদিনও কোনো ধ্বনি ফুটবে না। রেকর্ডটা পাশের সাইডটেবিলে শোয়াতে গিয়ে ওর চোখ পড়ল পাঁচ-পাঁচটা লাল রেক্সিন বাঁধাই সুকের সেই ডায়েরি। যার জন্য অরুণের এই আসা, ডরোথির এই আমন্ত্রণ। ঈশ্বর জানেন কী হিরেমানিক আছে ওর মধ্যে, কিন্তু ছেলেবেলায় সুকের কলমে রোজ একটু একটু করে জিনিসটাকে ফলে উঠতে দেখেছে ও। সেদিন ফোনে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলেছিল ডরোথি—এটা শুধু টোনির একার কথা নয়। এতে আমরা সব্বাই—আমি, তুমি, লোরেন, মার্নি, রিটা, ডুলু, মাম্পু সবাই আছি। ইটস লাইক আ হিউজ লাভলেটার। সত্যি একটা প্রেমের চিঠি। তোমায় পড়তেই হবে এটা, অরু। আর তারপর, তুমি তো লেখক, একটা লাভ স্টোরি লিখো আমাদের নিয়ে।
অরুণ বলেছিল, কিন্তু সেই প্রেমের গল্পটা তো খুব করুণই হবে, ডরোথি।
হোক না।–ওপার থেকে গলা ভেসে এসেছিল মহিলার। সব সত্যিকারের প্রেমের গল্প চোখের জলে শেষ হয়। তুমি লেখক, তুমি জান না চোখের জল কত মিষ্টি হয় যদি সেভাবে কাঁদতে পার?
ঠিক আছে, আমি আসব বলে ফোন নামিয়ে রেখেছিল অরুণ। আর এখন সেই ডায়েরিগুলোর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ও ভাবতে বসল, সত্যিই তো! এইসব ডায়েরি ও কোন কাজে লাগাতে পারবে। কয়েকটা প্রবন্ধ? হারিয়ে যাওয়া অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের সমাজচিত্র? লেট-ফিফটিজ আর আর্লি-সিক্সটিজের একটু কলকাতা? হারিয়ে যাওয়া মিন্টো রো, মিন্টো লেন? নাকি অদ্ভুতচরিত্র অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান পুরুষের মনের আগড়াম-বাগড়াম?
অরুণ আনমনে একদম ওপরের ডায়েরিটা তুলে নিয়ে, সে জায়গায় ইভ মত-র রেকর্ডটা রেখে ডায়েরির পাতা ওলটাতে লাগল। লম্বা-চওড়া ডায়েরির পাতায় সুকের হাতের লেখার স্মৃতি ওর একেবারে মুছে যায়নি, ওর মনে আছে সুকের বেশ মুশকিল হত পল্লির বাঙালিদের নামের বাংলা বানান লিখতে। একবার অরুণকেই জিজ্ঞেস করেছিল, অরু, হাউ ডু ইউ স্পেল ইয়োর নেম?