ইতিমধ্যে বারকয়েক দেখা হয়েছে সিরিলের সঙ্গে। ওর শুধু এককথা লেনিকে ক্ষমা করে দাও। ও পাগল, কিন্তু মানুষ খারাপ নয়।
যেদিন ট্রামস্টপে দাঁড়িয়ে ফের এটা বলল ও, পাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠল মার্লিন, খারাপ না মানে? মানুষ এর থেকে কত খারাপ হবে? সঙ্গে সঙ্গে চুপ মেরে গেল সিরিল।
আর কাল যেই বড়ো রাস্তার মুখে একই গাওনা শুরু করল ও, আমি পরিষ্কার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত সব বলো কেন রোজ? আই অ্যাম ওল্ড এনাফ টু আণ্ডারস্ট্যাণ্ড অল দিস। আর তুমি যদি জানতে চাও তো শোনো—লরা কোনো দিনও তোমায় পছন্দ করেনি।
দপ করে নিভে গিয়েছিল সিরিলের মুখটা। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মরা গলায় বলল, জানি আমি জানি।
–তা হলে?
—আসলে কী জানো, লেনি ছাড়া জগতে আমার কোনো বন্ধু নেই। আর প্রেমে পড়লাম তো ওরই বউয়ের প্রেমে পড়লাম। কত ছুরির আঁচড় যে মেয়েটা খেয়ে গেল আমার জন্য। গা দিয়ে রক্ত পড়ছে, কিন্তু কোনো দিনই ডাকেনি আমাকে বা মার্লিনকে। দেখতাম ডেটল নিয়ে তুমিই ছুটছ।
বললাম, তার যথেষ্ট মূল্যও পেয়ে গেছি সে-দিন।
সিরিল আমার কাঁধে হাত রাখল, অথচ জানো, তোমাকে ও ওভাবে ডাকছে দেখলে হিংসে হত আমার। ভাবতাম একদিন চারপাশে কোথাও তুমি থাকবে না, ও আমায় ডেকে ফেলবে নিরুপায় হয়ে। ডাকেনি। আর…
সিরিল একটু চুপ করে ছিল, আমি খোঁচালাম আর?
—আর মেয়েটা চলেও গেল তোমার জন্য। লেনিকে সেদিন রাতেই বলেছিল, ইউ হ্যাভ অ্যাবিউজড আ নাইস, ইনোসেন্ট বয়। আমি তোমার সঙ্গে আর থাকতে পারি না।
আমার বুকটা কীরকম কাঁপল হঠাৎ। বললাম, কিন্তু ও গেছে কোথায়?
সিরিল বলল, শুনেছি খড়গপুরে বোনের বাড়িতে।
—ফিরবে না?
—ফিরবে? আনবেটা কে?
–কেন, লেনার্ড!
সিরিল হাসল, ওর অবস্থা কী হয়েছে জানো? সেই থেকে ও মদ আর সিগারেটের উপর আছে। ও খায় না, ঘুমোয় না, কাজে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। ওর চাকরিটা হয়তো চলেই যাবে।
তাই! —জীবনে এই প্রথম লেনার্ডের জন্য একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুল আমার।
সিরিল বলল, তাও প্রথম প্রথম বলত তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে যাবে। এখন তো ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে, ওর সাড়াশব্দও বন্ধ হয়ে গেছে। পাশের ফ্ল্যাটে থাকে, তবু খবর নেওয়ার উপায় নেই।
-কেন?
—কারণ মার্লিন বলে হি ডিজার্ভজ টু বি লেফট অ্যালোন।
–তুমি তাই করছ তা হলে?
সিরিল প্রতিবাদ করল, না। আমি গতকাল ওর ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে ওকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বেশ ক-টা চড় কষিয়েছি গালে-–সোয়াইন! তুমি লরাকে সন্দেহ করো। তুমি জানো কী ধাতুতে তৈরি মেয়েটা? শি ইজ অ্যান অ্যাঞ্জেল, ইউ ব্লাডি ফুল! যাও গিয়ে ফিরিয়ে আনো ওকে। আর ক্ষমা চাও গিয়ে ডিপুর কাছে।
আমি সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেছি।… কেন, ক্ষমা চাইবে কেন আমার কাছে?
আমার তো কোনো অধিকার নেই ওর বউয়ের শরীরে ওষুধ লাগানোর! তুমি সহ্য করতে মার্লিন আর আমাকে ওভাবে দেখলে?
সিরিল স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলল, ইউ মিন ইট? ইউ রিয়েলি মিন ইট? ও তোমার মনের কথা?
আমি পকেট থেকে ছুরিটা বার করে ওর সামনে ধরলাম—যেদিন ব্যাপারটা ঘটল আমি এই ছুরি পকেটে ভরেছিলাম। ভেবেছিলাম লরাকে দিয়ে বলব, একবার অন্তত ওকে মারো, রক্ত বার করো। কিন্তু…
—কিন্তু?
—কিন্তু এখন মনে হয় লরা এটা চাইত না। ও অবাক হত আমার কথা শুনে।
-কেন?
আমার গলা জড়িয়ে আসছিল, বুকে একটা চাপা ব্যথা হচ্ছিল। কোনো মতে বলতে পারলাম, ও যে লেনার্ডের ছুরির কাঁটা-ছেড়াকে ভালোবাসার চিহ্ন ভাবত। লাভ মার্কস।
আমি ফের ছুরিটাকে দেখতে লাগলাম চাঁদের আলোয়। আধখাওয়া চাঁদের আলোতেও ছুরি বেশ হিংস্র। আমি আস্তে আস্তে বাঁ-হাতের কবজির কাছে ব্লেডটা বুলোলাম আর শিউরে উঠলাম ‘উঃ! আর চমকে দেখি আমার পাশে নিঃশব্দে প্রেতাত্মার মতো এসে দাঁড়িয়েছে লেনার্ড।
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, লেনার্ড! তুমি!
লেনার্ড আমার হাত থেকে ছুরিটা আস্তে করে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, এটা খেলার জিনিস নয়, ডিপু। এ সব আমার মতো খারাপ লোকদের কাছে থাকাই ভালো।
ও আস্তে করে ছুরিটা বন্ধ করে নিজের পকেটে রাখল। আমি অবাক হয়ে ওকে দেখছিলাম। রোগা ফরসা শরীরটা তামাটে মেরে গেছে। চোখের তলায় গর্ত, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর সারাহাতে সরু সরু আঁচড়।
আমি শিউরে উঠেছি—এ তোমার কী দশা, লেনার্ড? আর ইউ ও-কে?
ক্লান্ত হাসি হাসল লেনার্ড। পটপট করে জামাটা খুলে ফেলল। সারাগায়ে ছুরির দাগ। ঠিক যেমন ভরা লরার দেহ। বলল, আর ইউ হ্যাপি নাও, ডিপু?
বললাম, এতে খুশি হওয়ার কী আছে? আমি তো ড্রাকুলা নই।
লেনার্ড বলল, তুমি রিভেঞ্জ, বদলা চাও না? বললাম, না।
—আমি কিন্তু পেনান্সে, প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাসী।
–তোমার প্রায়শ্চিত্তের ধরনটা ভালো না।
–আমার ভালোবাসার ধরনটাও কি ভালো?
আমি চুপ করে গেলাম। ও কাছে এসে পকেট থেকে ছুরিটা বার করে বলল, জাস্ট টু শো হাও মাচ আই লাইক ইউ, ডিপু। তারপর কড়াৎ করে ছুরিটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল নীচে। ছুরি এসে ওর ঘাড় ঘেঁষে মাটিতে গোত্তা খেল। আমি বললাম, এটা কী হচ্ছে লেনার্ড?
লেনার্ড এবার আরও উঁচুতে ছুড়ে দিয়েছে ছুরিটা। আমি ছুরিটা দেখতে গিয়ে আধখাওয়া অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান চাঁদটাও দেখে ফেললাম। এবার ছুরি এসে পড়ল ওর কোমরের পাশে। আমি চিৎকার করলাম, লেনি, স্টপ ইট!