আমি এও শুনছি দূর থেকে লরা চেঁচাচ্ছে, লেনি, ইউ কান্ট ডু কিস টু হিম। লেনি, ও একটা বালক মাত্র। লেট হিম গো!
এ যে কতক্ষণ চলেছিল আর কোনো দিন আমার মনে পড়বে না। যখন সংবিৎ ফিরল দেখি খাটে শুয়ে লেনার্ড ওর ছুরিটা শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছে আর সেটা বুকে পড়ার আগে লুফছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে লরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আর আমার সারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছে মরা বৃষ্টির মতো। বাড়ি ফিরে এসে স্নানঘরে ঢুকে গায়ে প্রথম জলটা ঢালার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ফেটে ভুলে যাওয়া কান্নাটা বেরোতে শুরু করল।
সেই রাতে বাড়ির সবাই দল করে উত্তম-সুচিত্রার ‘সপ্তপদী’ দেখতে বেরুচ্ছিল; আমি বললাম, তোমরা যাও, আমার পড়া আছে।
পড়া ঘোড়াই ছিল, ছিল বোঝাপড়া। আমি সন্ধ্যে হতেই টুকটুক করে উদ্ধার করলাম বিশের ছুরিটা পায়রার খোপ থেকে। একট ন্যাকড়া জোগাড় করে ঝাড়লাম সেটা, তারপর ওর ভোলা ফলায় চুমু খেয়ে শপথ নিলাম, লেনার্ড, দিস ইজ ফর ইউ। এই রইল তোমার জন্য, লেনার্ড।
কিন্তু না, লরাকে আমি বাঁচাতে পারিনি। ও নিজেই পালিয়ে বেঁচেছে। আমার আর চুপি চুপি ওর হাতে ছুরি গুঁজে দিয়ে বলা হল না, সারাগায়ে তোমার ছুরির দাগ এঁকেছে লেনার্ড। একবার শুধু এইটা দিয়ে ওর বুকের কোথাও একটা দাগ কমো, আমি দেখতে চাই।
না, না, ওই দৃশ্যটা আমি ভাবতে চাই না আর। শেষ অবধি লেনার্ড আমার শরীর নিয়ে কী করেছে আমি জানতেও পারিনি, কিন্তু লরার বুকের মাঝ মধ্যিখানে ওই সরু রক্তের নালি!
ফের সেই ডাক শুনেছিলাম জানালা থেকে, ডিপু, রাশ! আই’ম ডাইং।
আমি দৌড়ে উঠে গিয়ে দেখি নীল স্কার্টের উপর পাতলা সাদা ব্লাউজে ঠক ঠক করে কাঁপছে লরা। বলল, ওই ডেটলটা শিগগির নিয়ে এসো। বলেই বেডরুমে ঢুকে গেল। আমি ডেটল, বেঞ্জিন, তুলো নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি মেয়েটা ব্লাউজ ছেড়ে খালি গায়ে খাটের উপর বসে। আমায় বুকের মাঝখানটা দেখিয়ে বলল, আজ ও এখানেও ছুরি বোলাল।
আমি থমকে দাঁড়িয়ে দেখি ডেটল তুলো নিয়ে। আমি একটা নগ্ন মেয়ের গায়ে হাত দেব কেন? এ তো অসভ্যতা। এই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখাটাও পাপ।
আমি লরার সামনে ডেটল রেখে পিছন ঘুরে বললাম, নো, লরা, আই কান্ট টাচ ইউ। ইটস নট ডান।
আমার তখন মনে পড়ছে কাকার কথা কিছুদিন আগে। মাকে বলছিল আমায় ফিরতে দেরি দেখে—জানো বউদি, শেষমেষ ঠিকই করলাম দিপুকে বোর্ডিঙে পাঠিয়ে দেব। তোমার কষ্ট হবে জানি। কিন্তু দাদা থাকলে সেও এটাই চাইত। এই সব অ্যাংলো-ফ্যাংলোদের সঙ্গে ওর এত মেশামিশি ঠিক না। ওদের তো চরিত্র বলে কোনো বস্তু নেই।
আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুপ মেরে শুনছিলাম।
লরার থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে কাকার কথাটাই ভাবছিলাম। টের পেলাম লরা শিশি খুলে ডেটলে তুলো ভিজিয়ে বুকে ঘষছে। ওর ঠোঁট গলে মাঝে মাঝেই ‘উঃ!’ ‘আঃ!’ শব্দ হচ্ছে। একবার বলল, হতচ্ছাড়া সিরিলটা বলে তোমার গায়ে ওষুধ দিতে আমায় ডাকো না কেন?’ স্কাউন্ডেল।
ও কেন বলেছিল এই কথাটা? আমাকে চটাতে? নাকি, আমি যাতে সিরিলকে ডেকে আনি? আমি বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝলাম ওভাবে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা অমানুষের কাজ। তা হলে ডাক শুনে রাস্তা ডিঙিয়ে ছুটে এসেছিলাম কেন?
আমি ঘুরে গিয়েছিলাম লরার দিকে। বললাম, দাও, আমি ওষুধ বুলিয়ে দিচ্ছি। নারীর বুক কত গভীর আমি জানিনি কোনোদিন। মার বুকে মুখ লুকিয়ে তো কত কাঁদি কতদিন। কিন্তু এ কেমন শিহরণ ঠাকুর! আমি কি খারাপ হচ্ছে যাচ্ছি?
কত কথা বলছে লরা, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ব্যথার মধ্যে ও গানও গাইছে। ন্যাট কিং কোলের ফ্যাসিনেশন’। আর লক্ষ লক্ষ অচেনা অনুভূতির মধ্যে, অজ্ঞাত শিহরণের মধ্যে আবছা আবছা ভাবে আমি বুঝতে শিখছি সিরিল কেন কথায় কথায় আমায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, ইউ থিঙ্ক লরা লাভজ লেনার্ড?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, ইয়েস! ইয়েস! ইয়েস!
ও ঘাবড়ে গিয়ে বলে, এত গলাবাজি করে বলার কী আছে? তখন ওর ওই বদ প্রশ্ন থামানোর জন্য আমি বলি, কারণ আমি জানি।
ও মুখ বিকৃত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, শিট! আর এখন লরার খালি গায়ে ওষুধ বোলাতে বোলাতে আমি কেনই জানি না জিজ্ঞেস করে বসালাম, লরা, ডু ইউ লাইক সিরিল?
লরা গান থামিয়ে গিয়ে ওর সুন্দর ভুরু দুটো ধনুকের মতো বাঁকিয়ে তুলে বলল, হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করলে কেন?
আমার সত্যিই তো কোনো কারণ ছিল না এটা জিজ্ঞেস করার। তাই চট করে একটা মনগড়া কারণ ফাঁদলাম, কারণ ও তোমার খুব পছন্দ করে।
–করুক গে! ওকে বোলো ওই পছন্দটাক যেন মার্লিনের উপরে খরচ করে।
—আর লেনার্ডকে? ডু ইউ লাভ হিম?
লম্বা একটা শ্বাস ফেলল লরা। হ্যাঁ, না কী বলবে বলে চোখ বন্ধ করল, আর ঠিক তক্ষুনি দড়াম করে বেডরুমের দরজায় লাথি মেরে ঘরে ঢুকল লেনার্ড ম্যাসি। ভগবান জানেন কেন, ঠিক সেই লহমায়, আমার তুলোধরা আঙুলগুলো থমকে দাঁড়িয়েছে লরার বুকে।
সো হোয়াটস দ্য গ্রেট হিয়র দিস আফটারনুন?—লেনার্ড হাতভর্তি মদ আর খাবার রাখল মেঝেতে। লরা ওর ব্লাউজটা গায়ে চড়াতে যাচ্ছিল, লেনার্ড সেটা খামচে নিয়ে ছুড়ে দিল মাটিতে।
তারপর…
তারপর তো আমার আর কিছুই মনে পড়ে না। যখনই ভাবি ওই দৃশ্য—লেনার্ডের ওই মদো, ঘেমো মুখ চষে বেড়াচ্ছে আমার সারামুখে…হয়তো দেহেও, কারণ বাড়ি ফিরে দেখেছি হাওয়াই শার্টের সব বোম খোলা…আমার সব স্মৃতি অন্ধকার হয়ে যায়।