ও যেন সাপের ছোবল খেয়েছে হঠাৎ। ওর ওই মদে ভাসা লাল চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে মেলে ধরে আমায় বলল, ইউ টক লাইক লরা। তুমি তো লরার মতো কথা বলছ।
লরা! এবার চমকে উঠেছি আমি। আমার পায়ের আর নড়ার জো নেই। তোতলানো শুরু হয়েছে আমার, কেন, লরার কথা বললে কেন?
সিরিল টলতে টলতে ওর ইটের উপর কোনো মতে গিয়ে বসে পড়ে বলল, বিকজ আই লাভড হার। ওকে আমি মার্লিনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম। মার্লিন আমার বউ ঠিকই, কিন্তু লরা…লরা…শি ওয়জ…
রাগে, ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে আমিই ওর হয়ে কথাটা শেষ করে দিলাম, আ বিচ!
সিরিল কিছু বুঝল, কি বুঝল না বুঝতে পারলাম না। অন্ধকারে হাবার মতো চেয়ে রইল আমার দিকে। আমি আমার পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ইস্পাতের ঠাণ্ডা ছুরিটা চেপে ধরলাম। সেই কবে তুলে এনেছিলাম পাড়ার ড্রেন থেকে। কেলে বিশেষ ছুরি। এই নিয়ে অ্যাটাক করেছিল মস্তান জগুদাকে। জগুদা এক প্যাঁচ ওকে মাটিতে ফেলে এই ছুরি দিয়ে ওর গেঞ্জি ফালা ফালা করে দেয়। তারপর পোড়া সিগারেটের মতো ছুরিটাকে টপকে দেয় নর্দমার দিকে। সে-দৃশ্য আমি ছাদ থেকে দেখেছিলাম। ওই চাঞ্চল্যের মধ্যে কারও নজরই যায়নি বিশের ছুরিটা শেষ অব্দি কোথায় গেল। পরে রাত নামতে, পাড়া শুনশান হতে আমি অন্ধকারে গুলি খোঁজার ভান করে জিনিসটাকে কুড়িয়ে এনেছিলাম ওখান থেকে। সেই থেকে তিন-তিন বছর এ জিনিস লুকোনো আমার ছাদে পায়রার খোপে। কেউ জানেনি কেলে বিশের অটোম্যাটিক ছুরি ঘুমিয়ে আছে আমার জিম্মায়। কেবল সেদিন চাঁদের আলোয়—
আমি চোখের জল মুছতে মুছতে ওটাকে ঘুম থেকে তুলে এই পকেটে ভরলাম…
আমি উঠে পড়েছি চলে আসব বলে, শুনি সিরিল ফের সেই ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে, ডিপু, ইউ টেক অল মাই লাটাইজ, অল মাই কাইটস অ্যাণ্ড মাঞ্জাজ, বাট…
আমি ভেংচানোর সুরে বললাম, বাট?
সিরিল ফের একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ফরগিভ লেনার্ড!
আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। লেনার্ডকে ক্ষমা! আর সে-কথা সিরিল বলছে কেন? ও কী জানে? কে ওকে কী বলল? হায় ভগবান, এভাবে তাজ্জব হওয়ার জন্য কি এই অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাদ? যে-ছাদে এই মুহূর্তে কোনো চাঁদও নেই।
আমার তোতলামি যেন আর কাটে না। কী…কী…কী…বলছ তুমি, সিরিল? লেনার্ডকে ক্ষমা করার কথা উঠছে কেন? ও কী করেছে?
সিরিল মুঠো করে সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল, ও যা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। ইভন জিসাস ক্রাইস্ট কান্ট ফরগিভ হিম।
—কিন্তু ও করেছটা কী?
—হি হ্যাজ রেপড ইউ, হ্যাজনট হি?
আমি ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমি পকেটের মধ্যে ফেলে বিশের ছুরিটা জোর করে চেপে ধরলাম। চোখ ফেটে ক-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গালে। সিরিল ওর নতুন ধরানো সিগারেটটা আলসের বাইরে ছুড়ে ফেলে এসে দাঁড়াল আমার পাশে। আমার চোখের জল মোছাতে লাগল সিরিল, আর বলল, তোমার জন্যই লেনার্ডকে ছেড়ে চলে গেছে লরা। লেনার্ড নিজে আমায় বলেছে। অল হি সিকস নাও ইজ ইয়োর ফরগিভনেস। তুমি ক্ষমা করবে না, ডিপু?
ক-দিন হল সিরিল লেনার্ডকে ক্ষমা করার কথাটা বলেছিল আমি ভুলে গেছি। লরাও যে কতদিন বর ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে মনে রাখতে পারছি না। চাঁদ থাকুক, না থাকুক আমি কী এক ঘোরের মধ্যে রোজ ছাদে উঠে আসি সন্ধ্যে নামলেই। এখন সব চাঁদকে আমার আধখাওয়া ঠেকে, চাঁদ আর কমেও না, বাড়েও না, অমাবস্যার রাতগুলোও কী করে, কী করেই জানি উধাও হয়ে গেছে। এই এক অদ্ভুত চাঁদ আর ওই একটা শব্দ, ফরগিভনেস’, সিরিল আমার জীবনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যের অন্ধকারে এখন আমি ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিরিলদের জানলাটা দেখি; যেখানে পর্দার ফাঁক দিয়ে কিছুটা লালচে আলো ঠিকরে বেরোয়। লাল শেডের হলল্যাম্পের চাপা আলো। আর দেখি লেনার্ড-লরাদের জানালা, যেটা সেই থেকে খোলাও হয় না। একটা নিরেট অন্ধকার টানিয়ে লেনার্ডটা যে কোথায় লুকিয়ে থাকে আমি বুঝতেও পারি না।
আমি আস্তে আস্তে পকেট থেকে বার করে আনলাম কেলে বিশের ছুরি। বোতাম টিপে বার করে ফেললাম ওর লিকলিকে ধারালো ফলা। আর-হায়, আজও এক আধখাওয়া চাঁদের রাত। জ্যোৎস্নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম নিষিদ্ধ অস্ত্রের আকার-প্রকার। তিন তিনটে বছর ঘুমিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু মরে যায়নি। ওকে দেখতে দেখতে মনে পড়ল লেনার্ডের বিশ্রী ছুরিটাও। যা শিল্পীর তুলির মতো আলতো করে ও বুলোচ্ছিল লরার হাতে, বুকে, তলপেটে আর সমানে আমার দিকে ঘুরে বলছিল, দিস ইজ হাও ইউ মেক লাভ, বচ্চা। ডেটল, বেঞ্জিন ঘষে মেয়েদের ভালোবাসা যায় না। ভয়ে, উৎকণ্ঠায় আমার গলা বুজে আসছিল। কোনো মতে তাও বললাম, আমি তোমার বউয়ের সঙ্গে খারাপ কিছু করছিলাম না, লেনার্ড। আমি ওর ক্ষতে ওষুধ বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।
ওষুধ?—বিশ্রীভাবে নাক সিটকালো লেনার্ড। মেয়েদের ওষুধের তুমি কী জানো? জানো, মেয়েরা কী ওষুধ চায়?
বলতে বলতে লরাকে ছেড়ে আমার উপর ঝাঁপাল লেনার্ড, ওর সারা গা থেকে বিশ্রী মদের গন্ধ। আমি দু-হাতে ওকে ঠেলে সরাতে গিয়ে হড়কে পড়লাম কাঠের আলমারিটার গায়ে। লেনার্ড চট করে আমার হাত দুটো ধরে টান টান করে বিঁধে দিল আলমারিতে। লজ্জায়, অপমানে আমি অবশ হয়ে গেছি, কিন্তু কাঁদতে পারছি না। যিশুর মতো আমার মাথাটা ঝুলে পড়েছে একদিকে, আর চোখ বন্ধ করে সহ্য করছি আমার গালে, আমার ঠোঁটে, আমার কপালে লেনার্ডের মাতাল চুম্বন।