নারী-পুরুষের সংগম সেই আমার প্রথম দেখা। লরার গায়ের রক্তের ছিটে লেনার্ডের গায়েও। ওরা ভালোবাসছে, না একে অন্যকে খেয়ে ফেলছে কেউ ঠাওরাতে পারবে না। আমি ডেটল আর তুলো চৌকাঠের উপর নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম ওদের রকমসকম, তারপর চুপচাপ বেরিয়ে এলাম।
এরপরেও একদিন ডেটল না বেঞ্জিন কিনে আনতে হল। নিয়ে গিয়ে আর লেনার্ডকে দেখলাম না, সে তার কাটাছেড়ার কাজ সেরে জাহাজ-ডকের ডিউটিতে চলে গেছে। পরনের ফ্রক ছেড়ে মেয়েটা বিছানার চাদর জড়িয়ে সোফায় বসে ভিজে কাকের মতো কাঁপছে। বললাম, ভালোবাসার আর তোক খুঁজে পেলে না, লরা? আর কতদিন সহ্য করবে একে?
ওষুধটা নিতে নিতে ও বলেছিল, জানি জানি। শুধু বুঝতে পারি না ও কেন আমায় মেরেই ফেলে না।
বলাইয়ের দোকান থেকে ফেরার সময় সিরিলের কথাটা ঘুরছিল মাথায়। অ্যাংলো চাঁদ আর বাঙালি চাঁদ আলাদা।
হয়তো ভুলও বলেনি। দু-দিন যেতেই কেউ আর দেখি বিশেষ উচ্চারণও করে না ব্যাপারটা। ভাবখানা এমন অ্যাংলোদের মধ্যেও তো ঘটেই চলেছে। ছ-বছর বিয়ে টিকেছে, আবার কী চাই! পাড়ার গেজেট বলাই মুদিও একসময় হাল ছেড়ে বসল। বাঙালি পাড়ায় অ্যাংলো চাঁদ উঠল কি ডুবল কারও খেয়ালই রইল না।
আমি যতই ভাবি, এই ভাগাভাগিটা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। শোভাকে নিয়ে চাঁদু পালালে গোটা পাড়া মাসখানেকের মতো ঝিম মেরে যায়। যেখানেই যাবে, একটা চাপা, ফিসফিসে কথাবার্তা। …হ্যাঁরে, ওরা কি রেজিস্ট্রি-টেজিস্ট্রি করেছে? না, এমনিই পালালে? …দূর! দূর! রেজিস্ট্রির কী দরকার? পেট তো বাঁধিয়েই বসেছে! সে খবর রাখো?… দ্যাখো, এবার কদ্দিন পর বউকে ঘরে তোলে কেষ্টচরণ!… তারপর হঠাৎ সংবিৎ ফিরলে আমাকে দেখে তোড়ফোড় বলাইয়ের, অ্যাঁ, এ সব কী? বড়োদের কথার মধ্যে টিপটিপ করে এসে দাঁড়ানো! কী চাই, মুড়ি-চানাচুর? তা, সেটা বলবি তো?
তখন আমার রাগি প্রতিবাদ, তোমরা তো সেই থেকে বিজ বিজ, বিজ বিজ করেই যাচ্ছ। আমার কথা শোনার মধ্যে আছ? বলাই বেগতিক দেখে একগাল হেসে বললে, তা যা বলিছিস। চাকরি-বাকরির যা মন্দার বাজার…এইসব নিয়েই বুড়োরা আমরা একটু ভাবনাচিন্তা করি।
কোনো মতে হাসি চেপে, সেই রাগভাব বজায় রেখে মুড়ির পয়সা গুনতে গুনতে বললাম, হু…!
লরার পালানো নিয়ে যে দু-দিন চর্চা চলল তারই মধ্যে ছোট্ট একটা বিপদ ঘটল আমার। পচা মাঞ্জা ফেরত দিতে গেছিলাম মৌলালির মোড়ে আক্রমের ঘুড়ির দোকানে। মাঞ্জা ফেরত নেবার ব্যাপারে ব্যাটা একদম পিশাচ। সমানে বাহানা করে যাচ্ছে একটা-না একটা। …ই দেখো, কৈসা মজবুত হ্যায়। ক্যা বোলতা মাঞ্জা তিখা নেহি?
আমি বলছি, এই ধরছি আমার এমনি সুতো। কাটো তত তোমার মাঞ্জা দিয়ে।
আক্রম ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে বলল, তুমি ঘুড়ি উড়াইতেই জানো না, ডিঙ্গু বাবা। তুমি আমার সময় নষ্ট করাচ্ছ।
আমি যারপরনাই রেগে গেছি, কী, আমি তোমার সময় নষ্ট করছি? তুমি যা-খুশি মাঞ্জা গচাবে আর…
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা হাত পড়ল আমার পিঠে, আস্তে করে। ঘুরে দেখি সিরিল। সারাশরীর মদে ভসভস করছে, চোখ দুটো জবার মতো লাল। বলল, লেট দ্যাট রাবিশ মাঞ্জা গো। তুমি আমার সঙ্গে এসো আমি তোমায় মাঞ্জা দেব।
ওর ওই অবস্থা দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে গেছি আমি। কোনোমতে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
ও শক্ত করে আমার লাটাইধরা হাতটা ধরে টানল, কাম! সিরিলদের ছাদে এসে বসেছি যখন দু-জনে, তখন সন্ধ্যে নেমেছে চারপাশে। ঝপ করে খানিকটা ঠাণ্ডাও পড়েছে, কিন্তু আকাশে কোনো চাঁদ নেই।? দু-জনে দূরে দূরে দুটো ইটে বসেছি, কিন্তু এইখান থেকেই ওর মদের বিদঘুটে গন্ধ পাচ্ছি। সিরিল বলল, আজ আমার সব লাটাই, সব মাঞ্জা তোমায় দিয়ে দেব। বাট…
মস্ত মস্ত শ্বাস ফেলে সিরিল কথা ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু আমার তর সইছে না, বলে বসলাম, বাট কেন?
সিরিল পকেট থেকে তামাক বার করে সিগারেট পাকিয়ে বলল, বাট…
ফের বড়ো বড়ো শ্বাস পড়া শুরু হল, কী বলতে চায় তাও যেন ভুলে গেল। আমি আর থাকতে না পেরে বলে দিলাম, ইউ আর ড্রাঙ্ক টুডে।
অন্ধকারে লম্বা একটা রিং ছাড়ল সিরিল। বলল, হ্যাঁ, আমি মাতাল। আমি সব সময়ই মাতাল। কিন্তু আমি কোনো অন্যায় করি না।
সিরিলের রিংগুলো যত উপরে উঠছে ততই রাস্তার আলো এসে পড়ছে ওগুলোর উপর। ছোট্ট ছোট্ট গর্তঅলা মেঘ যেন আমি ওই রিং গুনতে গুনতে বললাম, অন্যায়ের কথা বলছে কেন?
ও হাত দিয়ে একটা উড়ন্ত রিং ধরার চেষ্টা করল। দেখল রিংটা নেই। বলল, ইটস লাইক দিস। গত দু-দিনে আমি বারোশো টাকা রেসে হেরেছি, ঠিক এইভাবেই টাকাগুলো হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। কুইনেলা, ট্রেবল টোট, জ্যাকপট…সব ধোঁয়া!
বা-রো-শো টাকা! আমি মনে মনে হিসেব কষছি বারোশো টাকা মানে কত টাকা। কাকা মাইনে পায় হাজার। আমাদের জি ই সি রেডিয়োর দাম ছশো। জগরুর মাইনে তিরিশ। আমার স্কুলের মাইনে…
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, এত টাকা…
সিরিল বলল, ঠিক বলেছ, এত টাকা। বাট আই ক্যান অলওয়েজ আর্ন দ্যাট ব্যাক। আই অ্যাম আ বি ও এ সি স্টাফ। ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ারলাইন্স কর্পোরেশন। ইউ নো দ্যাট?
বললাম, জানি। তাই বলে এইভাবে টাকা ওড়াবে?
হঠাৎ সিরিল উঠে এল আমার দিকে, আমি ভয়ে উঠে দাঁড়িয়েছি ইট থেকে। সিরিল সিগারেটটা ছুড়ে দিয়ে আমাকে বিশ্রীভাবে জড়িয়ে ধরল আর কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর ঘামে, গন্ধে, আদিখ্যেতায় আমার গা ঘুলিয়ে উঠছে। আমি ওর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললাম, প্লিজ লেট মি গো।