নীতু! নীতু! নীচ থেকে হাঁক কাকার। আমি উত্তর করলাম যাই কাকা! বলে নামতে লাগলাম ছাদের সিঁড়ি বেয়ে। আর ভেতরে ভেতরে গজরানি আমার নাঃ! এ জীবনে শান্তি বলে কিছু নেই। নিজের মতো একটু থাকব তার জোর নেই।
কিন্তু কাকার সামনে পড়ে এক্কেবারে থমকে গেলাম। কাকার মুখ কী গম্ভীর। কেমন ব্যথা ব্যথা ভাব। আমি ভাবতে বসলাম, কী এমন করেছি যে কাকার এত কষ্ট হল। আমি চুপ করে পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
কাকা বলল, তোমার বন্ধুরা আজ শহর ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে, ওদের মা তোমাকে আজ ওদের ওখানে যেতে বলে গেলেন। তুমি যেয়ো।
আমি বুঝেই উঠতে পারলাম না কাকা বন্ধু বলতে কাদের কথা বলছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কাদের কথা বলছ, কাকা?
কাকা বলল, কাদের আবার? তোমার ওই ডম্বল আর ডোম্বলের কথা। মৃণালিনী বলছিল ওদের বাবা মারা যাবার পর থেকে সংসারে অভাব লেগেছে। ওদের তাই মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়েছে। আর দুপুরে মামা এসে নিয়ে যাবেন ওদের।
ভেতরটা অসম্ভব মোচড়াতে শুরু করল। একটা কান্না কাঁদতে ইচ্ছা হল। মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, মামাবাড়ি কোথায়?
কাকা বলল, আসামের কৈলাশহরে!
আমার ভেতরটা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। ডম্বল আর ভোম্বল তাহলে চলে যাবে? আমার ওই নিত্যদিনের সঙ্গীরা না থাকলে কার সঙ্গে পুজোর সকালে শিউলি কুড়োতে যাব? কাদের সঙ্গে গিয়ে ভিড় বাড়াব রথের মেলায়? দেশলাইয়ের টেলিফোন বানিয়ে কাদের সঙ্গে মনের কথা কইব? কাদের সঙ্গে গিয়ে দুপুরবেলায় বসে ‘অনুরোধের আসর’ শুনব? কে আমাকে প্রশ্ন করবে, আচ্ছা নীতু, তুই তো ইংরেজিতে পন্ডিত। বল তো ইংরেজিতে প্রেমিক শব্দের মানে কী?
মনে আছে ওদের ওই প্রশ্নটার উত্তরে বললাম, লাভার। তাতে দিগগজ ডাম্বল বলল, ধ্যাত! সেদিন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম উকিল বংশীকাকা বলছে প্রেমিকের ইংরেজি ‘প্রস্টিটিউট। আমি তখন ভয়ঙ্কর তাচ্ছিল্যের কন্ঠে শুনিয়ে দিয়েছিলাম, তোমার মাথা আর বংশীকাকার মুন্ডু। প্রস্টিটিউটের মানে হল খারাপ স্ত্রীলোক।
তখন ভোম্বল মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল, তাহলে তো ঠিকই হল। প্রেম তো খারাপ স্ত্রীলোকেরাই করে। তাই না?
আমি আর কথা বাড়াইনি। শুধু মনে মনে বললাম, মূর্খদের জ্ঞান দিয়ে লাভ নেই। যা জেনেছে তাই জানুক।
আর এখন সেই মূর্খদের জন্যে প্রাণ কাঁদছে আমার। কাকাকে বললাম, ঠিক আছে, যাব।
সকাল কেটে দুপুর হতে যে কত সময় লাগল তা ভগাই জানে। বইয়ের পাতা উলটোচ্ছি আর ডম্বল-ভোম্বলের কথা ভাবছি। স্নান করছি আর ওদের মুখ দুটো চোখের সামনে। ভাসছে। আর তারপরই ওদের দুই দিদি লালিমা আর গরিমার মুখ। আমরা শর্ট করে ডাকি লিমা আর রিমা বলে। ভাবছিলাম কে আর এরপর ওদের জন্য সুচিত্রা উত্তমের ছবির ম্যাটিনি শোয়ের টিকিট কেটে এনে দেবে। কে ওদের জন্য পাড়ার জগুদার হোলনাইট ফাংশনে সিট ধরে রাখবে। কে ওদের কাছে ফুচকার পয়সা চাইবে? কে আর আমাকে ওদের বাথরুমের দরজার ফুটোর সামনে বসিয়ে বলবে দিদিরা চান করছে। দেখবি?
আমি সেই ফুটোতে চোখ রেখে যেন স্বর্গে চলে গেলাম। লিমা আর রিমা চান করছে, একজন আরেকজনের গায়ে সাবান মাখাচ্ছে। একজন আরেকজনের গায়ে বিশেষ বিশেষ জায়গা খুঁটিয়ে দেখছে। রিমা লিমার বুকের বোঁটা দুটো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। তারপর একটা বোঁটায় ঠোঁট ছোঁয়াল। জিভ দিয়ে চাটল।
তখন ডম্বল আমাকে ঠেলা মারল, সর, সর, আমি একটু দেখি। আমি সরতেই ডম্বল সেখানে ফিট হয়ে গেল। আমি সরে এসে দেখি ভোম্বল মুখ গুঁজে সিঁড়িতে বসে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হল তোর আবার? মুখ তুলে বলল, দিব্যি খেয়ে বল একথা কাউকে বলবি না?
আমি বললাম, কোন কথা?
—এই যে আমরা ফুটো দিয়ে সব দেখি।
–সে কী! তোরা রোজ দেখিস নাকি?
–না তো কী? খুব ভাল্লাগে দেখতে। কী হয়েছে, নিজেরই দিদি ওরা।
দুপুরের ভাত আর মাংস খেয়ে ডোম্বল আর ডম্বলের সঙ্গে শেষবারের মতো বসলাম গিয়ে ওদের কলের গানটার পাশে। ভাইদের জন্য দিদিরা একটা ছোট্ট উপহার এনেছে আজ। একটা নতুন রিলিজ হওয়া রেকর্ড। পাশের ঘরে মাসিমা অঝোরে কাঁদছে দুই ছেলের জন্যে, ফের কবে বাড়ি আসবে কে জানে।
লালিমা রেকর্ডটা চাপিয়ে দিল কলের গানে। পাশে বসে গরিমা যন্ত্রে দম দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ঘরের কান্নায় ভরা নীরব হাওয়ার মধ্যে পান্নালাল ভট্টাচার্য গেয়ে উঠলেন, ‘মা আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা। এবার চোখ বেয়ে ধারা নামল আমার।
সন্ধ্যেবেলায় আলতো পায়ে ফের গেলাম। ডোম্বল-ডম্বলদের বাড়ি। দেখি সারাবাড়িতে একটা আলো জ্বলছে, বাকি সব অন্ধকার। যে-ঘরে আলো সেখানে চুপ করে বসে জানলার বাইরে অন্ধকার দেখছে লিমা। আমার পায়ের শব্দে চটকা ভাঙতে মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল
কে নীতু? এসেছিস?
বললাম, আর সবাই কোথায়? লালিমা বলল, শিবমন্দিরে পুজো দিতে গেছে।
-তুমি গেলে না?
–না রে, কিছু ভালো লাগছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে।
বললাম, আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে লিমাদি।
লালিমা বলল, জানি। সব ব্যাপারেই তো তোরা একসঙ্গে থাকতিস।
বললাম, সে আর বলতে! কত খারাপ কাজই না করেছি একসঙ্গে।
লালিমা চমকে উঠল। খারাপ কাজ। কী খারাপ কাজ করেছিস তোরা?
আমি মাথা হেঁট করে বসে রইলাম। লিমা ফের শুধোল, কী খারাপ কাজ? বল আমাকে আমি কাউকে বলব না।