মতিয়া ফের ফ্যাল ফ্যাল করে চাইল। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে না বলল। রানি দপ করে জ্বলে উঠে বললেন, তাহলে কালই আমি দলবীরকে রাজার খুনি বলে ধরিয়ে দেব। তখন বুঝবি তোর প্রেমের কী দশা হয়।
রাজার খুনি! মতিয়া কিছুই বুঝল না তখন। রানি ওকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে পেছনের দালানের জানালায় নিয়ে জালে ফাঁস-বাধা মোহন সিংয়ের দেহটা দেখালেন। লম্বা দড়ির জালে ঝুলছেন মোহন সিংহ তিন তলা সমান উঁচুতে। মুখে ছোপ ছোপ রক্ত। ভয়ে মুখ চাপা দিল মতিয়া। তারপর কাঁপতে কাঁপতে বলল, না না রানি মা। দলবীরকে খুনি সাজিয়ো না। আমি রানি হব। আমি রানি হব। আমি পাগলি সাজব!
রানি ফের নিজের শোবার ঘরে গিয়ে সমস্ত সিন্দুকের চাবি তুলে দিলেন মতিয়ার হাতে। কানে ফিস ফিস করে বললেন; ভগবান তোর মঙ্গল করুন মতিয়া। তারপর নিজের কাপড় ছেড়ে মতিয়ার কাপড় পরে রানি রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন। প্রাসাদের দ্বাররক্ষী রানিকে মতিয়া ভেবে অন্ধকারে জাপটে ধরল। গালে গাল ঘষতে লাগল, মুখে চুমু দিতে লাগল। ওর দেহের বিশ্রী গন্ধে রানির প্রাণ ওষ্ঠাগত হচ্ছিল। কিন্তু পালাতে হলে ওটুকু সহ্য করতেই হবে জেনে রানি মুখ বুজে রইলেন। কারণ তখন ভোর হয় হয়। রাজার ব্যাপারটা জানাজানি হলেই কেলেঙ্কারি। সাতদিন সমানে হেঁটে সারিন্দ রাজ্যে গিয়ে প্রথম বিশ্রাম নিলেন রানি সুখীন্দর। একটা হিরের আংটি বিক্রি করে দুটো বাঁদর, একগাছা দড়ি আর একটা ডুগডুগি কিনলেন। তারপর বাকি টাকা দিয়ে গোরখ মহল্লায় একটা ঘর ভাড়া করতে গিয়ে খবর পেলেন রাজা মোহন সিং এবং তাঁর রানিকে খুন করার দায়ে রাজপ্রাসাদের এক পরিচারিকা এবং পুরুষ কর্মচারীকে খোলা রাস্তায় কুত্তা দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। খবরটা শুনতেই একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল সুখীন্দরের শরীরে। ওর আর ঘর ভাড়া করা হল না। বাঁদরগুলোকে নিয়ে সরাসরি নদীর ধারে চলে গেলেন। জন্তুগুলোকে কিছু দানা ছড়িয়ে দিয়ে উদাসভাবে চেয়ে রইলেন নদীর নীল জলের ওপারে আধ-ডোবা সূর্যের দিকে। ওঁর মনে হল ওঁর হৃৎপিন্ডটাই যেন আস্তে আস্তে জলে ডুবে যাচ্ছে। এবং খানিক বাদে সত্যিসত্যিই পাগল হয়ে গেলেন।
অ্যাংলোচাঁদ
লরা ম্যাসি ওর বরকে ছেড়ে পালানোর পর হঠাৎ কথাটা মনে এল আমার। যেটা বলেছিল সিরিল আমায় চাঁদনি রাতে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে।
রোজকার মতো সিরিল সেদিনও নেশা করেই ছিল। না হলে আকাশের ত্রিসীমানায় কোথাও কোনো ঘুড়ি নেই, পাখি নেই, গর্জন করে উড়ে যাওয়া অ্যারোপ্লেন নেই, এমনকী শীতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘও নেই। নীলচে কালো আকাশে শুধু একটা নিস্তব্ধ চাঁদ, আর তারই মধ্যে শিস দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর শখ হয় সাহেবের!
আমি ওর মুখপোড়া ঘুড়ির বদলে আধখাওয়া চাঁদটাই দেখছিলাম, যেটা নজরে আসতে সিরিল বলল, দেখে নাও, দেখে নাও, দিস ইজ আ ডিফারেন্ট মুন। এ একেবারে অন্য চাঁদ। দেখে নাও ডিপু।
আমি চাঁদই দেখছিলাম, ওর কথা শুনতে ওর দিকে তাকাইওনি। কিন্তু কথাটা কীরকম টংটং করে বাজল কানে, ট্রামের ঘণ্টির মতো। জিজ্ঞেস করলাম, এটা আলাদা চাঁদ বুঝি? কীভাবে?
সিরিল সাঁ সাঁ করে টেনে ঘুড়ি নামাতে নামাতে বলল, এটা অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান চাঁদ, তোমাদের বাঙালি বাড়ির চাঁদ নয়।
নেশা করে সিরিল এরকম অনেক কথাই বলে, আমি আমল দিই না। ভাবলাম নেশার বুকনিতে ওকে মারে কে! তার উপর চাঁদে পেয়েছে।
সিরিল ঘুড়ি নামিয়ে, লাটাই গুটিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে ফের বলল, তুমি ভাবছ আমি ঠাট্টা করলাম, ভাবো। বাট ইটস ট্রু। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছাদ থেকে দেখা চাঁদ আর বাঙালি ছাদ থেকে দেখা চাঁদ এক না।
বাড়ি ফিরে সিরিলের আরও একশোটা কথার মতো এ কথাটাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম। অথচ, কেন জানি না, এইটাই সেই ট্রামের ঘণ্টির মতো মাথার মধ্যে বাজতে লাগল যেই খবরটা কানে এল বলাইয়ের মুদির দোকানে—লেনার্ডের বউ ভেগেছে।
লেনার্ড ম্যাসির বউ লরা। ছিপছিপে, হিলহিলে অ্যাংলো সুন্দরী, কেবল মুখটুকু বাদে সারাশরীরে সরু সরু, কাটা কাটা দাগ। দেখা যেত হাত, স্কার্টের নীচে পা, আর পিঠখোলা ব্লাউজ পরে থাকলে পিঠের খোলা অংশে। লরা রস করে বলত, মাই লাভমার্কস। ভালোবাসার চিহ্ন। আসলে লেনার্ডের ছুরিতে বানানো দাগ সব, খেপে গিয়ে, সন্দেহে পাগল হয়ে, কখনো বা ভালোবেসে করা। ছ-ছটা বছর মেয়েটা নাকি এভাবে ছুরির ডগায় বেঁচে আছে। একবার হাতে-পায়ে রক্তারক্তি অবস্থায় আমায় ডাক দিল দোতলার জানালা দিয়ে, ডিপু, হারি প্লিজ! শিগগির এসো!
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় করে উঠে গিয়ে দাঁড়াতে, বলল, শিগগির আমায় একটা ডেটল আর তুলে এনে দাও দাস ব্রাদার্স থেকে। রাশ, অর আইল ডাই। বলে রক্তে ভেজা একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে ধপাস করে পড়ে গেল বেতের সোফাতে।
আমি ডেটল এনে দাঁড়িয়ে আছি ওদের বসার ঘরে, লরা নেই। ছাঁৎ করে উঠল বুকটা। কী হল রে বাপ! মরে গেল নাকি? আমি বার কয়েক ডাক দিলাম, লরা! লরা! কোনো শব্দ নেই। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কানে এল একটা চাপা গোঙানি শোবার ঘর থেকে…আমার হাতে ডেটল আর তুলো কাঁপতে লাগল। আর দাঁড়িয়ে থাকা সয় না, আমি আস্তে করে ঠেলে সরিয়ে দিলাম বেডরুমের দরজা।