-কেন ডাকলে না?
—কোনো লাভ ছিল না, ও চলেই যেত।
—তো কী করলে শেষ অবধি?
—আমি ওকে একটা খুব প্রাইভেট বেরিয়াল দিলাম। খুব নির্জন কবর।
—নির্জন কবর? কোথায়?
ডরোথি একটা ডিকির গিফট করা সিনিয়ার সার্ভিস সিগারেট ধরাল আর একটা অফার করল অরুণকে। তারপর ওর হাতটা ধরে বলল, এসো, দেখে যাও।
ডরোথির হাত ধরে অরুণ ওদের বসার ঘরের পেছনের ডাইনিং রুম পেরিয়ে স্টোর রুমের ভেতরে ঢুকল। তার এক ধারে একটা বন্ধ দরজা। কী একটা ড্রয়ার খুলে একটা লম্বা চাবির গোছা বার করল। তারপর মিটসেফের ওপর থেকে একটা চার ব্যাটারির টর্চ নিয়ে বলল, এসো অরু। বাল্যে, কৈশোরে কত কত বার এই বিশেষ দরজাটা দেখেছে অরুণ। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি ওটার ওপারে কী। একবার সুক আর মাম্পুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতেও ওই দরজাটার পিছনে লুকোবার বাসনা হয়েছিল ওর। কিন্তু তখনও জানা হয়নি দরজাটা কীসের।
ডরোথি ইশারাতে বিন্দিয়াকে বলল বসার ঘরে যেতে আর দরজা খুলে অরুণকে বলল, সাবধানে নামো।
ডরোথির মস্ত টর্চের আলোয় অরুণ দেখল বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে একটা সেলারের মধ্যে। সাহেবরা বলবে সেলার, এদেশীয়রা গোপন কুঠুরি। সিঁড়ি দেখিয়ে নামতে নামতে ডরোথি বলল, মা-র কাছে শুনেছি একসময় এর ব্যবহার হত বন্দুক আর কার্তুজ রাখার জন্য।
অরুণের খুব ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে কার বন্দুক, কার কার্তুজ। কিন্তু তার আগেই ওর চোখ গেছে এক মস্ত লম্বাটে বাক্সের দিকে। পোশাকি ভাষায় যাকে বলে চেস্ট। ডালা দেওয়া প্রকান্ড বাক্স। অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলোয় ডরোথি ওর গোছর একটা চাবি দিয়ে খুলে ফেলল বাক্সের তালাটা। তারপর নীচু স্বরে অরুণকে বলল, একটু হাত লাগাও।
দু-জনে মিলে ঠেলে ডালাটা তুলে ধরতে এক বিকট গন্ধে পা থেকে মাথা অবধি ঝাঁকিয়ে উঠল অরুণের। ও হাতের সিগারেটে লম্বা টান মেরে নাকের বোধটা মারার চেষ্টা করল। ডরোথি দিব্যি ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরে বাক্সের কাপড়ের বাণ্ডিলগুলো সরাতে লাগল। বাক্সের মধ্যে কত যে সুগন্ধির বোতল ছড়ানো, যাদের সব গন্ধই জলাঞ্জলি হয়েছে শবের গন্ধ মারতে। একে একে ডরোথি সরাল ম্যাক্স ফ্যাক্টর, কোটি, পাট্টা, ইভনিং ইন প্যারিসের সব মহার্ঘ শিশি। শেষে এক বিবর্ণ গোলাপি চাদর টেনে তুলতে হুস করে ভেসে উঠল পচা, গলা এক দেহ যা বস্তুত কঙ্কালসর্বস্ব। ভয়ে শিউরে উঠেছিল অরুণ, কিন্তু ডরোথি সেই পূর্বের মতো শান্ত। বলল, বছরে বেশ কবার ওর বেশভূষা পালটে দিই। গলে পড়া শরীরের সবকিছু বার করে দিয়েছি। তবু এই গন্ধটা থেকে গেছে। আমি সব সহ্য করে নিয়েছি। দ্যাখো, কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে টোনি!
অরুণ দেখল শুধু একটা কঙ্কালের চোখের শূন্য কোটরে ক্লান্ত অন্ধকার। না বলে পারল, এভাবে একটা বডিকে বাড়িতে পুষে ঠিক করোনি, ডর। কঙ্কালটা মুক্তি চাইছে।
ওর কথার নিষ্ঠুরতায় চমকে গিয়েছিল ডরোথি। ফের পরিপাটি করে বাক্সটা গুছিয়ে ভারী ডালাটা নামিয়ে রেখে বলল, এভাবে ওকে রেখে দিতে পেরেছিলাম বলেই তো তুমি তোমার গল্পের গ্র্যাণ্ড ফিনালি পেয়ে গেলে, তাই না? এরকম একটা ভয়াবহ সেটিং ছাড়া তুমি টোনির অবিশ্বাস্য জীবনের শেষ দেখাতে কীভাবে? একটা প্রেমের উপন্যাসের এরকম এক ভয়াবহ শেষ কি খুব খারাপ?
অরুণ এসব কথার কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। জুতোয় মাড়িয়ে হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে চুপ করে উঠে এল বসার ঘরে। গ্রামে বসামো ইভ মত-র প্রেমের গানটা চালিয়ে দিয়ে এক পাত্র রাম নিয়ে বসল। একটা ড্রিঙ্ক বানিয়ে রাখল ডরোথির জন্য।
একটু পর ডরোথি দিব্যি সেই পুরোনো দিনের স্টাইলে সেজেগুঁজে, গায়ে অপূর্ব পারফিউম ছড়িয়ে এসে বসল। গান শুনতে শুনতে রাম খেল, স্মোক করল, এক ফাঁকে ন্যাট কিং কোলের ‘রেনড্রপস আর ফলিং অন মাই হেড’ চালিয়ে দিল, তারপর আরেক ফাঁকে এলভিসের ‘লাভ মি টেণ্ডার, লাভ মি ঠু’ চালিয়ে দিল, কিন্তু একটাও কথা উচ্চারণ করল না। কেমন যেন ভুলেই গেল যে ওর সামনে কেউ বসে আছে।
কত রাত অবধি গান, পান, ধূমপান চলল কিন্তু বহু চেষ্টাতেও অরুণ আর ওকে কথা বলায় ফেরাতে পারল না। অরুণ বুঝতে পারল ডরোথির চারপাশ ঘিরে তখন শুধু টোনি, টোনি আর টোনি। মদের প্রভাবে কখন এক সময় ডরোথির উলটো দিকের সোফায় বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল অরুণ।
তখন গানও বন্ধ হয়ে গেছে, বিন্দিয়া এসে না খাওয়া রোলের প্লেট, মদের খালি গেলাস সব তুলে নিয়ে গেছে। এক দফা কাশির পর নিজের সোফায় কাত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে ডরোথি। বিন্দিয়া ঘরের বাতিটাও নিভিয়ে দিয়েছে।
সকালের এক টুকরো রোদ এসে মুখে পড়তেই ধড়মড় করে জেগে উঠল অরুণ। হাতের ঘড়িতে দেখল আটটা। আরেক টুকেরা রোদ দেখল পড়েছে ডরোথির আজও সুন্দর মুখটায়। একবার ডাকবে মনে করল ওকে, পরমুহূর্তে ভাবল, না থাক। কী সুন্দর হাসি হাসি মুখে ঘুমিয়ে আছে। হয়তো ভোর রাতের স্বপ্নে এসেছে টোনি। শিশুদের মতো দেয়ালা করছে যেন আশ্চর্য নারীটি।
কিছুদিন আগে টেনিসনের ‘দ্য লেডি অফ শ্যালট’ থেকে কী সুন্দর আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল। যেন নিজেরই বর্ণনায় ওই আবৃত্তি। তা শুনে অরুণ হাততালিও দিয়েছিল, কিন্তু ডরোথির কোনো সাড়া পায়নি। আজও ডরোথির সাড়ার অপেক্ষায় নেই ও, নিদ্রিত নায়িকার রোদে রাঙানো মুখটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে কবিতার এক অন্য অংশ থেকে আবৃত্তি শুরু করল অরুণ