শমির ওখান থেকে ফিরে ছ-সপ্তাহ চলে গেল। প্রথম হপ্তা জুড়ে সুকের সবগুলো ডায়েরি পড়া হল অরুণের। বাকি পাঁচ হপ্তা ধরে লিখেই চলেছে, কিন্তু ওর উপন্যাস কোথাওই যাচ্ছিল না। অনেকগুলো প্রেক্ষিতের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর দুটো সুন্দর রাস্তার মধ্যে পথ হারাচ্ছিল-মিন্টো রো আর মিন্টো লেন। বার বার মনে পড়েছিল দিদি শমির কথা; চরিত্র তো দুটোই-ডরোথি আর তুই!
ভাবলেই একটা শেলের মতো বিধছিল কথাটা। সত্যিই তো ডরোথিকে সেভাবে ঘাঁটিয়ে দেখেছে ও? কিংবা নিজেকে? নিজের ভেতরেই কুড়িটা বছর ধরে লুকিয়ে থেকে থেকে ডরোথির সঙ্গে সম্পর্কটা ওর কোথায় যে তলিয়ে গেছে। সেই ঘুমিয়ে থাকা সাপটাকেই খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলেছে শমি। সিগমণ্ড ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণে যাকে বলা হচ্ছে ইমার্জেন্স অফ দ্য রিপ্রেসড। দমিত অনুভূতির নবজাগরণ। অরুণ বুঝতেই পারছে না ওর লেখায় নিজের এই অদৃশ্য নাটক কীভাবে চিত্রিত করবে। নিজের প্রেক্ষিত নিয়ে মাথা ঘামালেই তো সেইসব ছবি সিনেমার রিলের মতো নিজেদের মেলে ধরছে। আর ছবি মানেই তো…।
প্লেন নিয়ে একটা ছবির বই দেখছিল অরুণ, হঠাৎ চোখ তুলে দেখল একটু দূরে পোশাক বদলাচ্ছে ডরোথি। ওকে ডাকল, অরুণ আমার ব্রার হুকটা একটু লাগিয়ে দিয়ে যাও প্লিজ! অরুণ কাঁপা কাঁপা হাতে হুকটা লাগাতে গিয়ে দেখল তড়াং করে ইলাস্টিকটা ছিটকে গেছে। ডরোথির বুক থেকে নেমে এসেছে ব্রেসিয়ারের কাপ দুটো। ডরোথি ঘুরে ব্রা-টা ফেলে দিল কার্পেটে আর ঘুরে দাঁড়াল অরুণের দিকে। বলল, ভালো করে দ্যাখো ও বলো কেমন লাগছে।
অরুণের হাত আপনা-আপনিই উঠে গেল ওই অপরূপ বুক দুটোয় আর মুখ দিয়ে শুধু একটাই কথা বেরুল—সুইট!
একটু থেমে ফের বলল, বিউটিফুল!
তারপর আরেকটু থেমে, আই লাভ ইউ, ডর!
তখন ডরোথিই ওকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগল।
অফিস থেকে ফেরার পথে ফের এক বোতল রাম, দু-প্যাকেট বেনসন অ্যাণ্ড হেজেস আর নিজামের রোল নিয়ে ডরোথির ফ্ল্যাটে চলে এল অরুণ। পৃথা দু-দিনের জন্য মামাবাড়ি মিহিজামে গেছে। গল্পের সন্ধানে বেশি রাত অবধি ডরোথির সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে নেই। কাহিনির শেষ যে কোথায় হবে তার কোনো হদিশ এখনও করা গেল না। লাভস্টোরিটা বিয়োগান্তক হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু বিয়োগটা কোথায়, কীভাবে তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া দরকার। নাহলে পুরো কাহিনিটাই এক অস্থিরমতি অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানের অবিশ্রাম নারীবিলাস হিসেবে ঠেকবে। আর এই এতগুলো বছর একলা থেকে ডরোথি নিজেই বা কী করেছিল?
ডরোথির ফ্ল্যাটে এসে নক করে অন্ধকারে দাঁড়িয়েই অরুণ শুনতে পেল ডরোথি বসার ঘরে বসে কাশছে। বেশ ভালোই কাশি ধরেছে ওকে। অরুণ আবার নক না করে ঠেলা দিতে দরজাটা এক বিচিত্র আওয়াজ করে খুলে গেল। ও ভেতরে পা রাখতেই দেখল হল ল্যাম্পের মায়াবী আলো-আঁধারিতে ডরোথি সুকের উপহার করা ইভ মর্ত-র গানের রেকর্ডটা গ্রামে বসানোর উদ্যোগ করছে। অরুণকে দেখে একই সঙ্গে অবাক আর খুশি হয়ে বলল, তুমি? হাউ স্ট্রেঞ্জ! আজকেই তোমার কথা ভাবছিলাম।
–আমার কথা ভাবছিলে? কেন? লাভস্টোরি তো এখনও শেষ হয়নি।
—আসলে আমার একটা উকিল চাই, এ ব্যাটা বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাঙবে বলে জ্বালিয়ে মারছে।
অরুণ ওকে আশ্বস্ত করে বলল, ছাড়া তো! ভাঙব বললেই হল। সে আমি তোমাকে ভালো উকিল দিয়ে দেব।
ডরোথি নরম করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, ডিয়ার!
তারপর অরুণের হাতের জিনিসপত্তর দেখে বলল, আবার অত সবের কী দরকার ছিল? আমার এখানে রাম আর সিগারেটের অভাব রাখি না।
অরুণ কিছুটা ব্যঙ্গের সুরে বলল, জাহাজি বন্ধু ডিকির দৌলতে তো?
ডরোথি বেশ আহতই হয়েছে। খানিক চুপ করে থেকে বলল, আমি নিজেই চেয়ে নিয়েছি কাল এই অ্যানিভার্সারির জন্য।
অরুণ অবাক হয়ে গেল, কীসের বার্ষিকী? তোমার জন্মদিন? ডরোথি ঘাড় নাড়ল, না।
–টোনির বার্থ ডে?
ডরোথি ঘাড় নাড়ল, না।
-তাহলে তোমাদের বিবাহবার্ষিকী?
-না, তাও না।
-তাহলে?
ডরোথি কীরকম একটা আবছা গর্বের সঙ্গে বলল, টোনির ফিরে আসার।
গোটা আকাশটাই যেন ভেঙে পড়েছে অরুণের মাথায়—হোয়াট ডু ইউ মিন, ডর? টোনি ফিরে এসেছিল।
ডরোথি খুব শান্ত আর বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল—হ্যাঁ।
থরথর করে কাঁপছিল অরুণের গলা যখন জিজ্ঞেস করল-কবে?
ডরোথির ফের সেই শান্ত, বিষণ্ণ জবাব—চলে যাওয়ার দু-বছর পরে। তখন তোমরা কেউ আর এখানে ছিলে না।
—পৃথিবীর আর কেউ সেটা জানল না?
–আমি জানতে দিইনি।
—কারণ?
–তাহলে ওকে নিয়ে যেত আমার কাছ থেকে ওরা।
—সে আবার কী! নিয়ে যেত কেন?
–ন্যাচারালি কবর দেওয়ার জন্যে।
কবর দেওয়ার জন্যে? কেন, ও কি মরে গেছিল নাকি?
—হ্যাঁ! এই আমার কোলে। ও ফিরে এসেছিল আমার কোলে মরবে বলে।
–কোত্থেকে এসেছিল?
—আমি জানি না।
–সত্যি কথা বলো, ডর। গল্পের জন্য আমার জানা দরকার। ডোন্ট হাইড।
—আমি সত্যিই জানি না, অরু।
–তাহলে কী জান তুমি?
—শুধু এটাই যে শেষবারের মতো শমি ওকে না বলেছিল। শমির তখন বিয়ে ঠিক হয়ে। গেছে। আমায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শমি বলেছে গো ব্যাক টু ডর!’
—তাতে ও তোমার কাছে ঘুরে এল?
-না, ও আসেনি। সাতদিন ওর মদের সঙ্গী ছিল ডিকি আর আসরানি। জ্ঞান হারাবার আগে শুধু বলতে পেরেছিল, ‘আমাকে ডরোথির কাছে পৌঁছে দে। মাঝরাতে ওরা যখন ওকে রেখে গেল, ও মারাই যাচ্ছে। আমি নিজেই যা পারলাম যত্ন করলাম, কিন্তু ডাক্তার ডাকিনি।