—দ্যাটস জাস্ট লাইক ইউ!
–আগে বল প্রশ্নটা কী?
—আঁতোয়ান সুক, মানে আমাদের টোনিকে নিয়ে।
–টোনিকে নিয়ে হঠাৎ?
—ওকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখব ভাবছি।
–কী মনে করে?
—ওর সেই ডায়েরিগুলো পেয়েছি।
–অ! আর দে ইন্টারেস্টিং?
—কী বলছিস ইন্টারেস্টিং? দে আর ফ্যাসিনেটিং!
–তাই?
–তাই।
—তা আমি কী করব?
–বলবি, টোনি তোকে ভালোবাসত কি না।
–তাই তো মনে হয়।
—আর তুই?
—সার্টেনলি। তুই তো সত্যটাই জানতে চেয়েছিস।
—নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!
–তাহলে ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি না কেন?
–কোথায় পালাতাম?
—যেখানে নিয়ে যেত ও?
—কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিল জানিস?
—কোথায়?
–সাইপ্রাস।
—সব জায়গা ছেড়ে ফের সাইপ্রাস! সাইপ্রাস কেন?
–ও তখন ঠিক করেছিল ওখানে সমুদ্রের ধারে একটা ছোট্ট দোকান দিয়ে আমাকে নিয়ে থাকবে।
-তুই চাইলি না কেন? তুই তো চিরটাকাল প্রবল রোমান্টিক।
–কারণ আমি ওকে খোয়াতে চাইনি।
–খোয়াবার কথা ভাবলি কেন? ওখানে ওর ওই সব নারীসঙ্গের কথা ভেবে?
–না। ওর মার কথা ভেবে। ওর একটা সুপ্ত বাসনা ছিল সমুদ্রে নেমে হারিয়ে যাওয়া।
—কিন্তু তুই থাকতে…?
—আমি থাকতে মানে কী? তুই জানিস ও কখনো আমাকে টাচ করেনি?
—অথচ অত পাগলের মতো ভালবাসত?
—প্রিসাইজালি সেই কারণেই তো আমিও পাগলি হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে বলেছিল, তোমাকে বিয়ে না করে ছোঁব না। আর বিয়ের দিন শুধু একটা আনুষ্ঠানিক চুম্বন দেব। আমাদের সত্যিকারের মিলন হবে সাইপ্রাসের সমুদ্র তটে ঢেউয়ের নীচে। আমি শিউরে উঠে বলেছি, সে কী কথা! আমি তো সাঁতারই জানি না। ও হাসতে হাসতে বলত তাতে কী? আমিও তো সাঁতার জানি না, শুধু জলকেই জানি।
—আর তার পরেও তুই ওর সঙ্গে পালিয়ে গেলি না?
—তাতে কী লাভ হত? তোর উপন্যাস মাঝপথে শেষ হয়ে যেত।
–সে তো এমনিই মাঝপথে দাঁড়িয়ে।
—তার কারণ তুই এখনও ডরোথিকে বুঝে উঠতে পারিসনি।
–তার মানে?
–তার মানে তাই! টোনির চেয়ে কোনো অংশে কম রহস্যময় নয় ডরোথি। জগুদাকে দিয়ে টোনিকে মার খাওয়ানোর পিছনেও ডরোথি। আর তোকে প্রথম কে নষ্ট করেছে বল! সত্যি করে বল, আমি সব জানি।
—ড-ডু-ড-ডরোথি।
–কতদূর গিয়েছিলি ওর সঙ্গে বল! কাম আউট ছোটা ভাই।
—পুরোটা!
—তাহলে শোন, টোনিকে বেঁধে রাখার ওটাই ছিল ওর শেষ চাল। টোনিকে বলেওছিল তুমি শমিকে নিয়ে পালিয়ে গেলে আমিও অরুণকে নিয়ে চম্পট দেব। আর শমি আর ওর ফ্যামিলি কোনোদিন সেটা মেনে নিতে পারবে না। ওর ফ্যামিলির কথা ভেবে শমি গলায় দড়ি দেবে। তুই জানতিস এসব?
–না।
–তাহলে আরও শোন। এইসব ভেবেই কাকা গিয়ে তোর হোস্টেলের ব্যবস্থা করে এল। আমাকে রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলল, লক্ষ্মী মা, একবারটি বাড়ির সম্মানের কথা ভাববা! আমরা কাকে মুখ দেখাব তুই ওকাজ করলে? মা বলল, শমি, আমরা চিরকাল থাকব না, কিন্তু তুই বাড়ির সম্মান… …মার আর কথা জোগায়নি। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল, তবু বললাম, তোমরা কেঁদো না। আমি ও কাজ করব না, কথা দিলাম যখন এসব বলছি আমার চোখের সামনে কী দৃশ্য আসছে জানিস? শুধু তোর মুখ! তখন তোর কত বয়স বল?
–চোদ্দোর কিছুটা বেশি।
—আর তোকে নষ্ট করেছে ছাব্বিশ বছরের এক মেয়েছেলে।
–ওভাবে বলিস না প্লিজ! ও তো বলত আমি নাবালক, কিছুই বুঝি না।
–তাহলে নাবালকের সঙ্গে ওই ব্যবহার?
—ও তো এও বলল আমাকে যে তোকে বাঁচানোর জন্য টোনিকে ছেড়েছিল।
—আর তোকে বন্ধক রেখে!
–ওঃফ! তুই ফের সেই গাওনা ধরেছিস।
—ধরবই তো, টোনিকে আগলাবার জন্য ও সব কিছু করতে পারত। এই আমি বলে দিলাম। ও অসাধারণ গুণী মহিলা, কিন্তু টোনির ব্যাপারে শুধু অন্ধ বা পাগল নয়, একেবারে হিংস্র।
-তুই তো উপন্যাস লিখছিস, এগুলো একটু তলব কর। আর সত্যি বলব? নিজের। ভেতরটা ভালো করে খুঁড়ে দ্যাখ। কী তুই এখানে-ওখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছিস? সুকের ব্যাপারে সত্যিকারের কিছু লিখতে গেলে দুটোই তো চরিত্র—ডরোথি আর তুই!
সন্ধ্যেবেলায় শর্মিলাদের বাড়ির বাগানে দীপেনদার সঙ্গে হুইস্কি নিয়ে অনেক সময় কাটাল অরুণ। সুকের জটিল কাহিনির অনেক সূত্রই যেন ক্রমশ আলগা হয়ে আসছিল। দেশের রাজনীতি নিয়ে গল্প করতে করতে অনেক সময় অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল অরুণ। তখন দীপেনদা বলতে থাকলেন, আরে কী নিয়ে এত ভাবছ তখন থেকে? অফিসের সমস্যা? নাকি পৃথার সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করলে? পৃথা অরুণের স্ত্রী, সে এই সুক-ডরোথির বৃত্তান্তের বিন্দুবিসর্গও জানে না। ও শুধু জানে বর একটা বড়োসড়ো লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
দীপেনদার প্রশ্ন সামাল দেওয়ার জন্য অরুণ বলল, ও কিছু নয়, একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছি, থেকে থেকে ব্যাপারটা মাথায় ঘুরে আসছে।
দীপেনদা বললেন, তা গল্পের প্লট ভেবে বাস্তবকে ভুলে থাকা যায়? এই যে এমারজেন্সি ডেকে বসলেন মিসেস গান্ধী এও তো এক মস্ত প্লট। মানে চক্রান্ত। নয় কি?
দু-জনে এক প্রস্থ হাসির তোড়ে নতুন করে ড্রিঙ্ক ঢালল। অরুণের মনে পড়ল এক একেবারে ভিন্ন প্রসঙ্গ—দাবা। শমির কথায় হঠাৎ করে ওর কাহিনির সাজানো দৃশ্যটাই তছনছ হয়ে গেল, খেলাটা এখন দাঁড়িয়ে গেছে পুরোপুরি নিজের সঙ্গে। অরুণের মনে পড়ল সেই দুপুরবেলা যেদিন ডরোথি টোনির সঙ্গে ঝগড়া করে ওর হাত ধরে বেরিয়ে গেল ম্যাটিনি শোয়ে একটা হলিউডি ছবি দেখতে। হল খালি তবু ব্যালকনির একেবারে পিছনের সিট নিল। হলের আলো নিভতে ওর গায়ে হাত দিল। এক সময় গালে চুমু দিল, তারপর ঠোঁটে, তারপর ওর হাতটা নিজের বুকের ওপর রাখল, আর বলল, এটা তোমার, তুমি খেলতে পারো।