জানি না, এই ধারণাটা আমার ভুলও হতে পারে। খুব সম্ভবত ভুল, কারণ মা এথেলরেডের একটা চিঠি থেকে জেনেছিলাম যে, বছর দেড়েক পর ইগলেসিয়াস ফিরে গিয়েছিল সাইপ্রাসে মা-র কাছে। ওরা তখন সংসার বাঁধার পরিকল্পনা করছিল। আর স্টেফানি চলে গিয়েছিল বেইরুটে নাইটক্লাবে নাচিয়ে হয়ে। এসবই মা-র চিঠি থেকে জানা। তবে ইগলেসিয়াস ফিরে গেছে জেনে আমি তোমার এথেলরেডকে চিঠি দেওয়া বন্ধ করে দিই। মা তার পরেও বেশ কটা চিঠি আমায় লিখেছিল, কিন্তু আমি সে সবের উত্তর দিইনি। আমার শেষ চিঠিতে লিখেছিলাম, তুমি বার বার কেন আমার ফিরে যেতে বল? বাবার মতো আমিও দেশে ফেরার নৌকো পুড়িয়ে ফেলেছি।
বাবা, আমার প্রতিশোধের কথাটাও বলে নিই? বম্বে এসে তুমি ফের এক রেস্তরাঁর ম্যানেজার হলে। আমায় বললে, টোনি, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো। জাহাজে করে দেশবিদেশ ঘোরো। পারলে মাঝে মাঝে সাইপ্রাস হয়ে এসে আমায় গল্প শোনাও। উত্তরে আমি কী বলেছিলাম?—নো ড্যাড, সেটা হয় না, আমার সব নৌকো পুড়িয়ে ফেলেছি। উদবিগ্ন হয়ে তুমি কী বললে?—তাহলে তুমি কী করবে? আমার মতো রাতের পাখি হবে? আমি বললাম না। আমি আকাশের পাখি হব। তুমি ঠিক ধরতে পারোনি আমি কী বলতে চেয়েছিলাম। আমি তাই সহজ করে দিয়ে বললাম, আমি অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ যাব। তুমি খানিকটা গুম মেরে থেকে আপনমনে বিড়বিড় করে বললে, বুঝলাম।
আসলে তুমি কিছুই বোঝনি। তুমি বুঝতেই পারনি এ আমার এক ছোট্ট প্রতিশোধ ছিল তোমার সারাজীবনের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। তুমি চাইতে আমি সমুদ্রের জীবন নিই, কারণ সমুদ্রের হাওয়ার মধ্যেই আমরা মানুষ। অথচ ওই সমুদ্রই টেনে নিয়ে গিয়েছিল মাকে, মা শেষবার বারণও করে গিয়েছিল একলা একলা জলে না যেতে। অথচ কার হাত ধরে আমি সমুদ্রে যাব বল? তুমি কি একবারও আমাকে হাতে ধরে জলে নেমেছিলে? শুধু বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে দূরে জাহাজ দেখিয়ে বলেছ—ওটা ইংলণ্ডেশ্বরীর জাহাজ! ওটা অ্যারিস্টটল ওনাসিসের জাহাজ! ওটা যুদ্ধের! ওটা মাল বহনের! ওটা প্রমোদতরণী!
কিন্তু আমি বেছে নিলাম উড়োজাহাজ। অনেকপরে চাকরিতে প্রথম মাইনে পেয়ে তোমায় কী উপহার এনে দিয়েছিলাম মনে আছে? একটা টাইপিন। তার বিশেষত্ব? সেটা একটা ছোট্ট সোনালি প্লেন! তারপর থেকে টাই পরলেই সে প্লেনটা তোমার বুকে শোভা পেত। আর তোমার কফিনে ছোট্ট কী একটা শুইয়ে রেখেছিলাম তোমার মাথার কাছে খেয়াল করেছ? ওটা একটা ছোট্ট জাহাজ, যার গায়ে আমি লিখে দিয়েছি একটা নাম—রেবেকা। মহিলাকে মনে পড়ে?
না, বাবা, আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই, এখন থেকে তোমাকে আরেকটু ভালোবাসার চেষ্টা করব। নানা শত্রুতা সত্ত্বেও আমরা তো বন্ধুই ছিলাম।
আমি জানি তুমি স্বর্গে নয়, নরকেই যেতে চাও। কারণ ওখানে ফুর্তি বেশি। কিন্তু তোমার পুত্র হিসেবে আমি চাই তুমি স্বর্গে যাও এবং যৌনতাবিহীন এক অনন্ত জীবনযাপন করো। কিন্তু তুমি যা জিনিস বাপ, তুমি ঠিক স্বর্গের দারোয়ানকে ঘুষ দিয়ে নরকে ফুটে যাবে। যেখানে হেলেন অফ ট্রয়, ক্লিওপেট্রা, মাতা হারি-রা তোমার অপেক্ষায়। আর ভয় নেই, কালে কালে আমিও নরকে তোমার সঙ্গী হব। ততদিন তুমি নরকে ফুর্তি করো, আর আমি মর্তে ততদিন সবরকম অবাস্তবতা সহ্য করে যাই।
অতএব বিদায়, প্রিয় আউগুস্তে সুক! মাতালদের মতো আর কান্না জুড়বে না; দ্যাখো আমার চোখ কত শুকনো।
চিঠির আকারে বাবাকে লেখা সুকের ডায়েরির প্রথম এন্ট্রি পড়েই বেশ চুপ মেরে রইল অরুণ। একটা সিগারেট ধরাল, দুটো টান দিয়ে বহুক্ষণ ভাবল—সুকের জীবনের যত জানছে ততই কেমন জটিল হয়ে উঠছে লোকটা। ওর নিজের দেখা ও জানা সুকের চরিত্রকে খুবই খন্ড, আংশিক, একপেশে মনে হচ্ছে। কাহিনি করে লিখতে গেলেও আরও আরও প্রেক্ষিতের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে এক অ-অ্যাংলো প্রেক্ষিতের। কিন্তু কার হবে সেই প্রেক্ষিত? দুলালি? যে-মেয়েটিকে নিয়ে ইন্টালি সিনেমা হলে শাম্মী কাপুরের ‘দিল দেকে দেখো’ দেখতে গিয়েছিল বলে ডরোথি বারো দিনের মতো বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল? কিন্তু সে দুলালি কোথায় এখন? সে তো কবেই বিয়ে হয়ে আসামে। তাহলে সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়ে মাম্পু, যার পড়ার খাতা বাঁধিয়ে দিত সুক? কিন্তু মাম্পু কোথায়? তাদের গোটা পরিবারই তো কবে থেকে মিন্টো রো-ছাড়া! তাহলে… তাহলে… তাহলে কি দিদি শমি? ও কি রাজি হবে কিছু বলতে? জিজ্ঞেস করাটাও কি শোভন হবে? ওদের সুখী পরিবার…জামাইবাবু দীপেনদা খুব খোলামেলা, উদাস প্রকৃতির হলেও তার কি খারাপ লাগবে না?
নানা এলোমেলো প্রশ্নের মধ্যে ওর সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। অরুণ সেটা নিভিয়ে সুকের ডায়েরির অন্য পাতায় চলে গেল। কিন্তু খোঁচাটা ভেতরে থেকেই গেল। রাতের খাওয়ার সময় যখন টেবিল ছেড়ে উঠল তার মধ্যে মনস্থির করে ফেলেছে। শনিবার অফ ডে
-সেদিন ভোরে জামশেদপুরে রওনা হবে।
রাতের ঘুমের মধ্যে দিদি শর্মিলাকে স্বপ্ন দেখল অরুণ।
—দিদি তোকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করব, কিছু মনে করবি না তো?
–অদ্ভুত প্রশ্ন! হঠাৎ অ্যাদ্দিন পর কী এমন অদ্ভুত প্রশ্ন গজাল?
–আগে বল মাইণ্ড করবি না।
—মাইণ্ড করলে উত্তরই দেব না।