আর তখন, ঠিক রানির সর্বশক্তির চড় এসে পড়ল শংকরের গালে। তারপর ফের এক চড়। একজন খদ্দের উঠে একটা রদ্দা মারল শংকরের পিঠে; শংকর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। প্রকান্ড আয়নাটার ওপর। আর আয়নার ভেতর থেকেই দেখল রানি আলনার পিছনে কসাইয়ের ছুরিটা খুঁজছে পাগলের মতন। পকেট থেকে সেটি বার করে শংকর ছুড়ে দিল রানির হাতে। আর রানি সেটা লুফে নিয়ে তেড়ে গেল সেই খদ্দেরের দিকে যে হাত উঠিয়েছে শংকরের গায়ে। বাপরে! বাপরে!’ করে খদ্দের তিনটি কয়েক লাফে ঘর ছেড়ে পালাল। হার্মোনিয়ামের মেহফুজ আর সারেঙ্গির রশিদ আলিও কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতন মানে মানে উঠে গেল। একটা আসরের বারোটা টাকা ওদের পন্ড হল। তারপর রানি ফিরে এসে মাটিতে ঝুঁকে বসা শংকরের পিঠে হাত রেখে বলল, যাও শুতে যাও। আমারও ঘুম পাচ্ছে। রানি ছুরিটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, আরেকটু হলে আজ এতে খুন লাগত, বাবু।
আমি কিন্তু দেখলাম ওতে রক্ত লেগেই আছে। বাঁট অবধি। যেভাবে বর্ণনা আমার বইতে। বললাম, খুন যা লাগার ওতে লেগেই আছে। আরও কাছে এসো, দেখাতে পারব! একটু দুষ্টুমির হাসি হেসে রানি বলল, খুন তোমার মনে, তোমার চোখে। তোমার হাতে কোনো খুন নেই, তোমার হাত কখনো আমার বুক অব্দি উঠবে না। এই দেখো আমার বুক, কী গরম! হাত দাও তাহলে বুঝবে। দাও, হাত দাও। একটু ভালোবাসো আমাকে প্লিজ, আজ আমার জন্মদিন।
হ্যাঁ, সেই মুহূর্তে শংকরের হাত রানির বুকে বসল। কিন্তু হাতের সঙ্গে সঙ্গে ছুরিটাও উঠে গিয়েছিল। হতের সঙ্গে সঙ্গেই বহুদূর নেমে গেল সেটাও রানির বুকে। ওঃ বাবু! বলে বুকে হাত চাপা দিয়ে রানি শংকরকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেল দূরে। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এসে লাল করে দিয়েছে ওর সাদা শিফনের শাড়ি। আঘাতের জায়গাটায় দু-হাত চেপে ধরে রানি গোঙাতে লাগল। তুমি সত্যি সত্যি মারলে আমাকে বাবু? তুমি আমায় মারলে? ততক্ষণে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শংকরলাল আর ছুরিটা ওর ডান হাতটা চিরকালের মতন উন্মাদ করে দিয়েছে।
প্রথম আঘাতটাই ছিল শংকরের অভিপ্রেত, বাকি চুয়ান্নটি লজ্জা ও পাপবোধ থেকে ছুরির নিজস্ব হঠকারিতা থেকে। তা ছাড়া কিছু কিছু মানুষ ছুরি খেপায়, যেমন রানি। একটা ছুরি আসলে মুক্ত বিহঙ্গের মতন, শুধু অপেক্ষায় থাকে উড়বার। উড়তে উড়তেই থাকে, কখনো শরীরে বসে কখনো আসবাবে। উপরন্তু এ ছুরির কোনো নীড়, কোনো খাপও ছিল না। এ শুধু নিজেকে ফিরিয়ে নিচ্ছিল শংকরের হাতে। তাই বেশ কবার শংকরের মুঠো আলগা হওয়া সত্ত্বেও ছুরি পড়ে যায়নি, নিজের কাজ করে গেছে। রানি কোপগুলো গুনছিল দেখে কিছুটা নেশা হয়েছিল শংকরেরও। অন্তত ছাপ্পান্ন ঘা মারার বাসনা জেগেছিল ওরও। কিন্তু পঞ্চান্ন বারের পর রানির চোখ দুটো ছাড়া জায়গা ছিল না। চোখ খারাপ শংকরের, তাই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের চোখের জন্য ওর বড়ো মায়া। আর রানি চেয়েছিল চোখ দুটি যেন বেঁচে থাকে। শংকর রানির কোলে শুয়ে পড়লে চোখ দুটো এক দৃষ্টে ওকে দেখে গেল, পাহারা দিল। পাশের ঘরের মানুষও একটা আওয়াজ পেল না। রক্তের গন্ধ পেল না। বহুদিন আগে দিদির হাত ধরে যেমন নীরবে রানি এসেছিল এখানে প্রায় তেমনই নীরবে চলে গেল শংকরলালকে কোলে শুইয়ে।
আমি আর দূরত্ব রাখতে পারছি না শংকরের সঙ্গে। লোকের হাতে অপদস্থ হওয়ার চেয়ে থানায় আত্মসমর্পণ শঙ্করের কাছে ঢের সম্মানজনক। কেউ ওকে আঘাত করলে ও লজ্জায় মরে যাবে। অপমান ওর কাছে খুব শোচনীয় জিনিস। ছেলেবেলায় একবার ও পাবলিকের হাতে পকেটমারের মার দেখে কেঁদে উঠেছিল। কেঁদেছিল এইজন্য নয় যে, লোকের মারে পকেটমারের লাগবে, কেঁদেছিল ওই মারের চোটে পকেটমারটি হয়তো কেঁদেই ফেলবে। একটা পুরুষমানুষ কাঁদলে ওর মনে হত কিছু একটা অন্যায় ঘটছে, কোথাও। কারণ পুরুষমানুষের তো কাঁদার কথা নয়। শংকর সেই থেকে পুরুষের কান্না সম্পর্কে খুব সচেতন, যদিও নিভৃতে কখনো কখনো নিজেও কেঁদেছে। সাধারণত নিজের জন্য নয়, অন্যের দুঃখ কিংবা অপমানে। এই মুহূর্তে জনতার দ্বারা আক্রান্ত হলেও ভেতরে ভেতরে মরে যেত ওর এই ভাবমূর্তিটির জন্য। নিজেরই অজ্ঞাতে অথচ কিছুটা নিজেরই চেষ্টায় যে ভাবমূর্তিটি ও গড়ে তুলেছে নিজের জন্য। সহৃদয়, মানবিক, উন্নত, নিঃসঙ্গ, অভিমানী।
শংকর ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়াল থানার সদর দরজায়। একটা চিনে বাদামওলা ছলছল চোখে বসে আছে সেখানে, হয়তো জরিমানা মকুব করাতে এসেছে। দরজায় কোনো সেপাই নেই, কোনো আগন্তুকও নেই। থানার পক্ষে দিনটা এখনও শুরুই হয়নি কোনোভাবে। শংকরের খুব হাঁপ ধরেছে এই লম্বা ছুট লাগিয়ে। ও দরজা পেরিয়ে ঢোকার আগে দেওয়ালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়াল আর বুকের শ্বাস ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করল। আর ওর কানে এল বেশ খানিকটা চেঁচামেচি সামনের ঘরটার থেকে। এক বাঙাল কনস্টেবলই হয়তো আরেকজনকে বলছে, আরে দেখেন দিকি এই মাগিটার ব্যাপার-স্যাপার! সক্কাল থিকা আইয়া কয় হপন দেখসি, হপন দেখসি। তা হপন দ্যাখসো তো আমার কী করার আছে? অন্য কনস্টেবলটি এবার বলল, কী এমন স্বপ্ন দেখেচে বিবি? যে একেবারে সক্কালবেলা থানায় এসে ঢুকল? থানায় কি গণকার থাকে? এবার শংকর শুনতে পেল একটা অবাঙালি মহিলার কণ্ঠস্বর। না বাবু, আমি বলছি তুমি আমার সঙ্গে এসো। আমি যা স্বপ্ন দেখি তা ঘটে, আমার নাম আশিকী বাই। আমি সাফ সাফ দেখলাম এক বাঙালিবাবু চাকু দিয়ে আমাদের একশো পাঁচ নম্বরের রানিকে টুকরো টুকরো করছে। ওই স্বপ্ন দেখার পরই আমি এই থানার দরজায় এসে বসে আছি। তুমরা কেউ না গেলে আমি কিছুতেই ফিরে যাব না। শংকরের ঝিম ধরছিল মাথায়, দেয়াল থেকে ওর হাত সরে আসছে, পা দুটো ভেঙে মাটিতে শুয়ে পড়তে চাইছে, কিন্তু মন চাইছে আশিকীর সমস্ত বিবরণটা শোনে। শংকর শুনল আশিকী ওর বর্ণনা দিচ্ছে হুবহু। যেন ছবির বর্ণনা। বলছে, মানুষটা লম্বা, ফর্সা, রক্তেভেজা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা। চোখে চশমা, মুখে ও হাতে রক্ত, চোখের পাতায় রক্ত, কিন্তু ঠোঁটে সামান্য, প্রায় অদৃশ্য হাসি। লোকটা শরিফ।