যে ছুরিটা রানির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল সেটি ছাড়া বাকি দুটো এখন আমার পাঞ্জাবির পকেটে। যে কারণে দু-ধারের দুই পকেট বিশ্রীরকম ঝুলে আছে। কেনা অব্দি এ দুটির কোনো ব্যবহার কখনো হয়নি। আমার ইচ্ছে ছিল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তিনটেকেই ব্যবহার করব। কিন্তু কসাইয়ের ছুরিটা হাতে উঠে প্রথমবার রক্তপান করার পর, আর নামতেই চাইল না। আমার এখন মনে হচ্ছে কেবল প্রথম আঘাতটাই হেনেছিল আমার ডান হাত। বাকি চুয়ান্ন কোপ ছুরিটা নিজের থেকেই চালিয়েছে। হাত শুধু তাকে ধরেছিল। রক্তপান করলে ছুরিও জীবন পায়, অধিকতর রক্তপাতের অধিকার পায়। আমার এখন মনে হচ্ছে বেচারি শংকর ওই ছুরিটা কিনেই যাবতীয় সর্বনাশ ঘটিয়েছিল। শংকরের মগজে খুন থাকলেও হাতে কখনোই খুন ছিল না, একথা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানবে না। ওই তো আমি দেখতে পাচ্ছি বিভ্রান্তের মতন লম্বা লম্বা পায়ে শংকরলাল আমার পিছু নিয়েছে। আমাকে ছাড়া ওর কোনো গত্যন্তর নেই, কোনো রেহাই নেই। ও যদি বাঁচতে চায়—আমি জানি ও বাঁচতে ভালোবাসে— ওকে এই আমার পথেই আসতে হবে। আমি সুযোগ বুঝে পাশের এক গলিতে ঢুকলাম। শংকরও ঢুকল, অলিগলি সবই মুখস্থ শংকরের। বড়ো রাস্তার ভিড়ের চেয়ে গলির নির্জনতাই ওর পছন্দ। চোখে কম দেখে শংকর, বড়োসড়ো বস্তু হলেও পুরো চেহারার হদিশ পায় না। শংকর ভালোবাসে বস্তুর ডিটেল, ডিটেলের ভাঁজ। ও যখন কারও মুখের দিকে তাকায় ও মুখের রেখা, রেখার গতিপ্রকৃতি, রেখার গভীরতা, বয়স, তার সংলগ্ন দীর্ঘশ্বাসও দেখতে পায়। মুখের নীচের শিরা, শিরার ভেতর রক্ত, রক্তের ভেতর শ্বেত ও লোহিত কণিকা, রক্তের মধ্যে শংকর দেখেছিল ভালোবাসা নয়, ঘৃণা। বিশেষ কাউকে ঘৃণা করার ঘৃণা নয়, নিজের রক্তকে ঘৃণা। মরার জন্য যে রক্ত কণিকাগুলো দিবারাত্র ছটফট করত। শংকর না মারলে রানি নিজেই খুব শিগগির আত্মঘাতী হত।
রানি কসাইয়ের ছুরিটা আলনার পেছনে সরিয়ে রাখতে রাখতে শংকরকে বলেছিল, এই রইল তোমার ছুরি। পরে বোলো না আমি লুকিয়ে রেখেছি। তারপর সেজেগুঁজে হন হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শংকর বলল, কোথায় যাচ্ছ?
—সে খোঁজে তোমার কী দরকার?
–যদি আসতে চাই?
—নিতে পারব না। অন্য বাবু আছে।
—কে তিনি?
—যে কেউ! পয়সা দেবে এমন যে কেউ। রানি বেরিয়ে যেতে শংকর উঠে কিছু দূর অবধি ওর পিছু নিল। তারপর সড়াৎ করে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল রানি। ট্যাক্সি ওর জন্য দাঁড় করানোই ছিল। ট্যাক্সি রাস্তার থেকে বাঁক নিয়ে ফের চলতে শুরু করলে শংকর এক ঝলক দেখতে পেল রানি আর অজয়ের স্পষ্ট আত্মমুগ্ধ দুটো মুখ।
একটা অজানা, নামগোত্রহীন ব্যথা চাগিয়ে উঠল শংকরের বুকে। সেই সঙ্গে একটা তৃপ্তিও আনন্দও। ওর তিন বছরের সাধনার ধন ‘শেষ বাইজি’ বইটা সার্থক হয়েছে বলে মনে হল ওর। ওর হাত ঘামতে লাগল, ওর গলায় মদের পিপাসা লাগল। শংকরও একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি এল ঘেমো জামা বদলানোর জন্য। গায়ে দামি বিলিতি আফটার শেভ ছড়াল, আয়নায় একবার নিজের মুখটা দেখলে তারপর বেশ অন্যমনস্কভাবে দেরাজ থেকে তুলে নিল যত্ন করে রাখা দুটো ছুরি। ছুরি দুটো পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ একটা বিষাদ ছড়িয়ে পড়ল ওর ভেতরে। এই মুহূর্ত থেকে আর যা যা ঘটার আছে ওর জীবনে সবই ওর জানা, খুবই চেনা। যেমনটি যেমনটি লেখা হয়েছে ঠিক তেমন-তেমন করে ঘটনার শেষ করতে পারলে ওর তৃপ্তি হয়। আচমকা ওর মনে পড়ল বইতে রক্তচুনি আংটিটি মধ্যমায় নয়, অনামিকায়। ও সঙ্গে সঙ্গে আংটিটা খুলে যথাস্থানে পরাল। তারপর আরও মনে পড়ল বইতে ওর পায়ে কোলাপুরি চপ্পল, স্যামসন জুতো নয়। জুতো খুলে কোলাপুরি পরল ও। তারপর আরও মনে পড়ল ওর আফটার শেভ ‘শ্যানেল নাম্বার ফাইভ’ নয় ‘খ্রিস্তিয় দিওর। ফের একবার গালে স্প্রে করল নতুন গন্ধটা। ওর পকেটে দু-শো টাকা থাকার কথা। অতএব আরও এক-শো টাকা দেরাজ থেকে বার করল ও। এবং শেষমেষ চেনা বইটি, বইয়ে বর্ণিত ঘটনা অনুযায়ী মা, বাবা, কাকার ছবিতে প্রণাম করল। এবং খুব মৃদুস্বরে আওড়াল ওর প্রিয় কবি এলিয়টের পঙক্তি—দিস ইজ দ্য ওয়ে দ্য ওয়র্লড এনডজ, দিস ইস দ্য ওয়ে দ্য ওয়র্লড এনডজ/ নট উইথ এ ব্যাং বাট আ হুইমপর।
এই মুহূর্তে শংকর আমার পিছন পিছন আসছে। ঠিক এভাবেই ও কাল ট্যাক্সি নিয়ে ঘুরছিল রানির খোঁজে। এ বাড়ি। ও বাড়ি। এ হোটেল, ও হোটেল গঙ্গার ধার। তারপর একসময় ওর প্রিয় হুইস্কি নিয়ে এসে বসল রানির শোবার ঘরে। যে-ঘর গত তিন বছর শংকরেরও ঘর। খুব একলা বোধ করছিল ও, মাঝে-মধ্যেই কান্নায় ধরে আসছিল গলা। রাগিণী এসে ওর পাশে বসে জানকীর গল্প করতে চাইল, কিন্তু মন ভরল না শংকরের। পাশের বাড়ির থেকে দমাদ্দম ঢোলের আওয়াজ আর কাস্টমারের উল্লাস ভেসে আসছিল। রাগিণী একটা গান গাইবে ভাবছিল, কিন্তু শংকরলালবাবুর মন খুব উদাস ঠেকল। ও তখন কারণটা আঁচ করে বলল, জানো তো রানির আজ জন্মদিন। ও তাই বাইরে যাবে বলেছে। তোমার জন্যে খাবার আনিয়ে দেব? শংকর মাথা নেড়ে জানাল, না। তখনই বাইরে খদ্দেরের আওয়াজ পেয়ে রাগিণী উঠে গেল আর শংকরও কী ভেবেই জানি উঠে গিয়ে আলনার পিছন থেকে তুলে নিল কসাইয়ের ছুরিটা। তারপর জায়গায় ফিরে এসে রানির মতন চ্যাঁচড়-চ্যাঁচড় শব্দ করে দেয়ালে লিখল ‘শেষ বাইজি’। আবছা শুনতে পেল দর নিয়ে বচসা করে খদ্দের চলে যাচ্ছে। আর তখনই সিঁড়ির মুখ থেকে রানির গলা, বৈঠিয়ে সাহাবলোগ। চল কিউ যাতে? পৈসা কম হ্যায় তো বাদমে দিজিয়েগা। উসমে কা হ্যায়? রানিকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। কিছুটা স্বাধীন হওয়ার আনন্দ। আমি বললাম, তবলচি ডেকো না, আমি আজ তবলা বাজাব। বহুদিনের অনভ্যস্ত হাতে ঠেকাটা প্রথম জমছিল না। রানির নাচও দেহ ছেড়ে যায় যায়। খদ্দেররা বেশ বিরক্ত হচ্ছে মনে হল। একটু পরে নেশা চড়তে গান-বাজনা গৌণ হয়ে পড়ল। তিনজন খদ্দেরই ঘুরে-ফিরে রানিকে ছুঁতে চাইছে, ধরতে চাইছে, চুমু খেতে চাইছে। রানি ওদের থেকে সটকে সটকে যাচ্ছে বটে, কিন্তু আমার কাছে আসবে না। এবার ওরা টাকা ছোড়া শুরু করল, একজন লাফ দিয়ে রানির বুকে হাত রাখল, হাতটা ব্লাউজের ভেতর ঢোকাবার চেষ্টা করল। হাত নিশপিশ করছিল আমারও। বহুদিন রানির বুক স্পর্শ করিনি। কিন্তু রানি এখন স্বাধীন, ওকে চাইবার অধিকার আমার কম। তবু আমি তবলা থামিয়ে রানির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম, ওর বুকে হাত রাখার প্রয়াস করলাম, ওর ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে জিরাফের মতন লজ্জাহীনভাবে নিজেকে সঁপে দিলাম।