এই অজয়ের একটা অভিলাস ছিল শংকরের কৌমার্য হরণ করাবে কোনো মেয়ে লাগিয়ে। বলত, করে দ্যাখ মাইরি, সত্যি দারুণ ব্যাপার। তুই নিজেই এসে তারপর আমার কাছে। কবুল করবি। শরীর থেকে আগুন ঝরে গেলে তুই ঠাণ্ডা মাথায় আরও ভালো লিখবি। শংকর ‘দুর! দুর’ করে কাটিয়ে দিয়েছে ওকে। অথচ প্রথম যেদিন পারল ওকে রানির ঠেকে আনতে সেদিন থেকেই ওদের বন্ধুত্বের ইতি। অজয়ের হয়তো রাগ হয়েছিল, শংকরের অভিমান। দু জনের কেউই তাদের নিজের নিজের মনকে সঠিক জানে না, তাই কেন যে তারা আর একে অন্যের সামনে দাঁড়াতে পারল না সে-রহস্য রয়েই গেল।
শংকরলাল আচমকা ওর পেছনে ফেলে আসা গলির দিকে ফিরে চাইতে চমকে উঠল। এইমাত্র যে নিরিবিলি গলিটা ও পার হয়ে এসেছে সেখানে লোকে লোকারণ্য। এত লোক যে কোথায় থাকে কেউ জানে না। এত অল্প উত্তেজনাতেও ওরা যে কী করে এত শোরগোল বাধায় তাও শংকরের অজানা। তিন তিনটে বছর এই লোকের মধ্যে মিশে, এদের সুখ-দুঃখ পর্যবেক্ষণ করে এদের নিয়ে মস্ত কেতাব লিখেও শংকর ওদের সত্যিকার চরিত্রের কোনো হদিশ পায়নি। প্রায়ই ওদের দেখে ওর মনে হয়েছে ওদের মধ্যে কোনো প্রাণ নেই শুধু রক্তপ্রবাহ আছে ধমনীতে। ওরা আসলে সবাই মৃত, কোনো জাদুবলে চলে-ফিরে বেড়ায়। ওদের জীবনের একটা জাদু টাকা, অপরটা মৃত্যু। কোনো মৃত্যু ঘটলে এই মৃতেরা কীভবেই যেন সচল, জ্যান্ত হয়ে ওঠে। শংকর দেখল ওই অমানুষিক জনারণ্য থেকে উন্মাদের মতন ঠেলে বেরিয়ে আসছে বশির। বশির বড়ো ভালোবাসে শংকরলালবাবুকে। ও দৌড়ে এসে শংকরকে জাপটে ধরে কানের কাছে মিনতির সুরে বলল, বাবু, তুমি পালিয়ে যাও। ওই শুয়োরের বাচ্চারা তোমায় খুন করবে। আমার মাথার দিব্যি, থানায় যেয়ো না। পুলিশ তোমায় ফাঁসি দেবে। তাহলে রানি কোনোদিনই শান্তি পাবে না বাবু। বাবু, তুমি পালাও। তুমি এদেশ ছেড়ে চলে যাও।
শংকরলালবাবুর গাটা ধরে বশির বুঝল খুব জ্বর এসেছে লোকটার। ধড়াস ধড়াস করে ডাক ছাড়ছে বুকটা। গায়ে রক্তের গন্ধ। চোখ দুটো সাধু ফকিরদের মতন শান্ত, ঘুমিয়ে পড়া। এত সুন্দর একটা মানুষের এই দুর্দশা বশির জীবনে দেখেনি। রানি বলত, বাবুর গা দিয়ে আলো বেরোয়। কথাটা মিথ্যে নয়। বাবুর রক্তমাখা শরীর থেকে এখন আলো ঠিকরোচ্ছে। যেন অন্য জগতের লোক এই বাবু। বশির মাটিতে বসে বাবুর পা ছুঁল ফের। ভীষণ ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে বাবুকে এখন, যেন নিষ্পাপ শিশু। বাবুর হাঁটুতে মুখ ঘষল, তারপর লুঙির কোঁচড় থেকে বাঁকানো ছোরা বার করে ভান করল যেন পেটে কোপ মারবে। আর বলতে থাকল, বাবু তোমায় মারব বলে শুনিয়ে এসেছি আমি। আমার ঘরের মেয়ের জন্য প্রতিশোধ নেওয়ার ভার আমার। কিন্তু আমি তোমায় মারব না। তুমি পালাও, ওরা দেখুক আমি মারতে চেষ্টা করছি।
মানুষের ভিড় এবার এগিয়ে আসছে সামনে। প্রচন্ড আওয়াজ সর্বত্র। শংকর এক লাথিতে বশিরকে মাটিতে ছিটকে ফেলে ট্রাম রাস্তা ধরে দৌড় লাগাল থানার দিকে। বেইজ্জত এড়াবার একটিমাত্র জায়গা এখন ওইটা। শরীর বইছে না,মাথা পাক দিচ্ছে, কিন্তু ভীষণই সুখী সুখী লাগছে শংকরের। রানির মৃত্যুর অংশ লেখার সময় যে সুখ সে পেয়েছিল। সব কিছু হারিয়ে ফেলার সুখ।
আমি একটু একটু আভাস পাচ্ছিলাম রানি অন্য পুরুষের দিকে চলছে। ও আমাকে জব্দ করতে চায়। ওর ধারণা আমাকে রাগিয়ে তুললে আমি ওকে পাওয়ার চেষ্টা করব। কারণ এমনিতে পেলে আমার নেবার বাসনা নাকি মিটে যায়। কিছুদিন যাবৎ প্রায়ই বলছিল, আপনা-আপনি পেলে তো আমাকে। তাই কদর বুঝলে না। তোমরা বলো আমাদের বিবেক, ভালোবাসা নেই। সেটা নেই দেখছি তোমাদের। তোমাদের সব ভালোবাসা কোমরের তলায়। ও আমি জানি।
যে তিনটে ছুরি শংকরলাল এনে ও বাড়ির মেয়েদের দেখিয়েছিল। তার মধ্যে কসাইয়ের চাকুটাই রানির মনে ধরেছিল খুব। ইদানীং অকারণে দেয়ালে আঁকিবুকি কাটত। চ্যাঁচড়, চ্যাঁচড়! আওয়াজটা কান ভেদ করে মস্তিষ্কে গিয়ে চড়ত। ও থামাতে বললে রানিও ফুঁসে উঠত, বেশ করব। আমার ছুরি, আমার ঘর। তুমি তোমার বাড়িতে গিয়ে ধ্যান করো যাও। তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই আর। শংকর ওর ‘শেষ বাইজি’ থেকে পড়ে শোনানোর কথা তুলল যখন তখন রানি বলল, তোমাদের ওসব বাংলা আমি বুঝি না। সাহস থাকলে শরিফ মেয়ে কাউকে বিয়ে করে তাকেই পড়ে শুনিয়ো। সত্যি কথা লেখার হিম্মত কোনোদিন তোমার হবে না। পারবে লিখতে কীভাবে দিনের পর দিন বিলকুল বেহুশ মাতাল হয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতে বিছানায় আর আমাকে তোমার ওপরে চড়ে কাজ করতে হত? পারবে লিখতে আমার দু-বার পেট খালাস করতে হয়েছে? পারবে লিখতে আমি বাইজি নই, বেশ্যা? পারবে লিখতে আমি অজয়ের প্রেমিকা, আর তুমি কাবাবমে হাড্ডি? তুমি আমাদের কথা কী লিখবে, তুমি তো নিজের বাইরে কিছু জানো না, দেখো না? এক তোড়ে এত সব কথা বলে রানি ফের ছুরি দিয়ে দেয়ালে কাটাকাটি খেলায় মন দিত। শংকর মনে মনে ভাবত রানি যা যা বলে গেল ও নিজে কখনো চাইবে না শংকর তা লিখুক। খুব ভালো লেখা বলতে রানি বোঝে খুব বিশুদ্ধ রোমান্টিক প্রেমের কাহিনি, যেমন লেখেন গুলশন নন্দা। গুলশন রানির প্রিয় লেখক, শংকরলালের পরেই। একজনের সব লেখাই তার পড়া, অন্য জনের একটি বর্ণও সে পড়েনি কখনো কারণ বাংলা হরফও সে চেনে না। ওর বই শুধু যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখেছে সে।